দাওয়াতী কাজে মুসলিম নারীঃ একটি ভুলে যাওয়া ভূমিকা । পর্ব- ৩
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
অনুবাদক: রাবেয়া রওশীন |
সফল দাওয়াহ অনুষ্ঠান আয়োজন করা
মেয়েদের দাওয়াতী কাজে সাফল্য ও কাঙ্খিত ফল অর্জনের জন্য কিছু শর্ত মেনে
চলা প্রয়োজন। নিচের আলোচনার অনেক বিষয়ই সবসময় বিবেচনায় রাখা উচিত, কিন্তু
যে পরিবেশে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে সে পরিবেশকে জানা, বোঝা ও সেই
পরিবেশের প্রয়োজন অনুযায়ী অনুষ্ঠানে সামঞ্জস্য বিধান করা সবসময়ই দরকার।
১) কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা
যদিও আমরা ইসলামী দাওয়াহ কাজে মেয়েদের ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করছি,
কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রকৃতি ও লক্ষ্যের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে
না। দাওয়াতী কাজ করার পরিকল্পনা করার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য
রাখা উচিতঃ
ক) সাধারণত, মেয়েদের প্রধান ভূমিকা ও কাজ হচ্ছে তাদের ঘরে। এটা কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে…”(৩৩:৩৩)
মেয়েরা অবশ্যই সালাহ আদায় করার জন্য মসজিদে যেতে পারবে, প্রয়োজনীয় কাজে
অংশ নিতে পারবে এবং দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারবে। তবে, এসব কোন কাজই ঘরে
স্ত্রী ও মা হিসাবে তার দায়িত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই, মেয়েদের এই দায়িত্ব ও প্রয়োজনীয় দাওয়াতী কাজের মাঝে ভারসাম্য
বজায় রাখা নিয়েই পরিবারে ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। ড. হামদান বলেন,
“মেয়েরা ঘরে বসেই তাদের দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে পারে। তারা কোন
ইসলামী সংগঠনের জন্য কাজ করতে পারে যেমন, টেলিফোন রিসিভ করা বা নিজ নিজ
দক্ষতা ও আগ্রহ অনুযায়ী অন্য কোন কাজ করা।”
খ) নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ব্যপারে ইসলামে বিশেষ নির্দেশ দেয়া আছে যা যে কোন অবস্থায় যে কোন দাওয়াতী কাজে মেনে চলতে হবে।
- নারী ও পুরুষের মাঝে সঠিক পর্দা সবসময় মেনে চলতে হবে।
- নারীরা মাহরাম (যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ) ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবে না।
- মেয়েরা তাদের অনাত্মীয় পুরুষদের সাথে একত্রে মেলামেশা করবে না।
- মেয়েরা তাদের অভিভাবকের, তথা তাদের স্বামী বা বাবার, অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারবে না।
গ) ইসলামের
শত্রুরা সাধারণত এইসব আদেশকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে প্রচার করে যে
ইসলাম মেয়েদের অবমাননা করে থাকে। কিছু কিছু দা’ঈ এসব অভিযোগে প্রভাবিত হয়ে
কাজে শিথিল ও অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে। সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত সত্যিকারের দা’ঈ
এসব প্রশ্রয় দিবে না পাছে সে সমাজের লালসা ও খেয়ালখুশির দ্বারা প্রভাবিত
হয়ে পড়ে।
ঘ) দাওয়াতী কাজে
ছেলেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে যেমনটা রাসূল(সাঃ)-এর সময়ে ও তার পরের
স্বর্ণ যুগে হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা অনস্বীকার্য তবে সঠিক
দিকনির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
২) দাওয়াতী কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য
রাসূল(সাঃ) যেমন উনার সমাজের মেয়েদের প্রয়োজনে একটা নির্দিষ্ট সময় তাদের
সাথে ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন, তেমনভাবে দাওয়াতী
সংগঠনগুলোর উচিত তাদের কার্যক্রমে নারী ও সমাজের অন্যান্য বিষয়কে
অন্তর্ভুক্ত করা। মেয়েদের জন্য পরিচালিত যে কোন দাওয়াতী কার্যক্রমে অন্তত
নিচের লক্ষ্যগুলো অর্জনে সচেষ্ট হওয়া উচিতঃ
ঈমান দৃঢ় করাঃ এটা হতে
পারে ইবাদতের পরিমাণ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে, যিকরের দ্বারা আল্লাহকে স্মরণ
করার মাধ্যমে, তাঁর নাম নিয়ে, ক্ষমতা নিয়ে ও সেই সাথে নিজেদের এবং
মহাবিশ্বের সৃষ্টির ব্যপারে চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে। চিন্তাভাবনা করার
মাঝে বিরাট শক্তি নিহিত আছে।একজন মানুষের অন্তরে ও ঈমানে এর ইতিবাচক প্রভাব
তুলনাহীন। তবে আক্কীদা সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের সঠিক উপলব্ধি ছাড়া এটা সম্ভব
না। তাই তাওহীদের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে।
জ্ঞান বৃদ্ধি করাঃ জ্ঞান
ছাড়াএকজন দা’ঈ বেশি দূর আগাতে পারেনা। দ্বীনের মৌলিক বিষয় ও নিজের পরিবেশ
অনুযায়ী যেসব বিষয় একজন দা’ঈর জন্য প্রয়োজন সেসব বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে হবে।
বিভিন্ন বিভ্রান্ত দল ও মত সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। যেসব
ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের প্রসারের বিরোধিতা করে ও নানা উপায়ে মানুষের মনে
জায়গা করে নিচ্ছে তাদের সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
দা’ঈ হিসাবে ব্যক্তিত্ব গঠন করতে হবেঃ দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার
জন্য ত্যাগ স্বীকার করা প্রয়োজন আর তাই ইসলামের পথে মানুষকে ডাকার দায়িত্ব
বহন করার জন্য মেয়েদের প্রস্তুত থাকতে হবে। মুসলিমদের অবস্থা ও ইসলামের
শত্রুদের ইসলাম বিরোধী প্রচেষ্টা সম্পর্কে মেয়েদের সচেতন করার মাধ্যমে এটা
অর্জিত হতে পারে। নেতৃত্ব, দায়িত্ব ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ সম্পর্কে তাদের
শিক্ষা দিতে হবে। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। দা’ঈকে
প্রয়োজনীয় সামাজিক দক্ষতা, ভালো উদাহরণ ও আচরণের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত
দেয়ার গুরুত্ব শেখাতে হবে। তাদের সময়ের মূল্য ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে
এর সদ্ব্যবহার ও অবসরে হালাল বিনোদন কিভাবে করা যায় সেটাও শেখাতে হবে।
পাপের প্রতি সচেতন হওয়াঃ পাপের
ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। যে সব জিনিস মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে
যায় তা এড়িয়ে চলে সেসবের পথ বন্ধ করার ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। এখানে
বিশেষ করে যেসব পাপ মেয়েদের সাথে সম্পর্কিত সেসবের কথা বলা হচ্ছে।
৩) প্রশিক্ষণ
ক. এই ধাপের তাত্ত্বিক ভাগে দা’ঈকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা জরুরীঃ
(১) শিক্ষাগত
প্রস্তুতি – যথাযথ উপাদান দিয়ে সাজিয়ে সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে
শিক্ষামূলক কিছু তৈরী করা। ইসলাম মেয়েদের শিক্ষার অধিকার দিয়েছে। মেয়েদের
দাওয়াতী কাজে সাহায্য করবে এমন জ্ঞান অর্জন করা দরকার, যেমন শরীয়াহর
বিভিন্ন শাখা ও তা বোঝার জন্য আরও যে জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন সেসব। তবে
জ্ঞান অর্জন দাওয়াতী কাজ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত না, যা আজকের দিনে
লক্ষ্য করা যায়। ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরী।
(২) মানসিক
প্রস্তুতি – মেয়ে দা’ঈদের আন্তরিকভাবে আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও আশা থাকতে
হবে। দ্বীন ইসলাম নিয়ে গর্ব বোধ করতে হবে। ধৈর্যশীল হতে হবে এবং যাদের তারা
ইসলামের পথে ডাকছে তাদের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। এভাবে তাদের
মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। দা’ঈ হিসাবে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য এসব
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ একজন দা’ঈকে মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যেতে
হয়, যাদের প্রত্যেকের চরিত্র ও পছন্দ-অপছন্দ আলাদা।
(৩) সামাজিক
প্রস্তুতি – মেয়ে দা’ঈদের পরিবারে ও সমাজে ইসলাম পালন করে চলার মাধ্যমে
সমাজকে তৈরী করে নিতে হবে। তাদের ইসলামের নীতি মেনে চলা ও দাওয়াতী মনোভাব
পোষণ করা উচিত। সামাজিক প্রস্তুতি হিসাবে এই মানসিকতা ধারণ করতে হবে যে
ইসলামের দাওয়াত পাওয়া সকল মানুষের অধিকার যা সহজভাবে আন্তরিকতা ও বিনয়ের
সাথে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
খ. পর্যাপ্ত ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি জরুরীঃ
বক্তব্য ও লেখালেখির মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার
জন্য মেয়ে দা’ঈদের মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারার মতো বক্তব্য দেয়া ও
লেখালেখি করা ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাঝে অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হচ্ছে মানুষের
কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম যা তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণকে পূর্ণতা দেয় ও সঠিক ফল
অর্জন নিশ্চিত করে। এই দিকটা ভীষণভাবে অবহেলিত হয়েছে যার ফলে দাওয়াতী কাজে
বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে।
যারা জনসমক্ষে বক্তব্য দেয় তাদের দলিল, প্রমাণ ব্যবহার করে শ্রোতাকে
প্রভাবিত করার, তার অনুভূতিকে নাড়া দিতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যারা
বক্তব্য তৈরী করে তাদের ভাষার উপর ভালো দখল থাকতে হবে ও মসজিদ, স্কুলসহ
অন্য যেসব জায়গায় মেয়েরা একত্রিত হয় সেসব জায়গায় বক্তব্য দিতে হবে। নারী
শিক্ষানবিসদের উপরও নজর রাখতে হবে ও প্রয়োজনে নম্রভাবে তাদের ভুল শুধরে
দিতে হবে।
আমরা এমন একটা যুগে বাস করছি যেখানে মানুষ বই, পত্রিকা, প্রবন্ধ
ইত্যাদির মাঝে ডুবে আছে। তাই লেখালেখি ও প্রকাশনাকে উপেক্ষা করা ভুল হবে।
আন্তরিক ও যথাযথ দলিল-প্রমাণ ব্যবহার করে লেখাকে অলঙ্কারপূর্ণ ও
বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। লেখালেখি দাওয়াতী কাজ করার একটা মাধ্যম এবং
অনেকভাবেই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তারা ঘরে
থেকেই অবসর সময়কে কাজে লাগাতে পারে। এইভাবে তারা সমাজের সব স্তরের মানুষের
কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
No comments