দাওয়াতী কাজে মুসলিম নারীঃ একটি ভুলে যাওয়া ভূমিকা । পর্ব- ২

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে- 
 
অনুবাদক: রাবেয়া রওশীন
 

মুসলিম মেয়েদের যেমন হওয়া উচিত

দা’ঈ -এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা: সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী আমেরিকায় অন্য যে কোন শ্রেণীর তুলনায় মেয়েদের ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা বেশি। কানাডা, ইংল্যান্ড ও আরও অনেক জায়গার ক্ষেত্রে এই কথা বলা যায়। ডমিনিকান রিপাবলিকে আল-জুমুয়াহ ম্যাগাজিন কর্তৃক পরিচালিত এক সার্ভেতে দেখা গেছে যে স্থানীয়দের মাঝে যারা ইসলাম গ্রহন করেছে তাদের ৭৫%ই হচ্ছে মেয়ে। এই কারণে দাওয়াতী কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ ভীষণ জরুরী। “শাহাদাহ উচ্চারণের মাধ্যমেই দ্বীনের দাওয়াত দেয়া শেষ হয়ে যায় না,” ড. হামদান বলেন। “অন্য ধর্মের মেয়েদের ইসলাম গ্রহণে সাহায্য করার জন্য মেয়েদের দরকার, ইসলামে আসার পর তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য তাদের দরকার।” আসলে বহু কারণেই মেয়েদের দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করা জরুরীঃ
১) মেয়েরা সহজেই অন্য মেয়েদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, যা ছেলেরা পারে না। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অন্য মেয়েদের কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। মেয়েদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের  খুঁটিনাটি ও সমস্যা চিহ্নিত করতে মেয়েরাই বেশি উপযুক্ত।
২) মেয়েরা বেশি ভালো বুঝতে পারে কোন দিকে মেয়েদের দাওয়াতী কাজের প্রয়োজনীয়তা বেশি। তারাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম কারণ তারা এই ক্ষেত্র সম্পর্কে তুলনামূলক বেশি পরিচিত।
৩) ব্যক্তিগত দাওয়াতী কাজ হোক বা মেয়েদের ফোরাম অথবা মিটিং হোক, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা মেয়েদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
৪) বহু মুসলিম মেয়ের দিকনির্দেশনা ও শিক্ষার প্রয়োজন কিন্তু তাদের এই সেবা দিতে পারে এমন পুরুষের অভাব রয়েছে। তাই যোগ্যতা সম্পন্ন মেয়েদের এই কাজটা করা উচিত।
৫) ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বেশি। তারা গর্ভধারণ করে, সন্তান জন্ম দেয় ও প্রতিপালন করে। বাবার চেয়ে মায়ের সাথে সন্তানদের বন্ধন বেশি দৃঢ় হয়। মেয়েরা সন্তানদের সাথে ঘরে থাকে আর তাই তারা যেভাবে চায় সন্তানরা সেভাবেই বড় হয়। যদি তাদের মাঝে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করা না হয় তাহলে অনেক কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
৬) মেয়েরা তাদের স্বামীদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। যদি তাদের ঈমান ও চরিত্র দৃঢ় হয় তাহলে তারা তাদের স্বামীদেরও দৃঢ়তা অর্জনে খুব ভালো সাহায্য করতে পারে।
৭) মেয়েদের অনেক রকম বৈশিষ্ট আছে। দাওয়াতী কাজে সেগুলোর গুরুত্ব দিতে হবে। যখন কোন দাওয়াতী কাজের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় তখন এসব গুণের কথা মাথায় রাখতে হবে, যেমনঃ
  • মেয়েরা অন্তরে যা বিশ্বাস করে তা দৃঢ়ভাবে প্রকাশের সহজাত ক্ষমতা রাখে। ড. হামদান বলেন, “মেয়েরা সাধারণত কথা ও আবেগের ক্ষেত্রেও বেশি শক্তিশালী হয়।”
  • মেয়েরা মাঝে মাঝে ইচ্ছাশক্তি ও দিকনির্দেশনার অভাব বোধ করে। তাই তাদের শক্তি ও প্রেরণা অর্জনে অন্য মেয়েদের সাহায্য প্রয়োজন।

স্ত্রী ও সুহৃদ – কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকা

দাওয়াতী ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের কাজ পুরুষদের কাজকে আরও শক্তিশালী করে। যেখানে ছেলেরা পৌঁছাতে পারেনা সেখান পর্যন্ত তাদের কাজের বিস্তৃতি। দুঃখজনকভাবে মেয়েদের এই ভূমিকাকে স্থুলভাবে উপেক্ষা ও অবমাননা করা হয়। দাওয়াতী ক্ষেত্রে মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে কারণ প্রকৃতিগতভাবে তারা পুরুষের আত্মিক ও মানসিক সান্ত্বনাদানকারী। একজন পুরুষ যদি শুধুই তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাহলে সে নিজের সমস্যার সাথেই কুলিয়ে উঠতে হিমশিম খায়, দাওয়াতী কাজ করা তখন তার জন্য সুদূর পরাহত হয়ে যায়।  এই কারণে এই পথে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছে। রাসূল(সাঃ)-এর প্রতি খাদিজা(রাঃ)-এর সহানুভূতি ও সাহায্য এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। রাসূল(সাঃ)-এর যেসব সাহাবীরা হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিলেন মানুষের কাছে এই নতুন দ্বীনকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তারাও তাদের স্ত্রীদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
আজকের দিনের অনেক মেয়েই তাদের এই ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন না, জীবনে ধারণ করা তো পরের কথা। মেয়েরা মনে করতে পারে যে বিয়ের পর ঘর হচ্ছে তার জন্য আরামের জায়গা। মেয়েদের এখনো বুঝতে বাকি আছে যে বিয়ে হচ্ছে সংগ্রাম, ত্যাগ ও দায়িত্বের সূচনা।
মেয়েদের ভূমিকা দরজার কাছে এসেই শেষ হয়ে যায় না। অন্যদের কাছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হওয়ার মাধ্যমে, সহৃদয়, নম্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দ্বারা সে অন্যদের মনে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করতে পারে। সে মানুষের পরিস্থিতি বুঝে দ্বীনের প্রতি তাদের আহ্বান জানানোর সম্ভাব্য সমস্ত সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।

প্রয়োজন প্রকৃষ্ট উদাহরণ

যেসব মেয়েরা নিজেদের ভূমিকা বুঝেছিল তারা নিজেদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে শুরু করেছিল। শিক্ষা ও তারবিয়াতের অধিকার অর্জন করতে শুরু করেছিল। আবু সাইদ(রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটি দেখুন। একজন মহিলা রাসূল(সাঃ)-কে বলেছিল, “লোকেরা আপনাকে ব্যস্ত রাখে আর আমরা আপনাকে যথেষ্ট সময় পাইনা। আপনি কি আমাদের জন্য একটা দিন নির্দিষ্ট করবেন? তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন একদিন তাদের সাথে দেখা করে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে শিখাবেন।” (বুখারি) রাসূল(সাঃ)-এর মহিলা সাহাবীদের এই সচেতনতা ও তাদের প্রতি উনার মনোযোগ এক উজ্জল দৃষ্টান্ত এবং মুসলিম মেয়েদের জন্য গর্বের প্রতীক।

এমন আরও কিছু উদাহরণ আছে যা আমাদের ভাবতে শেখায়ঃ

উম্ম সুলাইম(রাঃ) তার ছেলে আনাস ইবন মালিক(রাঃ)-কে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন, যদিও উনার স্বামী ইসলাম গ্রহণ করেননি। যখন অমুসলিম অবস্থায় আবু তালহা উনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন উনি বলেছিলেন যে ইসলাম হবে উনার মোহরানা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তারপর উম্ম সালামা(রাঃ) উনাকে বিয়ে করেন। তিনি তার ছেলে আনাস(রাঃ)-কে রাসূল(সাঃ)-এর দাস করেছিলেন। উম্ম হাকীমের স্বামী তার কারণে ইসলাম গ্রহণ করেন ও আদি ইবন হাতেমের খালা উনাকে ইসলামের পথে নিয়ে আসেন। হাবিব আল আজামির স্ত্রী তাকে রাতে ডেকে তুলতেন সালাত আদায় করার জন্য। আবু বকর(রাঃ)-এর মেয়ে আসমা(রাঃ) তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইবন আয-যুবাইর(রাঃ)-কে বারণ করেছিলেন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন হীণ উপায় অবলম্বন করতে, যদিও উনার তখন অনেক বয়স হয়েছিল ও তার ছেলের সাহচর্যের প্রয়োজন ছিল।
আমরা যদি আরও বড় পরিসরের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো যে আল্লাহর দ্বীনের জন্য মুসলিম মেয়েরা কত বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে। সুমাইয়া(রাঃ) মুসলিম হওয়ার কারণে আবু জাহেলের হাতে জীবন দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য প্রথম শহীদ এবং প্রথম নারী। রাসূল(সাঃ)-এর প্রথম স্ত্রী খাদিজা(রাঃ) অনেক ধনী ছিলেন। তিনি তাঁর অর্থ উদারহস্তে ব্যয় করেছিলেন দ্বীনের দাওয়াতের কাজে। উম্ম সালামা(রাঃ) হিজরত করার সময় তার স্বামীকে ছেড়ে এসেছিলেন ও তার সন্তানকে নির্যাতিত হতে দেখেছিলেন। উহুদের যুদ্ধে উম্ম ইমারা(রাঃ) রাসূল(সাঃ)-কে রক্ষায় যুদ্ধ করেছিলেন। আর যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবা করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতো মুসলিম মেয়েরা ঐতিহাসিকভাবেই পালন করে এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.