আমের ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী (রঃ) । তাবেঈদের জীবনী


আমের ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী (রঃ)



যহদ ও সাধনা আট ব্যক্তির মাধ্যমে সমাপ্তির পৌঁছে, যাদের শীর্ষে রয়েছেন আমের ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী।
                                                                                    আলকামা ইবনে মরসাদ
এখন আমরা হিজরী চতুর্দশ বর্ষে।
আমাদের সামনে বড় বড় সাহাবী ও তাবেঈনের কাফেলা, খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাবের (রাঃ) নির্দেশে যারা বসরা শহরের সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। তারা সংকল্প করেছেন-এই নতুন শহরে পারস্যের গাজী সৈনিকদের জন্য একটি সেনাছাউনী তৈরী করবেন। গড়ে তুলবেন আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য এক বাহিনী…
নির্মাণ করবেন পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুম সমুন্নত করার এক কেন্দ্র। আর ঐ যে দেখা যায় দলে দলে মরু আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসছেন মুসলিম জনতা, তারা আসনে নবীন এই শহরটির দিকে।
আসছেন নজ্দ থেকে…
হেজায থেকে…
ইয়ামান থেকে…
ঐসব অঞ্চল থেকে তারা এখানে সমবেত হচ্ছেন নবী এই মুসলিম শহরের সীমান্ত রক্ষার জন্য।
সমাগত এই মুহাজির দলে ছিলেন নজদ থেকে আসা এক তামীম গোত্রীয় তরুণ, তাঁরই নাম আমের ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী আম্বরী।
সেদিন আমের ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও নির্মল আত্নার অধিকারী এক পবিত্র যুবক।
নবগঠিত বসরা ছিলো সরবাধিক ধনসম্পদ সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যপূর্ণ একটি মুসলিম শহর। কেননা সেখানেই জমা  হচ্ছিলো সকল গনীমত লব্ধ সম্পদ, সঞ্চিত হচ্ছিল খাটি সোনার স্তুপ।
কিন্তু তামীমী তরুণ আমের ইবনে আব্দুল্লাহ আকর্ষণ ছিলো না মোটেও এসবের প্রতি।
মানুষের ধন-ঐশ্বর্যর ব্যাপারে তিনি ছিলেন ত্যাগী, আল্লাহর সম্পদ-সওয়াবের প্রতি ছিলেন তিনি ভীষণ অনুরাগী।
সে সময় বসরার প্রধানতম ব্যক্তি ছিলেন বিখ্যা সাহাবী আবু মুসা আশ আরী (রাঃ)। তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ এই শহরের গভর্নর।
তিনিই ছিলেন এখান থেকে যে কোন গন্তব্যে চলমান সৈনিকদের প্রধান সেনাপতি। তিনিই ছিলেন এই শহরের প্রধান ইমাম। প্রধান শিক্ষক এবং হিদায়াত ও দাওয়াতের একজন তৎপর মুর্শীদ। তাবেঈ আমের ইবনে আব্দুল্লাহ আকড়ে ধরলেন এই সাহাবীর আস্তিন। কী রণাঙ্গনে, কী রণাঙ্গনের বাইরে সবখানেই তিনি রইলেন এই মহান সাহাবীর নিত্যসঙ্গী ও খাদেম।
তিনি তার সঙ্গী হলেন দেশে ও প্রবাসে।
এ্ই সাহাবীর কাছেই তিনি লাভ করলেন পবিত্র কুরআনের নিখুত ও নির্ভূল শিক্ষা, কুরআনের জ্ঞানার্জন করলেন হুবহু সেই ভাবে যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল হয়েছিলো। তারই সূত্রে তিনি বর্ণনা করেছেন বিশুদ্ধ মারফু হাদিস।
তারই কাছে অর্জন করেছেন দ্বীন ইসলামের সঠিক উপলব্ধি ও চেতনা। জ্ঞানার্জনের ঈপ্সিত স্তর যখন তিনি অতিক্রম করলেন তখন নিজের জীবনকে ভাগ করে নিলেন তিন ভাগে।
একঃ কুরএনর জন্যে, এ সময়ে তিনি বসরার মসজিদে মসজিদে গিয়ে কুরআনের শিক্ষা দিতেন।
দুইঃ নির্জন ইবাদতের জন্যে, এ সময়ে তিনি নিজের দুপা নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত নামাযে দাড়িয়ে থাকতেন।
তিনঃ জেহাদের জন্যে, এসময় তিনি খাপমুক্ত তরবারী নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লাই করতেন।
এই তিন উদ্দেশ্যের বাইরে তিনি জীবনের সামান্য সময়ও ব্যয করেননbি আর এ কারণেই তিনি আখ্যায়িত হয়েছিলেন বসরার আবিদ ও যাহিদ নামে।
বসরার জনৈক ব্যক্তি আমের েইবনে আবদুল্লাহ সম্পর্কে েএরকম বর্ণনা করেন-
আমি একবার এক কাফেলার সঙ্গে সফর করছিলাম, আমের ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন সে কাফেলার একজন সঙ্গী। চলতে চলতে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো আমরা একটি ঝোঁপের নিকট পৌঁছে যাত্রা বিরতি করলাম।
আমের (রঃ) নিজের সামনে একত্রিত করে ঘোড়াটিকে একটি গাছের সঙ্গে বাধলেন। ঘোড়ার রশি কিছুটা লম্বা রাখলেন। তার সামনে পরিমাণ মত ঘাস এনে দিয়ে প্রবেশ করলেন গভীর অরণ্যে। যেতে যেতে একসময় আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলেন। আমি সংকল্প করলাম-তার পিছু নেবো এবং দেখবো তিনি এত গভীর রাতে এই গহীন বনে করেন কী? দেখলাম- যেতে যেতে তিনি একটি ছোট্ট ঢিপির কাছে থামলেন, চতুর্দিক দিয়ে ঘন গাছপালায় ঘেরা এই নির্জন ঢিপিতে ঢুকে তিনি নামাযে দাড়িয়ে গেলেন। আমি অপলক দৃষ্টিতে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এত পরিপূর্ণ , খুশু খুযূ পূর্ণ এবং এত চমৎকার নামায আমার জীবনে আর কখনো দেখিনি।
দীর্ঘ সময় ধরে নামায আদায়ের পর তিনি দুআ করতে শুরু করলেন, দু হাত তুলে বলতে লাগলেন-
“হে আল্লাহ! তুমিই আপন নির্দেশে আমাকে সৃষ্টি করেছো অতঃপর আপন ইচ্ছায় আমাকে দুনিয়ার নানান পরীক্ষায় ফেলে নির্দেশ দিয়েছো- নিজেকে বাঁচাও।
হে সর্বশক্তিমান, মহাপরাক্রমশালী! তুমি আপন দয়া ও অনুগ্রহে যদি আমাকে না বাচাও, তবে আমি কীভাবে নিজেকে বাচাবো? কীরুপে আত্নরক্ষা করবো?
হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি জানো, যদি এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ আমার হাতে এসে যায় এবং তোমার নামে কেউ ‍সেটা চাইতে আসে তবে তোমার সন্তুষ্টির আশায় আমি সবই দান করে দিবো।
সুতরাং তোমার সন্তুষ্টি আমাকে দান করো ইয়া আরহামার রাহিমীন।
হে আল্লাহ! আমি তোমাকে এমন হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসি যা সকল মুসিবতকে আমার জন্য সহজ করে দেয় এবং তোমাকে সকল ফয়সালার প্রতি সন্তুষট করে দেয়।
তোমার ভালোবাসা পেলে আমি আর কোন পরোয়া করি না।
তোমার ভালোবাসা পেলে আমি আর ফিরেও দেখি না কিভাবে আমার সকাল গেলো আর কিভাবে আমার সন্ধ্যা এলো…
বসরার লোকটি বলেন-
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় আমি ভীষণ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
এরপর যতবার জেগেছি আমেরকে সেই একই স্থানে নামাযে অথবা মুনাজাতেই দেখেছি প্রভাতের আলো ফোটা পর্যন্ত।
ফজরের সময় হলে তিনি নামায পড়ে আবার যুআ করতে লাগলেন। তিনি বললেন- ইয়া আল্লাহ! এই যে প্রভাতের আলো ফুটলো, মানুষ জীবিকার সন্ধানে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটে বেড়াবে… প্রতিটি মানুষেরই নানান প্রয়োজনীয়তা আছে…অভাব আছে…কিন্তু আমেরের ‍শুধু তোমার ক্ষমা ছাড়া আর কোন অভাব নেই, প্রয়োজন নেই।
ইয়া আল্লাহ! তুমি আমার এবং সব মানুষের সকল অভাব মিটিয়ে দাও ইয়া আকরামাল আকরামীন! (হে মহান আল্লাহ)
ইয়া আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তিনটি প্রার্থনা করেছিলাম, যার দুিইটি তুমি কবুল করেছো আর একটিতে আমাকে বঞ্চিত করেছো, সেটা আমাকে দাওনি।
ইয়া আল্লাহ! দয়া করে সেটাও আমাকে দান করো, যেন আমি প্রাণভরে তোমার ইবাদত করতে পারি।
এরপর তিনি উঠে পড়লেন তখন হঠাৎ আমার উপর তার চোখ পড়লে তিনি বুঝতে পারলেন রাতভর আমি তাকে অনুসরণ করেছি। ফলে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন এবং আফসোস করে বললেন—
“মনে হচ্ছে রাতভর আমাকে পাহারা দিয়েছো?”
“হ্যা তা দিয়েছি । আমি জবাব দিলাম”
রাতভর যা দেখেছো দয়া করে তা গোপন রেখো, আল্লাহ তোমার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন।
আমি তখন বললামঃ আল্লাহর কসম! হয়ত আমাকে আপার তিনটি প্রার্থনার কথা বলবেন, না হয় যাা দেখেছি সেটা সব মানুষের কাছে বলে দেবো।
তিনি বললেন- দূর বোকা! এমন করো না।
আমি বল্লামঃ তাহলে আমি যা বললাম তাই করুন…
এভাবে বারবার আমার জিদ দেখে তিনি বললেন-
ঠিক আছে, বলবো তবে তোমাকে আল্লাহর নামে কসম করে বলতে হবে যে, একথা তুমি কারো কাছে প্রকাশ করবে না।
আমি বললাম- আমি আল্লাহর নামে কসম করছি যতদিন আপনি বেচে থাকবেন ততদিন এই রহস্য প্রকাশ করবো না।
তিনি বলতে শুরু করলেন-
দ্বীনের ব্যাপারে নারীই ছিলো আমার কাছে সর্বাধিক ভয়ঙ্কর, ফলে আমি প্রার্থনা করেছিলাম যেন আল্লাহ আমার অন্তর থেকে তাদের ভালোবাসা দূর করে দেন। তিনি এ িদুআ কবুল করেছেন, ফলে এখন আমি একজন নারী এবং একটি দেয়লেরপ্রতি দৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য বুঝি না। এ দুটি আমার মনে কোন আলাদা অনুভূতি জন্মায় না।
আমি বললাম- এতো হলো একটি, দ্বিতীয়টি কি?
তিনি বললেন- আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আমার অন্তরে যেন তিনি ছাড়া আর কারোর ভয় না থাকে, যেন আমি শুধুমাত্র তাকেই ভয় করি। এটাও তিনি কবুল করেছেন। এখন আসমান যমীনে তাকে ছাড়া আর কাউকে আমি বিন্দুমাত্র ভয় পাইনা।
তৃতীয়টি কী? আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার ঘুম দুর করে দেয়াার জন্য আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যেন আমি রাতদিন প্রাণভরে তার ইবাদত করতে পারি। আমার এই দুআটি কবুল হইনি।
আমি তার এই বিবরণ শুনে বললাম-নিজের শরীরের উপর একটু রহম করুন, আপনি তো রাতভর নামায আর দিনভর রোযা রাখছেন…
যে আমল আপনি করছেন তার সামান্যতেই জান্নাত অবধারিত আর যে ক্লেশ আপনি সহ্য করছেন তার সামান্যতেই জাহান্নাম থেকে মুক্তিও নিশ্চিত।
কিন্তু আমার ভয় হয় নাজানি কেয়ামতের ময়দানে আমাকে আল্লাহর সামনে লজ্জিত হতে হয়, যাা তখন কোনই কাজে আসবে না।
আর এই ভয়েই আমি যখনই সুযোগ পাই ইবাদতের চেষ্টা করি। আমি যদি নাজাত পেয়ে যাই, তবে সেটা হবে আল্লাহর অসীম রহমত। আর যদি জাহান্নামের ফয়সালা হয় তবে সেটা হবে আমারই অবহেলা ও অলসতার ফল।
আমের ইবনে আবদুল্লাহ যেমন ছিলেন ইবাদতগুযার তেমনি ছিলেন একজন ঘোড়সওয়ার মুজাহিদও।
যখনই জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহর আহবান আসতো সেখানে তিনিই থাকতেন সর্বাগ্রে সাড়াদানকারী। তিনি কোন রণাঙ্গনে শরীক হলে র্বপ্রথম মুজাহিদদের মাঝে নিরীক্ষণ চালিয়ে কিছুলোক বাছাই করতেন এরপর তাদের ডেকে বলতেন-
আমি তোমাদের সঙ্গী হতে চাই যদি আমার তিনটি শর্তে তোমরা রাজী থাকো…
কী শর্ত?
এক- আমি তোমাদের খেদমত করবো, এ ব্যাপারে তোমরা কেউ আপত্তি করতে পারবে না।
দুই- আমিই সবসময় নামাযের আযান দিবো, অন্য কেউ আযান দেয়ার দাবী জানাতে পাবে না।
তিন- আমি সামর্থ্য অনুযায়ী তোমাদের জন্য খরচ করবো, তোমাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না।
এগুলো সবাই একবাক্যে মেনে নিলে তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নিতেন।
আর তাদের কোন একজনও যদি কোন একটি বিষয়ে আপত্তি করতো, তবে তাদেরকে তিনি বিদায়ী সালাম জানাতেন।
আমের (রঃ) ছিলেন সেই বিরল মুজাহিদদের একজন যারা রক্ত দেয়ার সময় হলে থাকেন সবার আগে আর গনীমত বন্টনের সময় সবার পিছে। ফলে রণাঙ্গনে তিনি ঝাপিয়ে পড়তেন এমন বিক্রমে যা আর কারো পক্ষেই সমভব হতো না। গনীমত বন্টনকালেও তিনি দুরে সরে থাকতেন এমনভাবে যা সাধারণতঃ অন্য কেউ করেন না।
প্রাসঙ্গিক ঘটনাঃ
সা‘আদ ইবনে আবী অক্কাস (রাঃ) কাদেসিয়া যুদ্ধ শেষে পারস্য সম্রাট কেসরার রাজাপ্রাসাদে অবতরণ করলেন। তিনি উমর ইবনে মুকাররানকে নির্দেশ দিলেন সমস্ত গনীমতের মাল জমা করে হিসাব করতে। কেননা একপঞ্চমাংশ বাইতুল মালে পাঠিয়ে অবশিষ্ট মাল তিনি ভাগ করে দেবেন মুজাহিদদের মাঝে।
তার সামনে জা হলো বিভিন্ন প্রকার দামী ও উত্তম সম্পদ- যা বণণনার অতীত এবং গণনারও অতীত।
সঞ্চিত সম্পদরাশির মধ্যে আছে- সীসা দ্বারা সীল করা এক বিশাল ঝুড়ি, যাতে ঠাসা রয়েছে পারস্য সম্রাটদের সমস্ত স্বর্ণ, রৌপ্যের থালাবাসন।
আছে- উত্তম ও দামী কাঠের তৈরী অনেক বাক্স, যেগুলোতে ঠেসে ঠেসে রাখা হয়েছে কেসরাদের কাপড় চোপড় এবং মণিমুক্তার প্রলেপ দেওয়া বহু বর্ম ও কন্ঠহার।
আরো আছে- দুর্মূল্য আতর ও সগন্ধির বেশ কয়েকটি বড় বড় বাক্স। এছাড়াও রয়েছে- নারীদের সাজ-সরঞ্জাম, অলঙ্কার ইত্যদির বিস্ময়কর সমাহার।
এখানে রয়েছে পর্যায়ক্রমে পারস্য সম্রাটদের আলাদা আলাদা খাপবদ্ধ তরবারী। রয়েছে- সেই সব রাজা-বাদশা ও সেনাপতির তরবারী, যারা যুগে যুগে বশ্যতা মেনে নিয়েছে পারস্যের।
কর্মচারীরা যখন সকলের উপস্থিতিতে এইসব গনীমতের মাল হিসাব করছিলো তখন হঠৎ সেখানে ভীষণ ওজনের বিশাল একটি বাক্স নিয়ে হাজির ধুলিমলিন বেশ ও এলোমেলো কেশধারী একলোক। লোকটির বেশভূষায় সবাই ভাবলো- এ আবার কোন আপদ এলো!
কিন্তু এই তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টি যখন লোকটির উপর থেকে সরে বাক্সটির উপর পড়লো তখন বিস্ময়ের ধাক্কা খেয়ে তারা সবাই সোজা হয়ে বসলো। ভাবলো এত চমৎকার বাক্সতো জীবনে আর চোখে পড়েনি! এমনকি এখানে এই যে বিপুল গনীমত কিন্তু এসবের কোন একটিও কি এর মত কিংবা ন্তত এর কাছাকাছি হবার যোগ্য?
এরপর যখন বাক্সটির ভেতরে তাদের চোখ পড়লো তখন তো তাদের বাকরুদ্ধ হবার যোগাড় করন চমৎকার সেই বাক্সটি ছিলো দুস্প্রাপ্য সব মাণিক্য ও মুক্তা দিয়ে ভরা…
ফলে তাচ্ছিল্য পূর্ণ দৃষ্টির শিকার সেই এলোকেশ ও মলিন বেশধারীই সকলের নতুন এক ধরনের দৃষ্টির শিকার হলো, যার বঙ্ময় প্রকাশ দ্বনিত হলো কারো কারো কন্ঠে।
কিন্তু তুমি পেয়ে কোথায় এই অমূল্য সম্পদের খনি? তাদের সুরে ফুটে উঠলো অসম্ভব বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার তীব্র প্রকাশ।
অমুক যুদ্ধে- অমুক স্থানে গনীমত পেয়েছি…। লোকটির গায়ে না মাখা উত্তর।
তুমি কিছু সরিয়ে রাখনি তো?
আল্লাাহ তোমাদের ভ্রান্তি দুর করুন…
এই বাক্স এবং পারস্যের যাবতীয় সম্পদ আমার কাছে কর্তিত নখের বরাবরও তো নয়…
এতে যদি শুধু বাতিুল মালের হক জড়িত না থাকতো তবে আল্লাহর কসম আমি ওটা ছুয়েও দেখতাম না।
আমি নিতে চাইলে কিছু কেন পুরোটাই সরিয়ে রাখলে তোমরা জানতে কীভাবে?
আমি সরাতে চাইলে কেন এত কষ্ট করে ওটা এখানে টেনে আনবো?
কে তুমি হে মহান ব্যাক্তি? কী তোমার নাম? রাজ্যের শ্রদ্ধা ও সমীহ এসে ভর করলো এবার তাদের কন্ঠে
না না সেটা তোমাদের জানার দরকার নেই।
আমার নাম ধরে তোমরা প্রসংসা করবে? অন্যদের কাছে আমার সুনাম ও খ্যাতি ছড়াবে? আমাকে ফুলাবে?
আল্লাহর কসম আমি তা চাইনা, আমি সেটা হতে দেবোনা। আমি শুধু মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি, তার কাছেই এর বিনিয় চাচ্ছি।
এ কথাগুলো বলেই তিনি সেখান থেকে সরে পড়লেন। লোকটির নাম ধাম জানার জন্য তারা নিজেদের একজন লোককে তার পিছে পিছে পাঠালো।
অনুসরণকারী লোকটি মলিন বেশধারীর অজ্ঞাতসারে তার পিছে পিছে যেতে লাগলো।
তিনি স্বগোত্রীয়দের মাঝে পৌছে সালাম কালাম করছিলেন, অনুসরণকারী দুর থেকে তাকে দেখিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলো
আচ্ছা ঐ লোকটি কে? আশ্চর্য ! তুমি তাকে চেনোনা!
তিনিই তো বসরার বিখ্যাত আবিদ ও যাহিদ আমের ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী (রঃ)
এত কিছু সত্ত্বেও আমের ইবনে আবদুল্লাহর জীবন নির্ঝঞ্ঝাট ছিলো না, ছিলো না মানুষের নির্যাতনমুক্ত।
সত্য প্রকাশ ও অন্যায় প্রতিরোধ নামের আড়ালে একদল লোক তার বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছিলো।
প্রত্যক্ষভাবে যে ঘটনার কারণে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, সেটা ছিলো এরুপ-
বসরার এক পুলিশ ঘাড় ধরে এক যিম্মিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে…
যিম্মি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে…
বাচাও…বাচাও…
হে মুসলিম সমাজ! তোমাদের নবীর আশ্রিতকে বাচাও…
চিৎকার শুনে হযরত আমের এগিয়ে এলেন এবং যিম্শিকে জিজ্ঞাসা করলেন
তোমার কি কর বাকী পড়েছে?
জ্বি না হুজুর! একদম হাল পর্যন্ত শোধ করা আছে।
এবার পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলেন
কী চাও এর কাছে?েআমি একে বলেছি আমার সঙ্গে যেতে হবে, দারোগার বাগান সাফ করতে হবে।
তুমি কি এতে রাজী? তিনি আবার যিম্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন।
কক্ষোনো না…
এতে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি, তাছাড়া এই কাজের পর আমার উপার্জনের সময় থাকে না…
আমের (রঃ) গম্ভীর স্বরে পুলিশকে বললেন- ওকে ছেড়ে দাও বলছি…
ছাড়বো না , পুলিশের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব।
আর এক মুহূর্তেরও বিলম্ব সহ্য হলো না আমেরের (রঃ) গায়েব চাদর খুলে তিনি গর্জে উঠলেন-
আল্লাহর কসম ! আমার শরীরে এক ফোটা রক্ত থাকতেও মুহাম্মদ (সাঃ) এর অঙ্গীকার ভঙ্গ হতে দেবো না।
হৈচৈ শুনে সেখানে জমে গেলো বহু মানুষ, ঘটনা শোনার পর সবাই পুশিশের উপর ক্ষিপ্ত হলো এবং জোরপূর্বক তার হাত খেকে যিম্মিকে মুক্ত করলো।
এতে পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে চক্রান্ত করে আমেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ চাপালো। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মিথ্যা আপবাদ খাড়া করেলো-
তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পরিপ্থী।
তিনি বিবাহের সুন্নাতকে অস্বীকার করেন।
কোন প্রাণীর দুধ ও গোস্ত খান না । হালাল মনে করেন না।
ক্ষমতাসীনদের কাছে যান না অহঙ্কারী।

এসব কথা শেষ পর্যন্ত আমীরুল মুমিনীন উসমান (রাঃ) এর দরবারে উত্থাপিত হলো।

খলীফা বসরার গভর্নরকে নির্দেশ পাঠালেন আমের ইবনে আব্দুল্লাহকে ডেকে অভযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে সর্বশেষ ফলাফল তাকে জানাতে।
গভর্নর তাকে ডেকে খলীফার নির্দেশের কথা শোনালে আমের বললেন-
আপনি আমিরুল মুমিনীনের নির্দেশ পালন করুন, জিজ্ঞাসা করুন।
গভর্নর জিজ্ঞাসা করলেন-
আপনি কি বিবাহের সুন্নাতকে অস্বীকার করেন?
তিনি জবাব দিলেন-
মোটেও না। বিবাহের সুন্নত েআমি কখনোই অস্বীকার করি না। আমি জানি ইসলামে সন্নাস যাপনের সুযোগ নেই, তথাপ্রি আমি বিবাহ করিনি, তার কারণ- আমি এমনই দুর্বল ও অসহায় একজন মানুষ যার আশঙ্কা রয়েছে- আল্লাহর জন্য সম্পূর্ণ সমর্পিত হৃদয়টি হয়তো স্ত্রীর কাছে পরাজিত হয়ে যাবে।
আপনি গোস্ত খান না কেন?
না পেলে খাব কিভাবে ? খেতে ইচ্ছা করলে এবং তখন পেয়ে গেলে ঠিকই খাই
পনীর কেন খান না?
কারণ আমার এলাকায় পনীর তৈরী করে অগ্নিপূজকেরা, যাদের কাছে ছাগলের জবাই করা এবং মরার মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই। ফলে কোন পনীর হালাল আর কোনটি হারাম তা নির্ণয় করতে পারি না। তবে যদি দুজন মুসলমান বলে যে, এটা জবাই করা ছাগলের তৈরী পনীর, তখন আমি পনীর খেতে মোটেও দ্বিধা করি না।
আমীর উমারাদের মজলিসে যাান না কেন?
তোমাদের দুয়ারের প্রার্থী তো অনেক আছে, তাদেরকে ডেকে ডেকে কাছে বসাও…
তাদের অভাব অভিযোগগুলো মিটিয়ে দাও…
তোমাদের দুয়ারে যার কোন প্রার্থনা নে্‌, িতাকে তার আপন পথে চলতে দাও।
আমীরুল মুমিনীন উসমান (রাঃ) এর দরবারে এই খবর পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে পৌছানো হলো, কিন্তু তার মধ্যে কোন রাষ্ট্রদেদ্রাহিতার চিহৃ তিনি খুজে পেলেন না। পেলেন না আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের পরিপন্থী হওয়ার কোন প্রমাণও।
তবে এও সত্য যে তার বক্তব্যে বিশৃঙ্খলার আগুন নিভলো না…
বরং নানান কথার ফানুস তাকে ঘিরে বাতাসে উড়তে লাগলো। ক্রমেই তার সমর্থক ও বিরোধীদের মাঝে ভয়বহ ফেৎনা ধুমায়িত হতে লাগলো। ফলে উসমান (রাঃ) তাকে সিরিয়ায় প্রত্যাবাসনে নির্দেশ দিলেন…
সিরিয়ার গভর্নর মুআবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানকে নির্দেশ পাঠালেন- ভালভাবে তার ইস্তেকবাল করতে এবং তার মর্যাদার প্রতি যত্নবান হতে।
যেদিন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বের হলেনে সেদিন তাকে বিদায় জানাতে তার ভাই বন্ধু ছাত্র ও ভক্তের এক বিরাট দল বসরার পথে নেমে আসলো।
তারা শহর ছেড়ে মারবাদ অঞ্চলে পৌছলে তিনি সকল ভক্তকে বললেন
এখন আমি দুআ করবো, আপনারা আমীন বলুন…
একথা শুনে সকলের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো, ঘাড় উচু করে সবাই শেষ বারের মত তাকে দেখতে লাগলো।
তিনি দুহাত তুলে মোনাজাত করতে লাগলেন-
ইয়া আল্লাহ! যে সব লোক আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে অন্যায়ভাবে আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, যারা আমাকে মাতৃভূমি থেকে বহিস্কারের জন্য দায়ী এবং যারা আমার ও আমার পরম বন্ধু স্বজনদের মাঝে বিচ্ছেদের জন্য দায়ী…
ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম, দয়া করে তুমিও তাদের ক্ষমা করে দাও…
ইয়া আল্লাহ! তুমি তাদের দ্বীন ও দুনিয়াকে সুন্দর করে দাও…
তুমি আমাকে, তাদেরকে এবং সমস্ত মুসলমানকে তোমার রহমত, ক্ষমা ও অনুগ্রহ দ্বারা আচ্ছন্ন করে দাও, ইয়া আরহামার রাহিমীন!
এরপর তিনি বাহনের মুখ ঘুরিয়ে দিলেন সিরিয়ার দিকে, অতঃপর সম্পূর্ণ নতুন এই গন্তব্যে দিকে এগিয়ে গেলেন…
হযরত আমের ইবনে আবদুল্লাহ জীবনের বাকী দিনগুলো কাটিয়েছেন সিরিয়াতেই। সেখানে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসকে গ্রহণ করেছিলেন আপন আবাস হিসাবে। সেখানে তিনি আমীর মুআবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ারে প্রচেষ্টায় লাভ করেছিলেন উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা।
এরপর যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত, ভক্তবৃন্দ খবর পেয়ে তার কাছে সমবেত হলেন, তারা দেখতে পেলেন- তিনি অঝোরে কাদছেন।
বৃথাই কেন অশ্রু ঝরাচ্ছেন, আপনি ছিলেন বসরার আবিদ ও যাহিদ…
তিনি বললেন-
আল্লাহর কসম! আমি দুনিয়ার লোভে অথবা মৃত্যুর ভয়ে কাদছি না, আমার ভয় শুধু এতটুকুই যে, হায়! আখেরাতের সফর কতই না দীর্ঘ, আর আমার পাথেয় কতই না স্বল্প।
আমি পৌছে গেছি জীবনের শেষ সন্ধ্যায়, আমি এখন ভয়ঙ্কর এক উত্থান পতনের মাঝে অনিশ্চিত গন্তব্যের দোলায় দোদুল্যমান।
হয়তো জান্নাত…নয় তো জাহান্নাম…
আমি জানি না কোনটি আমার চূড়ান্ত মনযিল…
অতঃপর তিনি জীবনের শেষ কয়েকটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তখন তার জিহ্বা ছিলো আল্লাহর যিকিকের সিক্ত…
ঐখানে…
ঐ প্রথম কেবলার পবিত্র মাটিতে…
তৃতীয় হারামে পুন্য ভুমিতে…
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মেরাজ গমনের স্থানে…
চির নিদ্রায় শায়িত আছেন আমরে ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী…
আল্লাহ তায়ালা আমের (রঃ) এর জন্য তার কবরকে আলোকিত করুন…

চিরস্থায়ী জান্নাতে তার মুখ উজ্জ্বল করুন…

সুত্র:- ‍আলোর কাফেলা

No comments

Powered by Blogger.