দাওয়াতী কাজে মুসলিম নারীঃ একটি ভুলে যাওয়া ভূমিকা (শেষ অংশ) । পর্ব- ৪
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
অনুবাদক: রাবেয়া রওশীন |
মেয়েদের জন্য দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্র
শিক্ষাক্ষেত্রঃ ঈমানের
দ্বারা অন্তরকে আলোকিত করা ও আত্মাকে পবিত্র করা এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত।
মানুষের হৃদয়কে এসবের দ্বারা স্পর্শ করা সম্ভব। মসজিদে, স্কুলে, সংগঠনে,
দাওয়াতী দলের মাঝে ও অন্যান্য জায়গায় এর সুযোগ রয়েছে।
সামাজিক ক্ষেত্রঃ এই
ক্ষেত্র শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ও সেই সাথে সামাজিক উন্নয়ন ও মানুষের
মাঝে সংযোগ স্থাপনের কথা বলে। এই বিষয়গুলো আত্মিক শিক্ষায় শিক্ষীত হতে ও
মুসলিম হিসাবে চরিত্র গঠনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আত্মিক ও শারীরিক দুটোদিক একে অপরের পরিপূরক এবং ভারসাম্য বজায় রেখে
দুটোরই যত্ন নেয়া প্রয়োজন। শুধু আত্মার উন্নতীকরণ হচ্ছে বৈরাগ্য ও শুধু
শরীরের যত্ন নেয়া হচ্ছে ভোগবাদ। শারীরিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে বহু মানুষ
ইসলাম গ্রহণ করেছে। আজকের দিনের খ্রিষ্টান মিশনারীরা এই পদ্ধতিকে ব্যবহার
করছে। ক্ষুধার্ত, উলঙ্গ, অসুস্থ ও গৃহহীন মানুষের জন্য ধর্মপোদেশ শোনা
কঠিন।
দাওয়াতী কাজ হিসাবে মেয়েরা আরও কিসে অংশ নিতে পারে তার আরও কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ হচ্ছেঃ
১) ঘরঃ
নিশ্চিতভাবেই এটা সবচেয়ে উর্বর ও কার্যকর পথ। আল্লাহ স্বামী ও স্ত্রী
দুজনকেই আদেশ করেছেন একে অপরকে ও তাদের পরিবারকে শিক্ষাদান করতে। একজন মা
তার স্বামীর সাথে একে অপরের ও তাদের সন্তানদের শারীরিক, নৈতিক, মানসিক ও
বাহ্যিক বিষয়গুলোর ব্যপারে শিক্ষাদান করা ভাগাভাগি করে নেয়। পরিবারের
সদস্যরা দীর্ঘ সময় একসাথে ঘরে থাকে। এর ফলে তাদের মাঝে বোঝাপড়া ভালো হয় ও
ভালো উদাহরণ তুলে ধরার এবং সঠিক পথ দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়।
২) মুসলিম সমাজঃ আত্মীয়, প্রতিবেশী ও দুস্থদের সাদাকা, সদুপদেশ ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া।
৩) মসজিদঃ
মসজিদে যা শেখান হয় তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য মেয়েদের মসজিদে যেতে দেয়া
উচিত। মেয়েদের কার্যক্রম যেমন কুরআন শিক্ষা ও অন্যান্য প্রশিক্ষণের জন্য
মসজিদ খুবই উপযুক্ত জায়গা।
৪) হাসপাতাল, কয়েদখানা, সমাজ কল্যাণ সংস্থা, মেয়েদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
ড. হামদান বলেন, “বড় কোন কনফারেন্সের সাথে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য
কনফারেন্সের আয়োজন করা যেতে পারে যেন মেয়েরা তাদের মাহরামের সাথে ভ্রমণ
করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন,“ব্যক্তিগত পর্যায়েও দাওয়াতী কাজ করা যেতে পারে যেমন
বন্ধু, পরিবারের সদস্য,সহকর্মী ও বিশেষ করে যারা অমুসলিম তাদের মাঝে।
ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলামে আসা অনেক মেয়ের পরিবারের সদস্যরা অমুসলিম এবং এটা
দাওয়াতী কাজ করার জন্য এক মূখ্য সুযোগ, যদিও কাজটা কঠিন।”
কুরআন এবং সুন্নাহ কী বলেঃ
মুসলিম মেয়ে -আহ্বানকারী এবং আহ্বানকৃত: নিশ্চয়ই
কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই। সাধারণত পুরুষ সর্বনাম
ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র এই কারণে যে এটাই ভাষার রীতি। তা সত্ত্বেও, কিছু
কিছু নির্দেশ শুধুমাত্র পুরুষদের দেয়া হয়েছে। একই সাথে, আল্লাহ কিছু
নির্দেশ শুধু নারীদের দিয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে পুরুষদের থেকে তাদের
আলাদা চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব রয়েছে। এই কারণে দাওয়াহ, শিক্ষা, সংষ্কার ও
নির্দেশনায় বিশেষভাবে মেয়েদের উপযোগী করে আহ্বান করাজরুরী। তাদের উপেক্ষা
করা যাবে না। এটা এই কারণে যে রাসূল(সাঃ) পুরুষদের সম্বোধনকরার পর
বিশেষভাবে মেয়েদের সম্বোধন করেছিলেন এবং শুধুমাত্র মেয়েদের শেখানোর জন্য
তিনি সপ্তাহে একটি দিন নির্ধারণ করেছিলেন।
কুরআন আমাদের বলে যে পুরুষ তার ঘর ও পরিবারের ব্যপারে দায়িত্বশীল। “হে
মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর ঐ অগ্নি
হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়, কঠোর
স্বভাব ফেরেশতাগণ,” [৬৬:৬] এবং রাসূল(সাঃ)বলেছেন, “পুরুষ হচ্ছে তার পরিবারের অভিভাবক ও সে এর জন্য দায়িত্বশীল।”
(বুখারি ও মুসলিম) এসব দলিল মেয়েদের শিক্ষা ও যত্নের প্রয়োজনীয়তার উপর
গুরুত্বারোপ করে। অপর দিকে, কুরআন ও সুন্নাহতে এমন অনেক দলিল আছে যা
সাক্ষ্য দেয় যে মেয়েদের জন্যও দাওয়াতী কাজ করা বাধ্যতামূলকঃ
১) কুরআনে এমন
অনেক আয়াত আছে যা মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য দ্বীনের দাওয়াত দেয়া, ভালো
কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করাকে বাধ্যতামূলক করেছে। যেমন, আল্লাহ
বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে এরূপ এক
সম্প্রদায় হওয়া উচিত – যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং ভালো কাজের আদেশ
করবে ও মন্দ কাজের নিষেধ করবে এবং তারাই সুফল প্রাপ্ত হবে।” [৩:১০৪]
২) দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার আহ্বান জানিয়ে মেয়েদের সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে কারণ আল্লাহ বলেছেন, “হে
নবী পত্নীরা! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে
(পরপুরুষেরসাথে) মিষ্টি কন্ঠে এমনভাবে কথা বল না যাতে অন্তরে যার ব্যাধি
আছে, সে খারাপ ইচ্ছা পোষণ করে এবং তোমরা উপযোগী কথা বলবে।” [৩৩:৩২]
ইবন আব্বাস(রাঃ) ‘উপযোগী কথা বলবে’ – রাসূল(সাঃ)-এর স্ত্রীদের প্রতি
আল্লাহর এই আদেশ দ্বারা বুঝেছিলেন যে তাদের ভালো কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে
নিষেধ করতে হবে। এটা সকল মুসলিম মেয়ের প্রতি আল্লাহর আদেশ হিসাবে নেয়া যেতে
পারে। আল্লাহ আরও বলেন, “মু’মিন
পুরুষরা ও মু’মিনা নারীরা হচ্ছে পরস্পর একে অন্যের বন্ধু, তারা সৎ কাজের
আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে, আর নামাজ কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে,
আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ মেনে চলে।” [৯:৭১]
এই আয়াতে এটা স্পষ্ট যে ছেলেদের মতো মেয়েদেরও সাধ্যানুযায়ী এই কাজের ভার
দেয়া হয়েছে। রাসূল(সাঃ) বলেছেন, “মেয়েরা তাদের স্বামীর ঘর ও সন্তানের
রক্ষণাবেক্ষণকারী ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।” আর রক্ষণাবেক্ষণকারী হচ্ছে
এমন কেউ যাকে কোন আমানত দেয়া হয়েছে ও সে তা যত্ন করে রাখবে।
উপরন্তু, সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নিচের বিষয়গুলো থেকে এই উপলব্ধিতে আসা যায় যে ছেলেদের মতো মেয়েরাও দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য দায়িত্বশীলঃ
(ক) যেহেতু
ইসলাম নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষেধ করে ও পর্দাপ্রথা মেনে চলতে আদেশ
করে, তাই এটা বাস্তবসম্মত ও জরুরী যে সমাজের মেয়েদের মাঝে যোগ্যতা সম্পন্ন
মেয়েরা দাওয়াতী কাজ করবে।
(খ) রাসূল(সাঃ) থেকে কিছু শরীয়াহর নিয়ম শুধুমাত্র মহিলা সাহাবীদের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে।
(গ) মাঝে মাঝে
পুরুষ দা’ঈদের পক্ষে মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বিষয় সম্পর্কে কথা বলা
অসুবিধাজনক কারণ মেয়েদের কিছু ব্যক্তিগত বিষয় আছে যা তারা পুরুষদের কাছে
প্রকাশ করতে সংকোচবোধ করতে পারে। তারা হয়ত সেসব বিষয় নিয়ে শুধুমাত্র অন্য
মেয়েদের সাথে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।
যেমন কর্ম তেমন ফল
১) মেয়েদের মাঝে
থেকে অজ্ঞতা দূর করে উদার মনষ্ক বুদ্ধিদীপ্ত ও যোগ্যতা সম্পন্ন দা’ঈ তৈরী
করতে হবে। এর দীর্ঘস্থায়ী সুফল শুধু মুসলিম সমাজ ও মেয়েদের উপরই পড়বে না
বরং পুরো সমাজের উপরইপড়বে।
২) বহু ভুল প্রথা যা সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে তা সংশোধন করতে হবে।
৩) মেয়েদের আরও পরিপক্কতা অর্জন করতে হবে ও নিয়মনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে নারী ও পুরুষের মাঝে সুসম্পর্ক তৈরী হবে।
৪) ইসলামে মেয়েদের অবস্থান তুলে ধরতে হবে ও মুসলিম মেয়েদের তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
৫) তরুণদের গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যেন মুসলিম উম্মাহ পরবর্তী প্রজন্মে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মুসলিম পেতে পারে।
৬) মুসলিম পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করতে হবে এবং ভালো কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করার চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।
৭) মেয়েদের সাদাকা দেয়ার মাধ্যমে দাওয়াতী কাজের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
যারা সুন্নাহ পালন করেবলে দাবী করে তাদের মেয়েদের মাঝে ও মেয়েদের দ্বারা
দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার বিষয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। খাদিজা(রাঃ),
আইশা(রাঃ), সুমাইয়া(রাঃ) ও আমাদের ইতিহাসজুড়ে আরও অনেক মুসলিম মেয়েরা
দ্বীনের জন্য কী করেছিলেন তা আমাদের মনে রাখতে হবে ও সেটা থেকে শিক্ষা
গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে শুধুমাত্র কথা ও আবেগপ্রবণতা অর্থহীন।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের কিছু করা প্রয়োজন। মেয়েদের শিক্ষা,
প্রস্তুতি ও যোগ্যতা আমাদের ভবিষ্যত সাফল্যের চাবিকাঠি। আমরা যদি ইতিহাসের
দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে একটা সমাজের সমৃদ্ধি কতখানি তা পরিমাপের
মাপকাঠি হচ্ছে সেই সমাজের মেয়েদের অবস্থান কেমন তা লক্ষ্য করা। তাহলে আসুন
আমরা মুসলিম মেয়েদের স্রষ্টা প্রদত্ত গুণকে কাজে লাগিয়ে ও তাদের উপর ন্যস্ত
দায়িত্বকে পালন করতে দিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগীয়
পরিস্থিতি উন্নত করতে প্রচেষ্টা চালাই।
No comments