দাওয়াতী কাজে মুসলিম নারীঃ একটি ভুলে যাওয়া ভূমিকা | পর্ব- ১
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
অনুবাদক: রাবেয়া রওশীন |
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসের একদম সূচনালগ্ন থেকেই থেকেই দ্বীনের মৌলিক সত্য
প্রচারে নারীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুমাইয়া(রাঃ)-এর
আত্মত্যাগ থেকে শুরু করে আইশা(রাঃ)-এর হাদীস সংগ্রহ পর্যন্ত দ্বীনের
প্রচারে ও প্রসারে মেয়েরা সহায়ক ভূমিকা পালন করে এসেছে।
দূর্ভাগ্যজনকভাবে,বর্তমান সময়ে ইসলামী জাগরণে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন
ব্যক্তিত্বের প্রচণ্ড অভাব অনুভূত হচ্ছে যা দ্বীন প্রচারকে কিছু অভিজাত
শ্রেণীর মাঝে সীমাবদ্ধ রেখেছে। এর ফলে মেয়েদের মাঝে দাওয়াতী কাজের ব্যাপ্তি
খুব সীমিত হয়ে পড়েছে।
মেয়েদের মাঝে দাওয়াতী কাজ আসলে আরও অনেক বেশি মনোযোগের দাবীদার কিন্তু
এখন পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাওয়াতী কাজ থেকে
মেয়েদের দূরে রাখা হয়েছে। আমরা যদি বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে ইসলামী
দাওয়াতী কাজের অবস্থা ও বর্তমানে এই ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থানের প্রতি নজর
দেই তাহলে সহজেইআমাদের নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো চোখে পড়বেঃ
১) মেয়েদের মাঝে ও মেয়েদের দ্বারা দাওয়াতী কাজ করার সক্ষমতার অভাব।
২) ব্যবহারযোগ্য যে সীমিত সম্পদ রয়েছে তার অপব্যবহার ও সেই সাথে মেয়েদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব।
৩) দাওয়াতী কাজের পরিকল্পনায় মেয়েদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে অবহেলা করা বা বাদ দেয়া।
৪) মেয়ে দা’ঈদের
মাঝে ভালো প্রশিক্ষণ ও দ্বীনের মৌলিক জ্ঞানের অভাব। শুধু কিছু পুরুষ
দা’ঈদের স্ত্রী ও মেয়েদের মাঝে উপযুক্ত ইসলামী জ্ঞান বিদ্যমান রয়েছে।
৫) বেশিরভাগ
মেয়েরা উপলব্ধি করে না যে তাদের স্বামীদের জন্য দাওয়াতী কাজে অংশ নেয়া
বাধ্যতামূলক। যার ফলে তারা ঘরের বাইরে বিভিন্ন প্রজেক্টে স্বামীদের সময়
দেয়ার গুরুত্বকে অনুধাবন করে না। আর এ কারণে ঘরের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করে।
৬) বেশিরভাগ মেয়েদের মাঝে দ্বীনের সাধারণ জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
৭) মেয়েদের দাওয়াতী কর্মসূচি ও সেই সাথে সামগ্রিক দাওয়াতী কর্মসূচি ও প্রতিষ্ঠান বিরল। যেগুলো আছে সেগুলোও সুসংগঠিত না।
সমস্যার মূল যেখানে
বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা মেয়েদের মাঝে দাওয়াতী কাজের দূর্বলতা ও
অবহেলার পিছনে মূল কারণ। এইসব বাঁধাকে চিহ্নিত করতে পারলে তার সমাধান খুঁজে
বের করে সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব।
একটা প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, বহু পুরুষ দাওয়াতী ক্ষেত্রে মেয়েদের
ভূমিকা ও দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করে না। অনেক মানুষ কুরআনের “তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে…”(৩৩:৩৩) আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। সেই সাথে ভুল বুঝেছে নারীর উপর পুরুষের অভিভাবকত্ব বা ক্কাওয়াম এর বিষয়টিকে।
প্রায় সময়ই আমরা দেখি পুরুষরা দাওয়াতী ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণের
বিরোধিতা করে থাকে। এভাবে অন্য মুসলিমদের প্রতি ও বৃহত্তর সমাজের প্রতি
তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে। ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব ছেলে-মেয়ে
নির্বিশেষে প্রতিটা মুসলিমের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ড. আইশা হামদান, মিনেসোটার মিনিয়াপলিসে অবস্থিত ইসলামিক
এডুকেশন ফাউন্ডেশনের পরিচালক বলেন, “স্বামীদের পক্ষ থেকে স্ত্রীদের দাওয়াতী
কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” উনি ক্লিনিক্যাল
সাইকোলজিতে পিএইচডি করেছেন, যেখানে তাঁর স্পেশালাইজেশন ছিল শিশু ওপরিবার
বিষয়ে। টুইন সিটিতে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেন। বছর
দুয়েক আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তাঁর এই প্রতিষ্ঠানটির একটা লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম
নারী-পুরুষদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা ও দাওয়াতী ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়
প্রশিক্ষণ দেয়া। তিনি আরও বলেন, “স্বামীদের উচিৎ তাদের স্ত্রীদের দ্বীনের
বার্তা প্রচারে উৎসাহিত করা। তারা যখন দাওয়াতী কাজে বাইরে যায় তখন
স্ত্রীদের সাথে নিতে পারে। সঠিকভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করতে শেখাতে পারে।”
আরও নির্দিষ্ট একটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করার
ব্যাপারে দা’ঈদের মাঝে অনিশ্চয়তা কাজ করে। তাদের অনেকেই উম্মাহর বর্তমান
পরিস্থিতিতে আবেগাপ্লুত ও বিভ্রান্ত। এমনকি এই কারণে তারা নিজের পরিবারের
প্রতি সঠিক মনোযোগ দিতেও অবহেলা করে। তাদের সমস্ত শক্তি বাড়ির বাইরে কাজ
করেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এই অসমতা শুধু পরিবারকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে না বরং পুরো
সমাজকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে।
মেয়েদের শিক্ষার স্তর, তাদের অবস্থান এবং দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা একটা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা ও সচেতনতা কমে গেলে তাদের দেয়ার
মনোভাব কমে যায়, ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা কমে যায়। ড. হামদান বলছিলেন,
“দুঃখজনকভাবে, খুব বেশি মুসলিম মেয়ে মনে করে না যে তারা ইসলাম সম্পর্কে
যথেষ্ট জানে ও তা অন্যদের জানাতে পারে। তাদের বুঝতে হবে যে এই জ্ঞান অর্জন
করে তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া তাদের দায়িত্ব। অনেক মেয়ে বিভিন্ন কারণে
মানুষের সামনে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করে। এইকারণে কিভাবে দাওয়াতী কাজ করতে
হয় তার উপর আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। মেয়েরা যেন প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে
আত্মবিশ্বাসের সাথে মুসলিম হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রায়শই অবহেলিত এই
দায়িত্ব পালন করতে পারে, তার জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।”
ভোগবিলাসিতা মেয়েদের বাধ্য করে সেসবের পেছনে বেশি সময় দিয়ে দাওয়াতী
কাজের পেছনে কম সময় দিতে, যদিও বা সেটা হালাল বিলাসিতাও হয়। যখন তারা
অধিকার ও কর্তব্যের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না তখনও এমনটা হয়। কখনো
আবার মেয়েরা কক্ষচ্যূত হয়ে যায়, ভুলে যায় যে ঘরের কাজই হচ্ছে তাদের প্রধান
কাজ। এই ভূমিকাকে অবহেলা করার ফলে বা অগ্রাধিকার নির্ধারণকরতে ব্যর্থ হওয়ার
কারণে কিংবা এমন কোন কাজ যা তাদের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, তাতে
জড়িয়ে পড়ার কারণে তারা ঘরে ও বাইরে দাওয়াতী কাজে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে
ব্যর্থ হয়। ড. হামদান আরও বলেন, “অনেক মেয়ের জন্যই ঘরের ভেতর স্ত্রী, মা,
রাঁধুনী ও শিক্ষিকার কাজগুলো এত বেশি সময় সাপেক্ষ যে প্রায় সময়ই দাওয়াতী
কাজে অংশগ্রহণের প্রধান বাধা হচ্ছে সময়ের অভাব। এই কারণে ঘরে ও বাইরে
স্ত্রীদের দায়িত্ব পালনে স্বামীদের সহযোগিতা করা এতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
আরও একটি দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ দাওয়াতী সংগঠনগুলো মেয়েদের
প্রাণশক্তিকে আত্তস্থ ও সদব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই সাথে তারা
নিজেদের দাওয়াতী কর্মসূচির মাঝেও এমনভাবে সামঞ্জস্যতা আনতে পারেনি যাতে করে
মেয়েরা তাদের মৌলিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
মিডিয়া ও এই বিশৃঙ্খল সমাজের আরও অনেক উপাদানই মুসলিম মেয়েদের মনে বিশাল
বড় প্রভাব ফেলে থাকে। এই মানসিক বৈকল্য অনেক মেয়েকেই তাদের দায়িত্ব থেকে
দূরে সরিয়ে রেখেছে ও তাদের মনে ইসলামের ভাবমূর্তিকে বিকৃত করেছে।
No comments