তৃতীয় পর্যায়ঃ মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত। রাসূল (সাঃ) এর জীবনী। ১২ তম খন্ড
তায়েফে আল্লাহর রাসূল
নবুয়তের দশম বর্ষের (মাওলানা নজীবাদী তারীখে ইসলাম ১ম খন্ডে ১২২ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন আমার মতে এ তারিখটিই নির্ভুল) শুরুর দিকে ৬১৯ ঈসায়ী সালের মে মাসের শেষ দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ গমন করেন তায়েফ মক্কা থেকে ষাট মাইল দূরে অবস্থিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাওয়া আসার পথ একশত বিশ মাইল দূরত্ব পায়ে হেটে অতিক্রম করেছিলেন আল্লাহর রাসূলে সাথে তার মুক্ত ক্রীতদাস যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ছিলেন, তায়েফ যাওয়ার পথে পথে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন, কিন্তু কেউ তার দাওয়াত গ্রহন করল না, তায়েফ পৌছার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাকিম গোত্রের তিনজন সর্দারের কাছে যান, এরা পরস্পর ভাই এদের নাম ছিল আবদে ইয়ালিল, মাসউদ এবং হাবিব এদের পিতার নাম ছিল আমর ইবনে ওমায়ের ছাকাফি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে পৌঁছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং ইসলামের সাহায্য করার আহবান জানান, জবাবে একজন টিপ্পনির সুরে বলল, কাবার পর্দা সে ফেড়ে দেখাক যদি আল্লাহ তাকে রাসূল করে থাকেন (উর্দু ভাষায় এ পরিভাষার সাথে একথা মিলে যায় যে, যদি তুমি পয়গম্বর হও, তবে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করুন একথা দ্বারা এটাই বোঝানো হয় যে, তোমার মত লোকের পয়গাম্বর হওয়া অসম্ভব যেমন কাবাঘরের ওপর হামলা করা অসম্ভব)।
অন্য একজন বলল, আল্লাহ তায়ালা কি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে পেলেন না? তৃতীয়জন বলল আমি তোমার সাথে কোন কথাই বলতে চাই না, কেননা তুমি যদি নবী হয়ে থাক, তাহলে তোমার কথা রদ করা আমার জন্য বিপজ্জনক হবে আর তুমি যদি আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা রটাও তবে তা তোমার সাথে আমার কথা বলাই উচিত নয় এসব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন তোমরা যা করছ তবে বিষয়টা গোপন রেখ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফে দশদিন অবস্থান করেন, এ সময়ে তিনি তায়েফের সকল নেতৃস্থানীয় লোক অর্থাৎ গোত্রীয় সর্দারদের কাছে যান এবং প্রত্যেককে দ্বীনের দাওয়াত দেন কিন্তু সবাই এক কথা বলল যে, তুমি আমাদের শহর থেকে বেরিয়ে যাও, শুধু এ কথা বলেই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং উচ্ছৃংখল বালকদের উস্কানি দিয়েছিল, তিনি ফেরার সময় ওসব দুর্বৃত্ত বালক তার পেছনে লেগে গেল, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল করছিল, হাততালি দিচ্ছিল ও হৈ চৈ করছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে এত বালক এবং দুর্বৃত্ত লোক জড় হল যে, পথের দুধারে লাইন লেগে গেল, এরপর গালাগাল দিতে এবং ঢিল ছুড়তে লাগল, এতে তার দুপা রক্তাক্ত হয়ে তার জুত রক্তে ভরে গেল, এদিকে হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)ঢাল হিসাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আগলে রাখছিলেন ফলে নিক্ষিপ্ত ঢিল তার গায়ে পড়ছিল, তার মাথায় কয়েক জায়গায় কেটে গেল হৈ চৈ করতে করতে দুর্বৃত্তরা আল্লাহর রাসূলের পিছু নিয়েছিলেন এক সময় তিনি মক্কার ওতবা, শায়বা এবং রবিয়াদের একটি বাগানে আশ্রয় নিলেন, এ বাগান ছিল তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাগানে আশ্রয় নেয়ার পর দুর্বৃত্তরা ফিরে গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে আঙ্গুর গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন, কিছুটা শান্ত হওয়ার পর এই দোয়া করলেন যা দোয়ায়ে মোসতাদয়েফিন নামে বিখ্যাত এ দোয়ার প্রতিটি শব্দ দ্বারা বোঝা যায় যে, তায়েফবাসীদের খারাপ ব্যবহার এবং একজন লোকেরও ঈমান না আনার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতটা মনকষ্ট পেয়েছিলেন তার দুঃখ ও মনোবেদনা ছিল কত গভীর এই দোয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হে আল্লাহ তায়ালা আমি তোমার কাছে আমার দুর্বলতা, অসহায়তা এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতা সম্পর্কে অভিযোগ করছি দয়ালু দাতা, তুমি দুর্বলদের প্রভু, তুমি আমারও প্রভু, তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করেছ? আমাকে কি এমন অচেনা কারো হাতে ন্যস্ত করছো যে আমার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করবে, নাকি কোন শত্রুর হাতে ন্যস্ত করছো যাকে তুমি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছো? যদি তুমি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হও তবে আমার কোন দুঃখ নেই, আফসোসও নেই, তোমার ক্ষমাশীলতা আমার জন্য প্রশস্ত ও প্রসারিত কর, আমি তোমার সত্তর সেই আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূর হয়ে আলোয় চারিদিক ভরে যায়, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় তোমার হাতে ন্যস্ত, তুমি আমার ওপর অভিশাপ নাযিল করবে বা ধর্মকাবে, যে অবস্থায় তোমার সন্তুষ্টি কামনা করি, সকল ক্ষমতা ও শক্তি শুধু তোমারই তোমার শক্তি ছাড়া কারো কোনো শক্তি নেই।
রবিয়ার পুত্ররা আল্লাহর রাসূলের অবস্থা দেখে তার প্রতি দয়া পরবশ হল, নিকট আত্মীয়তার কথা ভেবে তাদের মন নরম হয়ে গেল, নিজেদের খৃষ্টান ক্রীতদাস আদাসের হাতে এক থোকা আঙ্গুর দিয়ে বলল, লোকটিকে দিয়ে এস, ক্রীতদাস আদাস আঙ্গুরের থোকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেয়ার পর তিনি বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করলেন।
আদাস বলল, খাওয়ার সময় এ ধরনের কথা তো এখানের লোকজনরা বলে না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কোথাকার অধিবাসী? তোমার ধর্ম কি ? সে বলল, আমার বাড়ী নিনোভায়, ধর্ম ঈসায়ী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তুমি পুণ্যশীল বান্দা হযরত ইউসুফের এলাকার অধিবাসী, আদাস বলল, আপনি ইউসুফকে কি করে চেনেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তিনি ছিলেন আমার ভাই, তিনি ছিলেন নবী, আমি নবী, একথা শুনে আদাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঝুঁকে পড়ল, এবং তার মাথা হাত ও পায়ে চুম্বন করল।
এ অবস্থা দেখে রবিয়ার দুই পুত্র নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, এই লোক এবার আমাদের ক্রীতদাসদের মাথা বিগড়ে দিয়েছে, মনিবদের কাছে ফিরে গেলে তারা আদাসকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে কি ব্যাপার? আদাস বলল, আমার বিবেচনায় পৃথিবীতে এই লোকের চেয়ে ভাল লোক আর নেই, তিনি আমাকে এমন একটি কথা বলেছেন যে কথা নবী ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, রবিয়ার পুত্ররা বলল, দেখ আদাস, এই লোক যেন তোমাকে তোমার ধর্ম বিশ্বাস থেকে সরাতে না পারে তোমার ধর্ম এ লোকের ধর্মের চেয়ে ভাল।
কিছুক্ষণ অবস্থানের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাগান থেকে বেরিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন মানসিকভাবে তিনি ছিলেন বিপর্যস্ত, কারণে মানায়েল নামক জায়গায় পৌছার পর আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ.) এলেন, তার সাথে পাহাড়ের ফেরেশতারাও ছিলেন, তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে অনুমতি চাইতে এসেছিলেন যে, যদি তিনি বলেন, তবে এর অধিবাসীদেরকে দুটি পাহাড়ের মধ্যে পিষে দেবেন।
এ ঘটনার বিবরণ বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওহুদের দিনের চেয়ে মারাত্মক কোন দিন আপনার জীবনে এসেছিল কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তোমার কওম থেকে আমি যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছির তায়েফের দিন আমি আবদে ইয়ালিস ইবনে আবদে কুলাল সন্তানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমার দাওয়াত গ্রহন করেনি, আমি দুঃখ কষ্ট ও মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় কারোন ছাআলেবে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, সেখানে মাথা তুলে দেখি মাথার ওপরে এক টুকরো মেঘ, ভালভাবে তাকিয়ে দেখি সেখানে হযরত জিবরাঈল (আ.) তিনি আমাকে বললেন, আপনার কওম আপনাকে যা যা বলেছে আল্লাহ তায়ালা সবই শুনেছেন, আপনা কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাদের পাঠানো হয়েছে, এরপর পাহাড়ের ফেরেশতারা আমাকে আওয়াজ দিলেন, সালাম জানালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল হা এ কথা সত্যই, আপনি যদি চান তবে আমরা ওদেরকে দুই পাহাড়ের মধ্যে পিষে দেব (এখানে সহীহ বোখারীতে আখশাবিন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে মক্কার দুটি বিখ্যাত পাহাড় আবু কোবায়েস এবং কাযাইকাযান সম্পর্কে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়, এ দুটি পাহাড় কাবাঘরের উত্তর ও দক্ষিণে মুখোমুখি অবস্থানে অবস্থিত সেই সময়ে মক্কার জনসাধারণ এই দুটি পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় বসবাস করত)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না আমি আশা করি আল্লাহ তায়ালা ওদের বংশধরদের মধ্যে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন যারা শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না (সহীহ বোখারী কেতাবে বাদায়াল খালক ১ম খন্ড, পৃ. ৪৫৮)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই জবাবে তার দূরদর্শিতা বিচক্ষণতা, অনুপম ব্যক্তিত্ব ও উত্তম মানবিক চেতনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, মোটকথা, আসমানের ওপর থেকে আসা গায়েবী সাহায্য তার মন শান্ত হয়ে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার পথে পা বাড়ালেন, ওয়াদীয়ে নাখলা নামক জায়গায় এসে তিনি থামলেন, এখানে তার অবস্থানের মত জায়গা ছিল দুটি, এক জায়গার নাম আসসাইলোল কাবির, অন্য জায়গা হলো জায়মা, উভয় জায়গার পানি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সজীবতা বিদ্যমান ছিল, এ দুটি জায়গার মধ্যে তিনি কোথায় অবস্থান করছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায়নি।
নাখলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকদিন কাটান সেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জিনদের দুটি দল তার কাছে প্রেরণ করেন পবিত্র কোরআনের দুই জায়গায় সূরা আহকাফ এবং সূরা জিন এ এদের কথা উল্লেখ রয়েছে।
সূরা আহকাফে আল্লাহ তায়ালা বলেন, স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে যারা কোরআন পাঠ শুনছিল, যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হল, ওরা একে অপরকে বলতে লাগলো চুপ করে শ্রবণ কর, যখন কোরআন পাঠ সমাপ্ত হল ওরা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল এক একজন সতর্ককারীরূপে এমন এক কেতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসা (আ.)এর উপর, এটি পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে, হে আমাদের সম্প্রদায়, আমাদের দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন (২৯-৩১, ৪৬)।
সূরা জিন এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, বল আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে আমরা তো এক বিস্ময়কর কোরআনে শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক স্থির করব না, সূরা জিন এর পনেরটি আয়াত পর্যন্ত এর বর্ণনা রয়েছে।
উল্লিখিত আয়াতসমুহের বর্ণনাভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিনদের আসার কথা প্রথম দিকে জানতেন না কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে জানানোর পর আল্লাহর রাসূল এ সম্পর্কে অবহিত হন কোরআনের আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, এটা ছিল জিনদের প্রথম আগমন, বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, পরবর্তী সময়ে তাদের যাতায়াত চলতে থাকে।
জিনদের আগমন এবং ইসলাম গ্রহন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল দ্বিতীয় সাহায্য আল্লাহর অদৃশ্য ভাণ্ডার থেকে তিনি এ সাহায্য লাভ করেন এ ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় রাসূলকে দ্বীনি দাওয়াতের সাফল্যের ব্যাপারে সুসংবাদ দিয়েছেন এবং একথা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীর কোন শক্তিই দ্বীন ইসলামের দাওয়াতের সাফল্য অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে টিকতে পারবে না, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া না দেয় তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পাবে না, এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না, ওরাই সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে রয়েছে (৩২, ৪৬)।
আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের উক্তির কথা বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা আল্লাহকে যমিনে অসহায় করতে পারব না, এবং আমরা পালিয়ে গিয়েও তাকে অসহায় করতে পারব না (১২, ৭২)।
এই সাহায্য এবং সুসংবাদের সামনে তায়েফের খারাপ ব্যবহারজনিত দুঃখ কষ্ট, মনের কালো মেঘ দূর হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহর রাসূল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, মক্কায় তাকে ফিরে যেতে হবে এবং নতুন উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে, এ সময় হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি করে মক্কায় যাবেন, মক্কার অধিবাসীরা তো আপনাকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে, তিনি বললেন, হে যায়েদ, তুমি যে অবস্থা দেখছ, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় আল্লাহ তায়ালা বের করে দেবেন, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তার দ্বীনকে সাহায্য এবং তার নবীকে জয়যুক্ত করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাখলা থেকে রওয়ানা হয়ে মক্কার অদূরে হেরা গুহায় অবস্থান করলেন, সেখান থেকে খাজায়া গোত্রের একজন লোকের মাধ্যমে আখনাস ইবনে শোরাইককে এ পয়গাম পাঠালেন যে, আখনাস যেন তাকে আশ্রয় দেন, আখনাস একথা বলে অক্ষমতা প্রকাশ করল যে, আমি তো মিত্রপক্ষ, মিত্রপক্ষ তো কাউকে আশ্রয় দেয়ার মত দায়িত্ব নিতে পারে না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর সোহায়েল ইবনে আমরের কাছেও একই পয়গাম পাঠালেন কিন্তু সেই লোকও এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলো যে, বনু আমরের দেয়া আশ্রয় বনু কাব এর ওপর প্রযোজ্য নয়, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোতয়াম ইবনে আদীর কাছে পয়গাম পাঠালেন মোতয়াম বললেন হ্যাঁ, আমি রাজি আছি এরপর তিনি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজের সন্তান এবং গোত্রের লোকদের ডেকে একত্রিত করলেন সবাই একত্রিত হওয়ার পর বললেন, তোমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে কাবাঘরের সামনে যাও, কারণ আমি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি, এরপর মোতয়াম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খবর পাঠালেন যে আপনি মক্কার ভেতরে আসুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর পাওয়ার পর যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন মোতয়াম ইবনে আদী তার সওয়ারীর ওপর দাড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে, কোরাইশের লোকেরা শোন আমি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি কেউ যেন এরপর তাকে বিরক্ত না করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজরে আসওয়াদ চুম্বন এবং দুরাকাত নামায আদায় করলেন নামায আদায়ের পর তিনি নিজের ঘরে ফিরে গেলেন এ সময় মোতয়াম ইবনে আদী এবং তার সন্তানেরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরে রাখল, আল্লাহর রাসূল ঘরে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তারা তার সঙ্গে ছিল।
বলা হয়ে থাকে যে, এ সময় আবু জেহেল মোতয়াকে জিজ্ঞাসা করছিল, তুমি শুধু তাকে আশ্রয় দিয়েছ, না তার অনুসারী অর্থাৎ মুসলমান ও হয়ে গেছ? মোতয়াম বললেন, আমি শুধু আশ্রয় দিয়েছি।
এতে আবু জেহেল বলল, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছ আমরাও তাকে দিলাম (তায়েফ সফরের এ ঘটনার বিবরণসমূহ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪২৯-৪২২, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৬-৪৭, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৭১-৭৪, তারীখে ইসলাম নযীরাবাদী, ১ম খন্ড, পৃ. ১২৩-১২৪)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোতয়াম ইবনে আদীর এ উপকার কখনো ভোলেননি, বদরের যুদ্ধের পর মক্কার কাফেররা বন্ধী হয়ে আসার পর কয়েকজন বন্দীর মুক্তির সুপারিশ নিয়ে মোতয়ামের পুত্র হযরত হোবায়ব (রা, )রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হলেন তিনি বলেছিলেন, মোতায়ম ইবনে আদী যদি আজকে বেচে থাকতো এবং আমার কাছে এসব দুর্গন্ধময় লোকদের ব্যাপারে সুপারিশ করতো, তবে তাদের খাতিরে আমি এদের সবাইকে মুক্ত করে দিতাম (সহীহ বোখারী ৩য় খন্ড, পৃ.৫৭৩)।
বিভিন্ন গোত্র ও ব্যক্তির কাছে ইসলামের দাওয়াত
নবুয়তের দশম বর্ষে যিলকদ মাসে অর্থাৎ ৬১৯ ঈসায়ী সালের মে মাসের শেষ বা জুনের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ থেকে মক্কায় আগমন করেন, সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোত্রের কাছে নতুন উদ্যমে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন, এ সময় হজ্জের মৌসুম হওয়ায় দূরে কাছে সর্বত্র থেকে হজ্জ পালনের জন্য পায়ে হেঁটে এবং সওয়ারীতে করে বহু লোক হজ্জ পালনের জন্য আসেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সময় তাদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন, নবুয়তের চতুর্থ বছর থেকে তিনি এ ধরনের দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন।
ইমাম যুহরী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল গোত্রের কাছে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন, তারা হচ্ছে, বনু আমের ইবনে সায়া, সায়া মোহারেব ইবনে খাছফা, ফাজারাহ, নাসসান, মায়রা, হানিফা, সালিম, আবাস, বনু নছর, বনু আলবাকা, কেলাব, হারেছ ইবনে আজারাহ ও হাজারেমা, কিন্তু কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি (তিরমিযি, মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ.১৪৯)।
ইমাম যুহরীর উল্লিখিত এ সকল গোত্রের কাছে একবার বা এক বছরের হজ্জ মৌসুমেই শুধু ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়নি বরং নবুয়তের চতুর্থ বছর থেকে শুরু করে হিজরত পূর্ববর্তী শেষ হজ্জ মৌসুম অর্থাৎ দশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে তাদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো (রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৭৪)।
ইবনে ইসহাক কয়েকটি গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করে, এবং তাদের জবাবের প্রতিকৃতি ও উল্লেখ করেছেন, নীচে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হলো।
এক) বনু কেলাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই গোত্রের কাছে একটি শাখা বনু আবদুল্লাহর কাছে গমন করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহ এবং তার রসূলের প্রতি আহবান জানান, কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, হে বনু আবদুল্লাহ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পিতামহের চরম নাম রেখেছিলেন, কিন্তু এই গোত্রের লোকেরা আল্লাহর রসূলের দেওয়া দাওয়াত গ্রহণ করে নি।
দুই) বনু হানিফা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের বাড়িতে গমন করেন তাদেরকে কে দাওয়াত দেন কিন্তু তারা যে জওয়াব দিয়েছিলো, সে রকম জবাব আরবের কেউ প্রদান করেনি।
তিন) আমের ইবনে সায়া’ সায়া’, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের কাছেও দাওয়াত দিয়েছিলেন, জবাবে এ গোত্রের বুহায়রাহ বিন ফারাস নামক এক ব্যক্তি বলেছিলো, আল্লাহর শপথ যদি আমি কোরাইশদের এক যুবককে সঙ্গে রাখি, তবে সমগ্র আরবকে খেয়ে ফেলবো, এরপর সে বললো একটা কথার জবাব দিন, যদি আমরা আপনার দ্বীন গ্রহণ করি, এবং আপনি প্রতিপক্ষের উপর জয়লাভ করেন, এরপর কি নেতৃত্ব আমাদের হাতে আসবে, ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নেতৃত্ব কর্তৃত্ব তো আল্লাহর হাতে, তিনি যেখানে ইচ্ছা করেন সেখানে রাখবেন, একথা শুনে সেই লোক বললো, চমৎকার কথা, আপনার নিরাপত্তার জন্য আমরা নিজেদের বুককে আরবদের নিশানা করবো অথচ আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন নেতৃত্ব কর্তৃত্ব থাকবে অন্যদের হাতে, এটা হয় না, আপনার দ্বীন আমাদের প্রয়োজন নেই।
এরপর বনু আমের গোত্র তাদের এলাকায় চলে যাওয়ার পর একজন বৃদ্ধা এ ঘটনা শুনলেন, বার্ধক্যের কারণে তিনি হজ্জে যেতে পারে নি, সব কথা শুনে তিনি দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বললেন, মারাত্মক ভুল করেছ তুমি, হে বনু আমের গোত্রের লোকেরা, সেই লোককে কি খুঁজে পাওয়ার কোন উপায় আছে? সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, হযরত ইসমাইলের কোন বংশধর মিথ্যা নবুয়তের দাবী করতে পারেনা, অতীতেও করেনি, তোমাদের বুদ্ধি চলে গিয়েছিলো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৪৪৩-৪৪৮)।
মক্কার বাইরে ইসলামের আলো
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন গোত্র ও প্রতিনিধিদলকেই শুধু নয়, বহু ব্যক্তিকেও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, এদের অনেকে ভালো জবাবও দিয়েছিলেন, হজ্জ মৌসুমের অল্পকাল পর কিছু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন, নীচে সম্পর্কিত একটি সংক্ষিপ্ত রোয়েদাদ পেশ করা হচ্ছে,
এক) সুয়াইদ ইবনে সামেত, এই লোক ছিলো কবি ও যথেষ্ট বুদ্ধি বিবেচনা রাখতো, সে ছিলো ইয়াছরিবের অধিবাসী, বুদ্ধিমত্তা কাব্যচর্চা, আভিজাত্য, এবং বংশমর্যাদার কারণে তার কওমের লোকেরা তাকে কামেল উপাধিতে ভূষিত করেছিলো, এই লোকটি হজ্জ বা ওমরাহ করার জন্য মক্কায় এসেছিলো, আল্লাহর রসূল তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, সে বললো, আমার কাছে যে জিনিষ আছে, সম্ভবত আপনার কাছে সে জিনিষ আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার কাছে কি রয়েছে? সে বললো, লোকমানের হেকমত, আল্লাহর রসূল বললেন শোনাওতো, সুয়াইদ শোনাল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ বাণী উত্তম কিন্তু আমার কাছে যা রয়েছে সেটা এর চেয়েও উত্তম, আমার কাছে রয়েছে কোরআন, এই কোরআন আল্লাহ আমার উপর নাযিল করেছেন, এটি হচ্ছে হেদায়েতের নূর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর লোকটিকে কোরআনের কিছু অংশ শোনালেন, এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করে বললেন, এটা তে চমৎকার কালাম, নবুয়তের একাদশ বর্ষের প্রথমদিকে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, ইসলাম গ্রহণের পর সুয়াইদ মদিনায় ফিরে এলে বুআস যুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধে তিনি শহীদ হন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৪২৫-৪২৭ রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড পৃ.৭৪)।
দুই) ইয়াসি ইবনে মায়াজে, এই ব্যক্তি ছিলো ইয়াসরিবের অধিবাসী, বয়সে ছিলেন যুবক, নবুয়তের একাদশ বর্ষে বুআস যুদ্ধের কিছু কাল আগে আওসের একটি প্রতিনিধিদল খাজরাজের বিরুদ্ধে কোরাইশদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশায় মক্কায় আসে, ইয়াশও তাদের সঙ্গে ছিলেন, সে সময় উভয় গোত্রের মধ্যে শত্রুতার আগুন জ্বলে উঠেছিলো, আওসের লোকসংখ্যা ছিলো খাজরাজের চেয়ে কম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রতিনিধিদলের আগমন সংবাদ শোনার পর দেখা করতে গেলেন, তাদের মাঝখানে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললে, আপনারা যে উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন এর চেয়ে ভালো কোন জিনিষ গ্রহনে রাজি আছেন কি? তারা বললেন কি সেই জিনিষ ? আল্লাহর রসূল বললেন আমি আল্লাহর রসূল, আল্লাহ তায়ালা আমাকে তার বান্দাদের কাছে এ দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেছেন, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে এবং তার সাথে কাওকে শরীক না করে, আল্লাহ তায়ালা আমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন, এরপর তিনি ইসলামের কথা উল্লেখ করে কোরআন তেলাওয়াত করেন।
ইয়াস ইবনে মায়াজ বললেন, হে কওম আপনারা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন, এই দাওয়াত তার চেয়ে উত্তম, প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য আবুল হাছির আনাস ইবনে রাফে একমুঠো খড় ইয়াসের মুখে ছুড়ে দিয়ে বললো এসব কথা ছাড়ো, আমার বয়সের শপথ এখানে আমরা অন্য উদ্দেশ্যে এসেছি, এরপর ইয়াস আর কোন কথা বলেন নি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও উঠে চলে গেলেন, এদিকে প্রতিনিধিদল কোরাইশদের সাথে মৈত্রী ও সহযোগীতা চুক্তি করতেও সক্ষম হয়নি, তারা ব্যর্থ হয়ে মদিনায় ফিরে এলো।
তিন) আবু যর গিফারী, এক ব্যক্তি শহর থেকে দুরে এক জায়গায় বসবাস করতেন, সুয়াইদ ইবনে সামেত এবং ইয়াশ ইবনে মায়জের কাছ থেকে আবু যর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের খবর পেয়েছিলেন, এ খবরই ছিলো তাঁর ইসলাম গ্রহণের কারণ (একথা আকবর নদীরাবাদী লিখেছেন, তারীখূল ইসলাম, ১ম খন্ড, পৃ.১২৮ দেখুন) তার ইসলাম গ্রহণের বুখারী শরীফে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা মতে আবু যর বলেন, আমি ছিলাম গেফার গোত্রের লোক, আমি শুনলাম এমন একজন লোক আবির্ভূত হয়েছেন যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেছেন, এ খবর শুনে আমার ভাই কে মক্কায় পাঠালাম, তাকে বলে দিলাম, তুমি সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করবে।
এরপর আমার কাছে তার খবর নিয়ে আসব, আমার ভাই মক্কায় থেকে ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করলাম, কি খবর এনেছো? সে বললো, খোদার কসম, আমি এমন একজন মানুষ দেখেছি, যিনি সৎ কাজের আদেশ দিয়ে থাকেন এবং খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখেন, আমি বললাম তুমি স্বস্তি পাওয়ার মতো খবর দিতে পারোনি, এরপর আমি কিছু পাথেয় সম্বল করে মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে সেখানে হাযির হলাম, কিন্তু সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পারলাম না, কারো কাছে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পেলাম না, যমযমের পানি পান করে মসজিদে হারামে পড়ে রইলাম, হযরত আলী (রা.) দেখে বললেন, আপনাকে অচেনা মনে হচ্ছে, আমি বললাম জ্বী হ্যাঁ, তিনি বললেন, আমার ঘরে চলুন, আমি তার সাথে গেলাম তিনি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না, আমিও কিছু বললাম না।
সকালে আবার মসজিদে হারামে গেলাম, আশা ছিলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো, কিন্তু তার সম্পর্কে কেউ আমাকে কিছু বললো না, সন্ধ্যায় হযরত আলী (রা.) এসে আমাকে দেখে বললেন, এই লোকটি এখনো নিজের ঠিকানা জানতে পারেনি? আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই, এখনো পারেনি, তিনি বললেন, চলুন, আমার সাথে চলুন, এরপর তিনি বললেন, কি ব্যাপার আপনার বলুন তো? আপনি এ শহরে কেন এসেছেন? আমি বললাম, আপনি যদি কথাটা গোপন রাখেন, তবে বলতে পারি, তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি বললাম এখানে একজন লোক নিজেকে নবী বলে দাবী করেছেন বলে আমি খবর পেয়েছি, খবর পাওয়ার পর আমি আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে বিস্তারিত কোন খবর জানাতে পারেনি, এ কারণে নিজেই এসেছি, হযরত আলী (রা.) বললেন, আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, আমার সাথে চলুন, সেখানে আমি প্রবেশ করবো, আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন, যাওয়ার পথে যদি কোন লোকের কারণে আপনা আশঙ্কার কারণ দেখা দেয় তবে আমি দোকানের কাছে যাব এবং জুতো ঠিক করার ভান করবো, সে সময়ে আপনি পথ চলতে থাকবেন, এরপর হযরত আলী (রা.) রওয়ানা হলেন আমিও তার সাথে রওয়ানা হলাম, অবশেষে তিনি ঘরে প্রবেশ করলে আমিও তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম, তাকে বললাম, আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিন, আল্লাহর রাসূল আমার কাছে ইসলাম পেশ করলেন, আমি ইসলাম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে গেলাম, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবু যর, তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখ এবং তোমার এলাকায় চলে যাও, আমরা প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেছি, এ খবর শোনার পর আমাদের সাথে এসে দেখা করবে, আমি বললাম, সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি কাফেরদের সামনে প্রকাশ্যে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করবো, এ কথা বলার পর আমি কাবাঘরের সামনে এলাম, কোরাইশরা সেখানে উপস্থিত ছিলো, আমি তাদের সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
এই ঘোষণার পর কোরাইশরা পরস্পর বলাবলি করলো যে, ওঠো তোমরা এই বেদ্বীনের খবর নাও, এরপর তারা আমাকে এমনভাবে প্রহার করলো যে, ভেবেছিলাম মরেই যাবো, এ অবস্থায় হযরত আব্বাস (রা.)এসে আমাকে বাঁচালেন, তিনি একটুখানি ঝুঁকে আমাকে দেখলেন, এরপর কোরাইশদের বললেন, এই লোক তো গেফার গোত্রের তোমরা এ গোত্রের এলাকার ওপর দিয়েই ব্যবসা করতে যাও, এ কথা শুনে পৌত্তলিক কোরাইশরা আমাকে ছেড়ে দিলো, পরদিনও আমি সেখানে গেলাম এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো, এবারও হযরত আব্বাস (রা.) এসে আমাকে উদ্ধার করলেন (সহীহ বোখারী, যমযমের কাহিনী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ আবূ জারের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫)।
৪) তোফায়েল ইবনে আমর দাওসি, এই লোক ছিলেন কবি, বুদ্ধি বিবেচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং তার গোত্রের সর্দার, এই গোত্র ইয়েমেনের কিছু এলাকায় শাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিলো, নবুয়তের একাদশ বর্ষে তিনি মক্কায় গেলে মক্কায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে নালিশ করে, তারা বলে যে, এই লোক আমাদের জটিল অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে, তার কথায় রয়েছে যাদুর মতো প্রভাব, এতে ভাই ভাইয়ের মধ্যে এবং স্বামীর স্ত্রীর মধ্যে, পিতা পুত্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা আশঙ্কা করছি, যে বিপদে আমরা পড়েছি, আপনিও সেই বিপদে পড়েন কিনা, কাজেই আপনার কাছে আবেদন এ লোকের সাথে কোন কথাই বলবেন না।
হযরত তোফায়েল (রা.) বলেন, কোরাইশ পৌত্তলিকরা আমাকে নানাভাবে বোঝালো, এক সময় আমি সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম যে, আল্লাহর রাসূলের সাথে কথাও বলবো না তার কোন কথাও শুনবো না, সকালে, মসজিদে হারামে যাওয়ার পর কানে তুলো গুজে দিয়েছিলাম যাতে আল্লাহর রাসূলের কোন কথা আমার কানে না যায়, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু কথা আমাকে শোনানর ইচ্ছা করেছিলেন, এরপর আমি কিছু ভালো কথা শুনলাম, মনে মনে বললাম, আমি তো বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ, খ্যাতনামা কবি, ভালমন্দ কোন কিছুই তো আমার কাছে গোপন থাকতে পারে না, কন আমি ভালো কথা শুনবো না? যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে গ্রহণ করবো, মন্দ হলে গ্রহণ করবো না, এ কথা ভেবে চুপচাপ থাকলাম, আল্লাহর রাসূল ঘরে ফিরতে শুরু করলে তার পিছু নিলাম, তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন, আমি প্রবেশ করলাম, এরপর লোকেরা আমাকে তার ব্যাপারে যে সতর্ক করেছিলো, এবং সতর্কতা হিসেবে নিজের কানে যে তুলো গুজে দিয়েছিলাম, সেসব কথা তাকে শোনালাম, এরপর বললাম, আপনি সবাইকে যে কথা বলে থাকেন আমাকেও বলুন, আল্লাহর রাসূল আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কোরআন পাঠ করে শোনালেন, আমি সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করলাম, আল্লাহর শপথ, আমি এর চেয়ে ভালো কথা আগে কখনো শুনিনি, আমি সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করে সত্যের সাক্ষ্য দিলাম, এর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করলেন।
হযরত তোফায়েল (রা.) কে যে নিদর্শন দেয়া হয়েছিল, সেটা এই যে, তিনি তার কওমের কাছাকাছি পৌছার পর তার চেহারা চেরাগের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিলো, তিনি বললেন, হে আল্লাহ অন্য কোথাও এ আলো স্থানান্তর করে দিন, অন্যথায় চেহারা বিকৃত হওয়ার অপবাদ দিয়ে ওরা আমারে সমালোচনা করবে, এরপর সেই আলো আমার হাতের লাঠির মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে যায়, হযরত তোফায়েল (রা.) তার পিতা এবং স্ত্রীর কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন, এতে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে তার কওমের লোকেরা ইসলাম গ্রহণে দেরী করে, কিন্তু হযরত তোফায়েল (রা.) ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যান, খন্দকের (সহীহ বোখারী, যমযমের কাহিনী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ আবূ জারের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫) যুদ্ধের পর তিনি যখন হিজরত করেন সে সময় তার কওমের সত্তর বা আশি পরিবার তার সঙ্গে ছিলো, হযরত তোফায়েল (রা.)ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন (মেশকাতুল মাসাবিহ)।
৫) জেমাদ আযদি, এই ব্যক্তি ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী এবং আযদ শানওয়াহ গোত্রের মানুষ, ঝাড়ফুঁক এবং ভূত প্রেত তাড়ানোর কাজ করতেন, মক্কায় এসে সেখানকার নির্বোধদের কাছে শুনতে পান যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাগল, আল্লাহর রাসূলের কাছে তিনি এ উদ্দেশ্যে গেলেন যে, হয়তো আল্লাহর রাসূল তার হাতে ভালো হয়ে যাবেন, আল্লাহর রাসূলের সাথে দেখা করে তিনি বললেন, আমি ঝাড় ফুক জানি, আপনারর কি এর প্রয়োজন আছে? জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, আমি তার প্রশংসা করি এবং তার কাছেই সাহায্যে চাই, আল্লাহ তায়ালা যাকে হেদায়াত করেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আর যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন কেউ তাকে হেদায়েত দিতে পারে না, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয় তার কোন শরীক নেই, আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বান্দা ও রাসূল,
জেমাদ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, আপনার কথাগুলো আমাকে পুনরায় শুনিয়ে দিন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথাগুলো তিনবার শোনালেন, জেমাদ বললেন, আমি যাদুকরদের জ্যোতিষীদের কথা শুনেছি, কিন্তু আপনি যেসব কথা বললেন, এ ধরনের কথা কোথাও শুনিনি, আপনার কথামতো সমুদ্রের অতলস্পর্শী গভীরতা থেকে উৎসারিত, দিন আপনার হাত বাড়িয়ে দিন আমি আপনার হাতে ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করবো, এরপর জেমাদ আযদি ইসলাম গ্রহণ করেন (সহীহ মুসলিম, মেশকাতুল মাসাবিহ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫২৫)।
মদিনায় ছয়জন পুণ্যশীল মানুষ
নবুয়তের একাদশ বর্ষে অর্থাৎ ৬২০ ঈসায়ী সালে জুলাই মাসের হজ্জ মওসুমে ইসলামের দাওয়াতের ফলপ্রসূ বিস্তার ঘটে, এ সময়ে সে দাওয়াত একটি মহীরুহে পরিণত হয়, সেই গাছের ঘন পত্র-পল্লবের ছায়ায় মুসলমানরা দীর্ঘদিনের অত্যাচার নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করেন, মক্কার অধিবাসীরা আল্লাহর রাসূলকে অবিশ্বাস করা এবং লোকদের আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলো তা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৌশলের আশ্রয় নেন, এ সময় তিনি রাত্রিকালে বিভিন্ন গোত্রের কাছে গিয়ে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন, তাই মক্কার পৌত্তলিকরা তার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি,
এ কৌশলের একপর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে একরাতে মক্কার বাইরে বনু যোহাল এবং বনু শায়বান ইবনে ছালাবা গোত্রের লোকদের বাড়ীতে গিয়ে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন, জবাবে তারা আশাব্যঞ্জক কথা বলে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন সাড়া দেয়নি, এ সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক এবং বনু যোহাল গোত্রের একজন লোকের মধ্যে বংশধারা সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক প্রশ্নোত্তর ঘটে, উভয়েই ছিলেন বংশধারা বিশেষজ্ঞ (সহীহ বোখারী, যমযমের কাহিনী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ আবূ জারের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর মিনার পাহাড়ী এলাকা অতিক্রমের সময় কয়েকজন লোককে আলাপ করতে শোনেন (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.৮৪) তিনি সোজা তাদের কাছে যান এরা ছিলো মদিনার ছয়জন যুবক, এরা ছিলো খাযরাজ গোত্রের সাথে সম্পর্কিত তাদের নাম ও পরিচয় এই,
১. আসয়াদ ইবনে যোরারাহ বনু নাজ্জার
২. আওন ইবনে হারেস ইবনে রেফায়া (ইবনে আফরা) বনু নাজ্জার
৩. রাফে ইবনে মালেক ইবনে আযলান বনু যোরায়েক
৪. কোতবা ইবনে আমের ইবনে হাদিদা বনু সালামা
৫. ওকবা ইবনে আমের ইবনে নাবি বনু হারাম ইবনে কাব
৬. হারেস ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রেআব বনু ওবায়েদেইবনে গানাম
এসব যুবক তাদের প্রতিপক্ষ মদিনার ইহুদীদের কাছে শুনতো যে, সেই যুগে একজন নবী আসবেন তার একথাও শুনেছিলো যে, তিনি সহসা আবির্ভূত হবেন (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫০, ইবনে সালাম ১ম খন্ড, ৪২৯-৫৪১)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে গিয়ে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন তারা বললো, আমরা খাযরাজ গোত্রের লোক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইহুদীদের প্রতিপক্ষ? তারা বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল বললেন, তোমরা একটু বসো আমি কিছু কথা বলি, তারা বসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে দ্বীন শোনালেন সেই ছয়জন যুবক পরস্পরকে বললো, এই তো মনে হয় সেই নবী, যার কথা উল্লেখ করে ইহুদীরা আমাদের ধর্মক দিয়ে থাকে, ইহুদীরা যেন আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করতে পারে আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে, এরপর সেই ছয় ভাগ্যবান যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত কবুল করে ইসলাম গ্রহণ করেন
এই ছয়জন ছিলেন মদিনার বিবেকসম্পন্ন মানুষ, এর কিছুদিন আগে মদিনায় একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেই যুদ্ধের ধোয়া তখনো মিলিয়ে যায়নি, সেই যুদ্ধ এদেরকে তছনছ করে দিয়েছিলো, এ কারণে তারা সঙ্গত কারণেই আশা করেছিল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত যুদ্ধ সমাপ্তির হিসেবে প্রমাণিত হবে, তারা বললেন আমরা আমাদের কওমকে এমন অবস্থায় রেখে এসেছি যে, তারা শত্রু পরিবেষ্টিত অন্য কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের শত্রুতা আছে বলে মনে হয় না, আমরা আশা করি যে, আপনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন সৃষ্টি করবেন, মদিনায় ফিরে গিয়ে আমরা তাদেরকে আপনার প্রচারিত দ্বীনের পথে আহবান জানাবো, আমরা আপনার কাছ থেকে যে দ্বীন গ্রহণ করেছি, এই দ্বীন গ্রহণ করার জন্য তাদেরও দাওয়াত দেবো, যদি আল্লাহ তায়ালা আপনার মাধ্যমে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেন, তবে আপনার চেয়ে সম্মানিত অন্য কেউই হবে না
এই ছয়জন নও মুসলিম মদিনায় ফিরে যাওয়ার সময় ইসলামের দাওয়াত সাথে নিয়ে গেলেন, এদের মাধ্যমে মদিনার ঘরে ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব ও দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়লো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪২৮-৪৪৩)।
হযরত আয়েশা (রা.) এর সাথে বিয়ে
সেই বছরেই অর্থাৎ নবুয়তের একাদশ বর্ষের শাওয়াল মাসের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, হযরত আয়েশার বয়স ছিলো তখন মাত্র ছয় বছর, হিজরতের আগের বছর শাওয়াল মাসে হযরত আয়েশা (রা.) স্বামী গৃহে গমন করেন, সেই সময় তার বয়স ছিলো নয় বছর (তালকিহুল হুকুম, পৃ. ১০, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৭)।
মেরাজের ঘটনা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও তাবলীগের সাফল্য এবং তার ইসলামের অনুসারীদের প্রতি অত্যাচার নির্যাতন মাঝামাঝি পর্যায়ে চলেছিলো, দূর দিগন্তে মিটিমিটি জ্বলছিলো তারার আলো, এমনি সময়ৈ মেরাজের রহস্যময় ঘটনা ঘটলো, এই মরাজ কবে সংঘটিত হয়েছিলো? এ সম্পর্কে সীরাত রচয়িতাদের মতামতের বিভন্নতা রয়েছে, যেমন-
এক) তিবরানী বলেছেন যে বছর নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে নবুয়ত দেয়া হয়, সে বছরই।
দুই) ইমাম নবব এবং ইমাম কুরতুবী লিখেছেন নবুয়তের পাচ বছর পর।
তিন) হিজরতের ১৬ মাস আগে অর্থাৎ নবুয়তের পাচ বছর পর।
চার) নবুয়তের দশ বর্ষে ২৭ শে রজব আল্লামা মানসুরপুরী এ অভিমত গ্রহণ করেছেন।
পাঁচ) হিজরতের এক বছর দুই মাস আগে অর্থাৎ নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের মহররম মাসে।
ছয়) হিজরতের এক বছর আগে অর্থাৎ নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে।
উল্লেখিত বক্তব্যসমূহের মধ্যে তিনটি বক্তব্যকে সঠিক বলে মেনে নেয়া যায় পাঞ্জেগানা নামায ফরয হওয়ার আগে হযরত খাদিজা (রা.)এর ইন্তেকাল হয়েছিল, আর এ ব্যাপারে সবাই একম যে, পাঞ্জেগানা নামায মেরাজের রাতে ফরজ করা হয় এর অর্থ হচ্ছে যে, হযরত খাদিজার মৃত্যু মেরাজের আগেই হয়েছিলো তার মৃত্যু নবুয়তের দশ বর্সের রমযান মাসে হয়েছিলো বলে জানা যায় কাজেই মেরাজের ঘটনা এর পরেই ঘটেছে, আগে নয় শেষোক্ত তিনটি ব্ক্তব্যের কোনটিকে কোনটির ওপর প্রাধান্য দেয়ার মত তার কোন প্রামণ পাওয়া যায়নি কোরআন হাদীসে বর্ণিত এ সম্পর্কিত বিবরণ উল্লেখ করব (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৪৯)।
ইবনে কাউয়েম লিখেছেন সঠিক বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে স্বশরীরে বোরাকে তুলে হযরত জিবরাঈল (আ.) এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বায়তুল মাকদেস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়, প্রিয় নবী সেখানে মজিদের দরজায় খুটির সাথে বোরাক বেধে যাত্রা বিরতি করেন এবং সকল নবীর ইমাম হয়ে নামায আদান করেন।
এরপর সেই রাতেই তাকে বায়তুল মাকদেস থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় হযরত জিবরাঈল (আ.) দরজা খোলেন প্রিয় নবী সেখানে হযরত আদম (আ.) কে দেখে সালাম করেন, হযরত আদম (আ.) তাকে মারহাবা বলে সালামের জবাব দেন, তার নবুয়তের স্বীকারোক্তি করেন সে সময়ে আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.) এর ডানদিকে নেককার এবং বামদিকে পাপীদের রূহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখান এরপর তিনি দ্বিতীয় আসমানে যান দরজা খুলে দেয়া হয় প্রিয় নবী সেখানে হযরত ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এবং হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) কে দেখ সালাম করেন তারা সালামের জবাব দিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের কথা স্বীকার করেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর যান চতুর্থ আসমানে সেখানে তিনি হযরত ইদরিস (আ.) কে দেখে সালাম করেন, তিনি সালামের জবাবে তাকে মোবারকবাদ দেন এবং তার নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।
এরপর তাকে পঞ্চম আসমানে নেয়া হয় সেখানে তিনি হযরত হারুন (আ.)কে দেখে সালাম দেন, তিনি সালামের জবাবে মোবারকবাদ দেন এবঙ তার নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর নেয়া হয় ষষ্ঠ আসমানে সেখানে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হয় তিনি সালাম করেন হযরত মূসা (আ.) মারহাবা বলেন এবং নবুয়তের কথা স্বীকার করেন নবী মুরসালিন সামনে অগ্রসর হলেন, এ সময় হযরত মূসা (আ.) কাদতে লাগলেন এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, একজন নবী যিনি আমার পরে আবির্ভূত হয়েছেন তার উম্মেতেরা আমার উম্মতদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী বেহেশতে যাবে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর নিয়ে যাওয়া হয় সপ্তম আসমানে সেখানে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সাথে তার দেখা হয়তিনি তাকে সালাম করেন তিনি জবাব দেন মোবারকবাদ দেন এবং তার নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।
এবার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয় তিনি আল্লাহর এতো কাছাকাছি পৌছেন যে, উভয়ের মধ্যে দুটি ধনুক বা তারও কম ব্যবধান ছিল, সেই সময় আল্লাহ তায়ালা তার যা কিছু দেয়ার দিয়ে দেন, যা ইচ্ছা ওহী নাযিল করেন এবং পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেন ফেরার পথে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কি কাজের আদেশ দিয়েছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায়ের আদেশ দিয়েছেন, হযরত মূসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত এতো নামায আদায় করার শক্তি রাখে না, আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন করুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈল (আ.) এর দিকে তাকালেন, তিনি ইশারা করলেন এরপর ফিরে গিয়ে নামাযের সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানালেন, হযরত মূসা (আ.) এর সাথে আবার ফেরার পথে দেখা তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর কাছ থেকে কি আদেশ নিয়ে যাচ্ছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পয়তাল্লিশ ওয়াক্ত নামাযের কথা বললেন হযরত মূসা (আ.) বললেন, আপনি ফিরে যান, এমনি করে বারবার ফিরে যাওয়ার এবং নামায কম করার হার এক পর্যায়ে সংখ্যা দাড়ালো পাচ, এই পাচ ওয়াক্ত নামাযও হযরত মূসা (আ.) বেশী মনে করলেন এবং আরো কমিয়ে আনার আবেদন জানানোর জন্যে ফিরে যেতে বললেন, হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার ভীষন লজ্জা লাগছে, আমি আর যেতে চাই না, আমি আল্লাহর এই আদেশের ওপরই মাথা নত করলাম ফেরার পথে কিছুদুর আসার পর আওয়ায হলো আমি আমার ফরয নির্ধারন করে দিয়েছি এবং আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিয়েছি (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, ৪৭-৪৮)।
আল্লামা িইবনে কাইয়েম এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, নবী কি আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন? ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন চোখে দেখার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কোন সাহাবী এ কথা বর্ণনাও করেননি, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে চোখ এবং অন্তর দ্বারা দেখার যে কথা উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে প্রথম বর্ণনা দ্বিতীয় বর্ণনার বিপরীত নয়, ইমাম ইবনে কাউয়েম যে নৈকট্য এবঙ নিকটতর হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন এটি মেরাজের সময়ের চেয়ে ভিন্ন সময়ের কথা, সূরা নাজম-এ হযরত জিবরাঈল (আ.) এর নৈকট্যের কথা উল্লেখ রয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) সে কথাই বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে মেরাজের হাদীসে যে নৈকট্যের কথা বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা হচ্ছেেএই যে, এটা আল্লাহরই নৈকট্য, সূরা নাজম-এ এ সম্পর্কে কোন ব্যাপক আলোচনা নেই বরং সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বিতীয়বার সেদরাতুল মোনতাহার কাছে দেখেছেন যাকে দেখেছেন তিনি জিবরাঈল (আ.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈলকে তার আসল চেহারায় দুবার দেখেছেন, একবার পৃথিবীতে এবং অন্যবার সেদরাতুল মুনতাহার কাছে (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৭, ৪৮, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০, ৪৫৫, ৪৫৬, ৪৭০, ৪৭১, ৪৮১, ৫৪৮, ৫৪৯, ৫৫০, ২য় খন্ড, ৬৮৪, মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ. ৯১, ৯১, ৯৩)।
এ সময়েও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাককুস সদর বা সিনা চাক এর ঘটনা ঘটেছিলো, এ সফরের সময় তাকে কয়েকটি জিনিস দেখানো হয়েছিল তাকে দুধ এবং মদ দেয়া হয়েছিল তিনি দুধ গ্রহণ করলেন, এটা দেখে হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন আপনাকে ফেতরাত বা স্বভাবের ফল দেখানো হয়েছে যদি আপনি মদ গ্রহন করতেন তবে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।
আল্লাহর রাসূল ৪ টি নহর দেখলেন ৪ টি যাহেরী আর ৪ টি বাতেনী প্রকাশ্য নহর ছিল নীল এবং ফোরাত এর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, তার রেসালত নীল এবং ফোরাত সজীব এলাকা সমূহে বিস্তার লাভ করবে অর্থাৎ এখানের অধিবাসীরা বংশ পরম্পরায় মুসলমান হবে এমন নয় যে, এদুটি নহরের পানির উৎস জান্নাতে রয়েছে।
জাহান্নামের দারোগা মালেককে তিনি দেখলেন তিনি হাসেন না, তার চেহারায় হাসিখুশীর কোন ছাপও নেই। আল্লাহর রাসূলকে বেহেশত ও দোযখও দেখানো হল।
এতিমের ধনসম্পদ যারা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের অবস্থাও দেখান হয়, তাদের ঠোট ছিল উটের ঠোটের মত, তারা নিজেদের মুখে পাথরের টুকরোর মতো অঙ্গার প্রবেশ করাচ্ছে আর সেই অঙ্গার তাদের গুহ্যদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদখোরদেরও দেখছিলেন তাদের ঠোট এতো বড়ছিলো যে তারা নড়াচড়া করতে পারছিল না ফেরাউনের অনুসারীদের জাহান্নামের নেয়ার সময় তারা এসব সুদখোরকে মাড়িয়ে যাচ্ছিলো।
যেনাকারীদেরও তিনি দেখছিলেন তাদের সামনে তাজা গোশত এবং দুর্গন্ধময় পচা গোশত ছিল অথচ তারা তাজা গোশত রেখে পচা গোশত খাচ্ছিল।
যেসব নারী স্বামী থাকা সত্ত্বেও নিজ গর্ভে অন্য পুরুষের সন্তান ধারণ করেছিল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরও দেখছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, ওসব মহিলার বুক বড় বড় কাটা বিধিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
তিনি মক্কার একটি কাফেলাকে দেখছিলেন সেই কাফেলার একটি উট পালিয়ে গিয়েছিল তিনি তাদেরকে সেই উটের সন্ধান বলে দিয়েছিলেন ঢেকে রাখা পাত্রে পানি ছিলো তিনি সেই পানি থেকে পান করেছিলেন সে সময় কাফেররা সকলে ঘুমচ্ছিল, মেরাজের রাতের পরদিন সকালে এই বিবরণ তার দাবীর সত্যতার একটি প্রমাণ হয়েছিল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৯ ৪০২, ৪০৬ তাফসীরে গ্রন্থাবলীতে সূরা বনি ইসরাইলের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য) বলে দিলেন যে, অমুক সময়ে সেই কাফেলা ফিরে আসবে কাফেলা থেকে পালিয়ে যে উটটি মক্কার দিকে আসছিলো তিনি সেই উটটির বিবরণও পেশ করলেন পরবর্তী সময়ে তার বর্ণিত সব কথাই সত্য প্রমাণিত হলো, কিন্তু এতোকিছু সত্ত্বেও কাফেরদের ঘৃণা আরো বেড়ে গেল এবং তারা তার কথা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল (যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮, এছাড়া দেখুন সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৬৮৪ সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড পৃ. ৯৬, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪০২, ৪০৩)।
বলা হয় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে নবীজি সেই সময়ই সিদ্দিক উপাধি দিয়েছিলেন কেননা অন্য সবাই যখন অবিশ্বাস করেছিল তিনি তখন সব কিছুই বিশ্বাস করেছিলেন (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৬৯৯)।
মেরাজের বিবরণ আল্লাহ তায়ালা কোরআনে উল্লেখ করেছেন।
নবীদের ব্যাপারে এটাই হচ্ছে আল্লাহর সুন্নত আল্লাহ তায়ালা বলেন এবং এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আসমান যমীনের রাজ্য ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছি যাতে সে বিশ্বাসীদের অন্তুর্ভক্ত হয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ.) কে বলেছিলেন তাহলে আমি তোমাকে আমার বড় কিছু নিদর্শন দেখাব।
এসব দেখানোর উদ্দেশ্যে হচ্ছে তারা যেন বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, এ কথাও আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন নবীরা আল্লাহর নিদর্শন সরাসরি প্রত্যক্ষ করায় তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় ফলে তারা আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে গিয়ে এমন সব দুঃখ এবং কষ্ট নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে পারেন, যা অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয় তাদের দৃষ্টিতে পার্থিব জগতের যাবতীয় শক্তিই মনে হয় তুচ্ছ এ কারণে তারা কোন শীক্তকে পরোয়া করেন না মেরাজের ঘটনায় ছোট খাট বিষয় এবং এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে শরীয়তের বড় বড় কেতাবে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে তন্মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েটি বিষয় উল্লেখ করা যাচ্ছে।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, আল্লাহ তায়ালা কোরআনে মাত্র একটি আয়াতে মেরাজের ঘটনা উল্লেখ করেই ইহুদীদের দুস্কৃতির কথা বর্ণনা করেছেন এরপর তাদের জানিয়েছেন যে, এই কোরআন সেই পথেরই হেদায়াত দিয়ে থাকে, যে পথ সঠিক এবং সরল কোরআন পাঠকারীদের মনে হতে পারে যে, উভয় কথা সম্পর্কহীন কিন্তু আসলে তা নয় আল্লাহ তায়ালা তার বর্ণনাভঙ্গিতে এই ইশারাই দিয়েছেন যে, এখন থেকে ইহুদীদের মানব জাতির নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দেয়া হবে কেননা এইসব ইহুদী এমন ভয়াবহ অপরাধ করেছে যে, নেতৃত্বের যোগ্যতা তাদের আর নেই কাজেই এই দায়িত্ব ও মর্যাদা এখন থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করা হবে এবং দুঃসাহসী দাওয়াতের উভয় কেন্দ্রকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন করা হবে, অন্য কথায় বলা যায় যে, রূহানী নেতৃত্ব এক উম্মত থেকে অন্য উম্মতের কাছে স্থানান্তর করা হবে যুলূম অত্যাচার এবং বিশ্বাসঘাতকতায় কলঙ্কিতি ইতিহাসের অধিকার িএকটি উম্মতের কাছ থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে এমন একটি উম্মতকে দেয়া হবে, যাদের মাধ্যমে কল্যাণের ঝর্নাধারা উৎসারিত হবে এই উম্মতের পয়গাম্বর ওহীর মাধ্যমে কোরআনে করিম পেয়েছেন কোরআন মানব জাতিকে সর্বাধিক হেদায়াত দান করেছে।
কিন্তু এই নেতৃত্বর পূর্ণতা কিভাবে সাধিত হবে? ইসলামের নবী তো মক্কার পাহাড়ে লোকদের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এটি একটি প্রশ্ন এই প্রশ্ন অন্য একটি সত্যের পর্দা উম্মোচন করেছে ইসলামের দাওয়াত একটা পর্যায় অতিক্রম করার কাছে পৌছেছে বর্তমানে অন্য একটি পর্যায় প্রবেশ করবে এই ধারা হবে অন্য ধারা থেকে ভিন্ন এ কারণে দেখা যায় যে, কোন কোন আয়াতে পৌত্তলিকদের সুস্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এবং কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি যখন কোন জনপদ ধ্বংস করতে চাই, তখন তার সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সৎ কাজ করতে আদেশ করি, কিন্তু তারা সেখানে অসৎ কাজ করে, তারপর তাদের প্রতি দন্ড প্রদান ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং আমি সেটা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি (সূরা বনি ইসরাঈল আয়াত ১৬)।
আল্লাহ তায়ালা উক্ত সূরায় আরো বলেন, নূহের পর আমি কত মানব গোষ্ঠি ধ্বংস করেছি তোমার প্রতিপালকই তার বান্দাদের পাপাচারের সংবাদ রাখা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট (সূরা বনি ইসরাঈল আয়াত ১৭)।
এ সকল আয়াতের পাশাপাশি এমন কিছু আয়াতও রয়েছে যাতে মুসলমানদের ভবিষ্যত ইসলামী সমাজের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তারা এমন এক ভূখন্ডে নিজেদের ঠিকানা তৈরী করেছে, যেখানে সবকিছু তাদের নিজের হাতে ন্যাস্ত, উল্লিখিত আয়াতে এমন ইশারা রয়েছে যে আল্লাহর রাসূল শীঘ্রই এমন নিরাপদ জায়গা পেয়ে যাবেন যেখানে দ্বীন ইসলাম যথাযথভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করবে।
মেরাজের রহস্যময় ঘটনার এমন সব বিষয় রয়েছে যার সাথে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান এ কারণে সেসব বর্ণনা করা দরকার আমরা এ সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছি যে, মেরাজের ঘটনা হয়তো বাইয়াতে আকবার কিছুকাল আগে ঘটেছিল অথবা প্রথম ও দ্বিতীয় বাইয়াতে আকবার মাঝামাঝি সময়ে ঘটেছিল আল্লাহ তায়ালাই সব কিছু ভালো জানেন।
প্রথম বাইয়াতে আকাবা
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবুয়তের দশ বর্ষে হজ্জ মওসুমে ইয়াসরেবের ছয়জন মানুষ ইসলাম গ্রহন করেছিলেন তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, নিজেদের কওমের কাছে ফিরে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতের তাবলীগ করবেন (সংকীর্ণ গিরিপথ বলা হয় আকাবা, মক্কা থেকে মিনায় আসার পথে মিনায় পশ্চিম পাশে একটি সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে হয়, এই গিরিপথ আকাবা নামে বিখ্যাত, দশই যিলহজ্জ তারিখে যে জামরাতে কংকর নিক্ষেপ করা হয় তা এ সুড়ঙ্গ পথের মাথায় অবস্থিত বলে একে জামরায়ে আকাবা বলা হয়, এর দ্বিতীয় নাম জামরায়ে কুবরা অন্য দুটি জামরা এ স্থান থেকে কিছু পূর্ব দিকে মিনা ময়দান এ তিনটি জামরার পূর্ব দিকে, এ কারণে জনসমাগম এদিকে লেগেই থাকে, পাথর নিক্ষেপের পর এদিকে আর লোক চলাচল থাকে না, তাই নবী করিম রাসূলুল্লাহ (সা.) যে বাইয়াত করেন বলা হয় বাইয়াতে আকাবা বর্তমানে এখানে পাহাড় কেটে প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করা হয়ছে)।
এর ফলে পরবর্তী হজ্জ মওসুমে ১৩ জন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসেন এদের মধ্যে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ ছাড়া অন্য ৫ জন ছিলেন যারা গত বছরও এসেছিলেন এরা ছাড়া বাকি সাতজনের নাম পরিচয় নিম্নরূপ
১. মায়ায ইবনে হারেস ইবনে আফরা বনি নাজ্জার খাযারাজ
২. যাকওয়ান ইবনে আবদুল কয়েস বনি যুরাইক খাযারাজ
৩. ওবাদা ইবনে সামেত বনি গানাম খাযারাজ
৪. ইয়াযিদ ইবনে ছালাবা বনি গানামের মিত্র খাযারাজ
৫. আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে নাযলাহ বনি সালেম খাযারাজ
৬. আবুল হায়ছাম ইবনে তাইহান বনি আবদে আশহাল, আওস
৭. ওযাইম ইবনে সায়েদাহ বনি আমার ইবনে আওফ, আওস
এদের মধ্যে শেষোক্ত দুজন ছিলেন আওস এবং বাকি সবাই খাযরাজ গোত্রের (রহমতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.৮৫, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৩১-২৩৩)।
এরা সবাই মিনায় আকাবার কাছে আল্লাহর রাসূলের কাছে কয়েকটি বিষয়ে বাইয়াত নেন, পরবর্তীতে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর এবং মক্কা বিজয়ের সময়ে এই সব কথার ওপরেই মহিলাদের কাছ থেকেও বাইয়াত গ্রহন করা হয়, আকবার এই বাইয়াতের বিবরণ বোখারী শরীফে ওবাদা ইবনে সামেতের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন এসো আমার কাছে এ মর্মে বাইয়াত কর যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেন না, চুরি করবে না, যেনা করবে না, নিজের সন্তানকে হত্যা করবে না, মনগড়া কোন অপবাদ কারো উপর দেবে না, ভালো কাজে আমার অনুসরণ করবে, কোন প্রকার অবাধ্যতা করবে না, যে ব্যক্তি এসব কিছু পালন করবে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে, আর যে ব্যক্তি এসব এবিষয়ের কোন কিছু অমান্য করবে, যদি তাকে সেই অবাধ্যতার জন্যে শাস্তি দেয়া হয় তবে তার শাস্তি তার পাপের কাফফারা হবে যদি কেউ অবাধ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহ যদি তার পাপ গোপন রাখেন তাহলে তার কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল তিনি ইচ্ছে করলে শাস্তি অথবা ক্ষমা করে দেবেন।
হযরত ওবাদা বলেন, এ সব বিষয়ে আমরা আল্লাহর রাসূলে কাছে বাইয়াত গ্রহন করলাম (বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫০, ৫৫১)।
মদিনায় রাসূলের দূত ও তার ঈর্ষনীয় সাফল্য
বাইয়াত শেষ হয়ে গেল এবং হজ্জ ও শেষ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগত লোকদের সাথে মদিনায় তার প্রথম দূত পাঠালেন মুসলমানদের ইসলামের শিক্ষা প্রদান এবং যারা এখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানই ছিল এ এই দূত প্রেরণের উদ্দেশ্য প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী যুবক মসআব ইবনে ওযায়ের আবদারি (রা.) কে আল্লাহর রাসূল মদিনায় প্রেরণ করেন।
হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.) মদিনায় পৌছে হযরত আসআদ ইবনে যুরারা (রা.) এর ঘরে অবস্থান করেন, এরপর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উভয়ে মদীনাবাসীদের ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন, এ সময় হযরত মসআব মুরকিউন উপাধি লাভ করেন এর অর্থ শিক্ষক বা মোয়াল্লেম।
দ্বীনের তাবলীগ করার ক্ষেত্রে তার সাফল্যর একটি বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে যোরারাকে একটি বাগানে মারক নামে একটি জলাশয়ের কিনারায় বসেন তাদের কাছে কয়েকজন মুসলমানও সমবেত হন বনি আশহাল গোত্রের সর্দার ছিলেন সাদ ইবনে মায়ায এবং উছায়েদ ইবনে খাযাযের তারা কখনো ইসলাম গ্রহন করেননি তারা নবাগত মুসলমানদের আগমনের খবর পেলেন হযরত সাদ অপর সর্দার উছায়েদ ইবনে খোযায়েরকে বললেন তুমি গিয়ে দেখ এসো ব্যাপারটা কি ওদের বলবে যে, তোমরা কি আমাদের দুর্বল লোকদের বেকুব বানাতে চাও তাদের ধর্মক দেবে এবং আমাদের মহল্লায় আসতে নিষেধ করবে, আসয়াদ ইবনে যোরারা আমার খালাতো ভাই, এ কারণেই তোমাকে পাঠাচ্ছি না হলে আমি নিজেই যেতাম
উছায়েদ নিজের বর্শা তুলে উভয়ের কাছে গেলেন হযরত আসয়াদ তাকে আসতে দেখে হযরত মসআবকে বললেন কওমের একজন সর্দার তোমার কাছে আসছে তার ব্যাপারে আল্লাহর রহমত মনে মনে কামনা কর, হযরত মসআব বললেন, তিনি যদি বসেন তবে আমি তার সাথে কথা বলব, উছায়েদ পৌছেই ক্ষেপে গেলেন বললেন, আপনারা কেন আমাদের এলাকায় এসেছেন? আপনারা কি আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চায়? প্রাণের মায়া থাকলে কেটে পড়ুন হযরত মসআব বললেন আপনি আমাদের কাছে বসুন, কিছু কথা শুনুন পছন্দ হলে গ্রহন করবেন পছন্দ না হলে করবেন না হযরত উছায়েদ বললেন কথা তো ঠিকই এরপর তিনি নিজের বর্শা মাটিতে পুতে বসে পড়লেন হযরত মসআব (রা.) ইসলামের কথা বলতে শুরু করলেন কোরআন তেলাওয়াত করলেন পরে তিনি বলেছেন উছায়েদ কিছু বরার আগেই আমি তার চেহারায় ইসলামের চমক লক্ষ্য করেছি সব কথা শুনে উছায়েদ বললেন, কথা খুব ভালো আপনারা কাউকে ইসলামে কিভাবে দীক্ষিত করেন? মসআব বললেন, আপনাকে গোসল করে পাক কাপড় পরতে হবে এরপর কালেমা তাইয়্যেবার সাক্ষ্য দিতে হবে এবং দুরাকাত নামায আদায় করতে হবে উছায়েদ সবই করলেন এরপর বললেন, আমাদের গোত্রে আরো একজন সর্দার রয়েছেন তিনি যদি ইসলামে দীক্ষা নেন তবে আমাদের গোত্রের আর কেউই বাদ থাকবে না আমি তাকে এখনই আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি
এরপর হযরত উছায়েদ তার বর্শা নিয়ে সাদ ইবনে মায়ায এর কাছে গেলেন সাদ উছায়েদকে দেখে বললেন, এই লোকটি যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিল তার চেয়ে অন্য রকম চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে উছায়েদকে সাদ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করেছ? উছায়েদ বললেন আমি তাদের সাথে আলাপ করেছি কিন্তু আপত্তিকর কিছুই পাইনি তবে আমি তাদের নিষেধ করেছি তারা বলেছে আপনারা যা চান, আমরা তাই করবো আমি শুনেছি বনি হারেছা গোত্রের লোকেরা আসআদ ইবনে যোরারাকে হত্যা করতে চায় এর কারণ হচ্ছে যে, তিনি আপনার খালাত ভাই ওরা আপনার সাথে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে চায় এর কারণ হচ্ছে যে, তিনি আপনার খালাত ভাই, ওরা আপনার সাথে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে চায় এ কথা শোনামাত্র সাদ ক্রোধে অধীর হয়ে বর্শা হাতে ওদের কাছে পৌঁছলেন গিয়ে দেখেন দুজনই নিশ্চিন্তে বসে আছেন, তিনি বুঝতে পারলেন যে, উছায়েদ চেয়েছে যে, আমি দুজন আগন্তুকের সাথে কথা বলি সাদ তাদের সামনে গিয়ে রুক্ষ ভাষায় বললেন তোমরা আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চাও? এরপর আস সাদকে বললেন, খোদার কসম হে আবু আনাস তোমার এবং আমার মধ্যে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকতো, তবে তুমি এমন কাজ করতে পারতে না, আমাদের এলাকায় এসে তোমরা এমন কাজ করছো, যা আমাদের পছন্দনীয় নয়
হযরত আসয়াদ হযরত মসআবকে আগেই বলেছিলেন যে, এমন একজন লোক আসছেন যিনি তার গোত্রের প্রভাবশালী নেতা যদি তিনি তোমার কথা শোনেন, তবে তার পেছনে কেউ বাদ থাকবে না এ কারণে হযরত মসআব হযরত সাদকে বললেন, আপনি বসুন কিছু কথা শুনুন ভালো না লাগলে শুনবেন না হযরত সাদ বললেন ঠিকই তো একথা বলে তিনিও বর্শা মটিতে পুতে বসে পড়লেন হযরত মসআব তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কোরআন তেলাওয়াত করলেন হযরত মসআব পরে বলেছেন সাদ বলার আগেই আমি তার চেহারায় ইসলামের চমক লক্ষ্য করেছি সাদ বললেন, তোমরা ইসলাম গ্রহণের পর কি করো? মসআব বললেন আপনি গোসল করুন, এরপর পাক কাপড় পরুন, এরপর কালেমা শাহাদাতের সাক্ষ্য দিবেন তারপর দুরাকাত নামায আদায় করবেন তারপর সাদ ইবনে মায়ায তাই করলেন
ইসলাম গ্রহণের পর প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে হযরত সাদ নিজের গোত্রের লোকদের কাছে ফিরে গেলেন লোকেরা বলল, আপনি ভিন্ন চেহারায় ফিরে এসেছেন মনে হচ্ছে হযরত সাদ বললেন, তোমরা আমাকে কেমন লোক মনে কর, হে বনি আবদুল আশহাল? সবাই বলল আপনি হচ্ছেন আমাদের নেতা, বুদ্ধি বিবেচনার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে বেশী সাদ ইবনে মায়ায বললেন আচ্ছা তবে শোন তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তার প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান না আনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সাথে কথা বলা আমার জন্য হারাম, বিকেল পর্যন্ত গোত্রের নারী পুরুষ সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন উসাইরেম নামে একজন লোক সে সময় ঈমান আনেননি, তিনি ওহুদের যুদ্ধের দিনে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন তিনি কোন নামাযও আদায় করেননি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন অল্প আমল করে সে অনেক বেশী পুরস্কার পেয়েছি
হযরত মসআব ও হযরত আসআদ ইবনে যোরারার ঘরে অবস্থান করেই ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেন এই দাওয়াতে আনসারদের প্রত্যেক পরিবারেই কয়েকজন করে নারী পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করলেন, পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার আগে হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.) সাফল্যের সুসংবাদ নিয়ে আল্লাহর রাসূলের কাছে মক্কায় হাজির হন, তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ইয়াসরেবের গোত্রসমূহের অবস্থা তাদের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার কৌশল এবং অন্যান্য যোগ্যতা সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৩৫, ২য় খন্ড পৃ. ৯০ যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫১)।
দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা
নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ ঈসায়ী সালের জুন মাসে মদিনা থেকে ৭০ জন মুসলমান হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় আগমন করেন এরা নিজ কওমের পৌত্তলিক হাজীদের সঙ্গে মক্কায় আসছিলেন মদিনায় থাকার সময়েই অথবা মক্কায় আসার পথে তারা পরস্পরকে বললেন, কতদিন পর্যন্ত প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমরা মক্কায় এভাবে কষ্টকর অবস্থায় ফেলে রাখব? তিনি মক্কায় যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সে সম্পর্কেও তারা আলোচনা করলেন
মক্কায় পৌছার পর গোপনে তারা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে গোপনে যোগাযোগ করলেন এবং সিদ্ধান্ত হলো যে, উভয় দল আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি (জিলহজ্জ মাসের ১১, ১২, ১৩ তারিখকে আইয়ামে তাশরিক বলা হয়) ১২ই জিলহজ্জ তারিখে মিনার জামারায়ে উলায় অর্থাৎ জামরায়ে আকাবার ঘাটিতে একত্রিত হয়ে রাতের অন্ধকারে গোপন আলোচনা করবেন
এই সম্মেলন ইসলাম ও মূর্তিপূজার সংঘাতের মধ্যে সময়ের গতিধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল, একজন আনসার নেতার মুখে সেই সম্মেলনের বিবরণী উল্লেখ করা যাচ্ছে
হযরত কাব ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমরা হজ্জ এর জন্যে বেরিয়েছিলাম প্রিয় নবী আইয়ামে তাশরিকের মাঝে আকাবায় আমাদের সাথে কথা বলার সময় নির্ধারণ করলেন, অবশেষে সেই রাত এলো, যে রাতে কথা বলার তারিখ ছিল, আমাদের সাথে আমাদের সম্মানিত নেতা আবদুল্লাহ ইবনে হারামের সাথে আমরা আলোচনা করে তাকে বললাম, হে আবু জাবের আপনি আমাদের একজন সম্মানিত নেতা আপনার বর্তমান অবস্থা থেকে আমরা আপনাকে বের করতে চাই অনন্তকাল দোযখের আগুন থেকে আপনি মুক্তি লাভ করবেন এটাই আমরা চাই এরপর আমরা তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমাদের আলোচনার বিষয় তাকে জানালাম তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে আকাবায় গেলেন, তাকে নকিব মনোনীত করা হল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪০)।
হযরত কাব (রা.) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, সেই রাতে আমরা নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ডেরায় শুয়ে পড়লাম রাতের এক তৃতীয়াংশ কেটে যাওয়ার পর আল্লাহর রাসূলের সাথে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হলাম, চড়ুই পাখী যেমন চুপিসারে তার বাসা থেকে বের হয়, আমরাও ঠিক সেভাবেই ডেরা থেকে বের হয়েছিলাম, এক সময় আমরা আকাবায় সমবেত হলাম সংখ্যায় ছিলাম আমরা ৭৫জন ৭৩জন পুরুষ এবং ২জন মহিলা দুইজন হচ্ছেন বনু মাজেন ইবনে নাজ্জার গোত্রের উম্মে আম্মারা নাছিবা বিনতে কাব এবং বনু সালমা গোত্রের উম্মে মানীঈ আসমা বিনতে আমর
আমরা সবাই ঘাটিতে পৌঁছে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এক সময় তিনি এসে পৌঁছলেন তার সাথে তার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেব ছিলেন তিনি তখনো যদিও ইসলাম গ্রহন করেননি, তবুও ভ্রাতুষ্পুত্রের হিতাকাঙ্খী ছিলেন সর্বপ্রথম কথা বার্তা তিনিই শুরু করেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪০)।
পরিস্থিতির নাজুকতা ব্যাখ্যা
সম্মেলন শুরু হল, দ্বীনি এবং সামরিক সহায়তাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে আলোচনা শুরু হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আব্বাস প্রথমে কথা বললেন, তিনি চাচ্ছিলেন যে, পরিস্থিতির আলোকে দায়িত্বের প্রতি আলোকপাত করবেন, সেই গুরুদায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত হতে যাচ্ছিল তাদের সম্বোধন করে তিনি বললেন মোহাম্মাদ মোস্তফার যে মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে সেটা তোমরা জান, আমাদের কওমের মধ্যে মোহাম্মাদ প্রবর্তিত ধর্ম বিশ্বাস যারা সমর্থন করে না, মোহাম্মাদকে তাদের কাছ থেকে আমরা দূরে রেখেছি, নিজ শহরে স্বজাতীয়দের মধ্যে তিনি নিরাপদ রয়েছেন, তিনি বর্তমানে তোমাদের কাছে যেতে চান তোমাদের সাথে মিশতে চান, যদি তোমরা তার নিরাপত্তা দিতে এবং বিরোধী পক্ষের হামলা থেকে তাকে হেফাজত করতে পারো তবে কিছু বলার নেই, তোমরা যে দায়িত্ব নিয়েছ সে সম্পর্কে তোমরাই ভালো জান, কিন্তু যদি তাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে থাক, তবে এখনই চলে যাও, কেননা তিনি স্বাজাতীয়দের মধ্যে নিজ শহরে নিরাপদেই আছেন, তার সম্মানও এখানে রয়েছে
হযরত কাব (রা.) বলেন, আমরা হযরত আব্বাসকে বললাম যে, আপনার কথা আমরা শুনেছি হে আল্লাহর রাসূল এবার আপনি কথা বলুন আপনি নিজের এবং আপনার প্রতিপালকের জন্য আমাদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার নিতে চান তাই নিন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪১-৪৪২)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা শুরু করলেন তিনি প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত করলেন আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিলেন এরপর বাইয়াত হল,
বাইয়াতের দফাসমূহ
বাইয়াতের ঘটনা ইমাম আহমদ হযরত জাবের (রা.) থেকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, হযরত যাবের (রা.) বলেন, আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল আমরা আপনার কাছে কি কি বিষয়ের উপর বাইয়াত করবো? তিনি বললেন নিন্মোক্ত বিষয়াবলীর ওপর।
১. ভালোমন্দ সকল অবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে।
২. সচ্ছলতা অস্বচ্ছলতা উভয় অবস্থায়ই ধন সম্পদ ব্যয় করবে।
৩. সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।
৪. আল্লাহর পথে উঠে দাঁড়াবে এবং আল্লাহর ব্যাপারে কারো ভয়ভীতি প্রদর্শনে পিছিয়ে যাবে না।
৫. তোমাদের কাছে যাওয়ার পর আমাকে সাহায্য করবে এবং নিজেদের প্রাণ ও সন্তানদের হেফাজতের মতোই আমার হেফাজত করবে এতে তোমাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল হাছান সনদের সাথে এ বর্ণনা করেছেন, ইমাম হাকেম ও ইবনে হাব্বান বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন, বনে হিশাম, ১ম খন্ড দেখুন)।
ইবনে ইসহাক উল্লেখিত হযরত কাব এর বর্ণনা শুধু পঞ্চম দফায় উল্লেখ রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআন তেলাওয়াত দ্বারা আল্লাহর প্রতি দাওয়াত এবং ইসলামের প্রতি তাকিদ দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের কাছে এ মর্মে বাইয়াত নিচ্ছি যে, তোমরা যে জিনিস দ্বারা নিজেদের সন্তানদের হেফাজত করে থাক, সেই জিনিস দ্বারা আমারও হেফাজত করবে এ কথা শুনে হযরত কাব ইবনে মারুর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত ধরে বললেন, হা সেই জাতের শপথ যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন আমরা অবশ্যই সেই জিনিস দ্বারা আপনার হেফাজত করব, যা দ্বারা নিজেদের সন্তানদের হেফাজত করি, কাজেই হে আল্লাহর রাসূল আপনি আমাদের কাছে বাইয়াত নিন খোদার কসম, আমরা যুদ্ধের পুত্র, (অর্থাৎ যুদ্ধের ছায়ায় আমরা জন্ম লাভ করেছি) হাতিয়ার হচ্ছে আমাদের খেলনা এবং পূর্ব পুরুষের সময় থেকেই এ অবস্থা চলে আসছে।
হযরত কাব বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলছিলেন এ সময়ন আবুল তায়াহাল ইবনে তাইহান বললেন, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের সাথে চুক্তি রয়েছে আমরা তার রজ্জু কেটে ফেলব, আমরা ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম এরপর আল্লাহ তায়ালা আপনাকে জয়যুক্ত করলে আপনি আমাদের ছেড়ে স্বজাতীয়দের কাছে ফিরে আসবেন না তো?
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হেসে বললেন না, তা হবে না তোমাদের রক্ত আমার রক্ত এবং তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস হিসেবে গণ্য হবে, আমি তোমাদের অন্তর্ভুক্ত আর তোমরা আমার অন্তর্ভুক্ত তোমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করব, তোমরা যাদের সাথে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব।
বাইয়াতের বিপজ্জনক অবস্থার বিবরণ
বাইয়াতের শর্তাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর উপস্থিত লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াতের ইচ্ছা করলেন এ সময় দুজন মুসলমান উঠে দাঁড়ালেন তারা নবুয়তের একাদশ ও দ্বাদশ বছরের মাঝামাঝির হজ্জের মৌসুমে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন তারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিত ভালোভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে চাইলেন তারা চাচ্ছিলেন যে বিষয়টির সব দিক যথাযথভাবে তুলে ধরে তারপর বাইয়াত করবেন তারা এটাই জানতে ও বুঝতে চাচ্ছিলেন যে, কওমের লোকেরা কতটা আত্মত্যাগে প্রস্তুত রয়েছে।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন লোকেরা বাইয়াতের জন্যে সমেবেত হওয়ার পর হযরত আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে নাযলা বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে তার সাথে কিসের ব্যাপারে বাইয়াত করছ? সবাই বললেন হা জানি, হযরত আব্বাস বললেন, তোমরা কালো এবং লাল লোকদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে তার হাতে বাইয়াত করছ, যদি তোমরা এরূপ মনে করে থাক যে, তোমাদের ধন-সম্পদ ব্যয়িত হলে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা নিহত হলে তোমরা তাকে পরিত্যাগ করবে তবে এখনই তাকে পরিত্যাগ কর, কেননা তাকে নিয়ে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ অবস্থায় পরিত্যাগ করা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য অবমাননাকর হবে যদি তোমরা মনে কর যে, ধন-সম্পদ কোরবানী দেয়ার পর নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হওয়ার পরও তার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পালন করবে, যেদিকে তোমাদের ডাকা হচ্ছে সেদিকে যাবে, তবে তোমরা তাকে নিয়ে যাও আল্লাহর শপথ, এতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪২)।
এসব কথা বলার পর সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন ধন-সম্পদ কোরবানী করব এবং নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হওয়ার ঝুঁকি নেব কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি পাব? আমরা আমাদের অঙ্গীকার যথাযথ পালন করব, কিন্তু আমাদের বিনিময় কি হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন জান্নাত, সবাই তখন হাত বাড়ালেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হাত বাড়ালেন, বাইয়াত হয়ে গেল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৬)।
হযরত জাবের (রা.) বলেন, সমবেত লোকের মধ্যে আসআদ ইবনে যোরারা ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সের আসআদ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত ধরে বললেন মদীনাবাসীরা একটু থামো, আমরা তার কাছে উটের বুক শুকানো দূরত্ব অতিক্রম করে এ কারণেই হাজির হয়েছি, যেহেতু তিনি আল্লাহর রাসূল, আজ তাকে মক্কা থেকে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সমগ্র আরবের সাথে শত্রুতা তোমাদের বিশিষ্ট নেতাদের নিহত হওয়া ও তলোয়ারের ঝনঝনানি কাজেই এসব কিছু সহ্য করতে পার তবেই তাকে নিয়ে যাও তোমাদের একাজের বিনিময় আল্লাহর কাছে রয়েছে আর যদি নিজেদের প্রাণ তোমাদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকে, তবে তাকে এখনই ছেড়ে দাও এটা হবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ওযর (মোসনাদে আহমদ)।
বাইয়াতের পূর্ণতা
বাইয়াতের দফাসমূহ আগেই নির্ধারিত ছিল, পরিস্থিতির গুরুতর অবস্থাও তুলে ধরা হয়েছে এরপর অতিরিক্ত তাকিদ দেয়ায় সবাই সমস্বরে বললেন, আস আদ ইবনে যোরারা তোমার হাত সরাও আল্লাহর শপথ আমরা এই বাইয়াতকে ছাড়তেও পারি না, নষ্টও করতে পারি না (মোসনাদে আহমদ)।
এই জবাব পেয়ে হযরত আসআদ ভালভাবে বুঝতে পারলেন যে, তার স্বজাতীয় লোকেরা দৃঢ় সংকল্প তারা জীবন দিতে প্রস্তুত মুসআব ইবনে ওমায়ের ছিলেন মদিনায় দ্বীনের বিশিষ্ট মোবাল্লেগ এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিলেন বাইয়াতকারীদের ধর্মীয় নেতা তাই সর্ব প্রথম আস আদ ইবনে যোরারা বাইয়াত করেন ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, বনু নাজ্জার বলেছে, আবু উমাশা আসআদ ইবনে যোরার প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন (ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, বনু আশহাল বলেছেন সর্ব প্রথম আবুল হায়হাম ইবনে তায়হান বাইয়াত করেছেন, হযরত কাব ইবনে মালেক বলেন, সর্ব প্রথম বাইয়াত করেছিলেন বারা ইবনে মারুর, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৭ আমার ধারণা বাইয়াতের আগে আবুল হায়ছাম এবং বারার কথাকেই বাইয়াত বলে ধরা হয়েছে অন্যথায় সে সময় সবার সামনে তো ছিলেন হযরত আসআদ ইবনে যোরারা তাই তার নামই আগে বর্ণণা করার কথা), এরপর অন্য সবাই বাইয়াত করেন হযরত জাবের (রা, ) বলেন, আমরা একজন করে উঠলাম, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের একজন কাছে বাইয়াত নিলেন বিনিময়ে তিনি আমাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন (মোসনাদে আহমদ)।
সেই সম্মেলনে উপস্থিত দুজন মহিলা মৌখিকভাবে বাইয়াত করছিলেন প্রিয় রাসূল কখনোই কোন অপরিচিতা মহিলার সাথে করমর্দন করেন নি (সহীহ মুসলিম বাইয়াতুল নেসা, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩১)।
বারোজন নকীব ও তাদের নাম
বাইয়াত সম্পন্ন হওয়ার পর প্রিয় নবী প্রস্তাব করলেন যে, বারোজন নেতা মনোনীত করা হোক, এরা হবে তাদের কওমের নকীব এরা বাইয়াতের শর্তাবলী নিজ নিজ কওমের লোকদের দ্বারা পূরণ করার দায়িত্ব পালন করবে প্রিয় নবী উপস্থিত লোকদেরই বারোজনের নাম জানাতে বললেন, তার একথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই ১২জন নকীব মনোনীত করা হল, এদেরে মধ্য ৯জন খাযরাজ ও ৩জন আওস গোত্রের ছিলেন
১. আসআদ ইবনে যোরারা ইবনে আদাছ ২. সাদ ইবনে রবিয়া ইবনে আমর ৩. আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা ইবনে সালাবাহ ৪. রাফে ইবনে মালেক ইবনে আযলান ৫. বারা ইবনে মারুর ইবনে ছাখার ৬. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম ৭. ওবাদা ইবনে সামেত ইবনে কায়েস ৮. সাদ ইবনে ওবাদা ইবনে অইম
৯. মুনযের ইবনে আমর খোনাইস এরা ছিলেন খাযরাজ গোত্রের
অন্য দিকে
১. উছায়েদ ইবনে খুজায়ের ইবনে ছাম্মাক ২. সাদ ইবনে খায়ছামা ইবনে হারেছ ৩. রেফায়া ইবনে আবদুল মুনেযের ইবনে যোবায়র ছিলেন আওস গোত্রের (কেউ কেউ যোবাইর এর পরিবর্তে যোনাইর উল্লেখ করেছেন কোন কোন সীরাত রচয়িতা রেফায়ার পরিবর্তে আবুল হায়ছাম ইবনে তাইহানের নাম সংযোজন করেছেন)।
১২ জন নকীব নিযুক্ত হওয়ার পর তাদর কাছ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় আরো একটি অঙ্গীকার নিলেন কেননা এরা ছিলেন অধিক দায়িত্বশীল তিনি বললেন আপনারা স্বজাতীয়দের সকল বিষয়েরই জন্যেই দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার, হাওয়ারিয়া (১২ জন) হযরত ঈসা (আ.) এর পক্ষ থেকে যেমন দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার ছিলেন, আপনারাও ঠিক তেমনি আমি মুসলমানদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার সবাই সমস্বরে বললেন, জ্বী হ্যাঁ
শয়তান কর্তৃক চুক্তির তথ্য ফাঁস
চুক্তি সম্পূর্ণ হওয়ার পর সবাই চলে যাওয়ার উপক্রম করছিলেন এমন সময় শয়তান সম্মেলনের বিষয়ে জেনে গেল, কোরাইশদের কাছে খবর পৌঁছানোর সময় ছিল না, যদি পৌছাত তবে তারা সংঘবদ্ধভাবে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, এ কারণে শয়তান উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে উচ্চস্বরে বলল, মিনাবাসীরা মোহাম্মাদকে দেখ, বে-দ্বীন লোকেরা বর্তমানে তার সঙ্গে রয়েছে তোমাদের সাথে লড়াই করার জন্য তারা সমবেত হয়েছে
প্রিয় নবী বললেন, ওটা হচ্ছে ঘাটির শয়তান, ওরে আল্লাহর দুশমন, শুনে রাখ, খুব শীঘ্রই আমি তোর জন্য সময় পাচ্ছি, এরপর তিনি লোকদের বললেন তারা যেন নিজ নিজ তাবুতে ফিরে যায় (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫১)।
শয়তানের আওয়াজ শুনে হযরত আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে সাজলা বললেন, সেই জাতের কসম যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন যদি আপনি চান তবে আগামীকালই আমরা মিনাবাসীদের ওপর তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমাকে এখনো এ কাজের আদেশ দেয়া হয়নি, তোমরা তোমাদের আস্তানায় ফিরে যাও, এরপর সবাই গিয়ে শুয়ে পড়লেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৮)।
মদিনার নেতাদের সাথে কোরাইশদের কথা কাটাকাটি
কোরাইশরা এ খবর পাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়ল, কেননা এ ধরনের বাইয়াতের সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল, পরদিন সকালে কোরাইশদের একদল বিশিষ্ট লোক মদীনাবাসী আগন্তুকদের তাঁবুর সামনে গিয়ে গত রাতের সম্মেলনের এবং বাইয়াতের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলো, তারা বলল, ওহে খাযরাজের লোকেরা আমরা শুনলাম তোমরা আমাদের এই লোককে আমাদের কাছ থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাও, তোমরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে তার হাতে বাইয়াত করছ, অথচ তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা অন্যসব আরব গোত্রের সাথে যুদ্ধ করার চেয়ে আমাদের কাছে অপছন্দনীয় (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৮)।
মক্কার কোরাইশরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পর মদিনা থেকে আসা অমুসলিম তীর্থযাত্রীরা বলল, তোমাদের কথা ঠিক নয়, তারা কসম করে বলল, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে না আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলল, আমার কওমের লোকেরা আমাকে বাদ দিয়ে এত বড় কাজ করবে, এটাতো চিন্তাই করা যায় না আমি তো এখন মক্কায় যদি আমি মদিনায় থাকতাম, তবুও তারা আমার সাথে পরামর্শ না করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করত না।
সম্মেলন এবং বাইয়াত রাতের আধারে হয়েছিল বিশ্বাস করার মত নয়, এ কারণে মদিনায় অমুসলিম তীর্থ যাত্রীদের কথাই মক্কার অমুসলিমরা বিশ্বাস করলো, মুসলমানরা একে অন্যের প্রতি আড়চোখে তাকালেন তারা ছিলেন চুপচাপ।
তারা হা বা না কিছুই বললেন না এক সময় কোরাইশ নেতারা বুঝলো যে আশঙ্কা করার মত কিছু আসলে ঘটেনি অবশেষে তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল।
বাইয়াতকারীদের ধাওয়া
মক্কায় কোরাইশ নেতারা এ বিশ্বাসের সাথে সাথে ফিরে এলো যে, তারা যা শুনেছে, সেটা সত্য নয় তবে যেহেতু সন্দেহ ছিল, এ জন্যে তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য অধীর হয়ে উঠলো, শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারল যে, ঘটনা সত্য, বাইয়াতের ঘটনা আসলেই ঘটেছে নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে কিন্তু এ খবর নিশ্চিতভাবে যখন তারা পেল তখন মদিনার হজ্জ যাত্রীরা রওয়ানা হয়ে গেছেন কিছুসংখ্যক অমুসলিম মদিনায় যাত্রীদের পিছু ধাওয়া করল, কিন্তু সুযোগ ততক্ষণে হাতছাড়া হয়ে গেছে, দ্রতগামী ঘোড় সওয়াররা সাদ ইবনে ওবাদা এবং মুনযের ইবনে আমরকে দেখতে পেল, মুনযের দ্রুত এগিয়ে গেলেন, সাদ ধরা পড়লেন তাকে মক্কায় বেধে নিয়ে আসা হল, তাকে প্রহার কার হল, মক্কায় নেয়ার পর মাতয়াম ইবনে আদী এবং হারেছ ইবনে হবর উমাইয়া তাকে ছাড়িয়ে দিলেন কেননা এই দুজনের বাণিজ্য কাফেলা মদিনায় সাদ ইবনে ওবাদার তত্ত্বাবধানে যাতায়াত করত, এদিকে মদিনায় হজ্জ যাত্রীরা তাদের সফরসঙ্গী সাদ ইবনে ওবাদার গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তারা মক্কায় ফিরে গিয়ে কাফের কোরাইশদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু মক্কার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই তারা লক্ষ্য করলেন যে, সাদ ইবনে ওবাদা ফিরে আসছেন এরপর কাফেলার সবাই নিরাপদে রওয়ানা হয়ে নিরাপদে মদিনা পৌঁছলেন (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫১-৫২, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৮-৪৫০)।
এটি হচ্ছে দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা এটাকে বাইয়াতে আকাবা কোবরাও বলা হয় এই বাইয়াত এমন এক পরিবেশে হয়েছিল যে ঈমানদারদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা সহযোগিতা বিশ্বাস বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রেরণা এখানে জাগরূক ছিল, মদিনার ঈমানদারদের অন্তর মক্কার দুর্বল ভাইদের প্রতি ভালবাসায় ছিল পরিপূর্ণ, সাহায্য করার উদ্দীপনায় মনে ছিল দুর্বার সঙ্কল্প, অত্যাচারী বিধর্মীদের জন্যে অন্তরে ছিল ক্রোধ ও ঘৃণা না দেখেও যাদের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ভাই হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে তারা ছিল প্রকৃতপক্ষেই দ্বীনি ভাই।
এ ধরনের প্রেরণা বাহ্যিক কোন আকর্ষণের কারণে ছিল না, সময়ের স্রোতধারায় এ ভালবাসার প্রেরণা মুছে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না, বরং এ ভালবাসার মূলে ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান ও আল্লাহর কোরআনের প্রতি ঈমান, এই ঈমান কোন প্রকার যুলুম নির্যাতন অত্যাচার ও শক্তির সামনে দুর্বল ও নষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, এই ঈমান বা অদৃশ্য বিশ্বাসের দৃঢ়তার পরিচয় আমলের মাধ্যমে পাওয়া যায়, এই ঈমানের কারণেই মুসলমানরা পৃথিবীতে বিস্ময়কর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিল, সেই কৃতিত্বের উদাহরণ অতীতের পৃথিবীতে যেমন পাওয়া যায়নি ভবিষ্যতের পৃথিবীতেও পাওয়ার তেমনি সম্ভাবনা নেই।
হিজরতকারী মুসলমানদের শঙ্কিত প্রতিনিধিদল
দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে ইসলাম, কুফুরী ও মূর্খতার অন্ধকারের মধ্যে নিজের জন্যে একটি আবাসভূমির বুনিয়াদ রাখতে সক্ষম হল, দাওয়াতের শুরু থেকে এটা ছিল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের অনুমতি দিলেন তারা যেন নিজেদের নতুন দেশে হিজরত করে চলে যায়।
হিজরত অর্থ হচ্ছে সব কিছু পরিত্যাগ করে শুধু প্রাণ রক্ষার জন্য কোথাও চলে যাওয়া, তবে এই প্রাণও শঙ্কামুক্ত নয়, যাত্রা শুরু থেকে গন্তব্য পৌছা পর্যন্ত যে কোন জায়গায় প্রাণ সংহার হয়ে যেতে পারে, যাত্রা শুরু হচ্ছে এক অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ভবিষ্যতে কি ধরনের বিপদ মুসিবতের সম্মুখীন হতে হবে, সে সম্পর্কে আগে ভাগে কিছুই বলা যায় না।
এসব কিছু জেনে বুঝেই মুসলমানরা হিজরত শুরু করেন এদিকে পৌত্তলিকরা মুসলমানদের যাত্রা পথে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল, কারণ পৌত্তলিকরা বুঝতে পেরেছিল যে, মুসলমানদের হিজরতের পর ভবিষ্যতে তাদের জন্য অনেক আশঙ্কা ও বিপদ দেখা দেবে নীচে হিজরতের কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করা যাচ্ছে।
এক. প্রথম মোহাজের ছিলেন হযরত আবু সালমা (রা.) ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী দ্বিতীয় বাইয়াতে আকবার এক বছর আগে তিনি হিজরত করেন স্ত্রী এবং সন্তানরাও তার সাথে ছিলেন, তিনি রওয়ানা হতে শুরু করলে তার শ্বশুরালয়ের লোকেরা বলল, আপনার নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমাদের চেয়ে আপনার বেশী রয়েছে, কিন্তু আমাদের মেয়ের কি হবে? আপনি তাকে শহরে শহরে ঘোরাবেন এটা জানার পরও কিভাবে তাকে আপনার সাথে যেতে দিতে পারি? সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়, আবু সালমর স্ত্রীকে তার মা-বাবা রেখে দিলেন, এ খবর পাওয়ার পর আবু সালমার মা-বাবা ক্ষেপে গেলেন তারা নিজেদের পৌত্রকে কেড়ে নিয়ে এলেন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে এক ধাত্রীর কাছে প্রতিপালনের জন্য দেয়া হল এর আগে এক জায়গায় শিশুকে উভয় পক্ষ টানাটানি করায় শিশুর হাতে ব্যথা পেল, মোটকথা হযরত আবু সালমা (রা.) একা মদিনায় চলে গেলেন এদিকে স্বামী সন্তান ছেড়ে উম্মে সালমা পাগলিনীর মত হয়ে গেলেন যেখানে তার স্বামী বিদায় নিয়েছিলেন এবং তার সন্তানকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল, সেই জায়গার নাম ছিল আবত্তাহ প্রতিদিন সকালে তিনি আবত্তাহ যেতেন এবং সারাদিন বিলাপ করতেন, এভাবে এক বছর কেটে গেল, অবশেষে উম্মে সালমর একজন আত্মীয় উম্মে সালমার মা-বাবাকে বলল, বেচারিকে কেন আপনারা স্বামীর কাছে যেতে দিচ্ছেন না? এরপর তার মা বাবা তাকে বললেন তুমি ইচ্ছা করলে স্বামীর কাছে যেতে পার, উম্মে সালমা তখন শ্বশুরালয়ে গিয়ে সন্তানকে ধাত্রীর কাছ নিয়ে নিলেন এবং একাকী সন্তানসহ মদিনা রওয়ানা হলেন, মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব পাঁচশত কিলোমিটার, তানঈম নামক জায়গায় পৌছার পর ওসমান ইবনে আবু তালহার সাথে দেখা হল, উম্মে সালমা তাকে সব কথা খুলে বললেন, সব শুনে ওসমান তাকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় রওয়ানা হলেন কোবার জনপদ দূরে থেকে দেখে বললেন এ জনপদে তোমার স্বামী রয়েছে তুমি সেখানে চলে যাও আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন এর ওসমান মক্কায় ফিরে এলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৬৯, ৪৭০)।
দুই) হযরত সোহায়ব (রা.) মদিনায় হিজরত করার ইচ্ছা করলে কোরাইশ পৌত্তলিকরা বলল, তুমি আমাদের কাছে যখন এসেছিলে তখন তুমি ছিলে নিঃসঙ্গ কাঙ্গাল, এখানে আসার পর তোমার অনেক ধন সম্পদ হয়েছে তুমি অনেক উন্নতি করেছ এখন তুমি সেসব নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়তে চাও? সেটা কিছুতেই সম্ভব নয় হযরত সোহায়েব বললেন আমি যদি ধন-সম্পদ সব ছেড়ে যাই তবে কি তোমরা আমাকে যেতে দেবে? তারা বলল হ্যাঁ দেব, হযরত সোহায়েব বললেন ঠিক আছে তাই হোক, সব কিছু তোমাদের কাছে রেখে গেলাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পাওয়ার পর মন্তব্য করলেন, সোহায়েব লাভবান হয়েছে, সোহায়েব লাভবান হয়েছে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৭৭)।
তিন) হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব, আইয়াশ ইবনে আবি রবিয়া এবং হিশাম ইবনে আস ইবনে ওয়ায়েল পরস্পর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে অমুক জায়গায় সকাল বেলা একত্রিত হয়ে সেখান থেকে মদিনায় হিজরত করবেন, এরপর হযরত ওমর এবং আইয়াশ নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে সক্ষম হলেন কিন্তু হিশাম পৌছুতে পারলেন না, তাকে বন্দী করে রাখা হল।
উল্লিখিত দুজন হিজরত করে কোবায় পৌছার পর আইয়াশের কাছে আবু জেহেল এবং তার ভঅই হারেস পৌছলো, তিনজন ছিলেন এক মায়ের সন্তান উভয় ভাই আইয়াশকে বলল মা প্রতিজ্ঞা করেছে যে তোমাকে না দেখা পর্যন্ত মাথার চুল আঁচড়াবে না, রোদ থেকে ছায়ায় যাবে না, একথা শুনে মায়ের জন্য আইয়াশের মন কেঁদে উঠল, হযরত ওমর (রা.) এ অবস্থা দেখে আইয়াশকে বললেন, শোন আইয়াশ, ওরা তোমাকে তোমার দ্বীনের ব্যাপারে একটা ফেতনায় ফেলতে চায়, কাজেই তুমি সাবধান হও, খোদার কসম তোমার মায়ের মাথায় যখন উকুন কামড়াবে তখন তিনি নিশ্চয়ই মাথায় চিরুনি দেবেন, মক্কায় কড়া রোদ অসহ্য হলে তিনি ঠিকই ছায়ায় যাবেন, কিন্তু আইয়াশ সেকথা কানে তুললেন না, তিনি মায়ের কসম পুরো করার জন্য জন্য ভাইদের সাথে মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, হযরত ওমর (রা.) বললেন, যেতেই যখন চাও, আমার এ উটনী নিয়ে যাও, এর পিঠ থেকে নামবে না মায়ের সাথে দেখা দিয়েই চলে আসবে যদি সন্দেহজনক কোন আচরণ দেখ দ্রুত মদিনায় ফিরে আসবে।
আইয়াশ উটনীর পিঠে চড়ে দুই ভাইয়ের সাথে মক্কা অভিমুখে ফিরে চললেন কিছুদূর যাওয়ার পর আবু জেহেল আইয়াশকে বলল, ভাই আমার উট খুব ধীরে চলে, তোমার উটনীটা কিছুক্ষণের জন্য বদল করবো, আইয়াশ উটনী বসানোর সাথে সাথে দুই ভাই মিলে আইয়াশকে রশি দিয়ে বেধে বাধা অবস্থায় দিনের বেলায় মক্কায় নিয়ে গেল, মক্কায় নেয়ার পর সবাইকে শুনিয়ে বলল, ওহে মক্কার অধিবাসীরা তোমরা তোমাদের বেকুবদের সাথে ঠিক এরূপ ব্যবহার কর, আমরা আমাদের এই বেকুবের সাথে যেমন ব্যবহার করেছি (হিশাম এবং আইয়াশ কাফেরদের হাতে বন্দী ছিল, রাসূল হিজরত করার পর একদিন বললেন, কে আছ যে আমার জন্য হিশাম এবং আইয়াশকে ছাড়িয়ে আনতে পারো, ওলীদ ইবনে ওলীদ এ দায়িত্ব নিলেন, গোপনে তিনি মক্কায় গেলেন, ওদের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া এক মহিলাকে অনুসরণ করে তাদের ঠিকানা জেনে নিলেন, ছাদ বিহীন একটি ঘরে উভয়কে আটকে রাখা হয়েছিল, গভীর রাতে ওলীদ দেয়াল বেয়ে উঠে ঘরের ভেতরে গেলেন তারপর বাধান কেটে দিয়ে বের করে নিজের উটে বসিয়ে উভয়কে মদিনায় নিয়ে এলেন, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৭৪-৪৭৬ হযরত ওমর (রা.) ২০ জন সাহাবীর একটি দলসহ মদিনায় হিজরত করেন, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড)।
হিজরত করার জন্য কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে এ খবর পাওয়ার পর পৌত্তলিকরা তাদের সাথে যেরূপ ব্যবহার করত, এখানে তার তিনিটি নমুনা তুলে ধরা হল, কিন্তু এত বাধা সত্বেও ঈমানের সম্বল বুকে নিয়ে মুসলমানরা হিজরত করতে থাকেন দ্বিতীয় বাইয়াতে আকবার দুই মাস কয়েক দিন পর মক্কায় প্রিয় নবী হযরত আবু বকর এবং হযরত আলী (রা.) ছাড়া অন্য কোন মুসলমান ছিলেন না, এরা দুজন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী মক্কায় রয়ে গেলেন, কয়েকজন মুসলমান এমন ছিলেন যে, তাদেরকে পৌত্তলিকরা জোর করে আটকে রেখেছিল, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের প্রস্তুতি নিয়ে আল্লাহর নির্দেশেরে অপেক্ষায় ছিলেন আর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সফরের সাজ সরঞ্জাম বেধে রেখে দিয়েছিলেন (যাদুল আয়অদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫২)।
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে এটি হচ্ছে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি এলাকা এরপর মুসলমানরা মদিনায় হিজরত শুরু করেন, হাবশায় যারা হিজরত করেছিলেন তারাও মদিনায় আসতে শুরু করেন, হযরত আবু বকর (রা) ও মদিনায় সফরের প্রস্তুতি নেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, অপেক্ষা কর, আমি ধারনা করছি যে, আমাকেও হিজরতের নির্দেশ দেয়া হবে হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি কি হিজরতের আশা করছেন? প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হা, এরপর হযরত আবু বকর (রা.) অপেক্ষা করতে লাগলেন, তিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী হবেন এ আশায় ছিলেন তার কাছে দুটি উটনী ছিল, তাদেরকে চার মাস যাবত ভালো করে বাচলা গাছের পাতা খাওয়ানো হল (সহীহ বোখারী, হিজরতে নবী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩)।
দারুন নোদওয়ায় কোরাইশদের বৈঠক
মক্কার পৌত্তলিকরা যখন দেখলো যে সাহাবায়ে কেরামরা পরিবার পরিজন ও ধন সম্পদ ফেলে রেখে আওস ও খাযরাজদের এলাকায় গিয়ে পৌঁছেছে, তখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়ল, ক্রোধে তারা অস্থির হয়ে উঠলো, ইতিপূর্বে তারা এ ধরনের বিপদজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনো হয়নি, এ পরিস্থিতি ছিল তাদের মূর্তি পূজা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর মারাত্মক আঘাত এবং চ্যালেঞ্জ স্বরূপ।
পৌত্তলিকরা ভাল করেই জানতো যে, হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এর মধ্যে নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশের যোগ্যতা এবং তার প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি বিদ্যমান রয়েছে একই সাথে তার সাহাবাদের মধ্যে আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার যে প্রেরণা রয়েছে সেটাও তাদের অজানা ছিল না, আওস ও খাযরাজ গোত্রের রণ কৌশল, যোদ্ধা বা লড়াকু হিসাবে সুনাম সুখ্যাতিও ছিল সর্বজনবিদিত উভয় গোত্রের মধ্যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যেসব নেতা রয়েছেন তাদের অসাধারণ প্রজ্ঞাও সকলের জানা ছিল, তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী যেমন লড়াই করতে জানেন, তেমনি প্রয়োজনে সন্ধি সমঝোতাও করতে জানেন, বহু বছর গৃহযুদ্ধের তিক্ততার পর আওস এবং খাযরাজ গোত্র বর্তমানে প্রয়োজনে সন্ধি এবং মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে এ খবরও কোরাইশদের অজানা ছিল না।
পৌত্তলিক কোরাইশরা এটা জানতো যে, ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত লোহিত সাগরের উপকূল দিয়ে সে পথ রয়েছে সেই পথেই চলাচল করে কোরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা সে পথ মদিনা থেকে বেশী দূরে নয়, কাজেই অর্থনৈতিক এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে মদিনা অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সিরিয়া থেকে মক্কাবাসীদের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল (সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী) আড়াই লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার সমপরিমাণ, তাবেরা এবং অন্যান্য এলাকার বাণিজ্যিক হিসাব ছিল এর অতিরিক্ত কাজেই বাণিজ্যিক পথ নিরাপদ থাকার নিশ্চয়তার মাধ্যমেই যে এ বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা হতে পারে এটা তারা ভালো করেই বুঝতো।
এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, মদিনায় ইসলামী দাওয়াতের বুনিয়াদ দৃঢ় হওয়া এবং মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে মদীনাবাসীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিণাম কত মারাত্মক পৌত্তলিকরা এসব আশঙ্কা সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত ছিল, এবং তারা বুঝতে পারছিল যে, সামনে কঠিন সময় ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে এ কারণে তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কার্যকর প্রতিষেধক সম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করল, তারা জানতো যে, এসব বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তির মূলে রয়েছেন ইসলামের পতাকাবাহী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নিজে।
দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবার প্রায় আড়াই মাস পর ২৬ শে সফর ১২ ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের শুক্রবার (আল্লামা মনসুরপুরী সংযোজিত তথ্যের আলোকে এ ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, রহমতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৯৫, ৯৭, ১০২, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৭১)। সকালে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় (প্রথম প্রহরে অর্থাৎ সকাল বেলায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে এতে তিনি বলেছেন, হযরত জিবরাঈল (আ.) প্রিয় রাসূল (সা.) এর কাছে এ বৈঠকের খবর নিয়ে আসেন এবং তাকে হিজরতের অনুমতি প্রদান করেন, সহীহ বোখারীতে হযরত আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা উল্লেখ রয়েছে যে, প্রিয় রাসূল (সা.) দুপুর বেলায় হযরত আবু বকর (রা.) এর কাছে এসে বলেন, আমাকে মদিনা রওয়ানা হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখ করা হবে) মক্কার পার্লামেন্ট দারুন নোদওয়ায় ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, এ বৈঠকে মক্কার কোরাইশদের সকল গোত্রের প্রতিনিধি যোগদান করেন আলোচ্য বিষয় ছিলো এমন একটি পরিকল্পনা উদ্ভাবন করা যাতে ইসলামী দাওয়াতের নিশানবরদারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ইসলামের আলো চির দিনের জন্য নিভিয়ে দেয়া যায়।
এ জঘন্য বৈঠকে যেসব গোত্রের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলো তাদের পরিচয়
১. আবু জেহেল ইবনে হিশাম বনি মাখযুম গোত্র
২. যোবায়ের ইবনে মুতয়েম তুয়াইমা ইবনে বনি নওফেল ইবনে আবদে মান্নাফ
আদী এবং হারেস ইবনে আমের
৩. শায়বা ইবনে রবিয়া, ওতবা ইবনে রবিয়া
এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারব বনি আবদে শামস ইবনে আবদে মান্নাফ
৪. নযর ইবনে হারেস বনি আবদুদ দার
৫. আবুল বুখতারি ইবনে হিশাম
জামআ ইবনে আসোয়াদ এবং
হাকিম ইবনে হেযাম বনি আসাদ ইবনে আবদুল ওজ্জা
৬. নবীহ ইবনে হাজ্জাজ এবং বনি ছাহাম
মুনাব্বাহ ইবনে হাজ্জাজ
৭. উমাইয়া ইবনে খালফ জুমাহ
পূর্ব নির্ধারিত সময়ে প্রতিনিধিরা দারুন নদওয়ায় পৌছে গেল, এ সময় ইবলিশ শয়তান একজন বৃদ্ধের রূপ ধারণ করে সভাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হল, তার পরিধানে ছিল জোব্বা, প্রবেশদ্বারে তাকে দেখে লোকেরা বলল, আপনি কি? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না, শয়তান বলল, আমি নজদের অধিবাসী একজন গেলো, আপনাদের কর্মসূচী শুনে হাজির হয়েছি, কথা শুনতে চাই, কিছু কার্যকর পরামর্শ দিতে পারব আশা করি, পৌত্তলিক নেতারা শয়তানকে যত্ন করে সসম্মানে নিজেদের মধ্যে বসালো।
আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার নীল নকশা
সবাই হাজির হওয়ার পর আলোচনা শুরু হল, দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর নানা প্রকার প্রস্তাব পেশ করা হল, প্রথমে আবুল আসওয়াদ প্রস্তাব করল যে, তাকে আমরা আমাদের মধ্যে থেকে বের করে দেবো, তাকে মক্কায় থাকতে দেব না, আমরা তার ব্যাপারে কোন খবরও রাখব না যে, তিনি কোথায় যান কি করেন এতেই আমরা নিরাপদে থাকতে পারব এবং আমাদের মধ্যে আগেরে মতো সহমর্মিতা ফিরে আসবে।
শেখ নজদী রূপী শয়তান বলল, এটা কোন কাজের কথা নয় তোমরা কি লক্ষ্য করনি যে, তার কথা কত উত্তম কত মিষ্টি তিনি সহজেই মানুষের মন জয় করেন যদি তোমরা তার ব্যাপারে নির্বিকার থাক তবে তিনি কোন আরব গোত্রে গিয়ে হাজির হবেন এবং তাদেরকে নিজের অনুসারী করার পর তোমাদের ওপর হামলা করবেন এরপর তোমাদের শহরেই তোমাদেরকে নাস্তানাবুদ করে তোমাদের সাথে যেমন খুশী আচরণ করবেন কাজেই তোমরা অন্য কোন প্রস্তাব চিন্তা কর।
আবুল বুখতারী বলল, তাকে লোহার শেকলে বেধে আটকে রাখা হোক বাইরের থেকে দরজা বন্ধ করে একটা বন্ধ ঘরে রাখা হোক, এতে করে সেই ঘরে তার মৃত্যু হবে কবি যোহাইর এবং নাবেগার এভাবেই মৃত্যু হয়েছিল।
শেখ নজদী রূপী শয়তান বলল, এ প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য নয়, তোমরা যদি তাকে আটক করে ঘরের ভেতরে রাখ, তবে যেভাবে হোক, তার খবর তার সঙ্গীদের কাছে পৌঁছে যাবে এরপর তারা মিলিতভাবে তোমাদের ওপর হামলা করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে এরপর তার সহায়তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে তোমাদের ওপর হামলা করবে সেই হামলায় তোমাদের পরাজয় অনিবার্য, কাজেই অন্য কোন প্রস্তাব নিয়ে চিন্তা কর।
উল্লিখিত দুটি প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পর তৃতীয় একটি প্রস্তাব পেশ করা হল, মক্কার সবচেয়ে জঘন্য অপরাধী আবু জেহেল এ প্রস্তাব উত্থাপন করল, সে বলল, তার সম্পর্কে আমার একটিই প্রস্তাব রয়েছে আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, এখনে কেউ সে প্রস্তাবের ধারে কাছে পৌঁছেনি, সবাই বলল, বল আবুল হাকাম কি সেই প্রস্তাব? আবু জেহেল বলল, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন যুবককে বাছাই করে তাদের হাতে একটি করে ধারালো তলোয়ার দেয়া হবে এরপর সশস্ত্র শক্তিশালী যুবকরা একযোগে তাকে হত্যা করবে এমনভাবে হামলা করতে হবে দেখে যেন মনে হয় একজন আঘাত করছে এতে করে আমরা এই লোকটির হাত থেকে রেহাই পাব, এমনিভাবে হত্যা করা হলে তাকে হত্যার দায়িত্ব সকল গোত্রের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে, বনু আবদে মান্নাফ সকল গোত্রের সাথে তো যুদ্ধ করতে পারবে না ফলে তারা হত্যার ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে রাজি হবে আমরা তখন তাকে হত্যার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব (হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮০-৪৮২)।
শেখ নজদী রূপী শয়তান এ প্রস্তাব সমর্থন করল, মক্কার পার্লামেন্ট এ প্রস্তাবের ওপর ঐকমত্যে উপনীত হল, সবাই এ সঙ্কল্পের সাথে ঘরে ফিরলো যে, অবিলম্বে এ প্রস্তাব কার্যকর করতে হবে।
আল্লাহর রাসূলের হিজরত
রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার জঘন্য প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর হযরত জিবরাঈল (আ.) ওহী নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরাইশদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করে বলেন যে, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন, হিজরত করার সময় জানিয়ে হযরত জিবরাঈল (আ.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন আপনি আজ রাত আপনার বাসভবনের বিছানায় শয়ন করবেন না (হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮০-৪৮২, যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫২)।
এ খবর পাওয়ার পর নবী ঠিক দুপুরের সময় হযরত আবু বকর (রা.)এর বাড়ীতে গেলেন তাকে সঙ্গে নিয়ে হিজরতের পরিকল্পনা তৈরি করাই ছিল তার উদ্দেশ্য, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন ঠিক দুপুরের সময় আমরা আবু বকর (রা.) এর ঘরে বসেছিলাম, এমন সময় একজন আবু বকরকে বললেন, আল্লাহর নবী মাথা ঢেকে এদিকে আসছেন, এই সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখন আসতেন না, আবু বকর (রা.) এ খবর শুনে বললেন, আমার মা বাবা তার জন্য কোরবান হউন, নিশ্চয়ই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে এসেছেন।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয় নবী এলে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, অনুমতি দেয়া হলে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন এরপর আবু বকরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন তোমার কাছে যারা রয়েছে তাদের সরিয়ে দাও, আবু বকর (রা.) বললেন শুধু আপনার স্ত্রী রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমাকে রওয়ানা হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আবু বকর (রা.)রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন সঙ্গে আমি? হে রাসূল আপনার ওপর আমার মা বাবা কোরবান হউন, হে আল্লাহর রাসূল, প্রিয় রাসূল বলেন হা (যাদুল মায়াদ ১য় খন্ড)।
এরপর হিজরতের কর্মসূচী তৈরি করে তিনি নিজের ঘরে ফিরে রাত্রির অপেক্ষা করতে লাগলেন (সহীহ বোখারী হিজরতে নবী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩)।
আল্লাহর রাসূলের বাসভবন ঘেরাও
এদিকে কোরাইশদের নেতৃস্থানীয় অপরাধীরা মক্কার পার্লামেন্ট দারুন নোদওয়ার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী সারা দিনব্যাপী প্রস্তুতি গ্রহণ করল, জঘন্য অপরাধীদের মধ্যে তেকে এগারজন সর্দারকে বাছাই করা হল, এদের নাম হচ্ছে,
১. আবু জেহেল ইবনে হিশাম
২. হাকাম ইবনে আস
৩. ওকবা ইবনে আবু মুয়াইত
৪. নযর ইবনে হারেছ
৫. উমাইয়া ইবনে খালফ
৬. জামআ ইবনে আসওয়াদ
৭. তুয়াইমা ইবনে আদী
৮. আবু লাহাব
৯. উবাই ইবনে খালফ
১০. নুবাইহ ইবনে হাজ্জাজ
১১. মুনাব্বাহ ইবনে হাজ্জাজ (যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ. ৫২)
ইবনে ইসহাক বলেন, রাতের আধার ঘন হয়ে এলে ১১জন দুর্বৃত্ত নবী (সা.) এর বাসভবনের চারিদিকে ওৎ পেতে রইল, তারা অপেক্ষা করছিল যে, তিনি শুয়ে পড়লে একযোগে হামলা করবে।
দুর্বৃত্তরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিল যে, তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অবশ্যই সফল হবে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২) আবু জেহেল তার সঙ্গীদের সঙ্গে ঠাট্টা মস্কারা করে বলছিল মোহাম্মাদ বলে যে, তোমরা যদি তার ধর্ম মতে দীক্ষা নিয়ে তার অনুসরণ কর, তবে আরব অনারবের বাদশাহ হবে এরপর মৃত্যু শেষে পুনরুজ্জীবিত হলে তোমাদের জন্য জর্দানের বাগানের মত জান্নাত থাকবে, যদি তোমরা তাকে না মার, তবে তারা তোমাদের জবাই করবে এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হলে তোমাদের আগুনে পোড়ানো হবে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৩)।
ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল রাত বারোটার পর, এ কারণে নির্ঘুম চোখে নির্ধারিত সময়ের প্রতীক্ষায় তারা অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছাই সফল করে থাকেন তিনি আসমান যমীনের বাদশাহ, তিনি যা চান তাই করেন তিনি যাকে বাচাতে চান কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না যাকে পাকড়াও করতে চান কেউ তাকে বাচাতে পারে না এই সময়েও আল্লাহ তায়ালা যা ইচ্ছা করেছিলেন তাই করলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে তিনি বলেন স্মরণ কর, কাফেররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দী করার জন্য হত্যা করার জন্য নির্বাসিত করার জন্য তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল করেন আর আল্লাহরই কৌশলীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)।
আল্লাহর রাসূলের গৃহত্যাগ
কোরাইশ কাফেররা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত প্রস্তুতি এবং সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও সফল হতে পারেনি, এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী (রা.) কে বললেন তুমি আমার এই সবুজ হাদরামি (দক্ষিণ ইয়েমেনের হাদরামাউতে নির্মিত চাদরকে হাদরামি চাদর বলা হয়) চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে থাক, ওদের হাতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না, প্রিয় নবী এই চাদর গায়ে দিয়ে রাতে ঘুমোতেন (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২, ৪৮৩)।
আল্লাহর রাসূল এরপর বাইরে এলেন একমুঠো ধুলো নিয়ে কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করলেন, এতেই আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্ধ করে দিলেন, তারা আল্লাহর রাসূলকে দেখতে পেল না, সে সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাক কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন, আমি ওদের সামনে প্রাচীর ও পশ্চাতে প্রাচীর স্থাপন করেছি এবং ওদেরকে আবৃত্ত করেছি, ফলে ওরা দেখতে পায় না (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৯)।
প্রতিটি পৌত্তলিকের মাথায় নিক্ষিপ্ত ধূলি গিয়ে পড়লো, এরপর তিনি হযরত আবু বকরের বাড়ীতে গেলেন, সেই ঘরের একটি জানালা পথে বেরিয়ে উভয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে ইয়েমেনের পথে যাত্রা করলেন, রওয়ানা হওয়ার পর কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছুর পাহাড়ের একটি গুহায় তারা যাত্রা বিরতি করলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৩ যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫২)।
এদিকে অবরোধকারীরা নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা নিজেদের ব্যর্থতার কথা জেনে ফেলল, অপরিচিত একজন লোক এসে দুর্বৃত্তদের বলল, আপনারা এখানে কার জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বলল, মোহাম্মাদের জন্য, সেই লোক বলল, আপনাদের ইচ্ছা পূরণ হবে না, আল্লাহর কসম মোহাম্মাদ আপনাদের মাথায় ধূলি নিক্ষেপ করে আপনাদের সামনে দিয়ে নিজের কাছে চলে গেছেন, তারা একথা শুনে বলল, কই আমরা তো তাকে দেখলাম না তারা সবাই নিজের মাথায় হাত দিয়ে ধূলি দেখতে পেল, তারা এরপর ধুলো ঝেড়ে সবাই উঠে দাড়ালো।
এরপর তারা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের ভেতর উকি দিয়ে দেখলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় কেউ শুয়ে আছেন ওরা হযরত আলীকেই আল্লাহর রাসূল মনে করে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করল, সকালে হযরত আলী (রা.) কে শয্যা ত্যাগ করতে দেখে দুর্বৃত্তরা চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে পড়ল, তারা হযরত আলী (রা.) কে জিজ্ঞাসা করল, আল্লাহর রাসূল কোথায়? হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি জানি না (যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ. ৫২ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৩)।
ঘর থেকে গারে ছূরে
প্রিয় রাসূল ২৭ শে সফর মোতাবেক ১২ ও ১৩ ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১২ ই সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে হিজরত করেন, তার সফরসঙ্গী ছিলেন তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাথী হযরত আবু বকর (রা.) তারা সূর্যোদয়ের আগেই মক্কার সীমানা অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চললেন (রহমতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৯৫ সফরের এ মাস নবুয়তের চতুর্দশ বর্ষ হিসাবে গণ্য হবে যদি মহররম মাস থেকে বর্ষ শুরুর হিসাব করা হয়, যদি নবুয়ত পাওয়ার মাস থেকে বর্ষ শুরুর হিসাব ধরা হয়, তাহলে সফর মাস হবে নবুয়তের ত্রয়োদশ বছর সীরাত রচয়িতাদের অধিকাংশ মহররম মাস থেকেই বর্ষ শুরুর হিসাব করেছেন কেউ কেউ উভয় রকমের হিসাব গ্রহণ করেছেন এ কারণে হিজরতের তারিখ নির্ধারণে তারা এলোমেলো করে দেখেছেন আমরা মহররম মাস থেকেই বর্ষ শুরুর হিসাব উল্লেখ করেছি)।।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন যে, কোরাইশ দুর্বৃত্তরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় তাকে খুঁজবে এবং স্বাভাবিকভাবে মদিনা অভিমুখী পথের দিকেই অগ্রসর হবে এ কারণে প্রিয় নবী উল্টো দিকে ইয়েমেনের পথে অগ্রসর হলেন, মদিনার পথ হচ্ছে মক্কা থেকে উত্তর দিকে আর ইয়েমেনের পথ দক্ষিণ দিকে পাঁচ মাইল অতিক্রমের পর প্রিয় নবী একটি পাহাড়ের পাদদেশে পৌছলেন, সেই পাহাড় ছুর পাহাড় নাম পরিচিত, একটি সুউচ্চ পাহাড় এই পাহাড়ে ওঠা খুব কষ্টকর এখানে বহু পাথর রয়েছে সেই পাথর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরণ যুগল রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল, বলা হয়ে থাকে যে, পায়ের ছাপ গোপন রাখার জন্য তিনি পায়ের গোড়ালি দিয়ে হাটছিলেন, এ কারণে তার পা জখম হয়ে যায়।
হযরত আবু বকর (রা.) প্রথমে পাহাড়ের কিছু অংশে উঠে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ওপরে উঠতে সহায়তা করেন, এরপর উভয়ে পাহাড় চুড়ার একটি গুহায় আশ্রয় নেন এই গুহা ইতিহাসে গারে ছূর নামে বিখ্যাত (রহমতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৯৫, মুখতাছারুছ সিরাহ শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ১৬৭৭, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২)।
ছূর পর্বতের গুহায়
গুহার কাছে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবু বকর (রা.) বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, গুহায় কোন কিছু থাকলে তার মোকাবেলা আমার সাথেই যা হবার হবে, এরপর তিনি গুহায় প্রবেশ করে পরিষ্কার করলেন, কয়েকটি গর্ত ছিল, যেগুলো তহবন্ধ ছিড়ে বন্ধ করলেন, দুটি গর্ত বাকি ছিল, সেগুলোতে পা চাপা দিয়ে প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভেতরে আসার আহ্বান জানালেন, প্রিয় নবী ভেতরে গেলেন এবং আবু বকরের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন, ইতিমধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) কে কিসে যেন দংশন করল, কিন্তু প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে এ আশঙ্কায় তিনি নড়াচড়া করলেন না, বিষের কষ্টে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো, বেখেয়ালে এক ফোটা অশ্রু প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারায় পড়তেই তিনি জেগে গেলেন, আবু বকর (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি হয়েছে? কিসে যেন আমাকে দংশন করেছে ।
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খানিকটা থুথু নিয়ে দংশিত স্থালে লাগিয়ে দিলেন সাথে সাথে বিষের যাতনা দূর হয়ে গেল (এই বক্তব্য ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)থেকে বর্ণনা করা হয়েছে এ বর্ণনায়, একথাও রয়েছে যে, পরবর্তী সময়ের সেই বিষের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং সেই বিষের প্রভাবেই তিনি ইন্তিকাল করেন, দেখুন মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৫৬, মানাকের আবু বকর শীর্ষক অধ্যায়)।
এখানে উভয়ে শুক্র, শনি ও রবিবার এ তিনদিন অবস্থান করেন (ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৩৩৬) এ সময়ে হযরত আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহও একই সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন আবদুল্লাহ ছিল খুব বুদ্ধিমান যুবক, সে শেষ রাতে উভয়ের কাছে থেকে চলে আসতো কিন্তু মক্কায় তাকে সকাল বেলাই দেখা যেত, যে কেউ দেখে ভাবত রাতে সে মক্কাতেই ছিল, সারাদিন উভয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের যেসব কথা শুনতো, সন্ধ্যায় অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সেসব খবর নিয়ে গারে ছূরে চলে যেত।
এদিকে হযরত আবু বকরের ক্রীতদাস আমের ইবনে যোহায়রা বকরি চরাতেন রাতের আধার গভীর হলে তিনি বকরি নিয়ে তাদের কাছে যেতেন এবং দুধ দোহন করে দিতেন, উভয়ে তৃপ্তির সাথে দুধ পান করতেন খুব ভোরে আমের বকরি নিয়ে রওয়ানা হতেন তিন রাতেই তিনি এরূপ করেছিলেন (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩-৫৫৪) এ ছাড়া আমের ইবনে যোহায়রা আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরের মক্কা যাওয়ার চিহ্ন সেই পথে বকরী তাড়িয়ে মুছে দিতেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৬)।
কোরাইশদের অভিযান
কোরাইশদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা যখন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছেন, তখন তারা যেন উম্মাদ হয়ে গেল, প্রথমে তারা হযরত আলীর ওপর তাদের ক্রোধ প্রকাশ করল, তাকে টেনে হিঁচড়ে কাবাঘরে নিয়ে গেল এবং কথা আদায়ের চেষ্টা করলো (রহমতুল লিল আলামীন 1ম খন্ড, পৃ. ৯৯) কিন্তু এতে কোন লাভ হল না, এরপর তারা হযরত আবু বকরের বাড়ীতে গেল, দরজা খুললেন হযরত আসমা বিনতে আবু বকর, তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, তোমার আব্বা কোথায়? তিনি বললেন আমি তো জানি না এ জবাব শুনে দুর্বৃত্ত আবু জেহেল আসমাকে এত জোরে চড় দিল যে, তার কানের বালি খুলে পড়ে গেল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৭)।
এরপর কোরাইশ নেতারা এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) কে গ্রেফতার করার জন্য সর্বাত্মক অভিযান চালাতে হবে, মক্কা থেকে বাইরের দিকে যাওয়ার সকল পথে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করল, সেই সাথে ঘোষণা করা হল যে, যদি কেউ হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এবং আবু বকর (রা.) কে বা দুজনের একজনকে জীবিত বা মৃত হাজির করতে পারে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৪) এ ঘোষণা সর্বসাধারণ্যে প্রচারিত হবার পর চারিদিকে বহু লোক বেরিয়ে পড়ল, পায়ের চিহ্ন বিশারদরাও উভয়কে তালাশ করতে লাগল, পাহাড়ের প্রান্তরে ও উঁচু নিচু এলাকায় সর্বত্র চষে বেড়াতে লাগল, কিন্তু এত কিছু করেও কোন লাভ হল না।
অনুসন্ধানকারীরা ছুর পাহাড়ের গুহার কাছেও পৌঁছল, কিন্তু সারা দুনিয়ার বাদশাহ আল্লাহ তায়ালা নিজের ইচ্ছাকেই পূর্ণতা দান করেন, সহীহ বোখারীতে হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে গুহায় ছিলাম, মাথা তুলতেই দেখি, লোকদের পা দেখা যাচ্ছে, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল ওরা কেউ যদি একটুখানি নিচু হয়ে এদিকে তাকায় তবেই আমাদের দেখতে পারবে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবু বকর চুপ কর, আমরা এখানে দুজন নই বরং আমাদের সাথে তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা, অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আবু বকর এমন দুজন সম্পর্কে তোমার কি ধারনা, যাদের তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১৬ ৫৫৮ এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, হযরত আবু বকরের অস্থিরতা নিজের জীবন রক্ষার জন্য ছিল না, তিনি প্রিয় নবী (সা.) এর জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন, তিনি দুর্বৃত্তদের পা দেখতে পাচ্ছিলেন, সে সময় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন এবং বললেন, যদি আমি মারা যাই তবে একজন আবু বকর মারা যাবে, কিন্তু আপনি মারা গেলে সমগ্র উম্মত বরবাদ হয়ে যাবে, এ সময়ে রাসূল বলেছিলেন ভয় পেয়ো না, আবু বকর আল্লাহ পাক আমাদের সঙ্গে রয়েছেন)।
মোটকথা অনুসন্ধানকারীরা তখনই চলে গেল, যখন আল্লাহর রাসূল ও দুর্বৃত্তদের মধ্যে ব্যবধান ছিল খুব কম মাত্র কয়েক কদম।
মদিনার পথে
মক্কার কোরাইশদের নেতৃত্বে পুরস্কারলোভী লোকদের অনুসন্ধান তৎপরতা নিষ্ফল প্রমাণিত হল, ক্রমাগত তিনদিন অনুসন্ধান করে তারা ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ল, তাদের অনুসন্ধান উৎসাহ স্তিমিত হয়ে এলো, এ অবস্থা লক্ষ্য করে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) মদিনার পথে রওয়ানা হলেন, বিভিন্ন পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত লাইছির সাথে আগেই চুক্তি হয়েছিল যে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই দুইজনকে মদিনায় পৌঁছে দেবেন, কোরাইশদের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর থাকলেও এ লোকটি ছিল বিশ্বস্ত, এ কারণে তাকে সওয়ারীও দেয়া হয়েছিল, তাকে বলা হয়েছিল যে, তিনদিন পর সে দুটি সওয়ারীসহ ছুর গুহার সামনে যাবে, সোমবার রাতে ১লা রবিউল আউয়াল মোতাবেক ১৬ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের সোমবার রাতে আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত সওয়ারী নিয়ে এলেন হযরত আবু বকর (রা.) এসময় তার দুটি উটনী দেখিয়ে বললেন, হে রাসূল আপনি এ দুটির মধ্যে একটি গ্রহণ করুন, রাসূল বললেন, হা, তবে মূল্যের বিনিময়ে
এদিকে আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) উটের ওপর বিছানোর বিছানা নিয়ে এলেন কিন্তু বাধার দড়ি আনতে ভুলে গিয়েছিলেন, রওয়ানা হওয়ার সময় হযরত আসমা উটের পিঠে বিছানা রাখার পর দেখা গেল বাধার দড়ি রেখে এসেছেন, তিনি তখন নিজের কোমরবন্দ খুলে সেটি দুভাগ করে ছিড়ে বিছানা উঠের পিঠের সাথে বেধে দিলেন অন্য অংশ নিজের কোমরে বাধলেন, এ কারণে তার উপাধি হয়েছিল যাতুন নেতাকাইন (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩-৫৫৫, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৬)।
এরপর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.)রওয়ানা হলেন, আমের ইবনে যোহায়রাও সঙ্গে ছিলেন, রাহবার আব্দুল্লাহ ইবনে আরিকত উপকূলীয় পথে মদিনা রওয়ানা হলেন।
গারে ছুর থেকে বেরবার পর আবদুল্লাহ প্রথমে ইয়েমেনের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে বহুদূর অগ্রসর হলেন এরপর পশ্চিমাভিমুখী হয়ে সমুদ্রোপকূল ধরে যাত্রা করলেন, পরে এমন এক পথে চলতে লাগলেন যে পথ সম্পর্কে সাধারণ লোকেরা কেউ অবহিত ছিল না, সে পথে উত্তর দিকে অগ্রসর হলেন লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী এ পথে খুব কম সময়েই লোক চলাচল করত।
আল্লাহর রাসূল এ পথে যেসব স্থান অতিক্রম করেছেন ইবনে ইসহাক তার উল্লেখ করেছেন তিনি বলেছেন পথ প্রদর্শক যখন তাদের নিয়ে বের হলেন, তখন মক্কার নিম্ন ভূমি এলাকা দিয়ে অতিক্রম করলেন, উপকূল দিয়ে চলার পর আসফানের নিচু এলাকায় বাক ঘুরলেন, সানিয়াতুল মুররা দিয়ে তারপর লকফ হয়ে লকফের বিস্তীর্ণ ভূমি অতিক্রম করলেন এরপর হেজাজের বিস্তীর্ণ ভূমিতে পৌঁছে এবং সেখান থেকে মুজাহের মোড় দিয়ে শস্যশ্যামল ভূমিতে গমন করেন তারপর যি কেশরার মাঠে প্রবেশ করে জুদাজাদের দিকে যান এবং সেখান থেকে আজদে পৌছেছেন, এরপর তাহানের বিস্তীর্ণ এলাকার পাশ দিয়ে যুযালাম অতিক্রম করেন, সেখান থেকে আবাদি, তারপর ফাজা অভিমুখে রওয়ানা হন তারপর অবতরণ করেন আজরে পরে রকুবার ডান পাশ দিয়ে লানিয়াতুল আযেরে গেলেন এবং রিম উপত্যকায় অবতরণ করেন সবশেষে কোবায় গিয়ে পৌঁছলেন ইবনে হিশাম (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯১, ৪৯২)।
পথের কয়েকটি ঘটনা
এক) সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন গারে ছুর থেকে বেরিয়ে আমরা সারারাত ধরে পথ চলেছি পরদিন দুপুর পর্যন্তও চলেছি ঠিক দুপুরের রাস্তায় কোন পথচারী ছিল না, আমরা এ সময় একটা লম্বালম্বি প্রান্তর দেখতে পেলাম এখানে রোদ নেই আমরা সেখানে অবতরণ করলাম নিজের হাতে আমি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শয়নের জন্য একটি জায়গা সমতল করলাম, এরপর সেখানে চাদর বিছালাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আপনি শয়ন করুন, বিশ্রাম নিন, আমি আশেপাশে খেয়াল রাখছি, নবীজি শুয়ে পড়লেন, আমি চারিদিকে নজর রাখলাম হঠাৎ দেখি একজন রাখাল কিছু সংখ্যক বকরি নিয়ে এদিকেই আসছে, সে প্রান্তরের ছায়ায় আসছিল, আমি তাকে বললাম, তোমার বকরির কি কিছু দুধ হবে? সে বলর হ্যাঁ, আমি বললাম, দোহন করতে পারি? সে বলল হ্যাঁ, এ কথা বলে সে একটি বকরি ধরে আনল, আমি বললাম মাটি খড়কুটো এবং লোম থেকে ওলান একটু পরিষ্কার করে দাও, পরিষ্কার করার পর একটি পেয়ালায় কিচু দুধ দোহন করে দিল, আমার কাছে ছিল একটি চামড়ার পাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওযু এবং পানি পান করার জন্য সেটি রেখেছিলাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে দেখি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন তাকে জাগানো সমীচীন মনে করলাম না, কিছুক্ষণ পর তিনি ঘুম থেকে জাগলেন, দুধের সাথে কিছু পানি মেশালাম, এতে পাত্রের নীচের অংশ ঠান্ডা হয়ে গেল, তাকে বললাম আপনি এ দুধটুকু পান করুন তিনি পান করে খুশী হলেন, এরপর বললেন, এখনো কি রওয়ানা হওয়ার সময় আসেনি? আমি বললাম কেন নয়? এরপর আমরা আবার রওয়ানা হলাম (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৬)।
দুই) এ সফরের সময় হযরত আবু বকর (রা.)রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে বসতেন, পথচারীদের দৃষ্টি তার দিকেই প্রথমে যেত, কারণ তার চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ছিল, তার তুলনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কমবয়সী মনে হচ্ছিল, পথচারীদের কেউ যখন জিজ্ঞাসা করত যে, আপনার সামনে উনি কে? হযরত আবু বকর (রা.) জবাব দিতেন যে, উনি আমাকে পথ দেখান, প্রশ্নকারী বুঝতো যে মরুভূমিতে পথ দেখাচ্ছেন, প্রকৃতপক্ষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নেকী ও কল্যাণের পথের কথাই বোঝাতেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৬)।
তিন) এই সফরের সময় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে মাবাদ খোযায়ার তাবুতে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করেন, এই মহিলা খুব বুদ্ধিমতী নিজের বাড়ীতে আঙ্গিনায় তিনি বসেছিলেন, যাতায়াতকারী পথচারীদের সাধ্যমত পানাহার করাতেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে? মহিলা বললেন, যদি কিছু থাকতো তবে আপনাদের মেহমানদারিতে ত্রুটি করতাম না, কয়েকটি বকরি আছে, যগুলো দূরে চারণভূমিতে রয়েছে, এখন দুর্ভিক্ষের সময় চলছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, বাড়ীর এক পাশে একটি বকরি বাধা আছে, তিনি বললেন, উম্মে মাবাদ, এ বকরি এখানে কেন? উম্মে মাবাদ বললেন, এ বকরি খুব দুর্বল, হাটতে পারে না, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অনুমতি যদি দাও, তবে ওর দুধ দোহন করি? মহিলা বললেন, হা, যদি দুধ দেখতে পান, অবশ্যই দোহন করুন একথার পর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বকরির ওলানে হাত লাগালেন আল্লাহর নাম নিলেন এবং দোয়া করলেন বকরি সাথে সাথে পা প্রসারিত করে দাড়াল, তার ওলানে ভরা দুধ, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বড় পাত্র নিয়ে সেই পাত্রে দুধ দোহন করলেন, সেই পাত্র ভর্তি দুধ এক দল লোক তৃপ্তির সাথে পান করতে পারতো, দুধ দোহনের পর পাত্রে ফেনা ভরে গেল, সঙ্গীদের পান করালেন উম্মে মাবাদ নিজে পান করলেন, এরপর সেই পাত্রে পুনরায় দুধ দোহন করলেন, সেই পাত্র ভর্তি দুধ উম্মে মাবাদের ঘরে রেখে আল্লাহর রাসূল গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলেন।
কিছুক্ষণ পর মহিলার স্বামী বকরির পাল নিয়ে বাড়ী ফিরলো, সেসব বকরিও দুর্বল, পথ চলতে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে ওঠে উম্মে মাবাদের স্বামী আবু মাবাদ দুধ দেখে তো অবাক! জিজ্ঞাসা করলেন, দুধ পেলে কোথায়? সব দুগ্ধবতী বকরি তো আমি চারণ ভূমিতে নিয়ে গেছি, ঘরে তো দুধ দেয়ার মত বকরি ছিল না, উম্মে মাবাদ বললেন, আমাদের কাছে একজন বরকত সম্পন্ন মানুষ এসেছিলেন তার কথা ছিলো এমন এবং তার অবস্থা ছিল এমন, সব শুনে আবু মাবাদ বললেন, এই তো মনে হয় সেই ব্যক্তি, যাকে কোরাইশরা খুঁজে বেড়াচ্ছে, আচ্ছা তুমি তার আকৃতি প্রকৃতি একটু বল, উম্মে মাবাদ অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিচয় বর্ণনা করলেন, সে বর্ণনা ভঙ্গি শুনে মনে হয় শ্রোতা যেন তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, গ্রন্থের শেষ দিকে এইসব বিবরণ উল্লেখ করা হবে, আগন্তুকের ভূয়সী প্রশংসা শুনে সে বলল, আল্লাহর শপথ এই হচ্ছে কোরাইশদের সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে লোকেরা না কথা বর্ণনা করেছে, আমার ইচ্ছা হতে তার প্রিয় সঙ্গীদের একজন হব, যদি কোন পথ পাই তবে অবশ্যই এটা করবো।
এদিকে মক্কার বাতাসে কবিতার ছন্দে কিছু কথা ভেসে আসছিল, যিনি কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, তাকে দেখা যাচ্ছিল না, কবিতার অর্থ নিম্নরূপ,
আল্লাহর পুরস্কার লাভ করুন সেই দুজন
উম্মে মাবাদের বাড়ীতে যারা করলেন পদার্পণ
ভালোয় ভালোয় থেমেছিলেন, যাত্রা করলেন, ফের সফলকাম হয়েছেন
তিনি সঙ্গী যিনি মোহাম্মাদের
হায় কুসাই তোমাদের থেকে
নজিরবিহীন সাফল্য এবং নেতৃত্ব নিলেন আল্লাহ কেড়ে
বুন কাব এর সেই মহিলা আহা কি যে ভাগ্যবান
মোবারক হোক মোমেনিনের জন্য সেই বাসস্থান
বকরির কথা পাত্রের কথা মহিলার কাছে জানতে চাও
সেই বকরিও সাক্ষী দেবে, তোমরা বকরির কাছে যাও
হযরত আসমা (রা.) বলেন আমাদের জানা ছিল না যে, আল্লাহর রাসূল কোনদিকে গেছেন হঠাৎ একটি জিন মক্কায় এসে এসব কবিতা শোনাল, উৎসাহী জনতা সেই জিনকে পাচ্ছিল না, তারা শব্দের পেছনে ছুটে যাচ্ছিল, শব্দ শুনছিল এক সময় সেই শব্দ মক্কার উঁচু এলাকায় মিলিয়ে গেল, সেই কবিতা শুনে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনদিকে গেছেন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তিনি মদিনার পথে রয়েছেন (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৩ ৫৪ বনু খোজাআ গোত্রের অবস্থানের কথা চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এ ঘটনা প্রিয় নবী (সা.) এর মদিনা রওয়ানা হওয়ার দ্বিতীয় দিনে ঘটেছিল)।
চার) পথে ছোরাকা ইবনে মালেক প্রিয় নবী এবং হযরত আবু বকর (রা.) কে অনুসরণ করেছিলেন ছোরাকার বর্ণিত ঘটনা নিম্নরূপ, আমি আমার কাওম বনি মুদলেজের এক মজলিসে বসেছিলাম এমন সময় একজন লোক এসে আমাদের কাছে দাড়াল, কিছুক্ষণ পর বসল, সেই লোকটি বলল, ওহে ছোরাকা একটু আগে আমি উপকূলের কাছে কয়েকজন লোক দেখলাম, আমার ধারনা তিনি মোহাম্মাদ এবং তার সাথী ছোরাকা বলল, আমি বুঝতে পারলাম যে এরাই তারা কিন্তু যে লোকটি খবর দিয়েছিল, তার কাছে মনোভাব গোপন রাখার জন্য বললাম না না ওরা তারা নয় তুমি যাদের দেখেছ তাদের তো আমরাও দেখেছি তারা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে গেছে, এরপর আমি মজলিসে কিছুক্ষণ বসে কাটালাম, তারপর ঘরের ভেতর গিয়ে আমার দাসীকে আমার ঘোড়া বের করতে বললাম, ঘোড়া বের করার পর তাকে বললাম, টিলার পেছনে নিয়ে যাও এবং সেখানে অপেক্ষা কর, আমি আসছি, এরপর আমি তীর নিলাম, ঘরের পেছন দিয়ে বাইরে বের হলাম, তীরের এক প্রান্ত ধরে অপর প্রান্ত মাটিতে হেঁচড়ে আমি ঘোড়ার কাছে গেলাম ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলে ঘোড়া আমাকে নিয়ে ছুটতে লাগল, এক সময় আমি উপকূলীয় এলাকায় তাদের কাছে এসে পৌঁছলাম, হঠাৎ ঘোড়া লাফাতে শুরু করল, আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলাম, পুনরায় আমি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করলাম এবং তূন এর দিকে হাত বাড়ালাম এবং পাশার তীর বের করে জানতে চাইলাম, তাকে বিপদে ফেলতে পারব কিনা, কিন্তু যে তীর বের হল সেটি আমার অপছন্দনীয় আমি লক্ষ্য করলাম যে, আল্লাহর রাসূল নির্বিকারভাবে একাগ্রচিত্তে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন, কোনদিকেই তার খেয়াল নেই, আবু বকর সিদ্দিক পেছন ফিরে আমাকে দেখছিলেন হঠাৎ আমার ঘোড়ার সামনের পা দুখানি মাটিতে দেবে গেল, হাঁটু পর্যন্ত দেবে গেল এক সময় আমি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলাম, ঘোড়াকে শাসন করলাম ঘোড়া উঠতে চাইল, অনেক কষ্টে ঘোড়া নিজের পা উপরে তুলল, ঘোড়া পা তুললে তার পায়ের নিশানা থেকে ধোয়ার মতো ধুলো উড়ছিল, আমি তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করলাম, এবার ও এমন তীর বের হল, যা আমি চাইনি, এরপর আমি স্বাভাবিক কন্ঠে তাদের ডাক দিলাম, তারা থামলেন, ঘোড়ার পিঠে করে আমি তাদের কাছে পৌঁছলাম যখনই আমি তাদের থামালাম, তখনিই হঠাৎ আমার মনে হল আল্লাহর রাসূলই বিজয়ী হবেন, আমি তখন আল্লাহর রাসূলকে বললাম, আপনার স্বজাতীয়রা আপনার জীবনের পরিবর্তে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, সাথে সাথে মক্কার লোকদের সংকল্প সম্পর্কেও আমি তাকে অবহিত করলাম, তাকে পথের কিছু সম্বলও দিতে চাইলাম কিন্তু তিনি কিছুই নিলেন না এবং আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসাও করলেন না, শুধু বললেন আমাদের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা কর, তাকে বললাম, আপনি আমাকে নিরাপত্তা পরোয়ানা লিখে দিন, আল্লাহর রাসূল তখনই আমের ইবনে ফোহায়রাকে আদেশ দিলেন আমের নিরাপত্তার পরোয়ানা স্বরূপ এক টুকরো চামড়ায় কিছু কথা লিখে আমাকে দিলেন, এরপর আল্লাহর রাসূল সামনে অগ্রসর হলেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৪, বনি মুদলেজদের জন্মস্থান ছিল বাবেগের কাছে ছোয়াক যে সময় অনুসরণ করছিল, সে সময় প্রিয় নবী (সা.) কোদায়েদ থেকে উপরের দিকে উঠছিলেন, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৩ গারে ছুর থেকে রওয়ানা হওয়ার তৃতীয় দিনে এ ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে হয়)।
এ ঘটনা সম্পর্কে হযরত আবু বকরের একটি বর্ণনা রয়েছে তিনি বলেন, আমরা রওয়ানা হওয়ার পর কওমের লোকেরা আমাদের তালাশ করছিল, কিন্তু ছোরাকা ইবনে মালেক ইবনে জুশুম ছাড়া কেউ আমাদের দেখতে পায়নি ছোরাকা ঘোড়ায় চড়ে এসেছিল, আমি বললাম, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি লোক আমাদের পিছু লেগেছে, সে কাছাকাছি এসে পড়েছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথে বললেন, লা তাহযান ইন্নাল্লাহ মাআনা অর্থাৎ ভয় পেয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১৬)।
ছোরাকা মক্কায় ফিরে এসে দেখতে পেল তখনো অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে, আল্লাহর রাসূলকে সে যে পথে দেখেছে, সেদিকে কিছু লোককে দেখে ছোরাকা বলল, ওদিকে তোমাদের যে কাজ ছিল সেটা হয়ে গেছে, দিনের শুরুতে যে লোক ছিল সন্ধানকারীদের একজন দিনের শেষে সেই ব্যক্তিই হয়ে গেল আমানতদার (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১৬)।
পাঁচ) পথে বুরাইদা আসলামির সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ হল, এই লোক ছিল তার কওমের সর্দার, কোরাইশদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে এই লোকও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) এর সন্ধানে বের হয়েছিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলার সাথে সাথে তার মনে ভাবান্তর হল, তিনি নিজ গোত্রের ৭০জন লোকসহ সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করলেন এরপর পাগড়ি খুলে বর্শায় বেধে দোলাতে দোলাতে সুসংবাদ শোনালেন যে, শান্তির বাদশাহ, সমঝোতার পথিকৃৎ, পৃথিবীকে ন্যায় বিচার ও ইনসাফে পরিপূর্ণ করার অগ্রপথিক আগমন করছেন (রহমাতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ.১০১)।
ছয়) মদিনা যাওয়ার পথে হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়ামের (রা.) সাথে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখা হল, তিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া থেকে ফিরছিলেন, তিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) কে কিছু জিনিস উপহার দেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৪)।
কোবায় অবস্থান
নবুয়তের চতুর্দশ বছরের ৪ই রবিউল আউয়াল অর্থাৎ ১লা হিজরি মোতাবেক ২৩শে সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের সোমবার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোবায় অবতরণ করেন (রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০২ সেই তারিখে প্রিয় রাসূল (সা.) এর বয়স পুরোপুরি তেপ্পান্ন বছর পূর্ণ হয়েছিল, যারা হস্তী যুদ্ধের ঘটনার বছর হিসেবে ৯ই রবিউল আউয়াল ৪১ সালের হিসাবে নবুয়তের হিসাব করেন, তাদের হিসাব মতে এ তারিখে নবুয়তের ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছিল, আর যারা হস্তী যুদ্ধের ঘটনার হিসাব ৪৯ সালের রমযান মাসে তার নবুয়তের শুরু মনে করেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী এ তারিখে তার নবুয়তের বয়স ১২ বছর ৫ মাস ১২ দিন বা ২২ দিন)।
হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) বলেন, মদিনার মুসলমানরা মক্কা থেকে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওয়ানা হওয়ার খবর জেনেছিলেন এ কারণে মদিনার বাইরে হাররার নামক স্থানে এসে প্রতিদিন তারা অপেক্ষা করতেন দুপুরের রোদ অসহ্য হয়ে উঠলে ফিরে যেতেন একদিন এমনি করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সবাই ঘরে ফিরে গেছেন এ সময় একজন ইহুদী ব্যক্তিগত কাজে একটি টিলার উপর উঠেছিল, হঠাৎ সে সাদা কাপড়ের তৈরি চাঁদোয়া লক্ষ্য করল, আনন্দের আতিশয্যে সে চিৎকার করে বলতে লাগল, শোন মুসলমানরা, শোন, তোমরা যার জন্যে প্রতিদিন অপেক্ষা করছিলে, তিনি আসছেন একথা শোনা মাত্রই মুসলমানরা ছুটে এল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বেরিয়ে পড়ল (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫)।
ইবনে কাইয়েম বলেন, ঘোষণার সাথে সাথে বনি আমর ইবনে আওফের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল এবং তকবির ধ্বনি শোনা গেল, মুসলমানরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভ্যর্থনা জানালো এবং চারপাশে ভিড় করতে লাগল, সে সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন নীরব, তার ওপর তখন কোরআনের এই আয়াত নাযিল হচ্ছিল, কিন্তু তোমরা যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে একে অপরের পৃষ্ঠপোষকতা কর, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালাই তার বন্ধু, জিবরাঈল ও সৎকর্মপরায়ন মোমেনরা উপরন্তু অন্যান্য ফেরেশতারাও তার সাহায্যকারী, (সুরা তাহরীম, আয়াত ৪)।
হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) বলেন, লোকদের সাথে মিলিত হওয়ার পর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে ডানদিকে অগ্রসর হলেন এবং বনি আমর ইবনে আওফের বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হলেন, এ দিন ছিল সোমবার, মাস ছিল রবিউল আউয়াল, হযরত আবু বকর (রা.) আগন্তুকদের অভ্যর্থনা জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপচাপ বসেছিলেন।
আনসারদের মধ্যে যারা ইতিপূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেননি তারা হযরত আবু বকর (রা.) কে সালাম করছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গায়ের উপর ঢলে পড়া সূর্যের কিরণ এসে পড়লে হযরত আবু বকর (রা.) একখানি চাদর দিয়ে তাকে ছায়া করে দাঁড়ালেন, এতে সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পারলেন(সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যর্থনার জন্য মদিনায় জনতার ঢল নামলো, এটি ছিল এক ঐতিহাসিক দিন মদিনার মাটি এ ধরনের দৃশ্য অতীতে কোনদিন দেখেনি, ইহুদীরাও প্রতিশ্রুত নবীর আগমন প্রত্যক্ষ করল, বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে আল্লাহ দক্ষিণ দিক থেকে তার আগমন ঘটাবেন এবং যিনি পবিত্র, তিনি ফারান পর্বত থেকে আগমন করবেন(বাইবেল হাবকুক অধ্যায় পৃ. ৩)।
রাসূল মদিনায় কুলসুম ইবনে হাদাম, মতান্তরে সায়াদ ইবনে খায়ছামার ঘরে অবস্থান করেন তবে প্রথম তথ্যটি অধিক নির্ভরযোগ্য।
ইতিমধ্যে হযরত আলী (রা.) মক্কায় তিনদিন অবস্থান করে মানুষের আমানতসমূহ বুঝিয়ে দিয়ে মদিনায় আসেন(যাদুল মায়াদ, ১য় খন্ড, পৃ. ৫৪ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৩, রহমতুল লিল আলামিন)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোবায় মোট চারদিন (এটা ইবনে ইসহাকের বর্ণনা, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৪ দেখুন, এই বর্ণনাই আল্লামা মনসুরপুরী গ্রহন করেছেন, রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০২, কিন্তু সহীহ বোখারীর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, প্রিয় রাসূল সেখানে ২৪ রাত অবস্থান করেন, ১ম খন্ড, পৃ. ৬১, অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে ১০ রাতের চেয়ে কিছু বেশীর কথা রয়েছে, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫ তৃতীয় এক বর্ণনায় ১৪ রাতের কথা রয়েছে, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৬০ ইবনে কাউয়েম শেষোক্ত বর্ণনা গ্রহন করেছেন, কিন্তু ইবনে কাউয়েম ব্যাখ্যা করেছেন যে, প্রিয় নবী সোমবার কোবায় পৌঁছেছেন এবং শুক্রবার সেখান থেকে রওয়ানা হয়েছেন, যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫৪-৫৫ সোমবার ও শুক্রবার যদি পৃথক দুই সপ্তাহের নেয়া হয় তবে পথের দিনগুলো ছাড়া মোট ১০ দিন হয়, পথের সময়সহ ১২ দিন এমতাবস্থায় ১৪ দিন কি করে হবে?) সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার অবস্থান করেন, কারো কারো মতে ১০ দিন কারো কারো মতে রওয়ানা ও পথের কয়েকদিন ছাড়া কোবায় ২৪ দিন অবস্থান করেন এ সময়ে তিনি মসজিদে কোবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন এবং সেই মসজিদে নামায আদায় করেন, নবুয়ত প্রাপ্তির পর এটি ছিলো প্রথম মসজিদ, তাকওয়ার ওপর এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল, পঞ্চম, দ্বাদশ বা ২৬ তম দিনের শুক্রবারে তিনি আল্লাহর নির্দেশে সওয়ারীর ওপর আরোহণ করেন, রওয়ানা হওয়ার আগে তিনি তার মামার গোত্র বুন নাজ্জাহকে খবর পাঠালে তারা তলোয়ার সজ্জিত হয়ে হাজির হল, তিনি তাদের সাথে নিয়ে মদিনার পথে রওয়ানা হলেন, বনু সালেম ইবনে আওফের জনপদে পৌছার পর জুমার নামাযের সময় হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকালয়ে জুমার নামায আদায় করলেন, জুমার জামাতে একশ মুসল্লি হাযির হয়েছিলেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫, ৫৬০ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৫ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৪ রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০২), এখনো সেখানে এ মসজিদ রয়েছে।
রাসূলুল্লাহর মদিনায় প্রবেশ
জুমার নামায আদায়ের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা গমন করেন, সেদিন থেকে ইয়াসরেবের নাম হয়েছে মদীনাতুর রাসূল, বা শহরে রাসূল সংক্ষেপে মদিনা এই দিন ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় দিন চারদিকে আল্লাহর প্রশংসা ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল আনসার শিশুরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এ গান গাইছিল,
দক্ষিণের সেই পাহাড় থেকে, উদয় হল মোদের ওপর চতুর্দশীর চাঁদ
শোকরিয়া আদায় করা আল্লাহর, কর্তব্য মোদের সকলের
তোমার আদেশ পালন আর আনুগত্য, কর্তব্য মোদের সকলের, পাঠিয়েছেন তোমায় আল্লাহ সর্বশক্তিমান (কবিতার এ তরজমা আল্লামা মনসুরপুরী করেছেন আল্লামা ইবনে কাইয়েম লিখেছেন এই কবিতা তবুক থেকে রাসূলের ফেরার সময় আবৃত্তি করা হয়েছিল, যিনি বলেন যে, মদিনায় নবী (সা.) এর প্রবেশের সময়েই শুধু এ কবিতা পড়া হয়েছে একথাকে তিনি ভুল বলেছেন, যাদুল মায়াদ, ৩য় খন্ড, পৃ.১০ তবে আল্লামা ইবনে কাইয়েম ভুল বললেও নির্ভরযোগ্য যুক্ত প্রমাণ দিতে পারেন নি, পক্ষান্তরে আল্লামা মনসুরপুরী একথাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, এ কবিতা মদিনায় প্রবেশের সময় পড়া হয়েছিল, তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য যুক্ত প্রমাণও রয়েছে দেখুন রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০৬)।
আনসাররা ধনী বা বিত্তশালী ছিলেন না, কিন্তু সবাই চাচ্ছিলেন যে, নবী তার বাড়ীতেই অবস্থান করবেন, যে এলাকা দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন সেখানের লোকেরাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উটের রশি ধরে তার বাড়ীতে আসার আবেদন জানাতেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দিলেন যে, উটনীর পথ ছেড়ে দাও, সে আল্লাহর তরফ থেকে আদেশ পেয়েছে এরপর উটনী ইচ্ছামত চলতে লাগলো এবং বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী রয়েছে সেখানে গিয়ে থামল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটনী থেকে নামলেন না, উটনী সামনে কিছুদূরে এগিয়ে গেল, এরপর পুনরায় ঘুরে আগের জায়গায় ফিরে এসে বসে পড়ল এটা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নানাদের মহল্লা অর্থাৎ বনু নাজ্জারদের মহল্লা উটনীকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়ায় সে বনু নাজ্জার এলাকায় থেমে নানাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মনে মনে এটাই চাচ্ছিলেন এবার বনু নাজ্জার গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়ীতে নিয়ে তাকে যাওয়ার জন্য আবেদন নিবেদন শুরু করল, আবু আইয়ুব আনসারী এগিয়ে এসে উটের লাগাম ধরলেন এবং তার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মানুষ তার উটের পালানের সঙ্গে রয়েছে এরপর হযরত আসআদ ইবনে যোরারাহ এসে উটনীর লাগাম ধরলেন উটনী তখন থেকেই তার নিয়ন্ত্রণেই থাকল (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০৬)।
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাদের মধ্যে কার ঘর সবচেয়ে কাছে? হযরত আবু আইয়ুব আনসারী বললেন, আমার ঘর হে আল্লাহর রাসূল, এই হচ্ছে আমার ঘর, আর এই আমার দরজা, আল্লাহর রাসূল বললেন যাও আমাদের জন্য কাইলুলা অর্থাৎ মধ্যাহ্নর বিশ্রামের ব্যবস্থা কর, আবু আইয়ুব বললেন, আপনারা উভয়ে আসুন, আল্লাহ তায়ালা বরকত দেবেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৬)।
কয়েকদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী উম্মুল মোমেনীন হযরত সাওদা, দুই কন্যা ফাতেমা ও উম্মে কুলসুম, ওসামা ইবনে যায়েদ এবং উম্মে আরমানও এসে পড়লেন, এদের সবাইকে হযরত আবু বকরের পরিবারের সাথে আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর মদিনায় নিয়ে আসেন, হযরত আয়েশা (রা.) ও এদের সঙ্গে ছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক কন্যা হযরত যয়নব হযরত আবুল আস এর কাছে রয়ে গেলেন, তিনি তখন আসতে দেননি, তিনি বদরের যুদ্ধের পর আগমন করেন (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫৫)।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয় রাসূল (সা.) মদিনায় আসার পর হযরত আবু বকর এবং হযরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হলেন, আমি তাদের কাছে গিয়ে বললাম, আব্বাজান আপনি কেমন আছেন? বেলাল (রা.) আপনি কেমন আছেন? হযরত আবু বকরের জ্বর এলে তিনি এ কবিতা আবৃতি করতেন,
পরিবারের সদস্যদের সবাই বলে সুপ্রভাত
কেই ভাবে না জুতোর ফিতার চেয়েও তার মরণ কাছে
হযরত বেলাল (রা.) কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তার সুরেলা কন্ঠে আবৃত্তি করলেন,
জানতাম যদি রাত্রি যাপন করবো আমি মক্কার প্রান্তরে চারিপাশে রবে ইযখিরও জালির (ঘাস), মার্জিন্নার ঝর্ণার ধারে যেতে পারব কিনা জানি না, সামা আর তোফায়েল পাহাড় দেখতে কি পাব?
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি গিয়ে এ খবর দিলাম, তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, মক্কা যেমন আমাদের কাছে প্রিয় ছিল, মদিনাকেও তেমন প্রিয় করে দাও, বরঞ্চ মদিনার পরিবেশ ও আবহাওয়া তার চেয়ে বেশী স্বাস্থ্যকর করে দাও, এখানে শস্যের মধ্যে বরকত দাও, এখান থেকে অসুখ জাহফায়ে সরিয়ে নাও (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৮৮-৫৮৯) আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীর দোয়া কবুল করলেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন হল।
এ পর্যন্ত প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের এক অংশ এবং ইসলামী দাওয়াতের মক্কী যুগ পূর্ণ হয়ে গেল।
আমি যদি এদের (আমার) জমিনে (রাজনৈতিক) প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে, (অবশ্য) সব কাজের চূড়ান্ত পরিণাম কিন্তু আল্লাহ তায়ালাই এখতিয়ার ভূক্ত (সূরা হজ্জ ৪১)।
সূত্রঃ- আর-রাহিকুল মাখতুম
১৩ তম খন্ড
No comments