মহানবীর ইয়াসরাবের দশ বছরঃ ফকীরের বেশে বাদশাহ। রাসূল (সাঃ) এর জীবনী। ১৩ তম খন্ড

মাদানি জীবনের বিভিন্ন ভাগ
হিজরতের সময় মদিনার সার্বিক অবস্থা

এক) প্রথমত মুসলমানদের ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, একই সাথে বহিঃশত্রুরা মদিনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে মদিনার ওপর হামলা চালিয়েছিল, ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত এ পর্যায় অব্যাহত ছিল।
দুই) দ্বিতীয়ত, পৌত্তলিকদের সাথে তাদের সন্ধি হয়েছিল, অষ্টম হিজরির রমযান মাসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যম পর্যায়ের সমাপ্তি হয়, এ পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের শাসনকর্তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়।
তিন) তৃতীয়ত, আল্লাহর দ্বীনে মানুষ দলে দলে প্রবেশ করতে থাকে, এ পর্যায়ে মদিনায় বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং গোত্রের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের শেষ অর্থাৎ একাদশ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে এ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন তিনটি গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল, যাদের ক্ষেত্রে ভিন্নতার প্রাধান্যই ছিল বেশী। এরা হচ্ছে,
এক) আল্লাহর মনোনীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও আল্লাহর পথে ধন প্রাণ উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর জামাত।
দুই) মদিনার প্রাচীন এবং প্রকৃত অধিবাসীদের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী পৌত্তলিকরা যারা তখনো ঈমান আনেনি।
তিন) ইহুদী সম্প্রদায় ও সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা ছিল এই যে, মদিনার অবস্থা ছিল মক্কার অবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক, মক্কায় যদিও ছিলেন একই কালেমার অনুসারী এবং তাদের উদ্দেশ্যেও ছিল অভিন্ন, কিন্তু তারা বিভিন্ন পরিবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, তারা ছিলেন শঙ্কিত, দুর্বল ও অবমাননার সম্মুখীন, তাদের হাতে কোন ক্ষমতা ছিল না, সকল ক্ষমতা ছিল শত্রুদের হাতে, যেসব উপাদানের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে একটি সমাজ গঠন করা হয়, মক্কায় মুসলমানদের হাতে তার কিছুই ছিল না, কিসের ভিত্তিতে মুসলমানরা সমাজ গঠনে সক্ষম হবে? এ কারণে দেখা যায় যে, মক্কায় অবতীর্ণ কোরআনের সূরা সমূহে শুধু ইসলামী দাওয়াতের বিবরণ দেয়া হয়েছে, এ সময়ে এমন সব আহকাম অবতীর্ণ হয়েছে যার উপর প্রতিটি মানুষই পৃথক পৃথক আমল করতে পারে।
পক্ষান্তরে মদিনায় যাওয়ার পর প্রথম দিন থেকেই ক্ষমতার বাগডোর ছিল মুসলমানদের হাতে, মুসলমানদের ওপর অন্য কারো আধিপত্য ছিল না, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধ, সন্ধিসহ তাদের অনেক আইন কানুনের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল, সেটা ছিল হালাল হারাম মেনে চলা ও উন্নত চরিত্রের প্রতিফলনের মাধ্যমে উন্নত জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের সময় মুসলমানদের একটি নয়া সমাজ অর্থাৎ ইসলামী সমাজ গঠনের প্রত্যক্ষ আদর্শ গড়ে তোলা, সেই সমাজ হবে একটি আদর্শ সমাজ, মূর্খতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত সেই সমাজে জাহেলী সমাজের কোন চিহ্ন থাকবে না সেই সমাজ হবে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামের দাওয়াতের জন্য মুসলমানরা যে দশ বছর যাবত নান ধরনের দুঃখকষ্ট নির্যাতন নিষ্পেষণ সহ্য করেছিল তা বস্তবতা প্রমাণের সময় তখন এসে পড়েছিল।
এ ধরনের কোন সমাজ একদিন একমাস বা এক বছরে গঠন করা সম্ভব নয় বরং এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময় যাতে করে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে নির্দেশ প্রদান করা যায় এবং আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, নির্দেশ ও আইন কানুন বাস্তবায়ন মুসলমানদের প্রশিক্ষণ ও পথনির্দেশের দায়িত্ব ছিল সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, তিনিই উম্মীদের মধ্য থেকে তাদের একজনকে রসূলরূপে পাঠিয়েছেন যিনি তাদের কাছে তার আয়াত তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদের কেতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন, অথচ ইতিপূর্বে এরাই ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত (সূরা জুময়া, আয়াত-২)।
এদিকে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা এরূপ ছিল যে, তারা সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মনোযোগি থাকতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আদেশ প্রদান করতেন সেই আদেশ যথাযথভাবে পালন করে সন্তুষ্টি লাভ করতেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন তার আয়াত নিদর্শন তাদের কাছে পাঠ করা হয় তখন সেটা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে।
এসব বিষয় আমাদের এখানে আলোচনার পর্যায়ভুক্ত নয়, এ কারণে আমরা সেসব বিষয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী যথাস্থানে আলোচনা করব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের ফলে সৃষ্ট বিষয়গুলো ইসলামের দাওয়াত এবং রেসালাতে মোহাম্মদীই হচ্ছে এখানে মুখ্য বিষয়, কিন্তু এটাও কোন হুজুগপূর্ণ বিষয় নয়, বরং এটা একটা পৃথক এবং স্থায়ী বিষয়, এছাড়া অন্য কিছু বিষয়ও ছিল যেসব বিষয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন ছিল সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ,
মুসলমানদের মধ্যে দুই প্রকারের লোক ছিল, এক প্রকারের লোক যারা ছিলেন নিজেদের জমি, বাড়ি-ঘর, এবং অর্থ সম্পদের মধ্যে নিশ্চিন্তেই জীবন যাপন করছিলেন, এরা ছিল আনসার গোত্রের লোক, এদের পরস্পরের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে শত্রুতা চলে আসছিল, এদের পাশাপাশি আরেকটি দলে ছিলেন মোহাজের, তারা উল্লিখিত সুবিধা থেকে ছিলেন বঞ্চিত, তারা কোন না কোন উপায়ে খালি হাতে মদিনা পৌঁছেছিলেন, তাদের থাকার কোন ঠিকানা ছিল না, ক্ষুধা নিবারণের জন্য কোন কাজও ছিল না, সঙ্গে টাকা পয়সা বা অন্য কোন জিনিসও ছিল না, যা দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত ব্যবস্থা করা যায়, পরাশ্রয়ী এসকল মোহাজেরের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছিল, কেননা কোরআনের ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল যে, আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যারা ঈমান রাখে তারা যেন হিজরত করে মদিনায় চলে আসে, এটা তো জানাই ছিল যে, মদিনায় তেমন কোন সম্পদও নেই এবং আয় উপার্জনের উল্লেখযোগ্য উপায় উপকরণও নেই ফলে মদিনার অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সেই সঙ্কটময় সময়ে ইসলামের শত্রুরা মদিনাকে অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করে এতে আমদানির পরিমাণ কমে যায় এবং পরিস্থিতি আরো গুরুতর হয়ে পড়ে।
অন্য একটি দলে ছিল মদিনার অমুসলিম অধিবাসী তাদের অবস্থা মুসলমানদের চেয়ে ভাল ছিল না, কিছু অমুসলিম পৌত্তলিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সন্দেহের মধ্যে ছিল এবং নিজেদের পৈতৃক ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তনে দ্বিধান্বিত ছিল কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের মনে কোন প্রকার শত্রুতা বা বিদ্বেষ ছিল না, এ ধরনের লোকেরা অল্পকালের মধ্যেই ইসলাম গ্রহন করে সত্যিকার মুসলমানে পরিণত হল।
পক্ষান্তরে কিছু পৌত্তলিক এমন ছিল, যারা মনে মনে নিজেদের বুকের ভেতর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করত, কিন্তু মুখোমুখি এসে দাঁড়াবার বা মোকাবেলা করার সাহস তাদের ছিল না, বরং পরিস্থিতির কারণে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসার ভাব দেখাতো এবং সরলতার অভিনয় করত, এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই, এখানে উল্লেখ্য যে, বুআসের যুদ্ধের পর আওস ও খাযরাজ গোত্র তাকে নিজেদের নেতা করার ব্যাপারে একমত হয়েছিল।
এর আগে অন্য কোন ব্যাপারে এ দুটি গোত্র ঐকমত্য উপনীত হয়নি, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে বাদশাহ ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়ে আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা বর্ণাঢ্য মুকুট তৈরি করেছিল, এমনি সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে পৌঁছুলেন, জনগণের দৃষ্টি তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইযের পরিবর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নিবদ্ধ হলো, এ কারণে আবদুল্লাহ মনে করলো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই তার বাদশাহি কেড়ে নিয়েছেন, ফলে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সে মনে মনে প্রচন্ড ঘৃণা পোষণ করত, তা সত্ত্বেও বদরের যুদ্ধের পর আবদুল্লাহ লক্ষ্য করল যে, পরিস্থিতি তার অনুকূলে নয়, এ অবস্থায় শেরেকের উপর অটল থাকলে সে পার্থিব সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে এ কারণে সে দৃশ্যত ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করল, কিন্তু মনে মনে সে ছিল কাফের ফলে মুসলমানদের ক্ষতি করার কোন সুযোগই সে হাতছাড়া করেনি, তার সাথী ছিল ওই সকল লোক, যারা এই মোনাফেকের নেতৃত্বে বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, কিন্তু সেসব সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হল, ফলে এরাও মুসলমানদের ক্ষতি করতে সব সময় প্রস্তুত থাকতো, মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহর পরিকল্পনা এরা বাস্তবায়িত করত, এই উদ্দেশ্যে তারা মদিনার কিছুসংখ্যক সরলপ্রাণ যুবক মুসলমানকেও নিজেদের দলে এনে ক্রীড়ানক হিসাবে ব্যবহার করত।
তৃতীয় শ্রেণির লোক ছিল এখানকার ইহুদী, এরা আশোরী এবং রোমীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হেজাযে আশ্রয় নিয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে এরা ছিল হিব্রু, হেজাযে আশ্রয় নেয়ার পর চালচলন, কথাবার্তা ও পোশাক পরিচ্ছেদে তাদেরও আরব বলে মনে মনে হত, এমনকি তাদের গোত্র এবং মানুষের নামকরণও ছিল আরবদের মতো, আরবদের সাথে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু এতসব সত্ত্বেও তারা তাদের বংশ গৌরব ভুলতে পারেনি, তারা নিজেদের ইসরাইলী অর্থাৎ ইহুদী হওয়ার মধ্যেই গৌরব বোধ করত, আরবদের তারা মনে করত খুবই নিকৃষ্ট, ওদেরকে উম্মী বলে গালি দিত, এই উম্মী বলতে তারা বোঝাতো নির্বোধ, মুখ, জংলী, নিচু, এবং অচ্ছুৎ, তারা বিশ্বাস করত যে, আরবদের ধন সম্পদ তাদের জন্যে বৈধ, যেভাবে ইচ্ছা তারা ভোগ ব্যবহার করতে পারবে, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা বলে, নিরক্ষরদের প্রতি আমাদের কোন বাধ্য বাধকতা নেই (আলে ইমরান, আয়াত ৭৫)।
অর্থাৎ উম্মীদের অর্থ সম্পদ ভোগ ব্যবহার আমাদের জন্য দোষণীয় নয়, এসব ইহুদীর মধ্যে তাদের দ্বীনের প্রচার প্রসারের ব্যাপার কোন প্রকার তৎপরতা লক্ষ্য করা যেত না, ভাগ্য গণনা, যাদু, ঝাড়ফুঁক এ সবই ছিল তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অংশ এ সব কিছুর মাধ্যমেই তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী পণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক নেতা মনে করত।
ইহুদীরা ধন সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে ছিল দক্ষ, তারা খাদ্য সামগ্রী খেজুর মদ এবং পোশাকের ব্যবসা করতো, তারা খাদ্য সামগ্রী পোশাক এবং মদ আমদানি করতো, এবং খেজুর রফতানি করতো এছাড়াও আরো নানা ধরনের কাজ কর্মে তারা নিজেদের ব্যস্ত রাখত, ব্যবসা বাণিজ্যের মালামালের মধ্যে তারা আরবদের কাছ থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ মুনাফা করত, শুধু তাই নয় তারা সুদও খেত, তারা আরবের শেখ সর্দারদের সুদের ওপর টাকা ধার দিত, ধার নেয়া অর্থ আরব শেখ ও সর্দাররা খ্যাতি লাভের জন্য তাদের প্রশংসাকারী কবিদের জন্য উদারভাবে ব্যয় করত, এদিকে ইহুদীরা সুদের ওপর অর্থ ধার দেয়ার বিনিময়ে বিভিন্ন জিনিস বন্ধক রাখত, এতে কয়েক বছরেই ইহুদীরা সেসব সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত।
ইহুদীরা ষড়যন্ত্র এবং যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ছিল তুখোড়, তারা প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে শত্রুতার বীজ বপন করত, একটি গোত্রকে অন্য গোত্রের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে এবং লেলিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তারা ছিল সদা তৎপর, অথচ যারা পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হত তারা ঘুণাক্ষরেও এসব বুঝতে পারত না পরবর্তী সময়ে বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগে থাকতো, যুদ্ধের আগুন নিভু নিভু হয়ে আসছে লক্ষ্য করলে ইহুদীরা পুনরায় তৎপর হয়ে উঠতো, বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে পরস্পরকে লেলিয়ে দিয়ে ইহুদীরা চুপচাপ বসে থাকত, তারা আরবদের ধ্বংসের দৃশ্য দেখত, সে সময়েও মোটা সুদে অর্থ ধার দিত, মূলধনের অভাবে যুদ্ধ বন্ধ হোক সেটা তারা চাইত না, এতে ইহুদীরা দুই প্রকারে লাভবান হত, একদিকে নিজেদের সম্প্রদায়কে নিরাপদ রাখত, অন্যদিকে সুদের ব্যবসা জমজমাট রাখত, সুদের ওপর সুদ হিসাব করেই তারা অর্থ উপার্জন করত।
মদিনার প্রধান তিনটি ইহুদী গোত্র
এক) বনু কাইনুককা, এরা ছিল খাযরাজ গোত্রের মিত্র এরা মদিনার ভেতরেই বসবাস করত।
দুই) বনু নাযির।
তিন) বনু কোরাইযা এদুটি গোত্র ছিল আওস গোত্রের মিত্র, মদিনার শহরতলী এলাকায় এরা বসবাস করত।
দীর্ঘকাল যাবত আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে যুদ্ধের আগুন জ্বলছিল, বুআস এর যুদ্ধে এরা নিজ নিজ মিত্র গোত্রের সমর্থনে নিজেরাও যুদ্ধে শরীক হত, ইহুদীরা ইসলামের প্রতি শত্রুতা পোষণ করেছিল, এটাই ছিল স্বাভাবিক এই ধরনের শত্রুতার স্বভাব তাদের চরিত্রে বহুকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বংশোদ্ভূত ছিলেন না, কাজেই তাদের আভিজাত্যের গৌরব কোন গুরুত্ব পাচ্ছিল না, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি তাদের মধ্যে থেকে আবির্ভূত হতেন তাহলে তারা মনে শান্তি পেত, তাছাড়া ইসলামের দাওয়াত ছিল একটি বলিষ্ঠ দাওয়াত, এতে মানুষ শত্রুতা ভুলে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়, ন্যায়নীতি, আমানতদারী এবং হালাল হারামের বিচার বিবেচনা করা হয়, এর অর্থ হলো, এবার ইয়াসরেবের বিবদমান গোত্রসমূহের মধ্যে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি সৃষ্টি হবে, এর ফলে ইহুদীদের বাণিজ্যিক তৎপরতা হ্রাস পাবে তাদের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি সুদভিত্তিক সম্পদ থেকে তারা বঞ্চিত হবে এমনকি এ ধরনের আশঙ্কা ছিল যে, এসব গোত্র আত্মসচেতন হবে এবং ইহুদীরা কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই যেসব অর্থ সম্পদ গ্রহণ করেছে ওরা সেসব ফিরিয়ে নেবে, অর্থাৎ সুদের ব্যবসায় বিভিন্ন গোত্রের যেসব বাগান ও জমি, ইহুদীরা দখল করেছে, সেসব ফিরিয়ে নেবে।
ইয়াসরেবে ইসলাম প্রচারের সূচনাতেই ইহুদীরা এসব কিছুই নিজেদের চিন্তার মধ্যে এনেছিল, এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আসার সময় থেকেই মদিনার ইহুদীরা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি প্রবল শত্রুতা পোষণ করত, তবে সেই শত্রুতার প্রকাশ তারা তখনই নয়, একটু দেরীতে করেছে ইবনে ইসহাক বর্ণিত একটি ঘটনায় এ অবস্থার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন যে, উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতার (রা.) থেকে একটি বর্ণনা আমি পেয়েছি, তিনি বলেন , আমি ছিলাম আমার পিতা ও আমার চাচার সন্তানদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয়, অন্য সব সন্তানদের থেকে তিনি আমাকে বেশী ভালবাসতেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর কোবা পল্লীতে বনু আমর ইবনে আওফের কাছে অবস্থান করলেন, এ খবর পাওয়ার পর হুয়াই ইবনে আখতার (রা.) এবং তার চাচা ইয়াছের খুব সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে গেলেন, এবং সূর্যাস্তের সময় ফিরে এলেন, তারা দুজনেই ছিলেন ভীষণ ক্লান্ত।
আমি অভ্যাসবশত তাদের দিকে ছুটে গেলাম, কিন্তু তারা চিন্তায় এমন বিভোর ছিলেন যে, আমার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না, আমি শুনলাম চাচা ইয়াছের এবং আমার পিতার সাথে এভাবে কথোপকথোন হচ্ছে-
এই কি তিনি?
-হাঁ, আল্লাহর শপথ।
-আপনি তাকে ভালোভাবে চিনেছেন তো?
-হাঁ।
এখন আপনি তাঁর সম্পর্কে কি মনোভব পোষণ করছেন?
-শত্রুতা, আল্লাহর শপথ যতদিন বেচে থাকি (ইবনে হিসাম, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮-৫১৯)।
সহীহ বোখারীতে উল্লিখিত একটি বর্ণনাও এর প্রমাণ পাওয়া যায়, সেই বর্ণনায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) এর মুসলমান হওয়ার বিবরণ রয়েছে,
হযরত আবদুল্লাহ ছিলেন এক উঁচু স্তরের ইহুদী পণ্ডিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদিনায় আগমনের খবর পাওয়ার পর পরিই তিনি তাঁর কাছে হাজির হলেন, এবং এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যেসব প্রশ্ন একজন নবী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সেসব উত্তর পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন ইহুদীরা অন্যের নামে অপবাদ দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত, যদি তামের কাছে আপনি আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে তারা যা বলবে আমার ইসলাম গ্রহণের খবর শোনার পর পরই বিপরীত কথা বলবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথেই কয়েকজন ইহুদীকে ডেকে পাঠালেন, এবং বললেন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম তোমাদের মধ্যে কেমন লোক? তারা বললো, তিনি আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানীর পুত্র, অন্য এক বর্ণনায় এরূপ রয়েছে যে, তিনি আমাদের সর্দার ও আমাদের সর্দারের সন্তান, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, যদি শোন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম মুসলমান হয়েছে? ইহুদীরা দুবার অথবা তিনবার বললো আল্লাহ তায়ালা তাঁর হেফাজত করুক, এরপরই হযরত আবদুল্লাহ বেরিয়ে এলেন এবং উচ্চস্বরে বললেন, আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহম্মাদুর রাছুলুল্লাহ, অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, এবং হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রসূল, একথা শোনার সাথে সাথেই ইহুদীরা বললো, এ হচ্ছে আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে মন্দ ব্যক্তি ও মন্দ ব্যক্তির সন্তান, এছাড়া তাঁর নামে আরো খারাপ কথা বলতে লাগলো, হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়, আল্লাহকে ভয় কর, সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তোমরা ভাল করেই জান যে, এই হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল, তিনি সত্যসহ আবির্ভূত হয়েছেন কিন্তু ইহুদীরা বলল, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন (সহীহ বোখারী প্রথম খন্ড, পৃ. ৪৫৯, ৫৫৬, ৫৬১)।
মদিনায় আগমনের প্রথমদিকেই ইহুদীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
এ যাবত যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছিলো তা হলো মদিনার অভ্যন্তরীণ অবস্থা, মদিনার বাইরে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল কোরাইশরা, তারা মক্কার মুসলমানদের দশ বছর সীমাহীন কষ্ট দিয়েছিলো, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, নির্যাতন ও অত্যাচারে মুসলমানদের জীবন জর্জরিত করে তুলেছিলো, মুসলমানদের কষ্ট দেওয়ার কোন সুযোগ তারা হাত ছাড়া করেনি, মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করার পর কাফেররা তাদের ঘরবাড়ী জায়গা জমি ধন-সম্পদ অধিকার করে নিল, মুসলমান ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ালো এমন কাউকে কাছে পেলে তাকে নানাভাবে কষ্ট দিচ্ছিল, শুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করে ইসলামের দাওয়াত সমূলে উৎপাটিত করার ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, এ উদ্দেশ্যে তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করলো, মুসলমানরা পাঁচশত কিলোমিটার দুরবর্তী মদীনায় গিয়ে পৌছার পরেও কাফেররা তাদের ষড়যন্ত্র বাদ দেয়নি, কোরাইশরা বায়তুল্লাহর প্রতিবেশী ছিলো, এবং আরবদের মধ্যে ধর্মীয় নেতৃত্বের আসন ছিলো তাদের দখলে, এ কারণে তারা সে প্রভাব বিস্তার করে মক্কার বিভিন্ন গোত্রের উপর চাপ সৃষ্টি এবং তাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে মদিনাকে রাজণৈতিকভাবে বয়কট করলো, এর ফলে মদিনায় জিনিষপত্রের আমদানি কমে গেল, এদিকে মদিনায় মোহাজেরদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে লাগলো, প্রকৃতপক্ষে মক্কার কাফেরদের সাথে মদিনার অধিবাসী মুসলমানদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, এ পরিস্থিতির জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হলে সেটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা।
মুসলমানদের বাড়ী-ঘর ধন-সম্পদ যেভাবে মক্কার কাফেররা জবরদখল করে নিয়েছিলো এবং যেভাবে মুসলমানদের উপের অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছিলো, মুসলমানরাও সঙ্গতভাবে সেরূপ কিছু করার অধিকার রাখে, মুসলমানদের স্বাভাবিক জীবনের পথে অমুসলিমরা যেভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো, মুসলমানরাও সঙ্গতভাবে সেরূপ বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অধিকার রাখে, অমুসলিমদের কাজ অনুযায়ী কাজের উপযুক্ত জবাবই তার পাওয়ার যোগ্য, এতে করে তাদের মুসলমানদের সমূলে উৎখাত করার চক্রান্ত সফল হবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমনের পর এসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, তিনি এসব সমস্যার প্রেক্ষিতে পয়গাম্বর নেতা সুলভ দৃষ্টি ভঙ্গি  গ্রহণ করেন, যারা অনুগ্রহ পাওয়ার উপযুক্ত ছিলো তাদের অনুগ্রহ করেন , আর যারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য ছিলো, তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করেন, তবে এটা ঠিক যে দয়া ও অনুগ্রহের পরিমাণ শাস্তি কঠোরতার চাইতে অনেক বেশী ছিলো, ফলে কয়েক বছরের মধ্যে নেতৃত্ব কর্তৃত্ব মুসলমানদের হাতে এসে পড়ে, পরবর্তী পর্যায়ে সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে।
সূত্রঃ- আর-রাহিকুল মাখতুম
১৪তম খন্ড

No comments

Powered by Blogger.