নিজ ঘরে তিনি পরদেশীঃ যুলুম নিপীড়নের তের বছর। রাসূল (সা:) এর জীবনী। ৭ম খন্ড
দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায়
রিসালাতের ছায়ায় হেরাগুহার অভ্যন্তরে
মোহাম্মদ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স চল্লিশ বছরের কাছাকাছি হলো। তাঁর পরিচ্ছন্ন অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে স্বজাতীয়দের সাতে মানসিক ও চিন্তার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেল। এ অবস্থায় রসুল নিঃসঙ্গতা প্রিয় হয়ে উঠলেন। ছাতু এবং পানি নিয়ে তিনি মক্কা থেকে দুই মাইল দুরে অবস্থিত হেরা পাহাড়ের গুহা গিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। এটি একটি ছোট গুহা, এর দীর্ঘ চার গজ প্রস্ত পৌনে দুই গজ। নীচেরদিকে গভীর নয়। ছোট একটি পথের পাশে ওপরের প্রান্তরের সঙ্গমস্থলে এ গুহা অবস্থিত। প্রিয় রসুল এই গুহায় যাওয়ার পর বিবি খাদিজাও তাঁর সঙ্গে যেতেন এবং নিকটবর্তী কোন জায়গায় অবস্থান করতেন। প্রিয় রসুল পুরো রমযান মাস এই গুহায় কাটাতেন। জগতের দৃশ্যমান এবং এর পেছনে কাজকর্ম কুদরতের কারিশমা সম্পর্কে চিন্তা করতেন। স্বজাতির লোকদের মূর্তি পূজা এবং নোংরা জীবন যাপন দেখে তিনি শানিত পেতেন না। কিন্তু তাঁর সামনে সুস্পষ্ট কোন পথ সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি, প্রচলিত অবস্থার বিপরীত কোন কর্মসূচী ছিল না যার ওপর জীবন কাটিয়ে তিনি মানসিক স্বস্তি ও শান্তি লাভ করতে পারেন। (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম, খন্ড, পৃ৪৭, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-২৩৫, ২৩৬, তাফসির ফি যিলালিল কোরআন-সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পৃ-২৯, ৬৬) রসুলের এ নিঃসঙ্গ প্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাকের হেকমতের একটি অংশ। এমনি করে আল্লাহ পাক তাঁকে ভবিষ্যতের গুরুদায়িত্বের জন্য তৈরি করছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধান দিয়ে যিনি জীবন ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হবেন, তিনি পারিপার্শ্বিক হৈ চৈ হট্টগোল থেকে দুরে নির্জনতায় কোলাহলমুক্ত পরিবেশ কিছুকাল থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।
এই নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহ পাক ধীরে তাঁর প্রিয় রসুলকে আমানতের বিরাট বোঝা বহনের এবং বিশ্ব মানবের জীবন ধারায় পরিবর্তনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি করছিলেন। তাঁকে আমানতের জিম্মাদারি অর্পণের তিন বছর আগে নিজনে ধ্যান করা তাঁর জন্য আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এই নির্জনতায় কখনো এক মাস পর্যন্ত তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আধ্যাত্মিক রূহানী সফরে তিনি সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন, গবেষণা করতেন, যাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পেলে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। (তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, পারা ২৯, পৃ-১৬৬-১৬৭, স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে এটা তাফসীরের আরবী সংস্করণের পৃষ্ঠা। বাংলাদেশ আল কোরআন একাডেমী লন্ডন এর যে বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন তার পৃষ্ঠা এর সাথে নাও মিলতে পারে। )
ওহী নিয়ে জিবরাইলের আগমন
চল্লিশ বছর বয়স হচ্ছে মানুষের পূর্ণতার পরিপক্বতার বয়স। পয়গম্বররা এই বয়সেই ওহী লাভ করে থাকেন। প্রিয় রাসুলের বয়স চল্লিশ হওয়ার পর তাঁর জীবনের দিগন্তে নবুয়তের নিদর্শন চমকাতে লাগলো। এই নিদর্শন প্রকাশ পাচ্ছিল স্বপ্নের মাধ্যমে। এ সময় প্রিয় রসুল যে স্বপ্ন ই দেখতেন সেই স্বপ্ন শুভ্র সকালের মতো প্রকাশ পেতো। এ অবস্থায় ছয়মাস কেটে গেল। এ সময়টুকু নবুয়তের সময়ের ৪৬তম অংশ এবং নবুয়তের মোট মেয়াদ হচ্ছে তেইশ বছর। হেরা গিরি গুহার নির্জন বাসের তৃতীয় বছরই আল্লাহ পাক জগতবাসীকে তাঁর করুনাধারায় সিঞ্চিত করতে চাইলেন। আল্লাহ পাক তখন তাঁর প্রিয় রসুলকে নবুয়ত দান করলেন। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত নিয়ে হাযির হলেন। (হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী লিখেছেন, বায়হাকী উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্ন দেখার মেয়াদ ছিল ছয় মাস। অর্থাৎ ছয় মাস যাবত বিভিন্ন সময়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। কাজেই স্বপ্নের মাধ্যমে নবুয়তের সূচনা চল্লিশ বছর পূর্তির পর রবিউল আওয়াল মাসে হয়েছিল। এ মাস ছিল প্রিয় রসুলের জন্মের মাস। জাগ্রতাবস্থায় তাঁর কাছে প্রথম ওহী এসেছিল রমযান মাসে। (ফতহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃ-২৭)
ইতিহাসের যুক্তি প্রমাণ এবং কোরআনসহ বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, প্রথম ওহী এসেছিল রমযান মাসের ২১ তারিখ সোমবার রাতে। চান্দ্র মাসের হিসাব মোতাবেক সে সময় রসুল করিম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স ছিল ৪০ বছর ৬ মাস ১২দিন।
ওহী নাযিলের সময়ে তাঁর বয়স
প্রিয় নবী কি মাসে নবুয়ত লাভ করেছিলেন এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ রীরাত রচয়িতার মতে প্রিয় রসল রবিউল আউয়াল মাসে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। কেই কেউ বলেছেন রমযান মাসে আবার কেউ কেউ বলেছেন রজব মাসে। দেখুন মুখতাছারুছ সিরাত, রচনা শেখ আবদুল্লাহ ১ম খন্ড, পৃ. ৭৫। আমার বিবেচনায় তা ছিল রমযান মাসে। ওহী নাযিল হওয়া অর্থাৎ নবুয়ত লাভ করার কথাই ঠিক। কেননা কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, রমযান মাসেই কোরআন নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ পাক আরো বলছেন, শবে কদরে কোরআন নাযিল করো হয়েছে। শবে কদর তো রমযান মাসেই হয়ে থাকে। আল্লাহ পাক আরো বলেছেন, আমি একটি বরকতময় রাতে কোরআন নাযিল করেছি এবং আমি লোকদের আযাবের আশঙ্কা সম্পর্কে অবহিত করি। রমযান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ার পক্ষে এ যুক্তিও রয়েছে যে, রসুল হেরা গুহায় রমযান মাসে ধ্যান করতেন। হযরত জিবরাইল (আ:)হেরা গুহায়ই এসেছিলেন।
যারা রমযান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ার উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রমযানের কতো তারিখে কোরআন নাযিল হয়েছিল এ ব্যাপারে আবার মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন সাত তারিখ, কেউ বলেন আঠারো তারিখ (মুখতাছারুস সীরাত ১ম খন্ড পৃ. ৭৫. রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড পৃ. ৪৯ দেখুন, আল্লামা হাযরামি লিখেছেন, সতের তারিখেই নির্ভুল।
(তারিখে হাযরামি ১ম খন্ড, পৃ-৬৯, এবং তারিখে আতৃতাশারিহ আল ইসলামী পৃ.৫, ৬, ৭ দেখুন।) আমি এ ব্যাপারে ২১ শে রমযান তারিখকে প্রাধান্য দিয়েছি। অথচ কে ২১শে রমযান কোরান নাযিল শুরু বলে উল্লেখ করেননি। আমার যুক্তি হচ্ছে যে, অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার মতে রসুলের আবির্ভাব ঘটেছিল সোমবার দিনে। হযরত কাতাদা রা: বর্ণীত একটি হাদিসেও এর প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেন, প্রিয় রসুলকে সোমবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এই দিনে আমাকে নবুয়ত দেয়া হয়েছে। সহি মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ-৩৬৮ মুসনাদে আহমদ ৫ম খন্ড, পৃ-২৯৭, ২৯৯, বায়হাকী ৪থ খন্ড, পৃ. ২৮৬, ৩০০ হাকেম ২য় খন্ড, পৃ-২, ৬। সেই বছর রমযান মাস সোমবার পড়েছিল। ৭, ১৪, ২১ এবং ৮ তারিখে। সহীহ বর্ণনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শবে কদর রমযান মাসের বেজোড় রাতে হয়ে থাকে এবং বেজোড় রাতেই আবর্তিত হয়। আল্লাহ পাক বলেছেন, শবে কদরে কোরআন নাযিল হয়েছে, যে, বছর তিনি নবুয়ত পেয়েছেন সে বছরের সোমবারসমুহ পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্ত পৌছা যায় যে, তিনি ২১শে রমযান সোমবার জন্মগ্রহণ করেন এবং এই তারিখেই নবুয়ত লাভ করেন।
আসুন, হযরত আয়েশার (রা) যবানীতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনা যাক। কোরআন নাযিল ছিল এক অলৌকিক আলোকে শিখার আবির্ভাব, সেই আলোকে শিখার সফল গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতার অন্ধকার তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসের গতিধারা এই ঘটনায় বদলে গিয়েছিল।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, প্রিয় রসুলের ওপর নাযিলের সূচনা স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন সে স্বপ্ন শুভ্র সকালের মত প্রকাশ পেতো। এরপর তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে যান। তিনি হেরা গুহায় এবাতদ বন্দেগীতে কাটাতে কাটাতে থাকেন এবং এ সময় একাধারে কয়েকদিন ঘরে ফিরতেন না। পানাহার সামগ্রী শেষ হয়ে গেলে সেসব নেয়ার জন্য পুনরায় বাড়িতে ফিরতেন। এমনি করে এক পর্যায়ে হযরত জিবরাইল (আ:) তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন, পড়ো। তিন বললেন, আমি পড়তে জানিনা। ফেরেশতা তাঁকে বুকে জড়িয়ে থরে সজোরে চাপ দিলেন, পড়ো। তিন বলেন, আমার সব শক্তি যেন নিংড়ে নেয়া হলো। এরপর ফেরেশতা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো। তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। পুনরায় ফেরেশতা আমাকে বুকে জড়িয়ে চাপ দিলেন।
এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো, তৃতীয়বার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, পড়ো ইকরা বে-ইসমে রারিব্বকাল্লাযি খালাক। (আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম পর্যন্ত নাযিল হয়েছিল। ) অর্থাৎ পড়ো সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
এই আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর প্রিয় নবী ঘরে ফিরে এলেন। তার বুক ধুকধুক করছিল। স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদকে বললেন, আমাকে চাদর গিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। বিবি খাদিজা প্রিয় নবীকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। তার ভয় কেটি গেল।
এরপর বিবি খাদিজাকে সব কথা খুলে বলে প্রিয় রসুল বললেন, আমার কি হয়েছে? নিজের জীবনের আমি আশংকা করছি। বিবি খাদিজা তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, আল্লাহ পাক আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্ত লেকদের সাহায্য করেন মেহমানদারী করেন, সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করন।
বিবি খাদিজা এরপর প্রিয় নবীকে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আবদুল ওযযা আইয়ামে জাহেলিয়াতে ঈসায়ী ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় লিখতে জানতেন। যতোটা আল্লাহ পাক তওফিক দিতেন হিব্রু ভাষায় ততোটা ইঞ্জিল তিনি লিখতেন। সে সময় তিন ছিলেন বয়সের ভোরে ন্যুজ এবং দৃষ্টিহীন। বিবি খাদিজা বললেন, ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকা বললেন, ভাতিজা তুমি কি দেখেছ?
রসূল (সা.) যা যা দেখেছেন সব তাকে খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, তিনি সেই দূত যিনি হযরত মুসার (আ) কাছে এসেছিলেন। হায় যদি আমি সেই সময় বেঁচে থাকতাম যখন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রসুল অবাক হয়ে বললেন, তবে কি আমার কওম আমাকে সত্যি সত্যিই বের করে দেবে, ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ তুমি যে ধরনের বাণী লাভ করেছো এ ধরনের বাণী যখনই কেউ পেয়েছে তার সাথে শত্রুতা করা হয়েছে। যদি আমি বেঁচে থাকি তবে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো। এর কিছুকাল পরই ওয়ারাকা ইন্তেকাল করেন। এরপর হঠাৎ ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে যায় [সহীহ বোখারীতে কিভাবে ওহী নাযিল হয়েছিল, (১ম খন্ড, পৃ-২, ৩) অধ্যায়ে ঈষৎ পরিবর্তিতভাবে এই বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে]
তাবারী এবং ইবনে হিশামের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ওহী নাযিল বন্ধ হওয়ার সময়েও তিনি হেরা গুহায় কিছুকাল অবস্থান করেন এবং নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করেন এরপর মক্কায় ফিরে যান। তাবারীর বর্ণনায় রসুলের ঘর থেকে বের হওয়ার ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ বর্ণনা নিম্নরূপ।
ওহী আসার পরের মানসিক অবস্থা আলোচনা কেরতে গিয়ে রসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর মখলুকের মধ্যে কবি এবং পাগল ছিল আমার সবচেয়ে ঘৃণিত। প্রচণ্ড ঘৃণার কারণে এদের প্রতি চোখ তুলে তাকাতেও আমার ইচ্ছা হত না। ওহী আসার পর আমি মনে মনে বললাম, কোরাইশরা আমাকে কবি বা পাগল বলবেন তো? এরূপ চিন্তার পর আমি পাহাড় চুড়ার উঠে নীচে নামিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তা করলাম। এমনকি এক পাহাড়ে উঠলামও। পাহাড়ের মাঝামাঝি ওঠার পর হটাৎ আসমান থেকে আওয়াজ এলো, মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রসুল। আমি জিবরাঈল। প্রিয় রসুল বলেন এই আওয়াজ শোনার পর আকাশের প্রতি তাকালাম। দেখলাম জিবরাঈল মানুষের আকৃতি ধরে দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, হে মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রসুল, আমি জিবরাঈল বলছি। রসুল বলেন, আমি থমকে দাঁড়িয়ে সেখানে যেতে পারছিলাম না পেছনে ও যেতে পারছিলাম না। আকাশের যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই জিবরাঈলকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এর মধ্যে খাদিজা আমার খোজে লোক পাঠালেন। খুঁজে তিনি মক্কায় ফিরে এসেছেন।
জিবরাঈল চলে যাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। খাদিজার উরুর পাশে হেলান দিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, আবুল কাশেম, আপনি কোথায় ছিলেন? আপনার খোঁজে আমি একজন লোক পাঠিয়েছি যে মক্কায় গিয়ে খুঁজে এসেছে আপনাকে পায়নি। আমি তখন যা কিছু দেখেছিলাম খাদিজাকে সে কথা বললাম। তিনি বললেন, হে আমার চাচাতো ভাই, আপনি খুশি হোন এবং দঢ়পদ থাকুন, আমার আশা আপনি এই উম্মতের নবী হবেন। এরপর তিনি ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গেলেন। তাঁকে সব কথা শোনালেন। তিনি সব শুনে বললেন, সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে ওয়ারাকার প্রাণ রয়েছে, তাঁর কাছে সেই ফেরেশতা এসেছেন, যিনি হযরত মুসার আ) কাছে এসেছিলেন। মোহাম্মদ এই উম্মতের নবী। তাঁকে বলবে তিনি যেন দঢ়পদে থাকেন।
এরপর হযরত খাদিজা ফিরে এসে রসুলকে ওয়ারাকার কথা শোনালেন। প্রিয় নবী, হেরা গুহায় তাঁর অবস্থানের মেয়াদ পূর্ণ করে মক্কায় আসেন। এ সময় ওয়ারাকা ইবনে নওফেল তাঁর প্রাণ রয়েছে, আপনি হচ্ছেন এই উম্মতের নবী। আপনার কাছে সেই বড় ফেরেশতা এসেছেন যিনি হযরত মুসার (আ ) কাছে এসেছিলেন। (হিযাব, পৃ-২০৭, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ২৩৭, ২৩৮, এ বর্ণনা সত্যতা সম্পর্কে আমি অবশ্য দ্বিধান্বিত। ওয়ারাকার সাথে আলোচনার ঘটনা ওহী আসার পরই ঘটেছিল। বোখারী কণিত হাদিসে পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্ত পৌছতে হয় যে, ওয়ারাকার সাথে আলোচনা মক্কায় ওহী প্রাপ্তির পরই হয়েছিল। )
সাময়িকভাবে ওহীর আগমন স্থগিত
ঐ সময়ে ওহীর আগমন কতদিন যাবত স্থগিত ছিল? এ সম্পর্কে ইবনে সাদ হযরত ইবনে আব্বাসের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এতে উল্লেখ রয়েছে যে, ওহী কয়েকদিনর জন্য স্থগিত ছিল। সবদিক বিবেচনা করলে এ বর্ণনাই যথার্থ মনে হয়। একটা কথা বিখ্যাত রয়েছে যে, আড়াই বছর বা তিন বছর ওহী স্থগিত ছিল, এই বিবরণ সত্য নয়। এ সম্পর্কিত যুক্তি প্রমাণ সম্পর্কে এখানে আলোচনার দরকার নেই। (১১ নং টীকায় এ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। )
ওহী স্থগিত থাকার সময়ে প্রিয় রসুল বিষণ্ণ এবং চিন্তাযুক্ত থাকতেন। তিনি মানসিক অস্থিরতা এবং উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। সহীহ বোখারী শরীফের কিতাবুত তাবীর এর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, ওহীর আগমন স্থগিত হওয়ার পর প্রিয় রসুল এতোটা অস্থিরতা এবং চিন্তার মধ্যে ছিলেন যে কয়েকবার উচু পাহাড়ের চুড়ায় উঠেছিলেন যেখান থেকে লাফিয়ে নীচে পড়বেন। কিন্তু পাহাড় ওঠার পর জিবরাঈল আসতেন এবং বলতেন হে, মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর প্রিয় রসুল। এ কথা শোনার পর তিনি থমকে দাঁড়াতেন? তাঁর উদ্বেগ অস্থিরতা কেটে যেতো। প্রশান্ত মনে তিনি ঘরে ফিরে আসতেন। পুনরায় ওহী ন আসার কারণে তিনি স্থির হয়ে উঠতেন। সেখানে জিবরাঈল এসে হাযির হতেন এবং বলতেন হে মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রসুল। (সহীহ বোখারী কিতাবুত তাবির, রুইয় সালেহা ২খ খণ্ড, পৃ-১০৩৪। )
ওহী নিয়ে পুনরায় জিবরাঈলের আগমন
হাফেজ ইবনে হাজার লিখেছেন ওহী কিছুকাল স্থগিত থাকার কারণ ছিল এই যে, তিনি যে ভয় পেয়েছিলেন সই ভয় যেন কেটে যায় এবং পুনরায় ওহী প্রাপ্তির আগ্রহ এবং প্রতীক্ষা যেন তাঁর মনে জাগে। (ফতহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃ-২৭)
বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাওয়ার পর, বাস্তব অবস্থা তার সামনে প্রকাশ পেলো, তিনি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন যে, তিনি আল্লাহ পাকের নবী হয়েছেন। তিন আরো বুঝতে সক্ষম হলেন যে, তাঁর কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ওহীর বাণী বহনকারী, আসমানী সংবাদবাহক। এইরূপ বিশ্বাস তাঁর মনে দৃঢ় হওয়ায় পর তিনি আগ্রহের সাথে ওহীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁকে দৃঢ় হয়ে থাকতে হবে এবং এ দায়িত্ব বহন করতে হবে। মানসিক অবস্থার এ পর্যায়ে হযরত জিবরাঈল (আ ) পুনরায় এসে হাযির হলেন। সহীহ বোখারী শরীফে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি প্রিয় নবীর মুখে ওহী স্থগিত হওয়ার বিবরণ শুনেছেন। রসুলে বলেছেন, আমি পথ চলছিলাম, হটাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ শোনা গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ফেরেশতা যিনি হেরা গুহায় আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আসমান জমিনের মাঝখানে একখানি কুর্সিতে বসে আসেন। আছেন। আমি ভয় পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এরপর বাড়ীতে এসে আমার স্ত্রীর কাছে বললাম, আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও। স্ত্রী আমাকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। এরপর আল্লাহ পাক সুরা মোদদাসসের এর ‘অররুজযা ফাহজুর’ পর্যন্ত নাযিল করেন এ ঘটনার পর থেকে ঘন ঘন ওহী নাযিল হতে থাকে। (সহীহ বোখারী কিতাবুত তাফসীর অধ্যায় ওয়ার রুজযা ফাহজুর ২য় খন্ড পৃ-৭৩৩। এ বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, রসুল বলেছেন, আমি হেরা গুহায় এতেকাফ করেছি। এতেকাফ পূর্ণ করার পর নীচে এলাম। এরপর আমি যখন প্রান্তর ধরে অগ্রসর হচ্ছিলাম তখন আমাকে ডাকা হলো। ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ফেরেশতা। —-। সীরাত রচয়িতাদের সকল বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রসুল তিনি বচর রমযান মাসে হেরা গুহায় এতেকাফ করেন। তৃতীয় রমযানে তাঁর কাছে জিবরাঈল ওহী নিয়ে আসেন। তিনি রমযানের পুরো মাস এতেকাফ করে১ম শাওয়াল খুব ভোরে মক্কায় ফিরে আসতেন। উল্লেখিত রেওয়োতের সাথে এ বিবরণ সংযুক্ত করলে এ সিদ্ধান্তে পৌছা যায় যে, সুরা মোদ্দাসসেরের প্রথম অংশের ওহী-প্রথম ওহীর দশদিন পর নাযিল হয়েছিল। অর্থাৎ ওহী স্থগিত থাকার মেয়াদ দিল দশদিন)
ওহীর বিভিন্ন রকম
প্রিয় নবীর ওপর ওহী নাযিল হওয়ার পর অর্থাৎ তিনি নবুয়ত পাওয়ার পর তাঁর যে জীবন শুরু হয় সে আলোচনায় যাওয়ার আগে ওহীর বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে অলোকপাত করা দরকার। এতে রিসালাত ও নবুয়ত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাবে। আল্লামা ইবনে কাইয়মে নিম্নোক্ত কয়েক প্রকারের ওহীর কথা উল্লেখ করেছেন,
এক. সত্য স্বপ্ন-স্বপ্নের মাধ্যমে রসুলের ওহী নাযিল।
দুই. ফেরেশতা তাঁকে দেখা না দিয়ে তাঁর মনে কথা বসিয়ে দিতো। যেমন প্রিয় নবী বলেছেন যে, রুহুল কুদুস আমার মনে একথা বসিয়ে দিলেন যে, কোন মানুষ তার জন্য নির্ধারিত রেযেক পাওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করে না। কাজেই আল্লাহকে ভয় করো এবং ভালো জিনিস তালাস করো। রেযেক পেতে হলে আল্লাহর নাফরমানীর মাধ্যমে রেকে তালাক করোনা। কেননা আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে সেটা তাঁর আনুগত্য ছাড়া পাওয়া যায় না।
তিন. ফেরেশতা মানুষরে আকৃতি ধরে তাকে সম্বোধন করতেন। তিনি যা কিছু বলতেন প্রিয় রসুল সেসব মুখস্থ করে নিতেন। এ সময় কখনো কখনো সাহাবিরাও ফেরেশতাদের দেখতে পেতেন।
চার. রসুলের কাছে ওহী ঘণ্টাধ্বনির মতো টন টন শব্দ আসতো। এটি ছিল ওহীর সবচেয়ে কঠোর অবস্থা। এ সময় ফেরেশতা তাঁর সাথে দেখা করতেন এবং প্রচণ্ড শীতের মওসুম হলেও প্রিয় নবী ঘেমে যেতেন। তাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়তো। তিনি উটের ওপর সওয়ার থাকলে মাটিতে বসে পড়তেন। একবার হযরত যায়েদ ইবনে সাবেতের উরুর ওপর তাঁর উরু থাকা অবস্থায় ওহী এলো, হযরত যায়েদ এতো ভারি বোধ করলেন যে, তাঁর উরু থেঁতলে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।
পাঁচ. তিনি ফেরেশতাকে তার প্রকৃত চেহারায় দেখতেন। সেই অবস্থায়ই আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর ওপর নাযিল হতো। দুবার এরূপ হয়েছিল। পাক সুরা নাজম এ আল্লাহ পাক সেকথা উল্লেখ করেছেন।
ছয়. মেরাজের রাতে নামায ফরয হওয়া এবং অন্যান্য বিষয়ক ওহী আকাশে নাযিল হয়েছিল। প্রিয় নবী তখন আকাশে ছিলেন।
সাত. ফেরেশতার মাধ্যমে ছাড়া আল্লাহ পাকের সরাসরি কথা বলা। হযরত মুসা (আ) সাথে আল্লাহ পাক যেমন কথা বলেছিলেন। হযরত মুসার সাথে আল্লাহর কথা বলার প্রমাণ কোরআনে রয়েছে। প্রিয় নবীর সাথে আল্লাহর কথা বলার প্রমাণ মেরাজের হাদিসে রয়েছে।
আট. একটি প্রকার কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। এটি হচ্ছে আল্লাহ পাকের মুখোমুখি পর্দা বিহীন অবস্থায় কথা বলা। কিন্তু এ ব্যাপারে মত পার্থক্যের অবকাশ রয়েছে (যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ-১৮)।
তাবলীগের নির্দেশ
সুরা মোদ্দাসসের-এর প্রথম কয়েকটি আয়াতে প্রিয় নবীকে যেসব নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এসব নির্দেশ দৃশ্যত সংক্ষিপ্ত এবং সহজ সরল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব নির্দেশ খুবই সুদূর প্রসারী এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তব জীবনের ওপর এসব নিদেশের কার্যকারিতা ও প্রভাব অসামান্য
এক. ভয় প্রদর্শন করার জন্য যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এই নিদেশের শেষে মনযিল হচ্ছে এই যে.বিশ্বে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে সব কাজ হচ্ছে তার মারাত্মক পরিণাম সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে দেয়া। সেই ভয় এমনিভাবে দেখাতে হবে যাতে আল্লাহ পাকের আযাবের ভয়ে মানুষের মনে মগজে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
দুই. রব এর বর্ণনার শেষ মনযিল হচ্ছে আল্লাহর যমীনে শুধুমাত্র তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব অটুট থাকবে, অন্য কারোর শ্রেষ্ঠত্ব বহাল থাকতে দেয়া যাবে না বরং অন্য সব কিছুর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য নস্যাৎ করে দিতে হবে। ফলে আল্লাহর যমীনে একমাত্র তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাই শুধু প্রকাশ পাবে এবং স্বীকৃত হবে।
তিন. পোশাকের পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতার শেষ মনযিল হচ্ছে এই যে, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল প্রকার পাক সাফ রাখতে হবে এ অবস্থা এমন পর্যায়ে হতে হবে যাতে করে আল্লাহ পাকের রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া যায়। এটা শুধুমাত্র তারই হেদায়েত ও নুরের দ্বারা সম্ভব হতে পারে। উল্লেখিত পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জনের পর অন্তর আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাই অন্তরে জাগ্রত হবে। এরফলে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বিরোধিতা অথবা আনুগত্যে তাঁর কাছাকাছি থাকবে। তিনিই হবেন সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।
চার. কারো প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ করার পর অধিক বিনিময়ে প্রত্যাশা না করার শেষ মনযিল এই যে, নিজের কাজ কমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা যাবেনা, বেশী গুরুত্ব দেয়া যাবে না। বরং একটির পর অন্য কাজের চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। বড় রকমের ত্যাগও কোরবানী করেও সেটাকে তুচ্ছ মনে করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর সামনে জবাবদিহির ভয়ের ব্যাপারে অনুভূতির সামনে নিজের চেষ্টা সাধনাকে ক্ষুদ্র ও সামান্য মনে করতে হবে।
পাঁচ. শেষ আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াতের কাজ শুর হওয়ার পর শত্রুরা বিরোধিতা, হাসিঠাট্টা, উপহাস বিদ্রূপ ইত্যাদির মাধ্যমে কষ্ট দেবে এবং প্রিয় নবীকে এবং তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তাঁকে এসব কিছুর সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এমতাবস্থায় তাঁকে দৃঢ়তার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এই ধৈর্য মনের শান্তির জন্য নয় বরং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং তাঁর দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য। কেননা আল্লাহ পাক বলেছেন, ওয়া লেরাব্বেকা ফাছবের অর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের জন্য ধৈর্য ধারণ করবে।
কী চমৎকার! এসকল নির্দেশ প্রকাশ্য ভাষায় কতো সহজ সরল এবং সংক্ষিপ্ত। শব্দ চয়ন কতো হালকা এবং কাব্যধর্মী কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কতো ব্যাপক কতো তাৎপর্যমন্ডিত। এই কয়েকটি শব্দের প্রকৃত প্রয়োগের ফলে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যাবে এবং বিশ্বর দিকদিগন্তের মানুষের মদ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন স্থাপিত হবে।
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে দাওয়াত ও তাবলীগের উপাদানও বিদ্যমান রয়েছে। বনি আদমের কিছু আমল এমন রয়েছে যার পরিণাম মন্দ। এ কথা সবাই জানে যে, মানুষ যা কিছু করে তার সব কিছুর বিনিময়ে এ পৃথিবীতে তাকে দেয়া হয় না এবং দেয়া সম্ভব হয় না। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা দিন থাকা দরকার যেদিন সব কাজের পুরোপুরি বিনিময়ে দেয়া হবে। সেইদিনের নাম হচ্ছে কেয়ামত। সেদিন বিনিময়ে দেয়ার একটা অনিবার্য প্রয়োজন এই যে, আমরা এ পৃথিবীতে যে জীবন যাপন করছি এর চেয়ে পৃথক একটা জীবন থাকা দরকার।
অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের কাছে নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসারী হওয়ার দাবী জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বান্দা যেন তার সব ইচ্ছা আকাংখা আল্লাহ পাকের ওপরই ন্যস্ত করে। প্রবৃত্তির খায়েশ এবং মানুষের অন্যান্য ইচ্ছার ওপর সে যেন আল্লাহর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। এমনি করে দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব সম্পন্ন হতে পারে। এসব শুত নিম্নরূপ।
ক. তাওহীদ।
খ. পরকালের প্রতি বিশ্বাস।
গ. তাযকিয়ায়ে নফস এর ওপর গুরুত্বারোপ। অর্থাৎ সকল প্রকার অশ্লীলতা ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। পুণ্য কাজ বেশী করে করা এবং পুণ্য কাজের ওপর অটল থাকার চেষ্টা।
ঘ. নিজের সকল কাজ আল্লাহ পাকের ওপর ন্যস্ত করা।
ঙ. এসব কিছু প্রিয় নবীর নবুয়ত ও রেসালাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন এবং অসাধারণ নেতৃত্বের অনুসরণের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
এসব আয়াতে আসমানী নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় নবীকে এক মহান কাজের জন্য এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। ঘুমের আরাম পরিত্যাগ করে জেহাদের কষ্টকর ময়দান অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুরা মোদ্দাসসেরের প্রথম কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ পাক যেমন বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের জন্য বাঁচবে শুধু সেইতো আরামের জীবন কাটাতে পারে, কিন্তু যার ওপর বিশাল মানবগোষ্ঠীর পথনির্দেশের দায়িত্বের বোঝা সে কি করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারে? উঞ্চ বিছানার সাথে আরামদায়ক জীবনের সাথে তার কি সম্পর্ক? তুমি সেই মহান কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ো যে কাজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তোমার জন্য প্রস্তুত বিরাট দায়িত্বের বোঝা তোলার জন্য এগিয়ে এসো। সংগ্রাম করার জন্য এগিয়ে এসো। কষ্ট করো। ঘুম এবং আরামের সময় অতিবাহিত হয়ে গেছ। এখন সময় বিনিদ্র কাটানোর সময় দীঘ পরিশ্রমের। তুমি একাজ করার জন্য তৈরি হও।
এ নির্দেশ বিরাট তাৎপর্য মণ্ডিত। এই নির্দেশ প্রিয় নবীকে আরামের জীবন থেকে বের করে তরঙ্গ সঙ্কুল অথৈ সমুদ্রে নিক্ষেপ করে দিয়েছে। মানুষের বিবেকের সামনে এবং জীবনের বাস্তবতার সামনে এনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এরপর আল্লাহর প্রিয় রসুল উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং সুদীর্ঘ বিশ বছরের বেশী সময় যাবত দাঁড়িয়েই থেকেছেন। এই সময় তিনি ছিলেন জীবন সংগ্রামে অটল অবিচল। আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করেছেন, নিজের এবং পরিবার পরিজনের সুখ-শান্তি আরাম বিসর্জন দিয়েছেন। উঠে দাঁড়ানোর পর তিনি সেই অবস্থায়ই ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়া। কোন প্রকার চাপ ছাড়াই এ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এই দায়িত্ব ছিল পৃথিবীতে আমানতে কোবরা অর্থাৎ বিরাট আমানতের বোঝা। সমগ্র মানবতার বোঝা, সমগ্র আকীদা বিশ্বাসের বোঝা। বিভিন্ন ময়দানে জেহাদের বোঝা। বিশ বছরেরও বেশী সময় তিনি এই সংগ্রাম মুখর জীবন যাপন করেছেন। আসমানী নিদেশে পাওয়ার পর থেকে কখনোই তিনি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থা সম্পর্কে অমনোযোগী বা উদাসীন ছিলেন না। আল্লাহ পাক তাকে আমাদের পক্ষ থেকে এবং সমগ্র মানব জাতির পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। (তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ সুরা মোযাম্মেল, সুরা মোদদাসসের, পারা-২৯, পৃ-১৬৮, ১৬৭, ১৭২)(মূল আরবী খন্ড)।
সূত্র:- আর-রাহিকুল মাখতুম
৮ম খন্ড
No comments