দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ঃ ব্যক্তিগত উদ্যোগ। রাসূল (সা:) এর জীবনী। ৭ম খন্ড

গোপনীয় দাওয়াতের তিন বছর

মক্কা ছিল আরব দ্বীপের কেন্দ্রস্থল। এখানে কাবাঘরের পাসবান বা তত্ত্বাবধায়ক ছিল। আরবরা মূর্তির নেগাহবানও ছিল। তারা যাদেরকে সমগ্র আরবের লোকেরা মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতো। এ কারণে অন্য সব স্থানের চেয়ে মক্কায় সংস্কার প্রচেষ্টা সফল হওয়া ছিল অধিক কষ্টকর। এখানে এমন দৃঢ় চিত্ততার প্রয়োজন ছিল যাতে কোন প্রকার দুখ কষ্ট এবং বিপদ বাধা বিন্দুমাত্র সরাতে না পারে বরং বিপদ বাধায় অটল অবিচল থাকা যায়। কাজেই কৌশল হচ্ছে যে, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ প্রথমে গোপনীয়ভাবে সম্পন্ন  করতে হবে। যাতে করে মক্কাবাসীদের মধ্যে হঠাৎ করে কোলাহল সৃষ্টি না হয়।
ইসলামের প্রথম পর্যায়ের কিছু সৈনিক
রসুল সর্বপ্রথম তাদের কাছেই দ্বীনের দাওয়াত দেবেন যারা তার নিকটাত্মীয়, যাদের সাথে রয়েছে তাঁর গভীর সম্পর্ক, এটাই স্বাভাবিক। নিজের পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের আগে দাওয়াত দেবেন। প্রিয় নবী প্রথমে তাই এসব লেকদের দাওয়াত দেন। এবং নমনীয়তার ছাপ তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি যাদের সম্পর্কে জানতেন যে তারা তাঁকে সত্যবাদী এবং ন্যায়-নীতিপরায়ণ সৎ মানুষ হিসাবে জানে এবং শ্রদ্ধা করে।
আল্লাহর রসুলের দাওয়াত কয়েকজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। এরা প্রিয় রসুলের সততা, সত্যবাদিতা মহানুভবতা সম্পর্কে কখনোই কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করতেন না। ইসলামের ইতিহাসে এরা সাবেকীনে আউয়ালীন নামে পরিচিত। এদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় রয়েছেন রসুলের সহধর্মিনী উম্মুল মোমেনীন খাদিজা বিনতে খোয়াইলেদ, তাঁর মুক্ত করা ক্রীতদাস যায়েদ বিনে সাবেত ইবনে শরাহবিল কালবি। (তিনি এসেছিলেন যুদ্ধে বন্দী দাস হয়ে। পরে হযরত খাজিদা তাঁর মালিক হন এবং স্বামীর জন্যে তাকে দান করে দেন। এরপর তাঁর পিতা ও চাচা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন কিন্তু পিতা ও চাচাকে ছেড়ে তিনি প্রিয় রসুলের সাথে থাকতে পছন্দ করেন। এরপর রসুল তাঁর ভৃত্য যায়েদকে আরব দেশীয় রীতি অনুযায়ী পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। এ ঘটনার পর তিনি যায়েদ মোহম্মদ নামে পরিচিত হন। ইসলামের আগমনে পালক পুত্রের আরবদেশীয় রীতির অবসান ঘটে। ) তাঁর চাচাতো ভাই হযরত আলী ইবনে আবু তালেব, যিনি সে সময় তাঁর পরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহ্নদ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহুম আজমাইন। এরা সবাই প্রথম দিনের ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড পৃ-৫০)
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন সর্বজন প্রিয় নরম মেজাজ উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং উদার মনের মানুষ। তাঁর চমৎকার ব্যবহারের কারণে সব সময় তাঁর কাছে মানুষ যাওয়া আসা করতো। এ সময় বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোকদের কাছে হযরত আবু বকর (রা) দ্বীনের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। আওফ, হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ ইসলাম গ্রহণ করেন। এরা ছিলেন ইসলামের প্রথম সারির সৈনিক।
প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে হযরত বেলাল (রা.)ও ছিলেন একজন। তাঁর পরে আমীন উম্মত হযরত আবু ওবায়দা, আমের ইবনে সালমা ইবনে আবদুল আছাদ, আরকাম ইবনে আবুল আরাকম ওসমান ইবনে মাজউন, এবং তার দুই ভাই, কোদামা ও আবদুল্লাহ এবং ওবয়দা ইবনে হারেস, মোত্তালেব ইবনে আব্দুল মান্নাফ, সাঈদ ইবনে যায়েদ এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ ওমরের বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাব, খাব্বাব ইবনে আরত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করেন। এর সম্মিলিতভাবে কোরাইশ বংশের বিভিন্ন শাখার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। ইবনে হিশাম লিখেছেন, এদের সংখ্যা ছিল চল্লিশের বেশী। (দেখুন ১ম খন্ড, পৃ-২৪৫-২৬২)। এদের মধ্যে কয়েকজনকে সাবেকীনে আউয়ালীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, উল্লিখিত ভাগ্যবানদের ইসলাম গ্রহণের পর দলে দলে লোক ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। মক্কার সর্বত্র ইসলামের আলোচনা চলেতে থাকে ইসলাম ব্যাপকতা লাভ করে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, -২৬২)
এরা গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। প্রিয় নবী এদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য এদের পথ নির্দেশ দেয়ার জন্য গোপনে এদের দেখা করতেন। কেননা তাবলীগের কাজ কখনো বিচ্ছিন্নভাবে এবং গোনে চলছিল। সুরা মোদদাসসের এর প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হওয়ার  পর ঘন ঘন ওহী নাযিল হতে থাকে। এ সময় ছোট আয়াত থাকতো চিত্তাকর্ষক গীতিধর্মিতা এবং কাব্যময়তা। পরিবেশের সাথে সেইসব আয়াত পুরোপুরি খাপ খেয়ে যেতো। এসব আয়াত তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মার শুদ্ধি ও সৌন্দর্য এবং দুনিয়ার মায়াজালে জড়িয়ে যাওয়ার কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া বেহেশত ও দোযখের বিবরণ এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেন চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে। এসকল আয়াত এমন সব স্থান পরিভ্রমণ করিয়ে আনছিল যা ছিল পরিবেশ সম্পূর্ণ নতুন।
নামাযের আদেশ
প্রথমে যা কিছু নাযিল হয়েছিল এর মধ্যে নামাযের আদেশ ও ছিল। মোকাতেল ইবনে সোলায়মান বলেন, ইসলামের শুরুতে আল্লাহ পাক দুরাকাত নামায সকালে এবং দুরাকাত নামায সন্ধ্যার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। কেননা আল্লাহ পাক বলেন, সকাল এবং সন্ধ্যায় তোমরা প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তার সেজদা করো।
ইবনে হাজার বলেন, প্রিয় রসুল এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম মেরাজের ঘটনার আগেই নামায আদায় করতেন। তবে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আগে অন্য কোন নামায ফরয ছিল কিনা। কেউ কেউ বলেন,  সূর্য উদয় হওয়ার আগে এবং অস্ত যাওয়ার আগে এক এক নামায ফরয ছিল।
হারেস ইবনে ওসামা হযরত যায়ে ইবনে হারেসা থেকে এই হাদিসে বর্ণনা করেছেন যে, প্রিয় নবীর কাছে প্রথম যখন ওহী এসেছিল সেই সময় জিবরাইল এসে তাঁকে প্রথমে ওযুর নিয়ম শিক্ষা দেন। ওযু শেষ করার পর এক আঁজলা পানি লজ্জাস্থানে ছুড়ে মারেন। ইবনে মাজাও এ ধরনের হাদিস বর্ণনা করেছেন। বাবা ইবনে আযেব এবং ইবনে আব্বাস থেকেও এ ধরনের হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ইবনে আব্বাসের বর্ণিত হাদিসে রয়েছে যে, এই নামায ছিল প্রথম দিকেরে ফরযের অন্তর্ভুক্ত। (মুখতাছারুছ ছিরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ-৮৮। )
ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, প্রিয় রসুল এবং সাহাবয়েকেরাম নামাযের সময়ে পাহাড়ে জলে যেতেন এবং গোপনে নামায আদায় করতেন। একবার আবু তালেব রসুল এবং হযরত আলীকে (রা) নামায আদায় করতে দেখে ফেলেন। তিনি এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তাঁকে জানানোর পর তিনি বলেন, এই অভ্যাস অব্যাহত রেখো। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৪৭)।
কোরাইশদের সংবাদ প্রদান
বিভিন্ন ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সময়ে তাবলীগের কাজ যদিও গোপনভাবে করা হচ্ছিল কিন্তু কোরাইশরা কিছু কিছু বুঝতে পারছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারটিকে কোনপ্রকার গুরুত্ব দেয়নি।
ইমাম গাজ্জালী লিখেছেন যে, কোরাইশরা মুসলমানদের তৎপরতার খবর পাচ্ছিল কিন্তু তারা এর প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়নি। সম্ভবত তারা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মনে করেছিল যারা বৈরাগ্যবাদ এবং সংসার বিরাগী হওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা বলে থাকেন। আরব সমাজে এ ধরনের লোক ছিল যেমন, উমাইয়া ইবনে আবু ছালত, কুস ইবনে সাদাহ আমর তোফায়েল প্রমুখ। তবে কোরাইশরা এটা লক্ষ্য করেছিল যে, তার তৎপরতা যেন একটু বেশী এবং ভিন্ন ধরনের। সময়ের গতিধারার সাথে সাথে কোরাইশরা প্রিয় নবীর ধর্মীয় তৎপরতা এবং তাবলীগের প্রতি ক্রমে ক্রমে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। (ফেকহুস সিরাত, পৃ-৭৬)
তিন বছর যাবত দ্বীনের কাজ গোপনভাবে চললো। এসময় ঈমানদারদের একটি দল তৈরি হয়ে গেল। এরা ভ্রাতৃত্ব এবং সহায়তার ওপর কায়েম ছিল। তারা আল্লাহ পাকের পয়গাম পৌঁছচ্ছিল এবং এ পয়গামকে একটা পর্যায় উন্নীত করার জন্য চেষ্টা করছিল। এরপর আল্লাহ পাক ওহী নাযিল করেন এবং এ পয়গামকে একটা পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করছিল। এরপর আল্লাহ পাক ওহী নাযিল করেন এবং তাঁর কওমকে নির্দেশ প্রদান করেন। দ্বীনের দাওয়াতের সাথে সাথে কোরাইশদের বাতিল শক্তির সাথে সংঘাত এবং তাদের মূর্তির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরারও নির্দেশ দেয়া হয়।
সূত্র:- আর-রাহিকুল মাখতুম
৮ম খন্ড

No comments

Powered by Blogger.