আল্লাহর রসুলের আবির্ভাব ও পবিত্র জীবনের চল্লিশ বছর। রাসূলের জীবনী। ৬ষ্ঠ খন্ড
তাঁর জন্ম মোবারক
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় বনি হাশেম বংশে ৯ই রবিউল আওয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। সেই বছরেই হাতী যুদ্ধের ঘটনাটি ঘটেছিল। সে সময় সম্রাট নওশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহণের চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। জন্ম তারিখ ছিল ২০ অথবা ২২ শে এপ্রিল। ৫৭১ ঈসায়ী সাল। সাইয়েদ সোলায়মান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকি গবেষণা করে এ তথ্য প্রদান করেছেন। (তারিখে খাযরাম, ১ম খন্ড, পৃ-৬২, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ-৩, ৩৯)
ইবনে সাদ এর বর্ণনায় রয়েছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাতা বলেছেন যখন তিনি জন্ম গ্রহণ করেন তখন দেহ থেকে এটি নুর বের হলো, সেই নুর দ্বারা শামদেশের মহল উজ্জ্বল হয়ে গেল। ইমাম আহমদ হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া থেকে প্রায় একই ধরনের একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ-১২)
কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবুয়তের পটভূমি হিসেবে আল্লাহর রাসুলের জন্মের সময় কিছু কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল। কিসরার রাজ প্রাসাদের চৌদ্দটি পিলার ধসে পড়েছিল অগ্নি উপাসকদের অগ্নিকুণ্ডে নিভে গিয়েছিল বহিরার গির্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল বায়হাকির বর্ণনা। কিন্তু মোহাম্মাদ গাযযালী এ বর্ণনা সমর্থন করেননি। (মুখতাছারুছ সীরাত, পৃ-১২)
জন্মের পর তাঁর মা তাঁর দাদা আবদুল মোত্তালেবের কাছে পৌত্রের জন্মের সুসংবাদ দিলেন। তিনি খুব খুশি হলেন এবং সানন্দভাবে তাঁকে কাবাঘরে নিয়ে গিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন। এ সময় তিনি তাঁর নাম রাখলেন মোহাম্মদ। এ নাম আরবের নিয়ম অনুযায়ী সপ্তম দিনে খৎনা করলেন। মায়ের পর তাঁকে আবু লাহাবের দাসী ছা্ওবিয়া দুধ পান করান। সে সময় ছাওবিয়ার কোলের শিশুর নাম ছিল মাছরুহ। ছাওবিয়া তাঁর আগে হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব এবং তাঁর পরে আবু সালমা সামা ইবনে আবদুল আছাদ মাখজুমিকে দুধ পান করিয়েছিলেন। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৪, মুখতাছারুছ সীরাত শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-১৩)
বনি সাদ গোত্রের অবস্থান
আরবের শহুরে নাগরিকদের রীতি ছিল যে, তারা নিজেদের শিশুদের শহরের অসুখ বিসুখ থেকে ভালো রাখার জন্য দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন নারীদের কাছে পাঠাতেন। এতে শিশুদের দেহ মজবুত এবং শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠতো। এ ছাড়া এর আরেক উদ্দেশ্য ছিল যেন সেই দুধ পানের সময়েই যেন তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিক্ষা করতে পারে। এই রীতি অনুযায়ী আবদুল মোত্তালেব ধাত্রীর খোঁজ করলেন এবং তাঁর দৌহিত্রকে হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের হাতে দিলেন। এই মহিলা ছিলেন বনি সাদ ইবনে বকরের অন্তর্ভুক্ত। তার স্বামীর নাম ছিল হারেস ইবনে আবদুল ওযযা, ডাক নাম ছিল আবু কাবশা। তিনিও ছিলেন বনি সাদ গোত্রের মানুষ।
হারেসের সন্তানরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পর্কের কারণে তাঁর দুধ ভাই ও বোন ছিল। তাদের নাম হলো আবদুল্লাহ, আনিসা, হোযাফা বা জোযামা। হালিমর উপাধি ছিল শায়মা এবং এই নামেই তিনি বেশী বিখ্যাত ছিলেন। তিনি আল্লাহর রাসুলকে বুকের দুধ খাওয়াতেন। এবং তিনি ছাড়া আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মোত্তালেব, যিনি রসুলুল্লাহর চাচাতো ভাই ছিলেন. তিনিও হালিমার মাধ্যমে তাঁর দুধ ভাই ছিলেন। তাঁর চাচা হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেবও দুধ পানের জন্য বনু সাদ গোত্রের একজন মহিলার কাছে ন্যস্ত হয়েছিলেন। বিবি হালিমার কাছে থাকার সময়ে এই মহিলাও একদিন আল্লাহর রসুলকে দুধ পান করিয়েছিলেন। এই হিসাবে তিনি এবং হামযা উভয়ে দুই সুত্রে রেযায়ী ভাই বা দুধ ভাই ছিলেন (একদিকে ছাওবিয়ার সূত্রে অন্যদিকে বনু সাদ গোত্রের এই মহিলার সূত্রে)(যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ-১৯)।
দুধ পান করানোর সময় হযরত হালিমা নবী করীম রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতের এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যে, বিস্ময় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বিস্তারিত বিবরণ তাঁর মুখেই শোনা যাক। ইবনে ইসহাক বর্ণনামতে হযরত হালিমা বলেন আমি আমার স্বামীর সাথে আমাদের দুগ্ধ পোষ্য শিশুসহ বনি সাদ গোত্রের কয়েকজন মহিলার সঙ্গে নিজেদের শহর ছেড়ে বের হলাম। সেটা ছিল দুর্ভিক্ষের বছর। চারিদিকে অভাব অনটন। আমি একটি মাদী গাধার পিঠে সওয়ার ছিলাম। আমাদের কাছে একটি উটনিও ছিল। কিন্তু সেই উটনি এক ফোটাও দুধ দিত না। ক্ষুধার জ্বালায় দুধের শিশু ছটফট করতো। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমার বুকেও দুধ ছিল না। উটনিও দুধ দিত না। বৃষ্টি এবং স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। মাদী গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় গাধা এতো ধীরে চলতে লাগলো যে, কাফেলার সবাই বিরক্ত হয়ে গেল। দুধ পান করানোর জন্য শিশুর সন্ধানে মক্কায় গেলাম। আমাদের কাফেলার যতো মহিলা ছিল সকলের কাচেই আল্লাহর রাসুলকে গ্রহণ করার জন্য পেশ করা হলো, কিন্তু পিতৃহীন অর্থাৎ এতিম হওয়ায় সবাই তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো। কেননা সবাই সন্তানের পরিবার থেকে ভালো পারিশ্রমিকের আশায় করছিল। একজন বিধবা মা কি আর দিতে পারবে? এ কারণেই আমরা কেউ তাঁকে নিতে রাজি হইনি।
এদিকে আমাদের কাফেলার প্রত্যেক মহিলাই কোন না শিশু পেয়ে গেল। আমি কোন শিশুই পেলাম না। ফেরার সময় স্বামীকে বললাম, খালি হাতে ফিরে যেতে ভালো লাগছে না। আমি বরং সেই শিশুকেই নিয়ে যাই। স্বামী রাজি হলেন, বললেন, হয়তো ওর ওছিলায় আল্লাহ পাক আমাদের বরকত দেবেন। এরপর আমি গিয়ে তাঁকে গ্রহণ করলাম।
হযরত হালিমা রাদি আল্লাহু আনহা বলেন, শিশুকে নিয়ে আমি যখন ডেরায় ফিরে এলাম তখন আমার উভয় স্তন ছিল দুধে পূর্ণ, শিশুটি পেট ভরে দুধ পান করল। তার সঙ্গে দুধ ভাইও পেট ভরে দুধ পান করলো। এরপর উভয়ে স্বস্তির সাথে ঘুমি পড়লো। অথচ এর আগে আমার সন্তান ক্ষুধার জ্বালায় ঘুমাতে পারত না। এদিকে আমার স্বামী উটনি দোহন করতে গিয়ে লক্ষ্য করল তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ। তিনি এতো দুধ দোহন করলেন যে, আমরা তৃপ্তির সাথে পান করলাম। বড় আরামে আমরা রাত কাটালাম। সকালে আমার স্বামী বললেন, খোদার কসম, হালিমা তুমি একটি বরকত সম্পন্ন শিশু গ্রহণ করেছ। আমি বললাম, আমারও তাই মনে হয়।
হালিমা বলেন, এরপর আমাদের কাফেলা রওয়ানা হলো। আমি দুর্বল গাধার পিঠে সওয়ার হলাম। শিশুটি ছিল আমার কোলে। গাধা এতো দ্রুত পথ চললো যে সব গাধাকে সে ছাড়িয়ে গেল। সঙ্গিনী মহিলারা অবাক হয়ে বলল, ও আবু যোবায়েরের কন্যা, এটা কি আশ্চর্য ব্যাপার, আমাদের দিকে একটু তাকাও। যে গাধার সওয়ার হয়ে তুমি এসেছিলে এটা সেই গাধা? আমি বললাম হ্যাঁ সেটিই। তারা বলল, এর মধ্যে নিশ্চয়ই বিশেষ কোন ব্যাপার রয়েছে।
এরপর আমরা বনু সাদ গোত্রে নিজেদের ঘরে চলে এলাম। আমাদের এলাকার চেয়ে বেশি অভাবগ্রস্ত দুর্ভিক্ষ কবলিত অন্য কোন এলাকা ছিল কিনা অমি জানতাম না। আমাদের ফিরে আসার পর আমাদের বকরিগুলো চারণভূমিতে গেলে ভরা পেটে ভরা স্তনে ফিরে আসতো। আমরা দুধ দোহন করে পান করতাম। অথচ সে সময় অন্য কেউ দুধই পেতো না। তাদের পশুদের স্তনে কোন দুধই থাকতো না। আমাদের কওমের লোকেরা রাখালদের বলতো, হতভাগ্যের দল তোমরা তোমাদের বকরি সেই এলাকায় চরাও যেখানে যোবায়েরের কন্যা বকরি চরায়। কিন্তু তবুও তাদের বকরি খালি পেটেই ফিরে আসতো। একফোঁটা দুধও তাদের স্তনে পাওয়া যেতো না। অথচ আমার বকরিগুলো ভরাপেটে ভরা স্তন ফিরে আসতো। এমনি করে আমরা আল্লাহ পাকের রহমত ও বরকত প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। শিশুর বয়স দুই বছর হওয়ার পর আমরা তার দুধ ছাড়ালাম। অন্যান্য শিশুদের চেয়ে এই শিশু ছিলেন অধিক হ্নষ্টপুষ্ট এবং মোটাসোটা। এরপর আমরা শিশুটিকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম। আমরা তার কারণে বরকত প্রত্যক্ষ করেছিলাম তাই চাচ্ছিলাম যে শিশ আমাদের কাছেই থাকুক। শিশুর মায়ের কাছে আমি এ ইচ্ছার কথা জানালাম। বার বার আবেদন নিবেদন জানাতে বিবি আমেনা পুনরায় শিশুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৬২, ১৬৩, ১৬৪)
সিনা চাকের ঘটনা
দুধ ছাড়ানোর পরও শিশু মোহাম্মদ বনু সাদ গোত্রই ছিলেন। তাঁর বয়স যখন চার অথবা পাঁচ বছর তখন সিনাচাক এর ঘটনাটি ঘটে। (অধিকাংশ সীরাত রচয়িতা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ইবনে ইসহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিন বছর বয়সে এ ঘটনা ঘটেছিল। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৬৪.১৬৫ )
এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণীত রয়েছে। বর্ণীত আছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আগমন করলেন। এ সময় আল্লাহর রসুল শিশুদের সাথে খেলা করছিলেন। জিবরাইল তাঁকে শুইয়ে বুক চিরে দিল বের করলেন, তারপর দিল থেকে একটি অংশ বের করে বললেন, এটা তোমার মধ্যে শয়তানের অংশ। এরপর দিল একটি তশতরিতে রেখে যমযম কাপের পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেন। তারপর যথাযথ স্থানে তা স্থাপন করলেন। অন্য শিশুরা ছুটে গিয়ে বিবি হালিমার কাছে বলল, মোহাম্মদকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরিবারের লোকেরা ছুটে এলো। এসে দেখলো তিনি বিবর্ণমুখে বসে আসেন। (সহীহ মুসলিম, আল আসরা অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-৯২)
মায়ের স্নেহে ও দাদার আদরে
এ ঘটনার পর বিবি হালিমা ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি শিশুকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। ছয় বচর বয়স পর্যন্ত তিনি মায়ের স্নেহ ছায়ায় কাটালেন। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৭ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ১৬৮)
এদিকে হযরত আমেনার ইচ্ছে হলো যে, তিনি পরলোকগত স্বামীর কবর যেয়ারত করবেন। পুত্র মোহাম্মদ, দাসী উম্মে আয়মন এবং শশুর মোত্তালেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছলেন। একমাস সেখানে অবস্থানের পর মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি আবওয়া নামক জায়গায় এসে বিবি আমেনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ক্রমে এই অসুখ বেড়ে চললো। অবশেষে তিনি আবওয়ায় ইন্তেকাল করেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৬৮, তালকিছুল তুহুম, পৃ-৭, ফেকহুছ সীরাত, গাযযালী, পৃ-৫০)
বৃদ্ধ আবদুল মোত্তালেব পৌত্রকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় পৌঁছলেন। পিতৃ-মাতৃহীন পৌত্রের জন্য তাঁর মনে ছিল ভালোবাসার উত্তাপ। অতীতের স্মৃতিতে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। পিতৃ-মাতৃহীন পৌত্রকে তিনি যতোটা ভালোবাসতেন এতো ভালোবাসা তাঁর নিজে পুত্র কন্যা কারো জন্যই ছিলনা। ভাগ্যের পরিহাস, বালক মোহাম্মদ সে অবস্থায় ছিলেন একান্ত নি:সঙ্গ কিন্তু আবদুল মোত্তালেব তাঁকে নি:সঙ্গ থাকতে দিতেন না, তিনি পৌত্রকে অন্য সকলের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। ইবনে হিশাম লিখেছেন, আবদুল মোত্তালেবের জন্য কাবাঘরের ছায়ায় বিছানা পেতে দেয়া হতো। তাঁর সব সন্তান সেই বিছানার চারিকে বসতো। কিন্তু মোহাম্মদ গেলে বিছানায়ই বসতেন। তিনি ছিলেন অল্প বয়স্ক শিশু। তাঁর চাচা তাঁকে বিছানা থেকে সরিয়ে দিনে কিন্তু আবদুল মোত্তালেব বলতেন, ওকে সরিয়ে দিয়ো না। ওর মর্যাদা অসাধারণ। এরপর তাকে নিজের পাশে বসাতেন। শুধু বসানোই নয় তিনি প্রিয় দৌহিত্রকে সব সময় নিজের সাথে রাখতেন। বালক মোহাম্মদ কাজকর্ম তাঁকে আনন্দ দিতো। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৬৮)
বয়স আট বছর দুই মাস দশদিন পর তাঁর দাদার স্নেহের ছায়াও উঠে গেল। তিনি ইন্তেকাল করলেন। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের পুত্র আবু তালেবকে ওসিয়ত করে গেলেন, তিনি যেন তার ভ্রাতুষ্পুত্রর বিশেষভাবে যত্ন নেন। আবু তালেব এবং আবদুল্লাহ ছিলেন একই মায়ের সন্তান। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৭, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৪৯)
চাচার স্নেহ বাৎসল্যে
আবু তালেব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে গভীর স্নেহ-মমতার সাথে প্রতিপালন করেন। তাঁকে নিজ সন্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বরং নিজ সন্তানের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন, চল্লিশ বছরের বেশী সময় পর্যন্ত ভ্রাতুষ্পুত্রকে সহায়তা দেন। আবু তালেব প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রর স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই মানুষের সাথে শত্রুতা মিত্রতার বন্ধন স্থাপন করতেন।
আল্লাহর রহমতের সন্ধানে
ইবনে আসকের জলাহামা ইবনে আরাফাতের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, আমি মক্কায় এলাম। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টির ফলেই এর সৃষ্টি হয়েছে। কোরাইশ বংশের লোকেরা বৃষ্টির আশায় দোয়া করার জন্য আবু তালেবের কাছে আবেদন জানালো। আবু তালেব একটি বালককে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। বালকটি কে খে মেঘে ঢাকা সূর্য মনে হচ্ছিল। আশে পাশে অন্যান্য বালকও ছিল। আবু তালেব সেই বালককে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘরের সামনে গেলেন। বালকের পিঠ কাবার দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলেন। বালক তাঁর তাতে আঙ্গুল রাখলো। আকাশে এক টুকরা মেঘও ছিল না। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সমগ্র আকাশ মেঘে ছেয়ে গেল এবং মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। শহরে প্রান্তর সজীব উর্বর হয়ে গেল। পরবর্তীকালে আবু তালেব এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, তিনি সুদর্শন তার চেহারা থেকে বৃষ্টির করুণা প্রত্যাশা করা হয়। তিনি এতিমদের আশ্রয় তিনি বিধবাদের রক্ষাকারী। (মুখতাছারু সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-১৫-১৬)
পাদ্রী বুহাইরা
নবী মোহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের বয়স যখন বারো বছর মতান্তরে বারো বছর দুই মাস দশদিন হলো (তালকিহুল ফুহুম, ইবনে জওযি, পৃ-৭) তখন আবু তালেব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ার রওয়ানা হলেন। বসরায় পৌছার পর এক জায়গায় তাঁবু স্থাপন করলেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী সেরা ছিল। সেই শহরে জারজিস নামে একজন পাদ্রী ছিলেন। তিনি বুহাইরা নামে পরিচিত ছিনে। কাফেলা তাঁবু স্থাপনের পরর বুহাইরা গির্জা থেকে বের হয়ে কাফেলার লোকদের কাছে এলেন এবং তাদের মেহমানদারী করলেন। অথচ পাদ্রী বাহাইরা কখনো তার গির্জা থেকে বের হতেন না। তিনি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনে ফেললেন এবং তাঁর হাত ধরে বললেন, তিনি সাইয়েদুল আলামিন। আল্লাহ পাক এঁকে রহমাতুল্লিল আলামিন হিসাবে প্রেরণ করবেন। আবু তালেব বুহাইরাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এটা কিভাবে বুঝলেন? তিনি বললেন, আপনারা এই এলাকায় আসার পর এই বালকের সম্মানে এখানকার সব গাছপালা এবং পাথর সেজদায় নত হয়েছে। এরা নবী ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করেনা। তাছাড়া মোহরে নবুয়তের দ্বারা আমি তাঁকে চিনত পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে নরম হাড়ের পাশে এটি সেব ফলের মতো মজুদ রয়েছে। তাঁর উল্লেখ আমরা আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে দেখেছি।
এরপর পাত্রী বুহাইরা আবু তালেবকে বললেন, ওকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিন। সিরিয়ার নেবেন না। ইহুদীরা ওর ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী আবু তালেব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-১৬, ইবনে হিশাম, পৃ-১৬, তিরমিযি সহ অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি হযরত বেলালের সাথে মক্কায় ফিরে যান, কিন্তু এটা ভুল। বেলালের তখনো জন্মই হয়নি। জন জন্ম হয়ে থাকলেও তিনি আবু বকরের সাথে পরিচিত ছিলেন না। যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ-১৭)।
ফুজ্জারের যুদ্ধ
নবী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়স যখন পনের বছর তখন ফুজ্জারের যুদ্ধ শুর হয়। ওই যুদ্ধে একদিকে কোরাইশ এবং তাদের সাথে ছিল বনু কেনানা অন্যদিকে ছিল কয়সে আয়নাল। কোরাইশ এবং কেনানার প্রধান ছিল হারব ইবনে উমাইয়া। বয়স এবং বংশ মর্যাদার কারণে কোরাইশদের নিকট সে সম্মানের পাত্র ছিল। বনু কেনানাও তাকে সম্মান করতো। যুদ্ধের প্রথম প্রহরে কেনানার ওপর কয়েসের পাল্লা ভারি ছিল। কিন্তু দুপুর হতে না হতেই কয়েসের ওপর কেনানার পাল্লা ভারি হয়ে গেল। এই যুদ্ধকে ফুজ্জারের যুদ্ধ এ কারণেই বলা হয়, যেহেতু এই যুদ্ধ হরম এবং হারাম মাস উভয়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর চাচাদের হাতে তীর তুলে দিতেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৮৪-১৮৬. কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ-৩৬০, তারিখে খাযরামি, ১ম খন্ড, পৃ-৬৩)
হেলফুল ফুযুল
ফুজ্জারের যুদ্ধের পর নিষিদ্ধ ঘোষিত জিলকদ মাসে হেলফুল ফুযুল সংঘটিত হয়। কয়েকটি গোত্র যেমন কোরাইশ অর্থাৎ বনি হাশেম, বনি মোত্তালেব, বনি আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা, বনি যোহরা ইবনে কেলাব এবং বনু তাইম ইবনে মোররা এর ব্যবস্থা করেন। এর সবাই আবদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাইমের ঘরে একত্রিত হন। এরা বয়সে এবং আভিজাত্যে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। এরা পরস্পর এ মমে অঙ্গীকার করলেন, যে মক্কায় সংঘটিত যে কোন প্রকার জুলুম অত্যাচার প্রতিরোধ করবেন।
হোক মক্কার অধিবাসী বা বাইরের কেউ-অত্যাচারিত হলে তার অত্যাচারের প্রতিকার করে তার অধিকার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ সমাবেশে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত ছিলেন। নবুয়ত পাওয়ার পর এ ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলতেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে এমন চুক্তিতে শরিক ছিলাম যার বিনিময়ে লাল উটও আমার পছন্দ নয়। ইসলামী যুগে সেই চুক্তির জন্য যদি আমাকে ডাকা হতো তবে আমি অবশ্যই হাযির হতাম। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৩৩-১৩৫, মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-৩০-৩১)
এ চুক্তির মূলে ছিল জাহেলী যুগের যাবতীয় বেইসনাফী দূরীকরণ। এ চুক্তির কারণ এটাই বলা হয়েছে যে, যোবায়েরের একজন লোক কিছু জিনিস নিয়ে মক্কায় এসেছিল আস ইবনে ওয়ায়েল তার নিকট থেক সেই জিনিস ক্রয় করে, কিন্তু তার মূল্য পরিশোধ করেনি। আস ইবনে ওয়ায়েলের নিকট জিনিস বিক্রেতা আবদুদ দার, মাখজুস, জামিহ, ছাহাম এবং আদীর আছে সাহায্যের আবেদন জানায়। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি। এরপর সেই লোকটি আবু কুরাইস পাহাড়ের উঠে উচ্চ স্বরে কয়েকটি কবিতা আবৃত্ত করলো সে কবিতায় তার প্রতি অত্যাচারের বর্ণনা করা হয়েছিল।
এতে যোবায়ের ইবনে আবদুল মোত্তালেব ছুটাছুটি শুরু করেন এবং বলেন, এই লোকটির প্রতি কোন সাহায্যকারী নেই কেন? তার চেষ্টায় উল্লেখিত কয়েকটি গোত্র একত্রিত হলো। প্রথমে তারা চুক্তি করলো এরপর আস ইবনে ওয়ায়েলের নিকট থেতে বিক্রীত পণ্যের মূল্য আদায় করে দিল। (মুখতাছারুছ সীরাত, পৃ-৩০-৩১)
সংগ্রামী জীবন যাপন
তরুণ বয়সে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের নিদিষ্ট কোন কাজ ছিল না। তবে বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিনি বকরি চরাতেন। তিনি বনি সাদ গোত্রের বকরি চরাতেন। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-৬২, ১৬৬)
কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কার বিভিন্ন লোকের বকরিও তিনি চরাতেন। ()(সহীহ বোখারী, ১মৃ খন্ড, পৃ-৩০১) পঁচিশ বছর বয়সে তিনি হযরত খাদিজা রাদি আল্লাহু আনহার বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন। ইনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, খাজিদা বিনতে খোয়াইলেদ একজন অভিজাত ধনবতী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন লোককে পণ্য কিনে দিতেন এবং সে সব পণ্য বিক্রি করতেন। লাভের একটা অংশ তিনি গ্রহণ করতেন। সমগ্র কোরাইশ গোত্রই ব্যবসা করতো। বিবি খাদিজা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের সততা, সচ্চরিত্রতা এবং নম্রতার কথা শুনে তাঁকে ব্যবসায় নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি তাঁর ত্রীতদাস মায়ছারাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন বিবি খাদিজা একথাও বললেন যে অন্য লোকদের যে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামকে তার চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দেবেন। আল্লাহর রাসুল এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং বিবি খাদিজার ব্যবসায়িক পণ্য তাঁর ক্রীতদাস মায়ছারাকে সাথে করে সিয়িয়া গেলেন। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৮৭, ১৮৮)।
বিবি খাদিজার সাথে বিয়ে
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম বাণিজ্যিক সফর থেকে মক্কা ফিরে আসার পর বিবি খাদিজা লক্ষ্য করলেন, অতীতের চেয়ে এবার তাঁর অনেক বেশী হয়েছে। এ ছাড়া তিনি ভৃত্য মায়ছারার কাছে আল্লাহর রসূলের উন্নত চরিত্র, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদির ভূয়সী প্রশংসা শুনলেন। এসব শুনে মনে মনে তিনি আল্লাহর রসুলকে ভালোবেসে ফেললেন। এর আগে বড় বড় সদার এবং নেতৃস্থানীয় লোক বিবি খাদিজাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু কোন প্রস্তাবই তিনি গ্রহণ করেননি। মনের গোপন ইচ্ছার কথা বিবি খাদিজা তাঁর বান্ধবী নাফিসা বিনতে মনব্বিহর কাছে ব্যক্ত করলেন। নাফিসা গিয়ে আল্লাহর রসুলের সাথে কথা বললেন। আল্লাহর রসুল রাযী হলেন এবং তার চাচার সাথে পরামর্শ করলেন। তাঁর চাচারা খাদিজার চাচার সাথে আলোচনা করনে এবং বিয়ের পয়গাম পাঠালেন। এরপর হয়ে গেল। এ বিয়েতে বনি হাশেম এবং মুজার গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সিরিয়া থেকে বাণিজ্যিক সফর শেষ করে ফিরে আসার দুই মাস পর এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহর রসূল বিয়ের মোহরানা হিসাবে বিশটি উট দিয়েছিলেন। বিবি খাদিজার বয়স সে সময় ছিল চল্লিশ বছর। তিনি বিবেক বুদ্ধি, সৌন্দর্য, অর্থ সম্পদ, বংশ মর্যাদার ছিলেন শ্রেষ্ঠ নারী। বিবি খাদিজার সাথে আল্লাহর রসুলের এটা ছিল প্রথম বিবাহ। বিবি খাদিজা বেঁচে থাকা অবস্থায় আল্লাহর রসুল অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৮৯, ১৯০, ফেকহুছ রীরাত পৃ-৫৯, তালকিছুল ফুহুম, পৃ-৭)
ইবরাহীম ব্যতীত রসুলুল্লাহ আলাইহিস ওয়াসাল্লামের সকল সন্তানে ছিল বিবি খাদিজার গর্ভজাত। সব প্রথম কাসেম জন্ম গ্রহণ করেন। এ কারণে আল্লাহর রসুলকে বলা হতো আবুল কাসেম বা কাসেমের পিতা। কাসেমের পর যয়নব, রোকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা এবং আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল্লাহর উপাধি ছিল তাইয়েব এবং তাহের। পুত্র সন্তান সকলেই শৈশবে ইন্তেকাল করেন। কন্যারা ইসলামের যুগে পেয়েছিলেন। তারা সকলেই ইসলাম গ্র্হণ করেন এবং হিজরতের গৌরব অর্জন করেন। হযরত ফাতেমা ছাড়া অন্য সকলেই রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর আব্বা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের ছয় মাস পর মৃত্যুমুখে পতিত হন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ১৯০-১৯১, ফেকহুছ সীরাত পৃ, ৬০, তহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ-১০৫, ঐতিহাসিক তথ্যে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। যে তথ্য নির্ভুল মনে হয়েছে সে তথ্যই আমি উল্লেখ করেছি। )
কাবার নির্মাণ এবং হাজরে আসওয়াদের বিরোধ মীমাংসা
নবী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর সে সময় কোরাইশরা নতুন করে কাবাঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এ উদ্যোগের কারণ ছিল এই যে, কাবাঘর মানুষের উচ্চতার চেয়ে সামান্য বেশী উচ্চতা বিশিষ্ট চার দেয়ালে ঘেরা ছিল। হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের জমানায়ই এসব দেয়ালের উচ্চতা ছিল নয় হাত এবং উপরের কোন ছাদ ছিল না। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত চোর ভেতরের সম্পদ চুরি করে। তাছাড়া নির্মাণের পর দীর্ঘকাল কেটে গেছে। ইমারত পুরনো হয়ে পড়েছিল এবং দেয়ালে ফাটল ধরেছিল। এদিকে সে বছর প্রবল প্লাবনও হয়েছিল, সেই প্লাবনের তোড় ছিল কাবাঘরের দিকে। এসব কারণে কাবারে যে কোন সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা ছিল কাবাঘরের দিকে। এসব কারণে কাবাঘর যে কোন সময় ধসে পড়ার আশংকা ছিল। তাই কোরাইশরা কাবাঘর নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো।
এ পর্যায়ে কোরাইশরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, কাবাঘরের নির্মাণ কাজে শুধু বৈধ উপায়ে অজিত অথই ব্যবহার করা হবে। এ সবের মধ্যে পতিতার উপার্জন, সুদের অর্থ এবং অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা কোন অর্থ সম্পদ ব্যবহার করা যাবে না।
কাবাঘর নতুন করে নির্মাণের জন্য পুরনো ইমারত ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেউ ঘর ভাঙ্গার সাহস পাচ্ছিল না। অবশেষে ওলীদ ইবনে মুগিরা মাখযমি প্রথমে ভাঙ্গতে শুরু করলো। সবাই যখন লক্ষ্য করলো যে, ওলীদের ওপর কোন বিপদ আপতিত হয়নি তখন সবাই ভাঙ্গার কাজে অংশগ্রহণ করলো। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিমিত অংশও ভাঙ্গার পর নতুন করে নির্মাণ শুরু করলো। নির্মাণ কাজে প্রত্যেক গোত্রের অংশ নির্ধারিত ছিল এবং প্রত্যেক গোত্র কাজ শুরু করলো। বাকুম নামে এক রোমক স্থপতি নির্মাণ কাজ তদারক করছিল। ইমারত যখন হাজারে আসওয়াদ পর্যন্ত উঁচু হলো তখন বিপদ দেখা দিল য, এ পবিত্র পাথর কে স্থাপন করবে। এটা ছিল একটা পবিত্র বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত কাজ। চার পাঁচ দিন যাবত এ ঝগড়া চলতে থাকলো। এ ঝগড়া মারাত্মক রূপ ধারণ করলো যে খুন খারাবি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিল। আবু উমাইয়া মাখজুমি এ বিবাদ ফয়সালার একটা উপায় এভাবে বের করলেন যে, আগামীকাল প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরোজা দিয়ে যিনি প্রবেশ করবেন তার ফায়সালা সবাই মেনে নেবে। এ প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করলো। পরদিন প্রত্যুষে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম কাবাঘরে প্রবেশ করলেন। এরপর তাঁকে বিচারক মনোনীত করা হলো। আল্লাহর রসুল একখানি চাদর মাটিতে নিজ হাতে সে চাদরের ওপর পাথর রাখলেন, তারপর বিবদমান গোত্রসমুহের সে চাদরের অংশ ধরে পাথর যথাস্থানে নিয়ে যেতে বললেন। তারা তাই করলেন। নির্ধারিত জায়গায় চাদর নিয়ে যাওয়ার পর আল্লাহর রসুল নিজ হাতে পাথর যথাস্থানে স্থাপন করলেন। এ ফায়সালা ছল অত্যন্ত বিবেক সম্মত এবং বুদ্ধিদীপ্ত। বিবদমান সকলেই এতে সন্তুষ্ট হলো। কারো কোন অভিযোগ রইল না।
এদিকে কোরাইশদের কাছে বৈধ অর্থের অভাব দেখা দিল। এ কারণে তারা উত্তর দিকে কাবার দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় হাত কমিয়ে দিল। এই অংশকে হেজর এবং হাতীম বলা হয়। এ পর্যায়ে কোরাইশরা কাবার দরোজা বেশ উঁচু করে দিলো যাতে একমাত্র তাদের অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিই কাবাঘরে প্রবেশ করেতে পারে। দেয়াল সমহু পনের হাত উঁচু হওয়ার পর ভেতরে ছয় খুঁটি দাঁড় করিয়ে ওপর ছাদ ঢালাই করা হলো। নির্মাণ শেষে কাবাঘর চতুষ্কোণ আকৃতি লাভ করলো। বর্তমানে কাবাঘরের উচ্চতা পনের মিটার। যে অংশে হাজরে আসওয়াদ রয়েছে সে অংশের দেয়াল এবং তার সামনের অর্থাৎ উত্তরও দক্ষিণ অংশের দেয়াল দশ দশ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন। হাজরে আসওয়াদ মাটি থেকে দেড় মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। যে দিকে দরোজা রয়েছে সেদিকের দেয়ার এবং সামনের দিকের অংশ পূব ও পশ্চিম দিকের দেয়াল থেকে বারো মিটার উচ্চ। দরোজা মাটি থেকে দুই মিটার উঁচু দেয়ালের ঘেরাও এর নীচে চারিদিক থেকে চেয়ারের আকৃতিবিশিষ্ট ঘেরাও রয়েছে। এর উচ্চতা পঁচিশ সেন্টিমিটার এবং দৈর্ঘ্য ত্রিশ সেন্টিমিটার। এটাকে শাজরাওয়ান বলা হয়। এটাও প্রকৃতপক্ষে কাবাঘরের অংশ কিন্তু কোরাইশরা এ অংশের নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখে। (বিস্তারিত বিবরণের জন্য ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৯২, ১৯৭, ফেকহুস সীরাত ৬২, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-১, ২, , ১৫)
নবুওয়তের আগের জীবন
বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যেসব গুণ বৈশিষ্ট্য বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায় রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে এককভাবেই সেই সব গুণবৈশিষ্ট ছিল। সেগুলো ছিলো দূরদর্শিতা, সত্যপ্রিয়তা এবং চিন্তাশীলতার এক সুউচ্চ মিনার। চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, পরিপক্বতা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পবিত্রতা তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। দীঘ সময়ের নীরবতায় তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আল্লাহর সাহায্য পেতেন। পরিচ্ছন্ন মাজিত সুন্দর বুদ্ধি, উন্নত স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি মানুষের জীবন সম্পর্কে বিশেষত জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে গভীরভাবে ধ্যান করেছিলেন। এ ধ্যানের মাধ্যমে মানুষকে যে সকল পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত দেখলেন, এতে তাঁর মন ঘৃণায় ভরে উঠল। তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হলেন। পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত মানুষ থেকে তিনি নিজেকে দুরে রাখলেন। মানুষের জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেয়ার পর মানব কল্যাণ যতোটা সম্ভব অংশগ্রহণ করতেন বাকি সময় নিজের প্রিয় নির্জনতার ভুবনে ফিরে যেতেন। তিনি কখনো মদ স্পর্শ করেন নি, আস্তানায় যবাই করা পশুর গোশত খাননি, মূর্তির জন্য আয়োজিত উৎসব, মেলা ইত্যাদিতে কখনোই অংশগ্রহণ করেননি।
শুরু থেকে তিনি মূর্তি নামের বাতিল উপাস্যদের অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। এতো বেশি ঘৃণা তাঁর অন্য কিছুর প্রতি ছিল না। লাত এবং ওযযার নামে শপথও তিনি সহ্য করতেন পারতেন না। (বুহাইরার ঘটনায় এর প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১২৮)
তকদীর তাঁর ওপর হেফাযতের ছায়া ফেলে রেখেছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। পার্থিব কোন কিছু পাওয়ার জন্য যখন মন ব্যাকুল হয়েছে, অথর্ব অপছন্দনীয় রুসম রেওয়াজের অনুসরণের জন্য মনে ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে তখন আল্লাহ পাক তাঁকে সেসব থেকে দুর সরিয়ে রেখেছিলেন।
ইবনে আছিরের এক বর্ণনায় রয়েছে রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জাহেলি যুগের লোকেরা যেসব কাজ করতো, দুবারের বেশি কখনো সেসব কাজ করার ইচ্ছে আমার হয়নি। সেই দুটি কাজেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে।
এরপর সে ধরনের কাজের ইচ্ছা কখনোই আমার মনে জাগেনি। ইতিমধ্যে আল্লাহ পাক আমাকে নবুয়তের গৌরবান্বিত করেছেন। মক্কার উপকণ্ঠে যে বালক আমার সাথে বকরি চরাতো একদিন তাকে বললাম, তুমি আমার বকরিগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য রাখতে তবে আমি মক্কায় গিয়ে অন্য যুবকদের মতো রাত্রিকালের গল্প গুজবের আসরে অংশ নিতাম। রাখাল রাযী হলো। আমি মক্কার দিকে রওয়ানা দিলাম। প্রথম ঘরের কাছে গিয়ে বাজনার আওয়াজ শুনলাম। জিজ্ঞাসা করায় একজন বলল, অমুকের সাথে অমুকের বিবাহ বিবাহ হচ্ছে। আমি শোনার জন্য বসে পড়লাম। আল্লাহ পাক আমার কান বন্ধ করে দিলেন, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রোদের আঁচ গায়ে লাগার পর আমার ঘুম ভাঙ্গলো। আমি তখন মক্কার উপকণ্ঠে সেই রাখালের কাছে ফিরে গেলাম। সে জিজ্ঞাসা করার পর সব কথা খুলে বললাম। আরো একদিন একিই রকমের কথা বলে রাখালের নিকট থেকে মক্কায় পৌঁছলাম কিন্তু প্রথমোক্ত রাতের মতই ঘটনা ঘটলো। এরপর কখনো ঐ ধরনের ভুল ইচ্ছা আমার মনে জাগ্রত হয়নি (হামেম যাবাবি এ হাদিসকে সহীহ বলেছেন, ইবনে কাছির তাঁর রচিত আল বেদয়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ২৮৭ পৃষ্টায় এই হাদিসকে যঈফ অর্থাৎ দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন)।
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বনিত আছে যে, কাবাঘর যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন নবী করিম রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আব্বাস পথর ভাঙ্গছিলেন। হযরত আব্বাস আল্লাহর রসুলকে বললেন, তহবন্দ খুলে কাঁধে রাখো, পাথরের ধুলোবালি থেকে রক্ষা পাবে। তহবন্দ খোলার সাথে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তারপর আকাশের প্রতি তাকালেন এবং বেহুশ হয়ে গেলেন, খানিক পরেই হুশ ফেরে এলে বললেন, আমার তহবন্দ আমার তহবন্দ। এরপর তাঁর তহবন্দ তাঁকে পরিয়ে দেয়া হয়। এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, এ ঘটনার পর আর কখনো তাঁর লজ্জাস্থান দেখা যায়নি। (সহীহ বোখারী, বাবে বুনিয়ানুল কাবা, ১ম খন্ড, পৃ.৫৪০)
নবী করিম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশংসনীয় কাজ, উন্নত সুন্দর চরিত্র এবং মাধুর্য মণ্ডিত স্বভাবের কারণে স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন সেকলের চেয়ে অধিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, উন্নত চরিত্রের অধিকারী, সম্মানিত প্রতিবেশী, সর্বাধিক দূরদর্শিতা সম্পন্ন, সকলের চেয়ে অধিক সত্যবাদী, সকলের চেয়ে কোমল প্রাণ পবিত্র পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী। ভালো কাজে ভালো কথায় তিনি ছিলেন সকলের চেয়ে অগ্রসর এবং প্রশংসিত। অঙ্গীকার পালন ছিলেন সকলের চেয়ে অগ্রণী। আমানতদারীর ক্ষেত্রে ছিলেন অতুলনীয়। স্বজাতির লোকেরা তার নাম রেখেছিলেন আল-আমিন। তিনি ছিলেন প্রশংসনীয় গুণ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়। হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা সাক্ষ্য দিয়েছেন য, তিনি বিপদ গ্রস্তদের বোঝা বহন করতেন, দু:খী দরিদ্র লোকদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতেন, মেহমানদারি করতেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্য করতেন। (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৩)
(আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে ওহী পাঠিয়ে বললেন) হে কম্বল আবৃত (মোহাম্মদ), উঠো তোমার শয্যা ছেড়ে দুনিয়ার মানুষদের ঈমান না আনার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করো এবং তুমি নিজে তোমার মালিকের মাহাত্য বর্ণনা করো। (সুরা মোদ্দাসসের-১-৩)
সূত্র:- সিরাত গ্রন্থ, আর-রাহিকুল মাখতুম
৭ম খন্ড
No comments