ইসলাম প্রচারক ভাই! প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দিন (পর্ব-১)
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
লিখেছেনঃ শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (রহ:) | অনুবাদ : জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের |
সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জন্য, আমরা তারই প্রশংসা করি, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তার কাছেই ক্ষমা চাই।
আর আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিকট আমাদের অন্তরসমূহের অনিষ্টতা থেকে
আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং খারাপ আমলের পরিণতি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেবে তাকে গোমরাহ করার কেউ নাই আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ
করে তাকে সঠিক পথ দেখানোর কেউ নাই। আর আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ
ছাড়া কোন সত্যিকার ইলাহ নাই। তিনি একক তার কোন শরিক নাই। আর আমরা সাক্ষ্য
দিচ্ছি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তার
রাসূল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর। আর তোমরা মুসলমান হওয়া ছাড়া মারা যেও না। [সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০২]
হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্নীয়তা নষ্ট করাকে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সুরা নিসা, আয়াত:১]
হে ঈমানদার গণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজগুলোকে শুদ্ধ করে দেবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করল। [সূরা আহযাব, আয়াত: ৭০-৭১]
এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রিসালা, যা সর্ব সাধারণ ও শিক্ষিত উভয়
শ্রেণীর লোকের জন্য বিশেষ উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ। রিসালাটিতে বর্তমান
সময়ের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন শেখ মুহাম্মদ নাছির উদ্দিন আল-আলবানী রহ. একটি
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেন। দ্বীনের প্রতি আগ্রহী প্রতিটি মানুষের
অন্তরে এ প্রশ্নটি বদ্ধমুল হয়ে আছে। যাদের চিন্তা-চেতনা সব সময় এ দ্বীনের
কল্যাণে ব্যয় হয়, যারা সর্বদা এ দীনের বিভিন্ন খেদমতে নিমজ্জিত এবং যারা
এ দ্বীনের ধারক-বাহক, তাদের প্রত্যেকের অন্তরে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রশ্নের সার-সংক্ষেপ হল,
মুসলিম জাতির পুণর্জাগরণের উপায় কি? কি পন্থা অবলম্বন করলে মুসলিম জাতি
তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরেয়ে পাবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যমিনে তাদের
ক্ষমতা দেবেন এবং অন্যন্য উম্মতদের তুলনায় অধিক সম্মানী আসনে পৌছতে ও
যথাযথ মর্যাদায় উন্নিত হতে পারবেন?
আল্লামা আলবানী রহ. রিসালাটিতে এ প্রশ্নের বিস্তারিত ও সু-স্পষ্ট উত্তর
দেন। যেহেতু প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে জানা প্রতিটি মুসলিমের জন্য খুবই
জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ, তাই আমরা উত্তরটি প্রচারের ব্যবস্থা করি, যাতে সবাই এ
প্রশ্নের বিশুদ্ধ সমাধান কি তা জানতে পারে। আল্লাহর নিকট আমাদের কামনা
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন, এ প্রশ্নের উত্তর জানা দ্বারা আমাদের দুনিয়া ও
আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করেন। আমরা আরও কামনা করি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন
যেন মুসলিম জাতিকে যা করলে তিনি পছন্দ করেন এবং সন্তুষ্ট হন, তা করার
তাওফীক দেন এবং তা করার প্রতি হেদায়েত দেন।
তাওহীদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া ও মনোযোগী হওয়া
প্রশ্ন: মাননীয়
শেখ, বর্তমানে মুসলিম উম্মার আকীদা বিষয়ে অজ্ঞতা ও আকীদার গুরত্বপূর্ণ
মাসায়েল সম্পর্কে ইলম না থাকার কারণে তাদের যে দূরাবস্থা তা আপনার অজানা
নয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মতাদর্শে উম্মতের বিভক্তি, অধিকাংশ স্থানে সালফে
সালেহীনদের আকীদা বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলামের দাওয়াত দেয়া ছেড়ে দেয়া
ইত্যাদি উম্মতের অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলছে। বর্তমানে উম্মতের এ নাজুক
পরিস্থিতি ও করুণ পরিণতি, মুখলিস বান্দা, সচেতন আলেমে দ্বীন দ্বীনের দাঈদের
অন্তরে এ অবস্থার পরিবর্তন করা এবং উম্মতে মুহাম্মদীকে সংশোধন করার প্রতি
এক ধরনের পিপাসা ও আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। এ সব দায়ী ও সংস্কারকরা তাদের
বিশ্বাস ও নিয়ম-নীতিতে মতানৈক্য থাকার কারণে উম্মতের বর্তমান অবস্থার
সংশোধন ও তাদের দাওয়াতের পদ্ধতি বিষয়েও বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন
করছে, এটিও আপনি ভালোভাবেই জানেন। বর্তমানে বিভিন্ন আন্দোলন, ইসলামী দল ও
জামাত যারা যুগ যুগ ধরে মুসলিম জাতিকে সংশোধন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু আজও কোন সফলতা ও কামিয়াবি তারা দেখতে পায়নি। বরং এ সব দল, সংগঠন ও
জামাতসমূহের আকীদা-বিশ্বাস রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
আদর্শ, কর্ম কৌশল ও তিনি যে দ্বীন নিয়ে এসেছে তার পরিপন্থী। এটি মুসলিম
জাতির বিপর্যয় ও তাদের মধ্যে অনৈক্য এবং তাদের পরস্পর দ্ধন্ধের কারণ হয়ে
দাড়িয়েছে। ফলে এ সব জামাত ও সংগঠনসমূহ মুসলিম জাতিকে এক প্রকার
অনিশ্চিয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। বিশেষ করে যুবক
শ্রেণীর বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ও সংশোধন করার বিষয়ে তাদেরকে বিপদে ফেলে
দিয়েছে। একজন মুসলিম প্রচারক, যিনি নবী ও রাসূলের প্রদর্শিত আদর্শের
অনুসারি, মুমীনদের পথের পথিক তিনি অবশ্যই জানেন বর্তমান অবস্থার সংশোধন করা
এবং এ অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টায় অংশগ্রহণ করা কত বড় দায়িত্ব ও
আমানতদারি।
* এ সব আন্দোলন ও দল সমূহের সাথে জড়িত হওয়ার বিষয়ে আপনার উপদেশ কি?
* বর্তমান অবস্থার উন্নতির জন্য উপকারি-ফলপ্রসু পন্থা ও উপায় কি?
* কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনর দরবারে একজন মুসলিম কিভাবে দায়মুক্ত হবে?
উত্তর: প্রথমে
তাওহীদের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। নবী ও রাসূলের মূলনীতি হল, তারা
প্রথমে তাদের উম্মতকে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন। প্রশ্নে উম্মতের যে করুণ
পরিণতি ও দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা বলব, বর্তমান
দূরাবস্থা জাহিলিয়্যাতের যুগে যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হিদায়েতের বাণী দিয়ে দুনিয়াতে
প্রেরণ করা হয়েছিল, তখনকার দুরাবস্থা থেকে কোন ক্রমেই বেশি করুণ নয়। তখন
মানবজাতির অবস্থা বর্তমান অবস্থার তুলনায় আরও অধিক খারাপ ও করুণ ছিল।
বর্তমান সময়ে মানব জাতির জন্য ইতিবাচক দিক হল, এখন আমাদের সামনে রিসালাত ও
পরিপূর্ণ দীন আছে। একটি অনুকরণযোগ্য হক জামাত আছে, যারা মানুষকে সহীহ
ইসলাম ও আকীদার দিক আহ্বান করে এবং উত্তম আর্দশ ও মানবতার দিকে মানুষকে
দাওয়াত দেয়। তবে এ কথা দিবা-লোকের মত স্পষ্ট, জাহিলিয়্যাতের যুগের
আরবদের অবস্থা ও বর্তমান যুগের অনেক মুসলিম জামাতের অবস্থা অভিন্ন। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বর্তমান যুগের মুসলিমদের অবস্থা জাহিলিয়্যাতের যুগের কাফেরদের অবস্থা হতে আরও বেশি করুণ।
এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলব, বর্তমান যুগের মুসলিমদের চিকিৎসা এটাই যেটা
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলিয়্যাতের যুগের লোকদের জন্য
প্রয়োগ করে ছিলেন এবং তাদের ঔষুধও একই ঔষুধ। যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলিয়্যাতের যুগের লোকদের চিকিৎসা করেছেন, এ
উম্মতের চিকিৎসা ও সংশোধন করতে হলে বর্তমানকালের ইসলাম প্রচারকদেরকেও একই
চিকিৎসা প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমান যুগের মানুষের মধ্যে ‘লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ সম্পর্কে যে ভ্রান্তি ও ভুল ব্যাখ্যা রয়েছে, তা দূর
করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ ও চিকিৎসা চালাতে হবে। তাদের দূরাবস্থা ও করুণ
পরিণতি দূর করতে হলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে চিকিৎসা ও
ঔষধ গ্রহণ করেছেন, তার হুবহু অনুকরণ করতে হবে। আমরা যদি আল্লাহ রাব্বুল
আলামীন এর বাণী সম্পর্কে একটু চিন্তা করি, তখন আমরা আমাদের এ কথার অর্থ,
আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
“অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আর্দশ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে”। [সূরা আহযাব, আয়াত: ২১]
মোট কথা, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমাদের উত্তম আদর্শ। বর্তমানে মুসলিমদের সমস্যা সমাধান ও তাদের
অধ:পতনের হাত হতে রক্ষা করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর আদর্শ অনুসরণ করার কোন বিকল্প নাই। কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম
উম্মাহর যত রকম সমস্যা হতে পারে, তার সমাধান রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম রেখে গেছেন। তিনিই আমাদের আদর্শ; তাকে আমাদের অনুকরণ করতে হবে।
সুতরাং আমরা যখন উম্মতের সংশোধন করতে যাব, তখন তা দিয়েই শুরু করব, যা
দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুরু করেছিলেন। প্রথমে
মুসলিম জাতির আকীদার চিকিৎসা করতে হবে। তাদের মধ্যে যে সব ভ্রান্ত আকীদা ও
বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে আছে, তা প্রথমে দূর করতে হবে। তারপর তাদের ইবাদত
বন্দেগীর ইসলাহ করতে হবে, তারপর তাদের মুয়ামালা বা লেন-দেন ইত্যাদির
সংশোধন করতে হবে। এখানে যে ধারাবাহিকতার কথা আলোচনা করা হয়েছে, তার অর্থ এ
নয়, প্রথমটি দ্বারা শুরু করবে তারপর যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি, তারপর
যেটি কম গুরুত্বপূর্ণ সেটি। এখানে সামগ্রিক বিষয়ের কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ, মুসলিম দীন প্রচারকরা আকীদার বিষয়ে দাওয়াত দেয়াকে অধিক পরিমাণে
গুরুত্ব দিবে। এখানে ‘মুসলিম’ দ্বারা সাধারণত উদ্দেশ্য হল, দীনের দায়ী তথা
যারা দীনের দাওয়াত ও প্রসারের কাজ করে। তবে এ ক্ষেত্রে ‘দায়ী বা দীন
প্রচারক’ না বলে ‘ওলামা’ শব্দ বলাই অধিক সঙ্গত। কারণ, অতি দু:খের সাথে বলতে
হয়, বর্তমানে ‘ইসলাম প্রচারক’ বললে সব মুসলিম তথা যার মধ্যে সামান্যতম
জ্ঞান, বুদ্ধি বা ইলম নাই তাকেও শামিল করা হয়; কারণ সবাই নিজেকে ইসলামের
প্রচারক হিসেবে চালিয়ে দেয়। একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হল – ‘যার নিজের কাছে
কিছু নাই, সে কাউকে কিছু দিতে পারে না’ – এ মূলনীতি শুধু শরয়ী আলেম নয়,
বরং সব জ্ঞানীদের নিকটও প্রসিদ্ধ। আমরা যদি তা নিয়ে আলোচনা করি, তখন আমরা
বুঝতে পারব, বর্তমানে একটি বড় জামাত আছে, যখন আমরা ‘দায়ী বা দীনের
প্রচারক’ শব্দ উচ্চারণ করি, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের দৃষ্টি তাদের দিকে যায়,
মানুষ মনে করে তারাই আল্লাহর পথের প্রচারক। এ বড় জামাত বলে আমি বুঝাচ্ছি,
জামাতে তাবলীগ, বা তাবলীগ জামাত। অথচ তাদের অধিকাংশ লোকের অবস্থা আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন এর বাণীর অনুরূপ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “অথচ অধিকাংশ মানুষ জানে না”। [সূরা আরাফ, আয়াত: ১৮৭]
তাদের দাওয়াতে পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা জানি তারা প্রথম যে বিষয়ে দাওয়াত
দেয়া দরকার অর্থাৎ তাওহীদ তা হতে সম্পূর্ণ বিমুখ। তারপর যেটি
গুরুত্বপূর্ণ অথাৎ ইবাদত এবং তারপর যেটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ মুয়ামালাত এ
সবটির কোনটির কোন খবর নাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনকি
সমগ্র নবী ও রাসূল যে বিষয়টি দ্বারা দাওয়াতের কাজ বা উম্মতের সংশোধন
আরম্ভ করেন, তা থেকে তারা একেবারেই বিমূখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
“আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে”।
[সূরা নাহাল, আয়াত: ৩৬]
তারা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন ও মৌলিক বিষয় হিসেবে মানুষের নিকট
প্রসিদ্ধ সে সব গুরুত্বপূর্ণ রুকন ও মৌলিক বিষয়ের প্রতি তেমন কোন
ভ্রূক্ষেপ করে না। অথচ সমস্ত রাসূলদের মধ্য হতে সর্বপ্রথম রাসূল নূহ
আলাইহিস সালাম। তিনি প্রায় সাড়ে নয় শত বছর পর্যন্ত তার উম্মতদেরকে
তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দেন। আমাদের কারও নিকট এ কথা অজানা নয়, পূর্বের
শরীয়তগুলো আমাদের শরীয়তের মত পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত ছিল না। আমাদের এ
দ্বীন হল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ দ্বীন; যেখানে কোন অস্পষ্টতা নাই। এ
দ্বীন হল, ইতিপূর্বে যত দীন দুনিয়াতে আর্ভিবাব হয়েছে, সব দ্বীন ও
শরিয়তের সমাপ্তি। নূহ আ. তার কাওমের মধ্যে প্রায় সাড়ে নয় শত বছর
অবস্থান করেন এবং তিনি এক মুহুর্তও আল্লাহর দ্বীন তথা তাওহীদের দাওয়াত হতে
বিরত থাকেননি। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা তিনি মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে
দাওয়াত দিতে থাকতেন। তারপরও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তার দাওয়াতে সাড়া
দেয়া বা দাওয়াত কবুল করা হতে বিরত থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
“আর তারা বলে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না; বর্জন করো না ওয়াদ, সুয়াদ, ইয়াগুছ ইয়াউক ও নাসরকে”।
[সূরা নুহ, আয়াত: ২৩]
আল্লাহর বাণী দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইসলামের দায়ীদের জন্য প্রথম কাজ হল, প্রথমে তাওহীদের দাওয়াতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া। এ কথাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করে বলেন,
“অতএব জেনে রাখ, নি:সন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই”।
[সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৯]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শও হল, তিনি বাস্তবে
মানুষকে প্রথমে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেন, এবং যাদের দাওয়াতের জন্য
প্রেরণ করেন তাদেরকে প্রথমে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়ার তালীম দেন। রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়া বিষয়ে
প্রমাণ খোঁজার প্রয়োজন নাই। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
মক্কী জীবনে তার কাজ ও দাওয়াতই ছিল, একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি
মানুষকে দাওয়াত দেয়া ও তার সাথে ইবাদাতে কাউকে শরীক না করা। তিনি মক্কার
কাফেরদের শুধু তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিতেন। আর তিনি কাউকে দাওয়াতের তালীম
দিতে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার তালীম দিতেন। যেমন, বুখারি ও মুসলিমে
আনাস বিন মালেক রা. এর হাদিস বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যখন মুয়াজ রা.কে ইয়ামনের দিকে প্রেরণ করেন, তখন তিনি তাকে
বলেন, তুমি তাদেরকে সর্ব প্রথম যে দাওয়াত দেবে তা যেন হয়, এ কথার সাক্ষ্য
দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। যদি তারা এ দাওয়াতে সাড়া দেয়… [বুখারি কিতাবুয যাকাত, ১৩৩১, তিরমিযি যাকাত, ৬২৫, নাসায়ি যাকাত ২৪৩৫ আবু দাউদ যাকাত ১৫৮৪, ইবনে মাযা যাকাত ১৭৮৩]
হাদিসটি প্রসিদ্ধ ও সবারই জানা।
মোট কথা, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যে বিষয়টির দাওয়াত দিয়ে শুরু করেন, অনুরূপভাবে তার
সাহাবীদেরকেও সে বিষয় দিয়ে দাওয়াত দেয়া শুরু করার নির্দেশ দেন। আর তা
হল, তাওহীদের দাওয়াত। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর যুগে আরবের মুশরিক –যারা তাদের ভাষায় কি কথা বলা হত, তা তারা বুঝত- আর
বর্তমান যুগের অধিকাংশ মুসলিমদের মধ্যে বিশাল তফাত ও পার্থক্য আছে। বর্তমান
যুগের মুসলিমদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার দাওয়াত দেয়ার কোন প্রয়োজন
নাই। কারণ, বর্তমান যুগের মুসলিমরা তাদের বিশ্বাস, নিয়ম-নীতি ও মতামতের
ভিন্নতা থাকা সত্বেও তারা মুখে ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ বলে। তারা সবাই মুখে
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে। কিন্তু তারা বাস্তবে কালিমায়ে
তাইয়্যেবার অর্থ ও মর্ম কি তা বুঝে না। বাস্তবে তাদের জন্য কালিমায়ে
তাইয়্যেবার অর্থ কি, তার মর্ম কি তা বুঝা অতীব জরুরি। বর্তমান যুগের
মুসলিম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের মুসলিমদের মধ্যে
এটি একটি মৌলিক পার্থক্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
যুগের মুশিরকদের যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার জন্য দাওয়াত দেয়া হত, তখন
তারা তা বলতে অস্বীকার করত এবং প্রত্যাখ্যান করত। কুরআনে বিষয়টিকে স্পষ্ট
উল্লেখ করা হয় এবং মুশরিকরা কি কারণে প্রত্যাখ্যান করত, তা জানানো হয়।[সূরা সাফ্ফাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ বাণীর প্রতি ইশারা করেন, যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, [35-36]
কারণ, তারা এ কালিমার মর্মার্থ কি তা জানতো। এ কালিমার মর্মাথ হল,
আল্লাহর সাথে কোন শরিক নির্ধারণ করো না, আর আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করো
না। অথচ, তারা গাইরুল্লাহর ইবাদাত করে, গাইরুল্লাহকে ডাকে এবং গাইরুল্লাহর
দ্বারা মানুষের থেকে সাহায্য কামনা করে। এ ছাড়াও তারা গাইরুল্লাহর জন্য
মান্নত করত, গাইরুল্লাহকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত
করত, গাইরুল্লাহর নামে জবেহ করত, এবং গাইরুল্লাহর নিকট বিচার ফায়সালা
নিয়ে যেত। তাদের পৌত্তলিকতা ও মুর্তি পুজাকে মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করা
ছিল খুব প্রসিদ্ধ। এতদসত্বেও তারা এ কথা
ভালোভাবে জানত, আরবী ভাষা অনুযায়ী কালিমা তাইয়্যিবা- লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ-র জন্য আবশ্যক হল, সব ধরনের গাইরুল্লাহ হতে দায়মুক্ত হওয়া এবং
গাইরুল্লাহর ইবাদাত হতে বিরত থাকা। কারণ, কালিমা তাইয়্যিবার অর্থের সাথে
গাইরুল্লাহর ইবাদাত করা, গাইরুল্লাহর নামে জবেহ করা এবং মুর্তি পুজা করা
সবই সাংঘর্ষিক।
চলবে……।
No comments