সুন্নাহ সম্পর্কে সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গী । পর্ব-১

প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে- 
 
মূল লেখা:জামাল আদ-দ্বীন জারাবোজো
 [সুন্নাহকে মুসলিম জীবনে বাতিল ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রমান করা হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী সকল অবিশ্বাসী এবং ইসলামী বিশ্বের আধুনিকতাবাদী তথা প্রগতিশীলদের একটা অন্যতম লক্ষ্য! কারণটা খুব সাধারণ: সুন্নাহ্ না থাকলে, ইসলামেরই আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না এবং কুরআন ও ইসলামকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যাখা করার সুযোগ তৈরী হবে। আজ আমরা ইনশা’আল্লাহ্ দেখবো মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবীরা (রা.) সুন্নাহকে কি চোখে দেখতেন! ]
আল্লাহর রাসূলের (সা.) পরেই যাঁরা কুর’আনের সত্যিকারের অর্থ সবচেয়ে ভাল বুঝতেন এবং একজন বিশ্বাসীর কি ধরণের আচরণ করা উচিত তা সবচেয়ে ভাল যাঁরা জানতেন, তাঁরা হচ্ছেন সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম ৷ আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজেই তাঁর প্রজন্মকে সর্বশ্রেষ্ট প্রজন্ম বলে আখ্যায়িত করেছেন: “তোমাদের (আমার উম্মতের) মাঝে সর্বশ্রেষ্ট হচ্ছে আমার প্রজন্ম, তারপর হচ্ছে তার পরের প্রজন্ম, এবং তারপর হচ্ছে তার পরের প্রজন্ম ৷”[সহীহ বুখারীঃ ৬০৬৫; সহীহ মুসলিমঃ ২৫৩৩] ৷ বাস্তবিকই সাহাবীদের (রা.) মাধ্যমে আল্লাহ কুর’আনকে সংরক্ষিত করেছিলেন এবং তাদের মাধ্যমেই পরবর্তী প্রজন্মগুলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত দিকগুলো সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নীচে আমরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও জ্ঞানী সাহাবীদের কয়েকজনের মতামত এবং রাসূল (সা.)-এঁর সুন্নাহ সম্বন্ধে তাঁদের অবস্থান তুলে দিলাম ৷
সুন্নাহ সম্বন্ধে সাহাবীদের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করার আগে, তাঁদের আচরণের একটা ব্যাপার সস্পর্কে উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে; তাঁরা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ট ঐ প্রজন্ম যাঁরা নবী (সা.)-কে তাৎক্ষিণকভাবে অনুসরণ করেছেন – কোন একটা নির্দিষ্ট কর্ম রাসূল (সা.) কেন সম্পাদন করলেন, সে সম্বন্ধে কোন সংশয় বা প্রশ্ন উত্থাপন করা ছাড়াই ৷ উদাহরণস্বরূপ বুখারীর বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এঁর সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি সোনার আংটি পরতেন, আর তাই লোকেরাও সোনার আংটি পরতে শুরু করলো ৷ তারপর নবী (সা.) আংটিটি পরিত্যাগ করলেন এবং বললেন, “আমি আর কখনো এটা পরবো না ৷” লোকেরাও সাথে সাথে তাদের সোনার আংটিগুলি পরিত্যাগ করলো ৷ [সহীহ বুখারী; অধ্যায়ঃ৭২/পোষাক-পরিচ্ছদ; হাদীস নংঃ ৭৫৬] আরেকটি উপলক্ষে নবী (সা.) সালাত আদায় করছিলেন এবং সালাতের মাঝে তিনি তাঁর জুতা খুলে ফেললেন ৷ সাহাবীরা (রা.) যখন তাঁকে ঐরকম করতে দেখলেন, তখন তাঁরা নিজেরাও তা অনুসরণ করলেন ৷ পরবর্তীতে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাঁরা কেন তাদের জুতা খুলে ফেলে দিলেন ৷ তাঁরা বললেন, “কেননা আমরা আপনাকে আপনার জুতো খুলে ফেলতে দেখেছি ৷” তিনি তাঁদের ব্যাখ্যা করলেন, “জিবরাইল (আ.) আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আমার জুতোয় কিছু ময়লা লেগেছিল ৷”[আবু-দাঊদঃ ৬৫০, শাইখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]

সাহাবীদের এই আচরণ এবং এর বাস্তবতা এই যে, তাঁদের এহেন আচরণের জন্য আল্লাহ এবং রাসূল (সা.) কখনোই তাদের তিরস্কার করেননি অথবা ভুল শুধরে দেননি – এটা হচ্ছে সুন্নাহ মর্যাদার ব্যাপারে আরেকটি প্রমাণ ৷ এ ধরনের ব্যাপার: ‘আল্লাহর নীরব অনুমোদন’ – এই শ্রেণীভূক্ত হবে ৷ এটা অকল্পণীয় যে তাঁরা যদি ভুল করে থাকতেন, তাহলে আল্লাহ তাঁর তরফ থেকে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত ছাড়া তাঁদের সে আচরণ অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যেতে দেবেন ৷
আল্লাহর রাসূলের জীবিত অবস্থায় তাঁদের উপরোক্ত ধরনের কর্মকান্ড ছাড়াও সাহাবীরা সুন্নাহর মর্যাদা ও কর্তৃত্ব সম্বন্ধে পরবর্তীতে তাঁদের বিশ্বাস ব্যক্ত করে বক্তব্য প্রদান করে গেছেন এমন বহু উদ্ধৃতির মাঝে নীচের উদ্ধৃতিগুলোও রয়েছে:
১)সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বলেন, “যারা উল্কি আঁকে, যারা উল্কি আঁকাতে চায়, যারা ভ্রু তুলে সরু করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন ঘটাতে দাঁত ফাঁক করে তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ ৷” একথা উম্ম ইয়াকুবের কাছে পৌঁছালে তিনি তাঁর কাছে আসেন এবং বলেন, “আমি শুনেছি আপনি এমন এমন কথা বলেছেন ৷” তিনি তাঁকে বললেন, “আল্লাহর রাসূল (সা.) যেটাকে অভিশাপ দিয়েছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে পাওয়া যায় সেরকম ব্যাপারে যদি আমি অভিশাপ দিই তাহলে আমার দোষ কোথায়” মহিলা তাঁকে বললেন ,”আমি (আল্লাহর কিতাব) শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি, কিন্তু কোথাও (আপনি যা বলেছেন) তা পাইনি ৷” আব্দুল্লাহ্‌ (রা.) তাঁকে বললেন,”আপনি পড়ে থাকলে তো আপনার পাবার কথা ৷ আপনি কি পড়েন নি ‘আল্লাহর রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করে তা থেকে দূরে থাকো’ ? (সূরা হাশর,৫৯;৭) মহিলা বললেন, “হ্যাঁ” তিনি বললেন, “তিনি [আল্লাহর রাসূল (সা.)] এসব জিনিস নিষেধ করেছেন ৷ ”[সহীহ বুখারীঃ ৪৬০৪; সহীহ মুসলিমঃ ২১২৫]
এই ঘটনায় একজন সাহাবী নবীর (সা.) প্রদত্ত বিধিনিষেধকে আল্লাহর বিধিনিষেধ বলে উল্লেখ করেছেন। ঐ ভদ্রমহিলা, অর্থাৎ, উম্ম ইয়াকুব, আব্দুল্লাহ্‌কে (রা.) ভুল বুঝেছিলেন, এবং ভেবেছিলেন যে, তিনি এমন কোন সুনিদিষ্ট আয়াতের কথা বলেছেন যেখানে ঐ কাজগুলির কথা নিদিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা রয়েছে ৷ আব্দুল্লাহ (রা.) তাঁর ব্যাখ্যায় দেখান যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা আসলে আল্লাহ যা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছেন তার মতই গুরুত্বপূর্ণ ৷ এ ব্যাপারে তাঁর প্রমাণ ছিল সূরা হাশরের সাত নম্বর আয়াত ৷
২)সাঈদ ইবন আল-মুসাইয়্যেব থেকে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর (রা.) বলেন, “একজন বিধবা তার স্বামী হত্যার বিপরীতে প্রাপ্ত রক্তপণ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে কিছুই পাবে না ৷আদ-দুহাক ইবন সুফিয়ান, উমর (রা.) কে বলেন যে, “রাসূল(সা.) একবার তাঁকে লিখেছিলেন যে, আস-শিয়াম আল-যাহাবীর স্ত্রীকে যেন তার স্বামীর রক্তপণের একটা অংশ উত্তরাধিকার হিসাবে দেওয়া হয় ৷” উমর (রা.) তারপর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন ৷ এবং রক্তপণের একটা অংশ বিধবাকে দান করেন ৷[সুনানে আবু-দাঊদ; খন্ড ১২, হাদীস নং ২৯২১] এই ঘটনা থেকে উমর আল-খাত্তাব (রা.) সুন্নাহর প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করতেন, তা বোঝা যায় – যিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন এবং দ্বীনের জ্ঞান ও সঠিক ধারণার জন্য যাঁর সুখ্যাতি ছিল ৷ না জেনে তিনি এমন একটা অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, যেটা রাসূল (সা.)-এঁর সিদ্ধান্তের বিপরীত ৷ কিন্তু যখনি তিনি বুঝলেন যে, তাঁর সিদ্ধান্ত সুন্নাহর বিপরীতে চলে যাচ্ছে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর মতামত পরিত্যাগ করলেন এবং আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা.) সিদ্ধান্তের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সমপর্ণ করলেন ৷
আরেকটি ঘটনায় যেখানে উমর (রা.) সম্পৃক্ত ছিলেন, একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কেননা একজন সাহাবী একটা সদৃশ ঘটনার ব্যাপারে নবী (সা.)-এঁর একটা হাদীস বর্ণনা করেছিলেন ৷ তারপর উমর (রা.) বলেছিলেন , “আমরা যদি এই হাদীস না শুনতাম, তবে আমরা একটা ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিতাম ৷ আমরা আমাদের মতামত অনুযায়ী বিচার করতাম ৷ এখানেও ইমাম শাফি’ঈ যেমন মন্তব্য করেন – উমরের (রা.) সিদ্ধান্ত নবীর (সা.) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হতো না ৷ কিন্তু যখন তাঁকে নবীর (সা.) সিদ্ধান্ত জানানো হলো, উমর (রা.) জানলেন যে, এ ব্যাপারে তাঁর আর কিছুই বলার রইলো না এবং উপরন্তু তিনি জানাতেন যে, একজন বিশ্বাসীকে অবশ্যই নবীর (সা.) সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে, এমনকি তা যদি তাঁর নিজের মতের বিপক্ষেও যায় ৷ 
সহীহ বুখারী ও মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় একটি ঘটনার কথা উল্লিখিত হয়েছে, যেখানে উমর (রা.) আল-শামে (বৃহত্তর সিরিয়া) যাবার জন্য মনস্থির করেছিলেন, সেখানে তখন একটা মহামারির প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ৷ এমতাবস্থায় তাঁর সাথে আব্দুর রহমান ইবন আউফ (রা.)-এঁর দেখা হলো, তখন আব্দুর রহমান (রা.) তাঁকে বললেন যে, নবী (সা.) বলেছেন, “যদি তোমরা শোন যে, কোন নিদিষ্ট স্থানে মহামারী দেখা দিয়েছে তবে, সে স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করো না; এবং তুমি যদি সেই স্থানে আগে থেকেই অবস্থান করে থাকো, তবে সেই স্থান ত্যাগ করে বাইরে যেও না ৷”[সহীহ বুখারীঃ ৫৭৩৯; সহীহ মুসলিমঃ ২২১৯] এটা শুনে উমর (রা.) বুঝলেন যে, তাঁর জন্য আল-শামের দিকে যাওয়াটা সঠিক হবে না, তাই তিনি মদীনায় ফিরে এলেন ৷
বুখারীতে লিপিবদ্ধ আরেকটি ঘটনায় দেখা যায় যে, ওমর (রা.) মাজুসিদের কাছ থেকে জিযিয়া কর সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকেন যতক্ষণ না আব্দুর রহমান ইবন আউফ (রা.) সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নবী (সা.) তাঁদের কাছ থেকে ঐ কর সংগ্রহ করেছিলেন ৷ [সহীহ বুখারীঃ ৩১৫৭] এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, এমনকি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নবীর(সা.) আদেশ ও সুন্নাহর কাছে সমর্পিত ৷ মাজুসীদের কাছ থেকে জিযিয়া কর গ্রহণ করার ব্যাপারে সংশয় থাকার দরুণ [যতক্ষণ না তিনি এ ব্যাপারে নবীর(সা.) উদাহরণ সম্পর্কে জানতে পারেন, ততক্ষণ], উমর (রা.) বর্ধিষ্ণু ইসলামী রাষ্ট্রের বাজেটের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছিলেন ৷
৩)আল- বাইহাকী ও আল-হাকিম কর্তৃক লিপিবদ্ধ সহীহ সনদে দেখা যায় যে, তাউস আসরের ফরজ সালাতের পরে ২ রাকাত নফল সালাত পড়ছিলেন ৷ ইবন আব্বাস (রা.) তাঁকে তা থেকে বিরত থাকতে বললেন ৷ তিনি উত্তর দিলেন যে, তিনি তা ত্যাগ করবেন না ৷ ইবন আব্বাস (রা.) তখন তাঁকে বললেন, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) আসরের সালাতের পরে সালাত নিষিদ্ধ করেছেন [মাগরেবের আগ পর্যন্ত] সুতরাং, আমি জানিনা (তুমি যে সালাত আদায় করেছো তার জন্য) তুমি শাস্তি পাবে না পুরষ্কৃত হবে ৷ [বাইহাকী ৪৪০৪]নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বলেছেন:“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে আদেশ দিলে, কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত্তের অধিকার থাকবে না ৷ কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে ৷”(সূরা আল-আহাযাব,৩৩:৩৬)
এই ঘটনা থেকে যে কেউ নবীর আদেশের গুরুত্বটা সহজেই বুঝতে পারবেন ৷ ইবাদতের মত একটা সৎকর্মের বেলায়ও যে কারো মনে রাখতে হবে যে, সে সম্বন্ধে নবী (সা.) প্রদত্ত নিয়ম-নীতি কী ৷ ইবন আব্বাস (রা.) তাউস-কে বললেন , “আমি জানি না তুমি পুরষ্কৃত হবে না শাস্তি লাভ করবে” – তাউস যে অতিরিক্ত সালাত আদায় করার জন্য শাস্তি লাভ করবেন তা কিভাবে হয়? তা এজন্যই যে, তিনি আসলে নবীর আদেশ অমান্য করছিলেন! এ থেকে বোঝা যায়, সকল সৎকর্ম – তা যতই উন্নতমানের হোক না কেন – গ্রহণযোগ্য হবার জন্য সেগুলোকে অবশ্যই কুর’আন ও সুন্নাহ দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে ৷

No comments

Powered by Blogger.