রাবী ইবনে খোসাইম (রঃ) তাবেঈদের জীবনী


হে আবু ইয়াযিদ, যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তোমাকে দেখতেন, তাহলে অবশ্যই তোমাকে ভালবাসতেন
-সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ)



হেলাল ইবনে ইসাফ তার মেহমান মুনযির সাওরী কে বললেন-
হে মুনযির তামি কি আমার সঙ্গে শায়খের দরবারে যাবে, যেখানে আমরা কিছু সময় ঈমানী পরিবেশে কাটাতে পারবো?
মুনযির বললেনঃ- অবশ্যই যাব…আল্লাহর শপথ আমিতো শুধুমাত্র শায়খ রাবী ইবনে খোসাইমের সঙ্গে সাক্ষাতের আকাঙ্খায় এবং তার ঈমানের নূরে আলোকিত মজলিসে কিছুটা সময় কাটানোর আকর্ষণে এই কুফা নগরীতে ছুটে এসেছি। সুতরাং সেখানে তো যাবই। কিন্তু তুমি কি আমাদের জন্য তার অনুমতি নিয়েছ? মুনযির জ্ঞিাসা করলেন।
আমি শুনেছি তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হবার পর থেকেই আর কোথাও বের হন না, আপন গৃহে আপন প্রভুর ইবাদত বন্দেগীতে সময় কাটিয়ে দেন। কোন মানুষকে সাক্ষাত প্রদানে তিনি তেমন আগ্রহী নন।
হেলাল (রঃ) বললেন-
কুফার লোকেরা যতদিন ধরে তাকে জানে, তিনি তো আগাগোড়া এমনই ছিলেন, অসুখ তার মধ্যে নতুন কোন পরিবর্তন আনেনি।
মুনযির বললেন-
তাহলে তো আমদের যেতে কোন বাধা নেই।
তবে এই সব শায়খের বিভিন্ন হাল ও বিভিন্ন আদাত (অভ্যাস) থাকে। সুতরাং আমরা কি প্রশ্ন করে করে তার কথা শুনো নাকি চুপচাপ বসে তিনি যা বলেন তাই শুনতে থাকবো?
তার দরবারের রীতি কোনটা?
হেলাল বললেন-
তুমি কিছু জিজ্ঞাসা না করলে রাবী ইবনে খোসাইম কিছুতেই মুখ খুলবেন না। কারন যিকির ও ফিকির (চিন্তা) এ দুটোই তার কথা ও নীরবতা।
মুনযির বললেন- তাহলে চলুন আল্লাহর নামে রওনা দেই।
তারা যখন সেখানে পৌছলেন উবয়ে তাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- কেমন আছেন?
শরীরে বল নেই, ইবাদত বন্দেগী করতে পারি না, শুধু শুয়ে বসে রিযিক ধ্বংস করছি,.. মৃত্যুর সময় গুনছি।
হেলাল (রঃ) বললেন- কুফা নগরীতে একজন বিখ্যাত চিকিৎসক এসেছেন, আপনি অনুমতি দিয়ে তাকে একবার নিয়ে আসতে পারি।
তিনি জবাব দিলেন-
হেলাল! আমি জানি ওষুধের মধ্যে কার্যকারিতা আছে। কিন্তু আদ সামুদ কুপবাসী এবং এদের মধ্যবর্তী অনেক সমপ্রদায় কেন ধ্বংস হয়েছিলো?
কত পার্থিব মোহ এবং পৃথিবীর ভোগ সামগ্রীর প্রতি তাদের কত আকাঙ্খাই না ছিলো!
শক্তি ও ক্ষমতায় আমাদের চেয়ে তারা কতই না কঠিনতর ছিলো …
তাদের মাঝেও নিশ্চয় অনেক চিকিৎসক ছিলো…
ছিলো অনেক রুগী। কিন্তু আল্লাহর আযাব থেকে না তাদের চিকিৎসক মুক্তি পেয়েছে, না পেয়েছে রুগী। আসল রোগ যদি এটাই হতো যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তাহলে আমি অবশ্যই তোমার ঐ ডাক্তারের চিকিৎসা নিতাম…
তাহলে আসল রোগ কোনটি? – মুনযির আদবের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন।
আসল রোগ হলো গুনাহ…
তার ওষুধ কি? একমাত্র ওষুধ এস্তগফার।
সুস্থ হওয়ার উপায় কি? মুনযিরের জিজ্ঞাসা।
তওবা এমন তওবা যার পর আর গুনাহের পুনরাবৃত্তি হবে না…
এরপর তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন-
গোপন গোনাহগুলোর ব্যাপারে সাবধান…
সেগুলো মানুষের কাছে, যতই গোপনীয় হোক না কেন, আল্লাহর কাছে মোটেও গোপনীয় নয়। সেগুলোর ওষুধ খোজ…
মুনযির জিজ্ঞাসা করলেন-
ওগুলোর ওষুধ কি?
শায়খ বললেন- তাওবাতুন নাসূহা… এরপর তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করতে লাগলেন যে, চোখের পানিতে তার দাড়ি ভিজে গেলো।
মুনযির বললেন- এত ইবাদত ও পরহেযগারী সত্ত্বেও আপনি কাদছেন?
তিনি বললেন- হায় আমার পরহেযগারী!!
আহা! আমাদের দেখা সেইসব মানুষকে যদি তোমরা দেখতে, যদি তাদের পরহেযগারীর খবর রাখতে! যাদে তুলনায় আমাদের পরহেযগারীর খবর রাখতে! যাদের তুলনায় আমাদের পরহেযগারী চুরি, ডাকাতির সমতুল্য। (তিনি সাহাবীদের প্রতি ইংগিত করেছেন)
হেলাল বলেন- এমনি মুহূর্তে আমাদের সামনে হাজির হলো শায়খের ছেলে, সে সালাম দিয়ে বললো- আব্বাজান! আম্মা কষ্ট করে আপনার জন্য বিশেষভাবে একটু মিষ্টান্ন তৈরী করেছেন। আপনার কখন ইচ্ছা হবে- সেটার জন্য আম্মা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন- এখন কি সেটা নিয়ে আসবো?
তিনি বললেন- নিয়ে এসো।
ছেলেটি মিষ্টন্ন আনতে গেলে তখনই এক ভিক্ষুক দরজায় আওয়াজ দিলো, শায়খ বললেন- ওকে ভেতরে নিয়ে এসো। সে বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করলো, আমি দেখলাম, ছিন্ন, ভিন্ন পোশাক পরা এব বৃদ্ধ, যার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে- লোকটি অপ্রকৃতিস্থ, পাগল। আমি চোখ ফিরিয়ে নেবার আগেই শায়খের ছেলে সেখানে প্রবেশ করলো মিষ্টির থালা নিয়ে; শায়খ ইশারায় ভিক্ষুকের সামনে থালাটি রাখতে নির্দেশ দিলেন। ভিক্ষুক থালাটির উপর যেন ঝাপিয়ে পড়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগলো।
আব্বাজান! আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন, আম্মার এত কষ্ট এবং আগ্রহ- সবকিছু উপপেক্ষা করে আপনি মিষ্টিটুকু নিজে না খেয়ে এমন এক পাগলকে খাওয়ালেন যে বুঝতেও পারলো না ওগুলো ছিলো কত দুর্লভ।
শায়খ বললেন-
বেটা! সে বুঝতে না পারলেও আল্লাহ কিন্তু বুঝতে পেরেছেন… এরপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন-
অর্থঃ- কষ্মিনকালেও তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় না করো। - আল ইমরানঃ৯২
এমনি সময় সেখানে প্রবেশ করলেন শায়খের জনৈক আত্নীয়। তিনি বললেন- হে আবু ইয়াযিদ ! হুসাইন ইবনে ফাতেমা (রাঃ) নিহত হয়েছেন।
শায়খ শুনে বললেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…
এরপর তিনি তেলাওয়াত করলেন-
অর্থঃ- বলুন হে আল্লাহ! সমস্ত আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী। আপনিই আপনার বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করতো। -যুমারঃ৪৬
আত্নীয়টি এত শান্ত হলো না, বরং আবারো জিজ্ঞাসা করলো- তার হত্যার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?িআমার কথা হলো- আল্লাহর কাছেই তাদেরকে ফিরতে হবে এবং আল্লাহর কাছেই তাদের হিসাব দিতে হবে।
হেলাল (রঃ) বলেন-
আমি দেখলাম – যোহরের সময় প্রায় হয়ে যাচ্ছে সুতরাং শায়খকে বললাম- আমাকে কিছু উপদেশ দিন…
তিনি বললেন- খবরদার হেলাল! মানুষের প্রশংসায় প্রতারিত হয়ো না।
কারণ, মানুষ তো শুধু বাহিরটুকুই জানে। মনে রেখো অবশ্যই তোমাকে তোমার আমলের পরিণতি ভোগ করতে হবে। যে সব আমল আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয়নি, সেগুলো খুজেই পাওয়া যাবে না, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
মুনযির বললেন- আমাকেও কিছু উপদেশ দিন, আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন। শায়খ বললেন-হে মুনযির! তোমার জানা বিশয়ে আল্লাহকে ভয় করো…
যা তুমি জাননা সে ব্যাপারে অভিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হও। হে মুনযির! (খাটি তওবার ইচ্ছা না থাকলে) তোমাদের মধ্যে কেউ যেন এরকম না বলে…
হে আল্লাহ! আমি অতীতের গুনাহ ত্যাগ করে তোমার কাছে ফিরে আসছি, অতঃপর সত্যি যদি ফিরে না আসে তাহলে সেটা হবে মিথ্যা ওয়াদার শামিল। বরং বলা উটিত হে আল্লাহ! আমার তওবা কবুল করো, তাহলে সেটা হবে দুআর শামিল।
হে মুনযির ! মনে রেখো দুনিয়াদারী কথায় কোন কল্যাণ নেই, কল্যাণ কেবল এই কথাগুলোতে-
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…
আল্লাহু আকবার…
আলহামদুলিল্লাহ…
সুবহানাল্লাহ… বলার মধ্যে।
এছাড়াও কল্যাণের প্রার্থনায়
অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনায়…
সৎকাজের আদেশে…
অসৎকাজের নিষেধে…এবং কুরআন পাঠে, কল্যাণ রয়েছে।
এছাড়া আর কোন কথায় কোন কল্যাণ নেই।
মুনযির বললেন-
আমরা দীর্ঘসময় আপনার কাছে বসেও, আপনাকে কো কবিতা বলতে শুনলাম না, অথচ আপনার কোন কোন সঙ্গীকে দেখেছি তারা কবিতা বলে দৃষ্টন্ত দিয়ে থাকেন।
তিনি বললেন-

এখানে (দুনিয়ায়) যে কথাই বলবে সেটাই লিখিত হবে এবং সেখানে (পরকালে) তোমাকে পড়ে শোনানো হবে…আমি চাইনা, আমার আমলনামায় এমন কোন পংক্তি লিখা হোক যা হিসাবের সময় আমার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত হবে।

এরপর তিনি আমাদের সকলের দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন- তোমরা বেশী বেশী মৃত্যুকে স্মরণ করবে, কেননা তৃত্যু আমাদের অবশ্যম্ভাবী, মৃত্যু আমাদের অনিবার্য প্রতীক্ষা। অনিবার্য প্রতিক্ষীতের অনুপস্থিতি যতিই দীর্ঘ হয় উপস্থিতি ততই ঘনিভূত হয়। এরপর তিনি এত ক্রন্দন করলেন যে, অশ্রুতে তার চোয়াল ভিজে গেলো। অশ্রুভেজা কন্ঠে বললেন-
আগামীকাল (কেয়ামতের দিনে) আমাদের কি করার থাকবে?
অর্থঃ- যখন পৃথীবী চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে এবং আপনার পালনকর্তা ও ফেরেস্তাগণ সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবেন এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে। (আল ফাজরঃ-২১-২৩)
হেলাল(রাঃ) বলেন-
রাবী ইবনে খোসাইমের কথা শেষ না হতেই যোহরের আযান হলো। তিনি ছেলের দিকে ফিরে বললেন- চলো আমরা আল্লাহর দাঈর (আহবানকারী) ডাকে সাড়া দেই…
ছেলে আমাদের সাহায্য চেয়ে বললো- দয়া করে একটু সাহায্য করুন, আব্বাজানকে মসজিদে নিতে হবে। আমি বাম দিকে আর ছেলে ডানদিকে ধরে তাকে উঠালাম, তিনি আমাদের দুজনের কাধে ভর দিয়ে মসজিদে পৌছলেন,…তখন মুনযির তাকে বললেন-
হে আবু ইয়াযিদ! আল্লাহ পাক আপনাকে অবকাশ দিয়েছেন, আপনি েএত কষ্ট না করে, নিজের ঘরেই নামায পড়ে নিতে পারেন! তিনি বললেন-
ঠিকই বলেছো…
কিন্তু আমি যে আহবান শুনলাম…
(কল্যাণের দিকে এসো)
(কল্যাণের দিকে এসো)
কেউ যদি কল্যাণের ডাক শুনতে পায় সেকি আর ঘরে থাকতে পারে? তার তো হামাগুড়ি দেয়ে হলেও সে ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত।
কে ছিলেন এই রাবী ইবনে খোসাইম?
তিনি ছিলেন বিখ্যাত এক তাবেঈ.. প্রসিদ্ধ সেই আট ব্যক্তির অন্যতম যাদের প্রত্যেকের উপর আপন আপন যুগের যুহুদ ও ত্যাগের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি ছিলেন আদি আরব বংশীয়…
তিনি ছিলেন মুদার গোত্রীয়…
তার বংশ সূত্র মিলিত হয়েছে রাসূলের (সাঃ) তিৃপুরুষ ইলিয়াস ও মুদার এর সঙ্গে। মায়ের কোল থেকেই তার বিকাশ ও বর্ধন ঘটেছে ইবাদত বন্দেগীর পরিবেশে …
তার দুধ ছাড়ানো হয়েছে তাকওয়া ও পরহেযগারীর ভেতর দিয়ে…
তার মা রাতে ঘুমিয়ে যেতেন অতঃপর ঘুম ভাঙ্গলেই বালক রাবীকে আর বিছানায় পেতেন না, পেতেন জায়নামাযে…
কখনো সে মুনাজাতের মধ্যে চোখের পানিতে ভাসছে… আবার কখনো নামাযে আল্লাহর ধ্যানে হাবুডুবু খাচ্ছে…
তিনি কোমল কন্ঠে তাকে ডেকে বলতেন- বাবারে! তোমার চোখে কি একটুও ঘুম নেই?
তিনি জবাব দিতেন- যার শত্রুর ভয় আছে, তার চোখে কি আধার ছড়িয়ে পড়লে ঘুম থাকতে পারে? একথা শুনে চোখের পানিতে বৃদ্ধার গাল ভেসে যেত, তিনি ছেলের জন্য দুআ করতেন।
আরো পরে রাবী (রঃ) যখন যুবক হলেন, তার সঙ্গে সঙ্গে যুবক হলো তার পরহেযগারী এবং খোদাভীতি… রাতের আধারে যখন সব মানুষ নরম বিছানায় না এলিয়ে দিতো তখন এই যুবকের কান্নাকাটি আর বিলাপ মায়ের কোমল মনকে অস্থির করে তুলতো। এমন কি তার মনে নানারকমের ভালো মন্দ সন্দেহের আনাগোনা হত…
সুতরাং তিনি তাকে ডেকে বলতেন- বাবাগো ! তোমার কি হয়েছে বলো না?
তুমি কি কোন অপরাধ করেছো…তুমি কি কাউকে হত্যা করেছো?
তিনি জবাব দিতেন- হ্যা মা আমি একটি প্রাণ হরণ করেছি…
সরল মা আফসোসের সুরে জিজ্ঞাসা কনের-
বাবা গো ! তুমি বলো কে সেই নিহত ব্যক্তি, তার পরিবারের লোকজনকে বলে করলে হয়ত তারা তোমাকে ক্ষা করে দেবে?
আল্লাহর কসম! নিহত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন তোমার কান্নাকাটি আর রাত্রি জাগরণের কথা শুনলে অবশ্যই তোমার উপর রহম করবে।
তিনি বলেন- কাউকে বলো না মা, তার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ আমি হত্যা করেছি আমারই আত্মাকে… তাকে হত্যা করেছি গুনাহের অস্ত্র দিয়ে।
বারী ইবনে খোসাইম (রঃ) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন স্বভাব চরিত্রে, আকৃতি-প্রকৃতিতে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সর্বাধিক নিকটতম সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর।
উস্তদের খেদমতে তিনি েএমনভাবে লেগে থাকতেন যেমন সন্তান তার মায়ের পিছে লেগে থাকে।
পক্ষান্তরে উস্তাদও শিষ্যকে এমন ভালবাসতেন যেমন পিতা বাসে তার একমাত্র সন্তানকে।
রাবী ইবনে খোসাইমের জন্য ইবনে মাসউদের গৃহে ছিলো সর্বক্ষণিক সাধারণ অনুমতি, তিনি যতক্ষণ উস্তাদের কাছে থাকতেন ততক্ষণ সেখানে আর কারও প্রবেশাধিকার থাকতো না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) রাবী এর পরচ্ছিন্ন হৃদয়, নিষ্কলুষ অন্তর ও ইখলাসপূর্ণ ইবাদত দেখে ভীষণ আফসোস করতেন। তিনি ভেবে ব্যথিত হতেন রাবী এর জীবন রাসূলের (সাঃ) যগ থেকে বিলম্বিত এবং তার সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত বলে।
তিনি রাবীকে বলতেন-
হে আবু ইয়াযিদ ! যদি রাসূল (সাঃ) তোমাকে দেখতেন, তবে অবশ্যই তোমাকে খুব ভালবাসতেন।
তিনি আরো বলতেন- আমি তোমাকে যতবারই দেখেছি ততবারই মনে পড়েছে বিনয়ী আর নিষ্ঠাবানদের কথা।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) তার সম্পর্কে মোটেও অতিরঞ্জিত কিছু বলেননি, কেননা রাবী ইবনে খোসাইম তাকওয়া, পরহেযগারী ও খোদাভীতির এমন উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন, যেখানে তখনকার খুব অল্প লোকই পৌছুতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার তাকওয়া, পরহেযগারী সম্পর্কে এমন এমন বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে যা নিয়ে ইতিহাসের সোনলী পাতা অনন্তাল ধরে অহঙ্কার করবে। তার এক সঙ্গী বর্ণনা করেছেন-আমি কুড়ি বছর রাবী েইবনে খোসাইমের সহচর্যে কাটিয়েছি কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও কখনো তাকে উত্তম কথা ছাড়া আর কিছু বলতে শুনিনি।
এরপর তিনি তেলাওয়াত করেন- অর্থ- তারই দিকে আরোহণ করে সৎবাক্য এবং সৎকর্ম তাকে তুলে নেয়। ফাতেরঃ১০
তার সম্পর্কে আবদুর রহমান ইবনে আজলান বলেন-
আমি রাবীর কাছে একবার রাতযাপন করেছি, তিনি যখন নিশ্চিত হলেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, তখন নামাযে দাড়িয়ে গেলেন, নামাযে দাড়িয়ে পড়তে লাগলেন-অর্থ- যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে, তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব। যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? তাদের দাবী কত মন্দ। সুরা জাসিয়াঃ২১
সে রাত তিনি নামাযের মধ্যেই কাটিয়ে দিলেন…আয়াতটি তিনি একবার পড়ে শেষ করেন অতঃপর আবার পড়েন, এভাবেই সকাল পর্যন্ত তিনি নামাযই পড়তে থাকেন… তার দু চোখে যেন অশ্রুর বল্যা বয়ে যায়।
রাবী ইবনে খোসাইমের খোদাভীতি সম্পর্কে রয়েছে প্রচুর ঘটনা..
তার সমকালীন একদল লোক বর্ণনা করেছেন-
রাবী ইবনে খোসাইম সহ আমরা একবার আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর নিকট থেকে ফিরে আসছিলাম।ফেরার সময় ফুরাত নদীর তীরবর্তী একটি বিশাল চুল্লির পাশ দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছিল, চুল্লিতে জ্বলছিলো দাউ দাউ আগুন। চারদিকে উড়ে উড়ে পড়ছিলো সেই আগুনের ফুলকি…
যার লেলিহান শিা অনেক উচু পর্যন্ত উঠে যাচ্ছিলো..যার হুঙ্কার ছড়িয়ে পড়ছিলো আশেপাশে…চুল্লিতে ফেলা হয়েছিলো বড় বড় পাথর যা জ্বলতে জ্বলতে চুন হয়ে যাবে।


এই আগুন যখন রাবী ইবনে খোসাইমের দৃষ্টিতে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে তিনি থেমে গেলেন…
তার শরীরে কম্পন শুরু হলো, কম্পিত কন্ঠে তিনি উচ্চারণ করলেন…
অর্থ- অগ্নি যখন দুর থেকে তাদেরকে দেখবে, তখন তারা শুনতে পাবে তার গর্জন ও হুঙ্কার। যখন এ শিকলে কয়েকজনকে বাধা অবস্থায় জাহান্নামের কোন সংকির্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন সেখানে তারা মৃত্যুকে ডাকবে। ফুরকান ১২-১৩
অতঃপর সংজ্ঞা হারিয়ে তার দেহ মাটিতে লটিয়ে পড়লো।
দীর্ঘ সময় আমরা তার সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলাম। এরপর তাকে তার বাড়িতে পৌছে দিলাম।
এই ঘটনার পর থেক রাবী ইবনে খোসাইম সারাজীবন ধরে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছেন এবং মৃত্যুকেই আলিঙ্গনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। যখন মৃত্যুর ঘনিয়ে এলা, তার শিয়রে বসে তার মেয়ে কাদতে লাগলো। তিনি বললেন- কী ব্যাপার মামনি! তুমি কাদছ কেন? তোমার বাবার কাছে তো কল্যাণ এসেছে।
অতঃপর তিনি ্পন প্রাণ সমর্পণ করলেন প্রাণস্রষ্টার কাছে…
হে আল্লাহ! তুমি তার সমাধিকে তোমার নূরে, রহমতে পরিপূর্ণ করে দাও।
নবীদের জীবনী, সাহাবীদের জীবনী, তাবেঈদের জীবনী পড়তে আমাদের সাইটে চোখ রাখুন

No comments

Powered by Blogger.