উরওয়াহ ইবনে যুবাইর (রঃ) | তাবেঈদের জীবনী

উরওয়াহ ইবনে যুবাইর (রঃ)  |  তাবেঈদের জীবনী




যদি কেউ জান্নাতী মানুষ দেখে সুখ পেতে চায়, সে যেন উরওয়াহ্ ইবনে যুবাইরকে দেখে
                                                            আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান

পড়ন্ত বিকালের অস্তগামী সূর্য বাইতুল্লাহর উপর সোনালী রেখা বিস্তার করতে শুরু করলো, এতে বাইতুল্লাহর উন্মুক্ত ও পবিত্র প্রাঙ্গণে শীতলবায়ু প্রবাহের আভাস পেয়েজীবিত সাহাবী ও বড় বড় তাবেঈদের অনেকেই তওয়াফ শুরু করে দিলেন, তারা হেরেমের বায়ুমন্ডলকে সুবাসিত করে দিলেন তাকবীর ও তাহলীল দ্বারা, পুণ্য ভূমির পরিবেশকে সুরভিত করে দিলেন উত্তম উত্তম দুআর দ্বারা।
সারাদিনের প্রখর উত্তাপে তেতে উঠা কারা অঙ্গনের ভাপ করে যাওয়ায় এখন অন্যরাও দলে দলে হালকাবন্দী হয়ে পবিত্র কাবার আশ পাশে বসে পড়লো। এই ঘরের মর্যাদা ও ভাবগাম্ভির্য বুকে নিয়ে তারা আসন করে নিলো বিভিন্ন স্থানে।
তারা বাইতুল্লাহর অপরুপ সৌন্দর্যমাখা দীপ্তি চোখভরে উপভোগ করছিলো। তারা পরস্পরের মাঝে চালাচ্ছিলোবিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনা, যার মাঝে কোন গুনাহ ছিলো না, ছিলো না কোন অর্থহীন কথা।
কাবা শরীফের অন্যতম খুটি রুকনে ইয়ামানীর কাছে বসেছিলো বুবাসিত পোশাক পরা ও উচ্চ বংশীয় চার তরুণ। উজ্জ্বল চেহারার এই চার তরুণের পোশাকের মিল আর হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা দেখে মনে হচ্ছিলো ওরাযেন এই মসজিদে উড়ে বেড়ানো কতগুলো পায়রা।
সেই চারজনের নাম আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর, মুসআব ইবনে যুবাইর উরওয়াহ ইবনে যুবাইর এবং আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান। পুণ্যপথের যাত্রী সেই চার তরুণের মাঝে আলোচনা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো, তাদের একজন হঠাৎ প্রস্তাব করে বসলো-
চলো আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই…
এভাবে তাদের নিষ্পাপ কল্পনাগুলো অদৃশ্যের বিশল ভুবনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগলো, তাদের স্বপ্নগুলো আকাঙ্খার সবুজ উদ্যানে পাখা মেলে ভাসতে লাগলো।
আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইব বললেন-
আমার আকাঙ্খা হলো হিজাযের কর্তৃত্ব লাভ করা, খেলাফতের গৌরব অর্জন করা…
তার সহোদর মুস আর বললেন-
কিন্তু আমার আকাঙ্খা- দুই ইরাকের (কফাও বসরার) শাসক হওয়া, আমি চাই এ দুই অঞ্চলে যেন আমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বি জন্ম নিতে না পারে।
আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান বললেন-

ঠিক আছে, তোমাদের আকাঙ্খাগুলো যথার্থ, তবে আমি কিন্তু সমগ্র অঞ্চলের খলীফা না হওয়া পর্যন্ত থামবো না…
মু আবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানের পর খেলাফতের মসনদ আমিই লাভ করতে চাই…
উরওয়াহ ইবনে যুবাইর নীরব হয়ে রইলেন; কিছুই বললেন না, ফলে সবাই তার দিকে তাকালো…
হে উরওয়াহ! তোমরা আকাঙ্খার কথা তো কিছুই বললে না?
তিনি বললেন- তোমাদের পার্থিব আকাঙ্খায় বরকত দান করুন, কিন্তু আমার আকাঙ্খা ভিন্ন রকম, আমি এমন একজন আমলদার আলেম হতে চাই, যার নিকট থেকে মানুষ আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ গ্রহণ করবে, দ্বীনের আহকাম লক্ষ্য হলো…
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত প্রাপ্তির মাধ্যমে আখিরাতের জীবনকে সফলকাম করা…
এরপর সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে, একসময় ইয়াযিদি ইবনে মআবিয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর খলীফা নির্বাচিত হন। আবার কাবা শরীফের পাশেই – যেখানে বসে তিনি খলীফা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার অদূরেই একদিন নিহতও হন…
এরপর মুসআব ইবনে যুবাইর একদিন নিহত ভাই আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে ইরাকের শাসক নিযুক্ত হন এবং শাসন প্রতিরক্ষায় তিনিও শেষ পর্যন্ত আততায়ীর হতে নিহত হন…
এরপর আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের পালা, নিজ পিতার মৃত্যুর পর তিনি হলেন ফিলাফতের সর্বোচ্চ মর্যাদার উত্তরাধিকারী। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর এবং মুসআব ইবনে যুবাইয়ের নিহত হওয়ার পর তার পক্ষেই সকল মুসলমানের সম্মিলিত সমর্থন ব্যক্ত হয়, তারই পক্ষে সর্বস্তরের মানুষের বাইআত গৃহীত হয় । এভাবে তিনি হয়ে উঠেন বিশাল সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ সম্রাট। তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাদশা। কিন্তু সেই স্বপ্ন ও কল্পনার চতুর্থ সঙ্গী উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের কি হলো?
এসো আমরা তার কাহিনী শুরু করি একেবারে গোড়া থেকে।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের জন্ম হয় হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর খেলাফতকাল শেষ হওয়ার এক বছর পূর্বে। তার পরিবার ছিলো সম্মান ও মর্যাদার বিচারে তৎকালীন পৃথিবীর সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তার পিতা ছিলেন যুবাইর ইবনে আওয়ম, যিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাওয়ারী বা বিশেষ সহচর, যিনি ছিলেন ইসলামের সর্বপ্রথম তরবারী কোষমুক্তকারী, সর্বপরি যিনি ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের এক ভাগ্যবান অংশীদার।
তার মাতা ছিলেন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর কন্যা আসমা, যার ডাকনাম দেওয়া হয়েছিলো যানুন্নেতাকাইন বা দুই বেল্টওয়ালী। তার নানা ছিলেন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম খলীফা এবং হিজরতের সময় তার পর্বত গুহার অকৃত্রিম সঙ্গী ও জানবাজ বন্ধু। তার দাদী ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফু হযরত সফিয়াহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব। খালা ছিলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত আইশা (রাঃ) এমনকি দাফনকালেও হযরত আইশা (রাঃ) এর কবরে অবতরণকারী তিনিই। তিনিই নিজের দুই হাতে উম্মুল মুমিনীনের কবরের মাটি সমান করেছিলেন।
প্রিয় পাঠক! তোমার কি মনে হয় এর চেয়েও সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ বংশ হতে পারে? ঈমান ও ইসলাম ছাড়া কি এর চেয়েও বড় সৌভাগ্য হতে পারে?
পবিত্র কাবা অঙ্গনে উরওয়াহ একজন সত্যিকার আলেম হওয়ার যে আকাঙ্খা পেশ করেছিলেন তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি রাসূল (সাঃ) এর বেচে থাকা অবশিষ্ট সাহাবীদেরকে গনীমত মনে করতেন।
তিনি সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে সেই সাহাবীদের গৃহে ছুটে যেতেন, তাদের পিছে নামায আদায় করতেন, তাদের মজলিসেই পড়ে থাকতেন, ফলে তিনি হাদীস শিখেছেন ও বর্ণনা করেছেন হযরত আলী ইবনে আবী তালেব থেকে আবদুর রহমান ইবনে আউফ যায়েদ ইবনে সাবেত, আবু আইয়ূব আনসারী, উসামা ইবনে যাায়েদ, সাইদ ইবনে যায়েদ, আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, নুমান ইবনে বশীর প্রমূখ সাহাবায়ে কেরাম রাযিআল্লাহু আনহুম থেকে…

তিনি সর্বাধিক হাদীস শিখেছিলেন স্বীয় খালা উম্মুল মুমিনীন হযরত আইশা (রাঃ) থেকে, এভাবেই তিনি শেষ পর্যন্ত মদীনার সেই বিখ্যাত সাতজন ফকীহের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, দ্বীনি বিষয়গুলোতে মুসলিম জাতি যাদের শরণাপন্ন হতেন বারবার।
এমন কি সৎ ও নেক শাসকবর্গও দায়িত্ব পালনে সাহায্য কামনা করতেন তাদেরই। এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোাগ্য ঘটনা হলো-
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রঃ) খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালিকের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসাবে মদীনার দশজন ফকীহকে আমন্ত্রণ জনোলেন, যাদের শীর্ষে ছিলেন উরওয়াহ ইবনে যুবাইর…
আমন্ত্রিত ফুকাহায়ে কেরাম হাজির হলে তিনি নিজেই সবাইকে স্বাগত জানালেন, স্ব সম্মানে তাদেরকে বসতে দিলেন। এরপর তিনি আল্লাহ তায়ালার যথাসাধ্য হামদ ও ছানা আদায়ের পর বললেন-
আমি আপনাদেরকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যার ফলে আপনারা হবেন আমার ন্যায় ও ইনসাফের সহযোগী এবং লাভ করবেন অশেষ নেকী।
আমি আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি যে আপনাদের মতামত ছাড়া কোন বিষয়ে আমি চূড়ান্ত ফয়সালা করবো না। আপনারা যদি কাউকে অন্যের উপর জুলুম করতে দেখেন, অথবা কারো উপর আমার কোন কর্মচারীর জুলুমের খবর শুনতে পান, তাহলে আপনাদের কাছে আল্লাহর দোহাই দিচ্ছি, দয়া করে সেটা আমাকে জানাবেন।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইর একথা শুনে তার জন্য কল্যাণের দুআ করলেন এবং হক ও হেদায়াতের উপর তাকে অবিচল রাখার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইর ছিলেন ইলম ও আমলের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ইবাদত-বন্দেগী, তাকওয়া-পরহেযগারী ও যোহদের সর্বোচ্চ ধাপ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, যার ফলে প্রচন্ড গ্রীষ্মেও তিনি বিরামহীন রোযা রাখতেন।
রাতভর ইবাদতে মশগুল থাকতেন…
আল্লাহর যিকিরে হামেশা জিহ্বা সচল রাখতেন…
এসব কিছু সত্ত্বেও কুরআনের তিলাওতেই তিনি ছিলেন সর্বাধিক অনুরাগী। দিনের বেলা দেখে দেখে কুরআনের এক চতুর্থাংশ পাঠ করা এরপর সেটুকুই রাতে আবার নফল নামাযে তেলাওয়াত করা ছিলো তার প্রতিদিনের রুটিন।
যৌবনের শুররু থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই আমল তিনি শুধুমাত্র একদিনের দুর্ঘটনা ছাড়া আর কখনোই ত্যাগ করেননি।
সে ঘটনাটি একটু পরে আসছে।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইর নামাযের মধ্যে খুজে পেতেন হৃদয়ের প্রশান্তি, চোখের শীতলতা। নামাযকেই তিনি মনে করতেন বেহেশতী সুখের নমুনা। ফলে তিনি নামাযকে পরিপূর্ণ সুন্দর করার উদ্দেশ্যে নামাযের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করতেন এবং নামায চূড়ান্ত রুপে দীর্ঘ করতেন…
তিনি একদিন দেখলেন এক লোক দ্রুত নামায পড়ছে, নামায শেষ হলে তিনি লোকটিকে কাছে ডেকে বললেন-
বাবা! আল্লাহর কাছে কি তোমার কোনই প্রয়োজন নেই?
আল্লাহর কসম! আমি তো নামাযের মাধ্যমেই আল্লাহর কাছে আমা সকল প্রয়োজনের কথা জানাই, এমনকি লবণের কথাটাও।
উরওয়াাহ ইবনে যুবাইর রিযওয়ানুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এক উদার ও অকৃপণ দানবীর…
মদীনায় ছিলো তার সর্ববৃহৎ এক বাগান…
যেখানে ছিলো সুমিষ্ট পানি, শীতল ছায়া আর সারি সারি খেজুরের গাছ…
তিনি বাগানটিকে শিশুদের ও উট, বকরীর নির্যাতন থেকে বাচানোর উদ্দেশ্যে চতুর্দিক থেকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতেন। একবার খেজুর পাকার সময় এলো, গাছে গাছে টসটসে খেজুর মানুষের দৃষ্টিকে লুব্ধ করতে লাগলো। সেই সময় একদিন বাগনের বেশীর ভাগ বেড়া পড়ে গেলো। মানুষের আনাগোনার সকল বাধা উন্মুক্ত হয়ে গেলো। ফলে লোকজন আসার পথে একবার, ফেরার পথে একবার সেখানে প্রবেশ করে ইচ্ছামত খেজুর খেতে লাগলো, এমন কি ইচ্ছামত খেজুর সঙ্গে নিয়েও যেতে লাগলো।
তিনি নিজের এই বাগানে যখনই প্রবেশ করতেন তখনই বারবার পড়তেন এই আয়াত-
অর্থঃ যখন তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করলে তখন একথা কেন বললে না; আল্লাহ যা চান তাই হয় আল্লাহর দেয়া ব্যতীত কোন শক্তি নেই। কাহাফঃ৯
ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালিকের শাসনামলে আল্লাহ তায়ালা উরওয়াহ ইবনে যুবাইরকে এমন এক কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন, যেখানে একমাত্রসজীব ঈমান ও দৃঢ় ইয়াকীন ছাড়া কারো পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
খলীফা ওয়ালীদ একবার উরওয়াহ ইবনে যুবাইরকে আমন্ত্রণ জানালেন দামেস্কে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে; তিনি লাব্বাইক বললেন সে আমন্ত্রণে। বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যখন তিনি খলীফার কাছে পৌছলেন, তার শুভাগমন উপলক্ষে খলীফা এক বর্ণাঢ্য সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করলেন। তিনি রাজকীয় অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের মাধমে মেহমানের চূড়ান্ত সম্মান প্রদর্শন করলেন।
কিন্তু এরপর আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় বাতাস বইতে লাগলো জাহাজের প্রতিকূলে- উরওয়াহর ছেলে খলীফার আস্তাবলে গেলেন শ্রেষ্ঠ ঘোড়াগুলো দেখার জন্য আর সেখানেই তাকে এমন ভীষণভাবে আঘাত করে বসলো একটি ঘোড়া, যাাতে তার জীবন প্রদীপ সঙ্গে সঙ্গেই নিভে গেলো।
ব্যথাতুর পিতা ছেলের সমাধির মাটি হাত থেকে ঝেড়ে ফেলার আগেই তার এক পা আক্রান্ত হলো ভীষণ ক্যান্সারে। তার পায়ের নলা ফুলে গেলো, ব্যথা তীব্র হতে লাগলো এবং দ্রুত সে ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।খলীফা ব্যাকুল হলে আশপাশের সকল চিকিৎসককে তলব করলেন…
তাদেরকে তিনি যেকোন মূল্যে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য উৎসাহিত করলেন…
কিন্তু সকল চিকিৎসক একমত হয়ে বললেন- ব্যথা সারা দেহে ছড়িয়ে তাকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়াার আগেই পা কেটে শরীর থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এছাড়া এখন আমাদের আর কোন উপায় নেই। খলিফা নিরুপায় হয়ে অনুমতি দিলেন…
শল্য চিকিৎসক গোস্ত, হাড্ডি ও চামড়া কাটার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলেন। তিনি উরওয়াহকে বললেন- আপনাকে সংজ্ঞাহীন করার জন্য এক ঢোক নেশাকর পানীয় পান করাতে চাই। তাতে আপনি যন্ত্রণা থেকে বাচতে পারবেন।
তিনি বললেন, খবরদার এমন করবেন না।
সুস্থতার জন্য আমি হারামের সাহায্য নিতে চাই না…
চিকিৎসক বললেন-
তাহলে আপনাকে অবশ করার ওষুধ নিতে হবে।
উরওয়াহ বললেন-
আমার শরীর থেকে একটি অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে আর আমি তার কোন কষ্ট অনুভব করবো না এটা আমার পসন্দনীয় নয়। আমি এই কষ্টের উপযুক্ত প্রতিদান আল্লাহর কাছে পেতে চাই।
চিকিৎসক যখন শুরু করতে যাাবেন তখন একদল লোক সামনে এগিয়ে এলো, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- এর কারা? কেন এসেছে?
বলা হলো-
আপনাকে ধরার জন্য এদের আনা হয়েছে, তীব্র ব্যাথায় হঠাৎ আপনি যেন পা টান দিতে না পারেন, সেজন্যই এরা আপনাকে শক্ত করে ধরে রাখবে।
তিনি বললেন-
ওদেরকে বিদায় করে দাও…
ওদের প্রয়োজন হবে না। আশা করি সেটা আমি যিকির ও তাসবীহ দ্বারা সেরে নেব…
এরপর চিকিৎস গোস্ত কাটতে লাগলেন, ছুরি যখন হাড্ডিতে গিয়ে ঠেকলো তখন করাত দিয়ে হাড্ডি চিরতে লাগলো উরওয়াার মুখে শুনা যাচ্ছিল-
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার”
চিকিৎসক হাড্ডি চিরতেছিলেন আর উরওয়াহ তাকবীর ও তাহলীল (আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) পড়ছিলেন।
এভাবেই তাকবীর ও তাহলীলের মধ্যে দিয়ে তার পায়ের নলা সম্পূর্ণরুপে বিচ্ছিন্ন করা হয়ে গেলো। তাকে বেহুশ করা হয়নি, অবশ করা হয়নি এমকি ধরেও রাখা হয়নি।
এরপর লোহার বড় চামচে তেল গরম করা হলো, রক্তের বেগ থামানো ও ক্ষত শুকানোর উদ্দেশ্যে তার মধ্যে পা ডুবানো হলো, এতে তিনি মূছিত হয়ে দীর্ঘ সময় সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে রইলেন যাতে ঐ দিনের নির্ধারিত তেলাওয়াত ছুটে গেল…
এ দিনটিই ছিল যৌবনের শুরু থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত একমাত্র ব্যতিক্রম, যাতে তিনি তেলাওয়াতের ‍রুটিন রক্ষা করতে পারেন নি।
তিনি যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, কেটে ফেলা পা দেখতে চাইলেন। উপস্তিত লোকেরা সেটা তার সামনে পেশ করলো…
তিনি সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলতে লাগলেন…
আমি সেই মহান সত্তার কসম করে বলছি যিনি তোমার মাধ্যমে আমাকে রাতের আধারে মসজিদে নিয়ে যেতেন। তিনি খুব ভালভাবে জানেন, আমি কখনো তোমার মাধ্যমে কোন হারাম কাজে হেটে যাইনি…
এরপর তিনি মুসআব ইবনে আউসের কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেন…

কসম! আমার দু হাত কোন অন্যায় স্পর্শ করেনি
আমার দুটি পা অশ্লীল কাজে আমাকে বহন করেনি,
আমার চক্ষু, কর্ণ, বিবেক-বুদ্ধি সে পথে টানেনি,
সংশয়-সন্দেহ, অন্যায় – অশ্লীল পথ আমি মাড়াইনি,
আমি জানি কালচক্রে কোন বিপদ আমার ঘাড়ে চাপেনি
আমার পূর্বে শুধু এক তরুণের বড় বিপদ হয়েছিলো।



খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালিকের কাছে মহামান্য মেহমানের এই বিপদ অসহনীয় ঠেকতে লাগলো………
পুত্র হারানোর শোকে তিনি মুহ্যমান, এরই মধ্যে আবার নিজের পা হারালেন। এ অবস্থায় মহামান্য মেহমানকে শোক প্রকাশের ও সান্ত্বনা প্রদানের এক কৌশল তিনি খুজছিলেন। আকস্মিক আবস গোত্রের একদল লোক এলো রাজপ্রাসাদে, যাাদের মাঝে ছিলো এক অন্ধ ব্যক্তি। খলীফা ওয়াালিদ লোকটির কাছে দুষ্টিহীনতার কারণ জানতে চাইলে লোকটি বললো-
আমীরুল মুমিনীন! আবস গোত্রে আমার চেয়ে ধন, জন, সন্তান ইত্যাদিতে ঐশ্বর্যশালী লোক আর একটিও ছিলো না। আমিই ছিলাম তাদের মাঝে সর্বাধিক সম্পদশালী, ঈর্ষণীয় সুখ ও সৌভাগ্যের মালিক। আমি পরিবারবর্গ ও সম্পদসহ আমার স্বজাতির লোকরে সঙ্গে এক উপত্যকায় বাস করতাম। হঠাৎ এক রাতে আমাদের দিকে তেড়ে আসলো এক সর্বগ্রাসী বন্যা । তমন ভয়াবহ বন্যা ইতিপূর্বে আমরা আর কথনো দেখিনি… যা আমার সকল সম্পদ, পরিবার, পরিজন ও সন্তানকে ভাসিয়ে নিলো…
বন্যার সেই ভয়াাবহ ঢল আমার জন্য একটি মাত্র উট ও এক ছোট্র শিশু ছাড়া আর কিছুই রেখে গেলো না। উটটি ছিলো খুবই দুস্ট প্রকৃতির, সে আমার হাত থেকে ছুটে পালালো,  আমি বাধ্য হয়ে কোলের ছোট্ট শিশুকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে তার পিছে পিছে ছুটতে লাগলাম… সামান্য কিছু দুর যেতেই শিশুটির চিৎকার আমার কানে এসে লাগলো…
তাকিয়ে দেখি েএকটি নেকড়ের মুখে আমার মা-হারা সন্তানের মাথা। আমি এবার ঘুরে শিশুটির দিকে দৌড়ালাম, আমি সেখানে পৌছুতে পারলাম না, তার আগেই আমার একমাত্র মা হারা সন্তানটিকে খেয়ে শেষ করলো নেকড়ে বাঘটি।
এবার আমি আবার জীবনের শেষ সম্বল উটটির পিছে দৌড়াতে লাগলাম। একসময় তার কাছে পৌছে গেলাম, তার লাগাম ধরতে গেলাম অমনি সে পা দিয়ে আমার মুখে সজোরে আঘাত করলো, আমি লুটিয়ে ‍পড়লাম মাটিতে, সঙ্গে সঙ্গে আমার দৃষ্টি শক্তি  নষ্ট হয়ে গেলো, এই সুন্দর পৃথিবী আমার কাছে পুরোপুরিই আধার হয়ে এলো। এভাবেই মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে আমি হয়ে পড়লাম সন্তান ও সম্পদহীন, পরিবার হারা, সবশেষে দৃষ্টিশক্তিহীন…
সবকথা শুনে খলীফা দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন-
আমাদের মেহমান উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের কাছে লোকটিকে নিয়ে যাও এবং তাকে এর কাহিনী শোনাও যেন তিনি বুতে পারেন এই পৃথিবীতে তার চেয়েও বেশী বিপদগ্রস্ত মানুষ আছে।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইরকে যখন মদীনায় আনা হলো এবং তাকে তার পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, তিনি প্রথমেই তাদেরকে বলে দিলেন, খবরদার! তোমরা যা শুনছো ও দেখছো, তাতে ভীত হয়ো না। কারণ আল্লাহ তায়ালা আমাকে চারটি ছেলে দান করেছেন যার মধ্য থেকে তিনি একটি ছেলে নিয়ে তিনটিকে আমার কাছে রেখে দিয়েছেন…
সুতরাং তার প্রশংসাই করতে হবে, আলহামদুলিল্লাহ…
তিনি আমাকে চারটি পার্শ্ব দিয়েছেন, যার থেকে তিনি একটি নিয়ে আমার কাছে তিনটি রেখে দিয়েছেন…
সুতরাং এ ব্যাপারেও তারই প্রশংসা করতে হবে, আলহামদুলিল্লাহ…
আমি আল্লাহর কসম করে বলছি তিনি আমার থেকে নিয়েছেন সামান্য এবং রেখেছেন অনেক বেশী। তিনি আমাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন মাত্র একবার কিন্তু সুস্থ রেখেছেন দীর্ঘকাল।
মদীনার লোকেরা যখন তাদের প্রিয় আলেম ও ইমাম উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের ফিরে আসার খবর পেলো, তখন তার গৃহে মানুষের ঢল নামলো। তারা তাকে সমবেদনা জানাতে ও তার প্রতি শোক প্রকাশ করতে সমবেত হলো। ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তালহার সান্ত্বনাবানীই ছিলো সবচেয়ে উত্তম। তিনি বললেন-
হে আবু আবদুল্লাহ! সুসংবাদ প্রহণ করুন, আপনার সমগ্র অংগ থেকেএকটি অংগ এবং সকল সন্তানের মধ্য থেকে মাত্র একটি সন্তান আপনার পূর্বেই জান্নাতে পৌছে গেছে…ইনশাআল্লাহ একক অংশের পিছে পিছে সমগ্রটাও একই গন্তব্যে পৌছে যাবে… আল্লাহ তাআলা আমদের জন্য আপনার সেই অসাধারণ জ্ঞান, ফিকাহ ও মতামতকে অবশিষ্ট রেখেছেন যার আমরা অভাবী এব যার প্রয়োজনীয়তা আমাদের ফুরোয়নি… উহার দ্বারা আল্লাহ আপনাকে এবং আমাদেরকে উপকৃত করুন… আল্লাহই আপনার সওয়াবের মালিক, তিনিই আপনার উত্তম হিসাবের জামিন।
উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের সমগ্র জীবনটােই ছিলো মুসলমানদের জন্য হিদায়াতের আলোকবর্তিকা, সফলতার পথপ্রদর্শক এবং কল্যাণের আহবায়ক…তিনি সর্বধিক যন্তবান ছিলেন বিশেষতঃ নিজ সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি আর ব্যাপকভাবে সকল মুসলমানের সন্তানদের প্রতি, সুতরাং তাদেরকে উপদেশ প্রদানের সামান্য সুযোগকেও তিনি গনীমত হিসাবে গ্রহণ করতেন। তিনি একটি মুহুর্তের জন্যও তাদের হিতাকাঙ্খার সুযোগকে অবহেলা করতেন না। তিনি সর্বদাই তাদের কল্যাণ কামনা করতেন। তিনি নিজ সন্তানদিগকে ইলম শিক্ষার উপদেশ দিতেন, তাদেরকে উৎসাহিত করে বলতেন-
বাবারা, তোমরা ইলম শিক্ষা কর এবং তার হক আদায় কর- তোমরা আজ ছোট ও গুরুত্বহীন হলেও খুব শীঘ্রই আল্লাহ তোমাদেরকে ইলমের মাধমে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ করে দিবেন।
তিনি আরো বলতেন-ছিছি দুনিয়াতে মূর্খ দাতপড়া বুড়োর চেয়ে খারাপ কিছু কি আর আছে?
তিনি দান সদকাকে আল্লাহর জন্য হাদিয়া হিসাবে গন্য করতেন। তিনি বলতেন- হে ছেলেরা! তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার প্রতিপালককে এমন কোন হাদিয়া না দেয়, যা সে কোন মর্যাদাবান ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে দিতে লজ্জাবোধ করে…
কেননা আল্লাহ হলেন র্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদাবান ও সেরা সম্ভ্রান্ত।
তিনি সন্তানদেরকে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন করে তুলতে চাইতেন, তাদেরকে মানুষের গভীরে পৌছুতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন- হে ছেলেরা! তোমরা যখন কোন লোককে চমৎকার একটি কাজ করতে দেখবে, তখন তার প্রতি কল্যাণের চিন্তা করবে, যদিও যে মানুষের চোখে ‍একজন খারাপ লোক। কেননা ঐ ব্যক্তি অনুরুপ চমৎকার কাজ নিশ্চয়ই আরো অনেক করে থাকে…আর যখন  ‍কাউকে কোন কুৎসিত কাজ করতে দেখবে, তখন তার ব্যাপারে সাধান থাকবে, যদিও সে মানুষের দৃষ্টিতে একজন ভাল মানুষ ; কেননা নিঃসন্দেহে অনুরুপ স্বভাব তার মাঝে আরো আছে। মনে রেখো ভালো কাজ জানান দেয় আরো অনেক ভালোর কথা। আর মন্দ কাজ বলে দেয় আরো অনেক মন্দের কথা…
তিনি তাদেরকে সদাচারণের ও উত্তম কথা বলার নির্দেশ দিতেন, প্রফুল্ল চেহারায় মানুষের মখোমুখী হতে বলতেন। তিনি বলতেন- হে ছেলেরা! হিকমত ও দর্শনে লিখিত আছে- তোমার কথা সুন্দর করো, চেহারা হাস্যোজ্জল করো, তাহলে তুমি হবে সর্বধিক জনপ্রিয় মানুষ…
তিনি যখন মানুষকে শৌখিনতা ও বিলাসিতার প্রতি ঝুকতে দেখতেন এবং দেখতেন সুখ ও সম্ভোগপূর্ণ জীবনকে পছন্দ করতে, তখন তিনি স্মরণ করিয়ে দিতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, তার ত্যাগ ও কুরবানীর কাহিনী। নবী জীবনের সেই সব অমর কাহিনীর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য একটি হলো- মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির থেকে বণিত, তিনি বলেন- উরওয়াহ ইবনে যুবােইরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি আমার হাত ধরে বললেন-
হে আবু আবদুল্লহ!
লাব্বাইল-
তিনি বললেন- আমি আমার মা(হযরত আইশা রাঃ ছিলেন তার খালা, যা এই জীবনীর শুরুতেই উল্লেখ রয়েছে। খালাকে মা বলা কোন অভিনব কিছু নয়) আইশা রাযিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, তিনি বললেন-
হে ছেলে!
আমি বল্লাম- লাব্বাইক
তিনি বললেন-আল্লাহর কসম! আমরা একনাগারে চল্লিশ রাত পর্যন্ত এমনভাবে কাটিয়েছি যে, রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহে আমরা আগুন দিয়ে না কোন বাতি জ্বালিয়েছি না অন্যকিছু…
আমি জিজ্ঞাসা করলাম-
হে আম্মা! আপনারা জীবন ধারণ করতেন কিভাবে?
তিনি বললেন-
দুই কালো বস্তু দিয়ে, খেজুর আর পানি।
এরপর হযরত উরওয়াহ পূর্ণ একাত্তর বছর বেচেছিলেন ভালভাবে, কল্যাণে পূর্ণ, পর্যাপ্ত নেকীতে ভরা আর তাকওয়ার ভিত্তিতে গড়া ছিলো তার বর্ণঢ্য জীবন…মৃত্যুর চূড়ান্ত সময় যেদিন উপস্থিত হলো, সেদিনটিতেও তিনি ছিলেন রোযাদার…
তার পরিবারের লোকেরা বহু জোরাজুরি করলেন তার রোযা ভাঙ্গানোর জন্য, কিন্তু তিনি কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না… আসলে তিনি রোযা ভাঙ্গতে অস্বীকার করেছেন, কারণ তিনি চাচ্ছিলেন, তার ইফতার হবে হাউজে কাউসারের পানি দিয়ে…
রুপোর ঝকঝকে গ্লাসে…
ডাগর ছোখের হুরদের হাতে

1 comment:

Powered by Blogger.