আতা ইবনে আবী রাবাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি | তাবেয়িদের জীবনী

আতা ইবনে আবী রাবাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি 


বংশগতভাবে তেমন নামকরা না হলেও গৌরব তাঁকে ছাড়েনি। মর্যাদাবেষ্টিত এক ব্যক্তিত্ব। যিনি কথায় লোকদেরকে কাঁদাতেন। তাঁর মত ও পরামর্শ গৃহীত হোক তিনি তা অপছন্দ করতেন। নিজেকে যিনি অমর লোকদের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। মহামনীষী মাঝে যাঁর অবস্থান সুদৃঢ়। তিনি আতা ইবনে আবী রাবাহ, আবূ মুহাম্মাদ আলকুরাশী। হারাম শরীফের ফকীহ ও প্রধান মুফতী। বিশিষ্ট ইসলামী আইনজ্ঞ। শাইখুল ইসলাম। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. এর ইলমী মজলিসের উত্তরাধিকারী। জন্মগ্রহণ করেন ইয়েমেনে। বেড়ে ওঠেন মক্কা শরীফে। আবূ মাইসিরাহ আলফিহরী বংশের আযাদকৃত বংশধর। গায়ের রং কালো ছিল। চেহারার আদল অনেকটা চেপ্টা ছিল। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে খোঁড়া হয়ে যান এবং পরবর্তীতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ্ বলেন, তাঁর আসরে বিরামহীন যিকির চলতো। কোন কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে সুন্দর উত্তর দিতেন। সালামা বিন কুহাইল রহ. বলেন, একমাত্র আতা ইবনে আবী রাবাহকে দেখেছি যিনি এই ইলম ও জ্ঞান হাসিল করেছেন শুধু আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য। একদিন আতা রহ. কে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, লা আদরী, আমি জানি না। প্রশ্ন করা হলো, আপনি নিজের থেকে কিছু একটা বলুন? তিনি যাহিদ ও দুনিয়াবিমুখ লোকদের ন্যায় বললেন, আমি এই মর্মে আল্লাহ্ তা’আলাকে লজ্জা পাই যে, আমার কোন মত দুনিয়ার জগতে আমল করা হতে থাকবে।
উমর ইবনে যির রহ. বলেন, আতা রহ. এর মতো কাউকে দেখিনি। তাঁর গায়ে কখনও জামা দেখিনি। গায়ের বস্ত্রের দাম পাঁচ দিরহাম মূল্যমানের হবে না। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হজ্জ্ব করতে মক্কা শরীফ আসলেন। লোকজন তাঁর চারপাশে জমায়েত হলো। বিভিন্ন মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। তিনি বললেন, আমাকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে তোমরা আমার চারপাশে জড়ো হয়েছো অথচ তোমাদের মাঝে আতা ইবনে আবী রাবাহ রয়েছেন?
দুনিয়া সেজেগোছে তাঁর কাছে ধরনা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। গোটা জীবন যাহিদ ও দুনিয়াবিমুখ হয়ে কাটিয়েছিলেন। বাদশাহগণ তাঁকে কাছে টানতে চেয়েছেন আর তিনি দূরে থেকেছেন। কেবল মুসলমানদের সেবা করার উদ্দেশ্যে বাদশাহদের দুয়ারে এসেছিলেন। নিজের প্রয়োজনে কখনও রাজা-বাদশাহ ও আমীরদের কাছে ঘেঁষেননি।
উসমান ইবনে আতা খুরাসানী বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আব্বার সাথে হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের দরবারে রওনা হলাম। সফরের এক সকালে দামেস্কের কাছাকাছি একটি লোকালয়ে একজন বৃদ্ধ লোককে দেখতে পেলাম। তিনি গাধায় আরোহী। গায়ের রং কালো। পরনে মোটা জামা। জীর্ণ জুব্বা। মাথায় চেপে লাগা একটি টুপি। তাকে দেখে আমি হাসলাম। বাবাকে বললাম, এই লোকটি কে? আব্বাজান আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ! তিনি গোটা হিজাযের প্রধান ফকীহ ও মুফতী। ইনি আতা ইবনে আবী রাবাহ।
আব্বাজান তাঁর খচ্চর থেকে নেমে আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. এর সাথে মুয়ানাকা করলেন। আতা রহ. তখনও নিজের গাধায় আরোহী ছিলেন। এরপর উভয়জন সওয়ার হয়ে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের প্রাসাদের ফকটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ভিতরে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করা হলো। প্রাসাদ থেকে বের হলে আমি আব্বাজানকে জিজ্ঞাসা করলাম প্রাসাদের ভেতরে কী ঘটেছে? তিনি বললেন, হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক যখন জানতে পারলেন যে, গেইটে আতা ইবনে আবী রাবাহ দাঁড়িয়ে আছে তৎক্ষণাৎ দৌড়িয়ে এসে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করলেন। কসম, তিনি না থাকলে আমি প্রবেশ করতে পারতাম না। হিশাম তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং নিজের সিংহাসনে বসালেন। এরপর হিশাম বললেন, আবূ মুহাম্মাদ! আপনার কী কী বিষয় দরকার মনে করেন সেগুলো বলুন। আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. মক্কাবাসী, মদীনাবাসী এবং সীমান্ত প্রহরীদের জন্য বিশেষ ভাতা প্রদানের কথা বললেন। সাথে সাথে হিশাম তার সেক্রেটারিকে বললেন, এদের জন্য বিশেষ ভাতার ফরমান জারি করে দাও। তাদের প্রতি সুনজর রাখারও পরামর্শ দিলেন।
এরপর হিশাম ঘুরে ফিরলেন আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. এর দিকে। বললেন, আর কোন খেদমত? অন্য কোন প্রয়োজন থাকলে সেগুলো বলুন। আতা রহ. বললেন, আমীরুল মুমিনীন, আপনি নিজের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাোক ভয় করুন। খেয়াল রাখবেন, আপনি একাকীভাবে সৃজিত হয়েছেন। মৃত্যুর সময়ও একাকী থাকবেন। হাশরে মাঠেও একা। নিজের হিসাব নিজেকে একাকী দিতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলার কসম, এখন আপনি যাদেরকে আপনার সাথে দেখছেন তারা কেউ আপনার সাথে নেই। এসব কথা শোনে হিশাম কেঁদে কেঁদে সারা। তিনি মাটিতে শলাকা দিয়ে খুঁড়ছেন আর কাঁদছেন।
এরপর আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. বাদশাহ’র দরবার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। তাঁর সাথে আমিও দাঁড়ালাম। আমরা প্রধান গেইটে পৌঁছামাত্র হঠাৎ এক লোক আমাদের পেছনে একটি ব্যাগ নিয়ে হাজির। তাতে কী আছে তা আমি জানি না। বলল, আমীরুল মুমিনীন এগুলো আপনাকে দিয়েছেন। একথা শোনে আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. বললেন, কখনও নয়; কখনও নয়। এরপর এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন (অনুবাদ) ‘আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে।’ (সূরা শুয়ারা, আয়াত : ১০৯)
কসম খোদার, তিনি বাদশাহ’র দরবারে প্রবেশ করেছেন এবং বের হয়েছেন; কিন্তু তিনি এক ফোঁটা পানিও পান করেননি। হিজরী ১১৪ সালে তিনি মক্কা শরীফে ইন্তেকাল করেন। ইমাম আওযায়ী রহ. বলেন, যে দিন আতা ইবনে আবী রাবাহ মারা যান সে দিন পৃথিবীবাসীর নিকট অতি মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.