হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা সাহমী (রাঃ) এর জীবনী

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা সাহমী (রাঃ) এর জীবনী



৬ষ্ঠ হিজরী। যখন রাছূল (সাঃ) অনারব রাজা-বাদশাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য সাহাবাদেরকে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। রাছুল (সাঃ) এ মিশনকে খুব গুরুত্ব দেন। যেহেতু আরবীয় এই দুতগণ এমন দূর দেশে যাবেন, যার সাথে তাদের কোন পূর্ব পরিচয় নেই। সে সব দেশের ভাষা ও জানেন না । ঐ সব রাজা বাদশাহ্দের মেজাজ মানসিকতা সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা নেই । এছাড়া এরা সেসব বাদশাকে তাদের দ্বীন-ধর্ম ত্যাগ করার দাওয়াত দেবে, তাদের মান-সম্মান ও বাদশাহী ত্যাগের দাওয়াত দেবে। এমন এক গোষ্ঠীর ধর্ম মেনে নিতে বলবেন, যারা ইতিপূর্বেও তাদের অনুগত ছিল। সুতরাং এ সফর ছিল শংকায় ভরা। যে এ সফরে যাবে, সে হারিয়ে যাবে। যে এ সফর থেকে ফিরে আসবে, সে নব জীবন-ই পাবে।
এজন্য রাছুল (সাঃ) সাহাবাদের সমবেত করে ভাষণ দিলেন তোমাদের কাউকে কাউকে আমি অনারব বাদশাদের কাছে পাঠাতে চাচ্ছি। অতএব তোমরা আমার সিদ্ধান্তে সে রূপ মতভেদ করোনা, যেরূপ বনি ইস্রাঈলের লোকেরা ঈসা (আঃ) বিন মরিয়ামের সাথে করেছে।
সাহাবায়ে কেরাম স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে রাছুল (সাঃ) এর সিদ্ধান্ত মেনে নিলে তিনি ছয়জন সাহাবীকে এই স্পর্শ কাতর কাজের জন্য নির্বাচিত করেন। এ ছয় জনের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা আছ ছাহ্মী (রাঃ) কে নির্বাচিত করা হয়েছে পারস্যের রাজা কিসরার কাছে নবী (সাঃ) এর চিঠি নিয়ে যাওয়ার জন্য।
স্ত্রী-পুত্র সবার থেকে বিদায় নিয়ে তিনি কখনো পাহাড়ে, কখনো নীচু ভূমিতে চড়ে সঙ্গীহীন একাকী সফর করে সুদূর পারস্যে পৌঁছেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি রাজ দরবারের অনুচরদেরকে তার মতলব বললেন এবং অনুমতি চাইলেন। বাদশা দুতের খবর পেয়ে দরবারে গন্যমান্য, উজির-নাজিরদেরকে নিয়ে মজলিশে বসলেন এবং আগন্তুককে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ্ হালকা একটা চাদর, মোটা জামাটি পরে গ্রাম্য সাদা-সিদে পোশাকে পারস্য অধিপতির দরবারে প্রবেশ করলেন। কিন্তু হৃদয়ভরা ঈমানে টগবগে যুবক আবদুল্লাহকে আসতে দেখেই কিসরা তার দরবারের একজনকে ইঙ্গিত দিল- সে যেন দূতের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নেয়। তখন আবদুল্লাহ্ বিন হুযাফা (রাঃ) বলেন- “না, রাসুল (সাঃ) চিঠিটা সরাসরি আপনার হতে অর্পন করতে আমাকে আদেশ করেন। আর আমি আল্লাহর রাছুলের কোন আদেশের অবাধ্য নই॥” তখন কিসরা দরবারের লোকদের বলল, তাকে আমার কছে আসতে দাও। তিনি কিসরার কাছাকাছি হলেন এবং নিজ হাতে চিঠিটা হস্তান্তর করেন। অতঃপর কিসরা হিরার অধিবাসী দরবারের একজন আরবী পন্ডিতকে ডাকলেন এবং তা পড়তে বলল। সে চিঠি খুলে পড়তে লাগলঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম,
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারস্য অধিপতি কিসরার প্রতি, যে হেদায়াতের অনুসরণ করে তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক…………..”
কিসরা এতটুকু শুনা মাত্রই তার বুকে আগুন জ্বলে উঠল। তার চেহারা ক্রোধে লাল হয়ে গেল, রগগুলো ফুলে উঠল। কেননা রাসূল (সঃ) নিজের নাম দিয়ে চিঠিটি শুরু করেছেন।
বাদশা পাঠকের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল অথচ জানলো না চিঠিতে পুরা কি আছে। সে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল- সে আমাকে এমন লিখতে পারে? অথচ সে আমার গোলাম। এরপর আবদুল্লাহ বিন হুজাফাকে দরবার থেকে বের করে দেয়া হল।
মনে কোন ব্যথা নেই, পরোয়া নেই। রাছুলের আদেশ পালন করতে পেরেছি এই আনন্দে আবদুল্লাহ সওয়ারীতে রওয়ানা হল।
রাগ ঠান্ডা হলে কিসরা আবদুল্লাহর খোঁজে লোক পাঠাল কিন্তু তারা আরব উপদ্বীপ পর্যন্ত খুঁজেও আবদুল্লাহকে পেল না।
আবদুল্লাহ নবী (সাঃ) এর কাছে ফিরে এসে কিসরার অহমিকা ও চিঠি ছিঁড়ে ফেলার সব ঘটনা বললেন। শুনে রাছুল (সাঃ) শুধুমাত্র এতটুকু বললেন- “আল্লাহ তার রাজত্বকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিক।”
এদিকে কিসরা ইয়ামেনে নিযুক্ত তার গভর্ণরকে (বাজান) ফরমান পাঠাল- “ হেজাজে যে লোকটির আবির্ভাব হয়েছে, তার কাছে তোমার থেকে দু’জন শক্তিশালী লোক প্রেরণ কর। তাদেরকে এই মর্মে আদেশ দাও যে- তারা যেন ঐ লোকটিকে আমার কাছে নিয়ে আসে।”
বাজান তার শীর্ষস্থানীয়, দৃঢ়প্রত্যয়ী দু’জনকে রাছুল (সাঃ) এর কাছে পাঠান । যেই কথা সেই কাজ। তারা দু’জনে খোঁজ খবর নিয়ে রাসূল (সাঃ) এর কাছে পৌঁছল এবং ইয়ামানের গভর্নর বাজানের লিখিত চিঠি মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাতে ন্যস্ত করে বলল ঃ- আমাদের শাহেনশাহ্ আদিষ্ট হয়েছে আপনাকে পারস্য সম্রাট কিসরার নিকট নিয়ে যেতে। আমরা সেই আদেশ পালনে এসেছি। যদি আপনি বাড়বাড়ি না করে আমাদের সাথে যেতে রাজি হন তবে আমরা কিসরার সঙ্গে দেখা করে আপনার জন্য সুপারিশ করব এতে আপনার শাস্তি মওকুফ হতে পারে। আর যদি অস্বীকৃতি জানান তবে আপনি তো তার ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে জানেন-ই।
রাসুল (সাঃ) একটু মৃদু হেসে বললেন- “ তোমরা আজ তোমাদের তাবুতে ফিরে যাও, আগামী কাল এসো।”
পরের দিন তারা দু’জন নবী (সাঃ) এর কাছে এসে তাকে বললঃ কিসরার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমাদের সাথে যেতে আপনি কি মনস্থির করেছেন?
তখন নবী (সাঃ) বলেন- আজ থেকে তোমরা আর কিসরার সাক্ষাৎ পাবে না। আল্লাহ তার ছেলে শিরাওয়াইকে তার উপর চড়াও করে দিয়েছেন।
এ কথা শুনে তারা নবী-করিম (সাঃ) এর চেহারার দিকে গভীর দৃষ্টিপাতে উভয়ে বিষ্ময় খেয়ে গেল। তারা বলল, আপনি কি বলছেন, তা কি বুঝতে পারছেন ? আমরা কি এ কথা বাজানের নিকট লিখে পাঠাবো ?
তিনি বললেন হ্যাঁ ! পাঠাও, আর তোমরা তাকে এটাও বল- “কিসরার রাজত্ব যে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে আমার দ্বীন সে পর্যন্ত পৌঁছবে। যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তাহার এলাকা ও সম্প্রদায়ের উপর তাকে কর্তৃত্ব দেয়া হবে।”
লোক দু’টি তাই লিখে বাজানের কাছে পাঠালো।
এর কিছু দিন পরেই বাজানের নিকট পারস্যের নতুন বাদশা শিরাওয়াই এর চিঠি আসল, চিঠিতে সে বলছে- “ অতঃপর আমি কিসরাকে হত্যা করেছি। আর আমি তা করেছি জাতির পক্ষ থেকে প্রতিশোধ হিসাবে। কেননা সে জাতির গন্যমাণ্য লোকদেরকে হত্যা করা বৈধ করে ফেলেছে। সুন্দরী ললনা দেরকে কুমতলবে বন্দী করা ও জনগনের সম্পদ লুটপাট করাকে বৈধ করে নিয়েছে। অতএব আমার চিঠি যখন পৌঁছবে তখন তুমি সেখানকার জনগণের থেকে আমার পক্ষে আনুগত্যের স্বীকৃতি নেবে।”
শিরাওয়াই এর চিঠি পড়া মাত্র বাজান তা একদিকে ফেলে দিলেন এবং উপস্থিত অন্যান্যদেরকে সঙ্গী করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এটা ছিল আবদুল্লাহ্ বিন হুযাকার প্রথম ঘটনা।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে হুযাফা (রাঃ) এর দ্বিতীয় ঘটনা ছিল হযরত ওমর (রাঃ) এর খিলাফত কালে। ১৯হিজরীতে ওমর (রাঃ) রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাও ছিলেন। মুসলমানদের ঈমানের দৃঢ়তা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর “কায়সার” সেনাপতিকে বললেন, “তোমরা মুসলিম কোন সৈন্যকে গ্রেফতার (বন্দি) করতে পারলে তাকে হত্যা না করে জীবিত অবস্থায় আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
তারা মুসলিম অগ্রসেনাদের একজনকে বন্দী করে বাদশার দরবারে নিয়ে এলো। তিনি ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফা আছ ছাহমী (রাঃ)। রোমের বাদশা আব্দুল্লাহ্ বিন হুযাফা এর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, এরপর বলে উঠলেন- আমি তোমার সামনে একটি প্রস্তাব রাখব।
তিনি বললেন তা কি?
বাদশাহ বললেন- আমি প্রস্তাব করছি, তুমি খৃষ্টান হয়ে যাও। যদি তাতে রাজি হও তবে তোমাকে মুক্ত করে দেব এবং তোমার অবস্থা হবে খুবই আনন্দময়, গৌরবান্বিত, মর্যাদাকর। বন্দি নাক ছিটকে দৃঢ়তার সহিত বলল- দূর হও। তুমি আমাকে যা করতে বলেছ, তার চেয়ে এক হাজার বার মৃত্যু বরণ করা আমার জন্য উত্তম।
কায়সার বলল- আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি একজন আত্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যাক্তি। তুমি যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত হও তা হলে আমার বিষয়াদিতে তোমাকে অংশীদারী করে নিব এবং আমার রাজত্বে তোমাকে ভাগীদার করবো।
শৃংখলে বন্দী আব্দুল্লাহ মুচকি হেসে বললেন- আল্লাহর কছম, তুমি যদি আমাকে তোমার পুরো রাজত্ব এবং আরবের পুরো রাজত্বও দিয়ে দাও এবং এক পলকের জন্য মুহম্মদের ধর্ম থেকে ফিরে আসতে বলো, আমি তা করব না। কায়ছার বললেন, তাহলে আমি তোমাকে হত্য করব।
বন্দি বললেন, তা তুমি করতে পার, তোমার ইচ্ছা।
কায়ছার তীরন্দাজকে রোমান ভাষায় বলল তার দুই হাতের কাছাকাছি তীর মার। আর বাদশাহ তার সামনে খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের প্রস্তাব পেশ করেই চলছে আর বন্দি অস্বীকার করতেছে। এরপর পায়ের কাছে মাথার কাছে তীর মারতেই লাগল। আর বাদশা বুঝাতেই লাগল। বন্দীর দৃঢ় অবস্থান দেখে বাদশাহ্ তীরন্দাজকে বিরত থাকতে বললেন। এবার একটি বড় ডেকচি আনা হল। তাতে তেল ভর্তি করে চুলায় চড়ানো হল। তেল টগবগে করতে লাগল। দু’জন মুসলমান বন্দিকে ডেকে আনা হল। কায়ছার ঐ তেলে একজনকে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলে যে মাত্র একজন নিক্ষিপ্ত হলো তাতে তার গোশত গুলো ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল, হাঁড়গুলো সাদা হয়ে বের হয়ে গেল। এমনি অবস্থা দর্শন মূহুর্তে কায়ছার আবদুল্লাহকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাবনা করে চলছেন। বন্দী পূর্বের চেয়ে আরও কঠিনভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
বাদশা যখন তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেল, তখন তাঁকে ঐ ডেকচিতে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দিলেন। আদেশ মোতাবেক তাকে যখন ডেকচির দিকে নিয়ে যাওয়া হল, তার দু’নয়ন অশ্র“সিক্ত হলো। সে কেঁদে ফেললো।
বাদশা ভাবলেন বন্দী হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। তাই তাকে খাছ কামরায় নিয়ে গেল।
এবার কায়ছার তার সামনে নতুন করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করে। এবারও আব্দুল্লাহ বিন হুযাফার অস্বীকার উক্তি-না।
বাদশা বললেন, দূর হও। তাহলে তুমি কেঁদে ফেললে কেন ?
সে বলল- আমি কেঁদেছি এজন্য যে, আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, আমাকে এখন এই ডেকচিতে নিক্ষেপ করা হবে, তখন আমার প্রাণ পাখি উড়ে যাবে অথচ আমার কামনা, আমার শরীরে যত পশম আছে যদি আমার ততগুলো প্রাণ থাকতো এবং আল্লাহর রাস্তায় সবগুলো প্রাণকে এই ডেকচিতে নিক্ষেপ করা হতো।
বন্দীর ঈমান দীপ্ত সাহসী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখে বাদশা বলে উঠল- তুমি কি আমার মাথায় একটু চুমু দেবে ?
তা হলে তোমাকে ছেড়ে দেব।
আব্দুল্লাহ্ বলল- সকল মুসলিম বন্দীদেরকে মুক্তি দেবে ?
হ্যাঁ সকল মুসলিম বন্দিকেও -বাদশা বলল।
আব্দুল্লাহ বলেন- একথা শুনে আমি ভাবলাম একটি চুমুর বিনিময়ে মুসলিম সব বন্দিরা মুক্তি পাবে। সুতরাং এতে আমার কোন গুনাহ্ হবে না।
এরপর তিনি বাদশাহ্র নিকটস্থ হলেন এবং তার মাথায় চুমু দিলেন। রোমের বাদশা সকল মুসলিমকে একত্র করার হুকুম দিলেন এবং তাদেরকে আব্দুল্লাহর হাতে সোপর্দ করে মুক্ত করে দিলেন।
দেশে ফিরে আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা খলিফা ওমর (রাঃ) এর কাছে গিয়ে সমূহ ঘটনা শুনালেন, আমীরুন মো’মেনীন সব শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বন্দীদের দিকে তাকিয়ে বললেন- প্রতিটি মুসলমানের (বন্দীর) দায়িত্ব আবদুল্লাহ্ বিন হুযাফার মাথায় চুমু খাওয়া। আর আমিই তা প্রথম শুরু করেছি। একথা বলে ওমর তার মাথায় চুমু খেলেন।

No comments

Powered by Blogger.