ক্যাট স্টিভেন্স থেকে ইউসুফ ইসলাম: একটি আলোকিত জীবনের ইতিকথা

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। সুপ্রিয় বন্ধুগণ, আজকে আপনাদের এমন একজন ব্যক্তিত্বকে পরিচয় করিয়ে দিব যে পাশ্চাত্যের চাকচিক্যময় পপ জগত ছেড়ে খৃস্ট ধর্ম বদলে শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। তাই প্রতিপদে তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতার। তবু তার জনপ্রিয়তা কমেনি একদমই। চালিয়ে যাচ্ছেন ইসলামের সৌন্দর্য প্রচারে নিরলস কর্মযজ্ঞ।
“এটি আল্লাহর হেদায়েত। তিনি এর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। (সূরা আনআম: ৮৮)
ইসলাম পালনের সাথে প্রগতি, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবনে উন্নতি, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি সাংঘর্ষিক – এমন ভ্রান্ত ধারনা প্রায়ই শোনা যায়। কোন ধর্মই অশান্তির কথা বলে না। ধর্ম চায় মানুষ সামাজিক নিয়মের মধ্যে থেকে স্রষ্টাকে মেনে চলুক। কিন্তু নিজের এবং স্ব-গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ পূরণের জন্য ধর্ম অপব্যবহার হয়ে আসছে, যুগে যুগে – এখনও। কলুষিত হচ্ছে ধর্ম। ইউসুফ ইসলামের জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যাবে, সঠিকভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করেও সফল, পরোপকারী, আধুনিক মানুষ হিসাবে নিজেকে বদলে নেয়া যায়।

ইউসুফ ইসলাম (ক্যাট স্টিভেন্স): 

■জন্ম: একুশে জুলাই ১৯৪৮
জন্মস্থান: লন্ডন, ইংল্যান্ড
বাবা: Stavros Georgiou (গ্রিক)
মা: Ingrid Wickman (সুইডিস)
পূর্বের নাম: Stephen Demetre Georgiou
গানের জগতে Cat Stevens নামে পরিচিত
■ একাধারে মানবতাবাদী, শিক্ষাগুরু, গায়ক, গীতিকার, মাল্টি ইনস্ট্রুমেন্টালিস্টস।

আধাঁর থেকে আলোর পথে:

১৯৭৬ সালের ছোট একটি দূর্ঘটনা বদলে দেয় তার সারাটা জীবন। ঘটনার দিন আমেরিকার ম্যালিবু বিচে সাতার কাটতে যেয়ে প্রায় ডুবতে বসেছিল। তখন সে মৃত্যু ভয়ে চিৎকার করে উঠে,
“Oh God! If you save me I will work for you.”
বলতে না বলতেই অপ্রত্যাশিত উল্টো একটি ঢেউ তাকে তীরে আছড়ে ফেলে! এই ঘটনার পর থেকে ক্যাট স্টিভেন্সের মনে আমূল পরিবর্তন আসে। পাশ্চাত্যের জড়বাদী জগতের পিছনে না দৌড়ে মনের শান্তি এবং আধ্যাত্মিক সত্যানুসন্ধানের দিকে ঝুঁকে পরেন। শুরুতে বৌদ্ধ ধর্ম, জেন, রাশিফল, অ্যাস্ট্রলজি, নিউমারলজি, টেরট কার্ড ইত্যাদি তুলনামুলক বোঝার চেষ্টা শুরু করেন।
আবার স্টিভেন্সের ভাই ডেভিড গর্ডন জেরুজালেম ঘুরতে যেয়ে ভাইয়ের জন্য একটি পবিত্র কোরান নিয়ে আসেন। ধারণা করা হয় এই সময় থেকেই ক্যাট স্টিভেন্সের ইসলামকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। এমন সময় ছুটিতে স্টিভেনস মরোক্কো ঘুরতে যেয়ে প্রথম আজানের ধ্বনি শুনতে পেয়ে অভিভূত হয়ে পরেন। জানতে চান, “এটা কিসের শব্দ?” উত্তরে জানতে পারেন, “এটা আজান, ঐশ্বরীয় বার্তা। যার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে মুসলমানদের মসজিদ মুখে আহ্বান করা হয়।” স্টিভেন্স ভাবেন, জীবনে টাকার জন্য গান করতে শুনেছি, গান হয়েছে খ্যাতির জন্য.. ক্ষমতা.. কিন্তু ঐশ্বরিক গান? জীবনেও শুনি নি! অসাধারন কনসেপ্ট! বলা যায় এই ভ্রমণটি ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পথে তার শেষ পদক্ষেপ। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালের ক্যাট স্টিভেন্স তেইশ ডিসেম্বর খৃস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। নিজের নাম ‘ক্যাট স্টিভেন্স’ পরিবর্তন করে ‘ইউসুফ ইসলাম’ রাখেন। পবিত্র কোরান শরীফের ইউসুফ নবীর কাহিনী পড়ে এই নামটির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হয়।

ইসলাম ধর্ম প্রচারে অবদান:

বর্তমানে ইংল্যান্ডে মুসলিম কমিউনিটিতে ইউসুফ ইসলাম জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। মূলত তিনটি মৌলিক ক্ষেত্রে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন:
১. শিশুদের ইসলাম শিক্ষা:
১৯৮৩ সালে মাত্র ৩ থেকে চার বছর বয়সের ১৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে লন্ডনে  Islamia Primary School  প্রতিষ্ঠা করেন। অসাধারন ব্যপার সে বছরেই অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর আবেদনের ভীড়ে অপেক্ষামান শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়!
১৯৮৯ Islamia Girls’ Secondary School প্রতিষ্ঠা করে অভূতপূর্ব সাফল্য পান। GCSE examination level এ এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গড় ফলাফল সবার চাইতে ভাল হয়। যা ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক নতুন ধারনা, মানদণ্ডের ভীত তৈরি করে।
ইউসুফ ইসলাম  Brondesbury College  নামের আর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এখানে মূলত স্কলারশিপ নিয়ে ছাত্ররা ইসলামি শিক্ষার আলোকে পড়াশোনা করে থাকে। তাদের ঈর্ষণীয়  রেজাল্ট  দেখলে ধারনা করা যায় তাদের সাফল্য।
ইউসুফ ইসলাম  United Kingdom Islamic Education Waqf (UKIEW) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এ প্রতিষ্ঠান মূলত ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। তিনি  “Association of Muslim Schools ”  এর ও চেয়ারম্যান। যারা সমগ্র ইংল্যান্ডে সকল ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ, তথ্য, শিক্ষা, ট্রেনিং ইত্যাদি দিয়ে থাকে।
১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডে তার তত্বাবধানে WAQF AL-BIRR EDUCATIONAL TRUST নামের একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান নথিভুক্ত হয়। এই প্রতিষ্ঠান ইসলাম প্রচারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠা এবং গবেষণার কাজও করে থাকেন তারা। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (মুসলিম/অমুসলিম) তারা International Board of Educational Research and Resources (IBERR) সাথে নিয়ে বিষয় ভিত্তিক ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োগ, ট্রেনিং, শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করে থাকে।
২. ইসলামের দাওয়াত:
১৯৯৪ সালে ইউসুফ ইসলাম  MOUNTAIN OF LIGHT  প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি মূলত ইসলাম ধর্ম বিষয়ক দাওয়াতি তথ্য উপকরণ, প্রচারের বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি করে থাকে। যেমন, মাল্টিমিডিয়া অডিও-ভিডিও ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি। এখান থেকে রিলিজ পায়  ‘Life of the Last Prophet’ । অ্যালবামটি ইন্সট্রুমেন্ট একদমই ব্যবহার হয়নি। এটা ২০ বছর মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রিস থেকে দূরে থাকার পর তার প্রথম অফিসিয়াল রিলিজ। তাদের নতুন রিলিজ A Is for Allah। ইসলাম শিক্ষা বিষয়ক ডাবল অ্যালবাম।
৩. বিশ্বের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের পাশে:
Muslim Aid একটি আর্ন্তজাতিক সাহায্য সংস্থা। ১৯৮৫ সালে ইউসুফ ইসলাম সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথিবীর অন্যান্ন মুসলিম সাহার্য সংস্থার সাথে মিলিতভাবে তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছে।
সংস্থাটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যস্থ মানুষদের সাহায্য করে থাকে। এযাবৎ কালে প্রায় চার লক্ষ মানুষকে তারা প্রত্যক্ষ সাহার্য করেছে। এছাড়া এতিম শিশু এবং দুস্থ পরিবারদের বিভিন্ন সাহার্য দিয়ে থাকে। আফ্রিকা, ইরাক, ইন্দেনেশিয়া এবং কসোভোতে হাজার হাজার দুস্থ পরিবার এবং এতিম শিশুকে পুনর্বাসন করেছে। বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে এই সংস্থাটি বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
ক্যাট স্টিভেনস মিউজিক‘ হতে বছরে আয়কৃত প্রায় দেশ মিলিয়ন ডলার পুরোটা ইসলাম প্রচার প্রসার এবং বিভিন্ন ত্রাণ কার্যে দান করে থাকেন।
ইউসুফ ইসলাম  FORUM AGAINST ISLAMOPHOBIA AND RACISM (FAIR)  নামের ফোরামের হয়ে ইসলাম ভীতি এবং বর্ণবাদ (Islamophobia and Racism) এর বিরুদ্ধে সর্বদা একটি সোচ্চার গলা। ভিন্ন বর্ণ-ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া নানা বৈষম্যমূলক নীতি, আইনের বিরুদ্ধে তারা কাজ করে যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশ ভ্রমণ:

 UNICEF এর বিশেষ দূত হয়ে ক্যাট স্টিভেন্স যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, পটুয়াখালি, ভোলা, রংপুর ইত্যাদি স্থানে ঘুড়ে বেড়িয়েছেন। দেশের ধনী ও গরীব শ্রেনীর বৈষম্য এবং রাজনীতির দৈন্যতা তার ভালই চোখে পরেছে! তার সেই করুন মধুর অভিজ্ঞতা জানতে এই  আর্টিক্যাল এ ক্লিক করুন।

আমেরিকায় অনুপ্রবেশে বাধা:

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে রেকর্ডিং এর কাজে লন্ডন থেকে ওয়াশিংটনে যাবার পথে তাকে আটক করা হয়। অভিযোগ আমেরিকার Border Protection (CBP) এ  No Fly List  এ তার নাম আছে। সে কারনে তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে হয়।
এ বিষয়ে আমেরিকার Homeland Security এর এক মূখপাত্র দাবি করে,
“নানা ঘটনা বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তার দ্বারা সম্ভাব্য ‘টেরোরিস্ট’ সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে! তাই এই ব্যবস্থা।” ২০০০ সালে ইসরাইলী সরকারও তাকে ইসরাইলে ঢুকতে দেয়নি। অভিযোগ প্যালেস্টাইনী সংস্থা ‘হামাস’ কে সাহায্য করার। ইউসুফ ইসলাম সব সময়ই এই সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, আমার সবাই জানি পবিত্র নগরী প্যালেস্টাইনে কি হচ্ছে এবং তাদের সত্যি অনেক সাহায্য প্রয়োজন। যে কোন ‘রাষ্ট্রকে অর্থ সাহায্য’ করাকে অনেকেই রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে তাদের হীন স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করে। পরে ইউসুফ ইসলাম এই বিষয়টি নিয়ে Paul McCartney, Alison Krauss, Dolly Parton এবং Terry Sylvester সাথে নিয়ে Boots and Sand নামের একটি গান লিখেন।

যথারীতি পশ্চিমা মিডিয়ার আক্রমন:

২০০৪ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের নামকরা পত্রিকা ‘The Sun’ এবং ‘The Sunday Times’ তাদের বিভিন্ন রিপোর্টে বলতে থাকে ইউসুফ ইসলামকে আমেরিকা থেকে ফেরত পাঠানো সঠিক ছিল। এবং তারা দাবী করে ইউসুফ ইসলামের সাথে সন্ত্রাসী গ্রুপের যোগসাজস আছে। এ কারনে ইউসুফ ইসলাম পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করে দেন। এবং সফলতার সাথে কোর্ট এর বাহিরে সমঝোতার মাধ্যমে পত্রিকার কাছে থেকে অর্থ দন্ড পান এবং পত্রিকাগুলো তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। যদিও The Sun এর সম্পাদক দাবী তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে!
ইউসুফ ইসলামের ভাষ্য, “এখন বর্তমান বিশ্বে খুবই সহজেই যে কোন মুসলিমকে প্রমান ছাড়া হাস্যকর ভাবে দোষী বলা যায়! আমার বেলায় এইরকম মিথ্যা বানোয়াট খবর সরাসরি আমার পরিচালিত রিলিফ কার্য এবং আর্টিস্ট হিসাবে আমার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। অনেক সময় এই রকম অসুস্থ আঘাতের ক্ষতিপূরুন হয় না। মিথ্যা একবার প্রচার হলে সবাইকে সত্যটা জানানো বেশ কঠিন।”
যাহোক, ক্ষতিপূরণ হিসাবে কোর্ট থেকে প্রাপ্ত সকল অর্থ সে সময়ে ভারত মহাসাগরের ঘটে যাওয়া সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যর্থে দান করে দেন।
< এই বিষয়ে ইউসুফ ইসলামের প্রেস রিলিজ >

সালমান রুশদি বিতর্ক:

সালমান রুশদির লেখা বিতর্কিত বই ‘The Satanic Verses’ নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে সে সময় ইউসুফ ইসলাম বিবিসির Hypotheticals নামের একটি অনুষ্ঠানে মডারেটর এবং অধ্যাপক, লেখক, আইনজীবি Geoffrey Robertson এর সাথে এই বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ:
রবিনসন: আপনি কি মনে করেন তার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া উচিৎ
ইউসুফ ইসলাম: কেসালমান রুশদি?
রবিনসন:হ্যাঁ।
ইউসুফ ইসলাম:হ্যাঁঅবশ্যই!
রবিনসন:এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা কি আপনার দায়িত্বে পরে?
ইউসুফ ইসলাম: নাঠিক তা নয়যদি না আমরা কোন ইসলামিক আইন বলবৎ আছে এমন কোন দেশে না থাকি এবং সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা/বিচারক তাদের আইন অনুযায়ী যদি রায় দেয়তাহলে হয়ত ঠিক আছে!
(কিছুক্ষণ পর টিভিতে সালমান রুশদির কুশপুত্তিলিকা পোড়ানোর ভিডিও দেখানো হয়)
 রবিনসন: আপনি কি এইরকম কোন প্রতিবাদের অংশ হতে চানযেখানে প্রতিবাদকারীরা এইভাবে কুশপুত্তিলিকা পোড়াতে যাচ্ছে?
ইউসুফ ইসলাম:আশা করি সেটা (কুশপুত্তিলিকা) যেন আসল মানুষটিরই হয়!
যদিও পরবর্তীতে চাপের মুখে ইউসুফ ইসলাম তার বক্তব্যকে, “বোকামি এবং কিছুটা আক্রমনাত্মক কৌতুক” বলে মন্তব্য করেন। “যার ফলে শুধু তিক্ততাই জন্ম দিবে”।

হিজাব বিতর্ক:

জার্মানে The Echo music award অনুষ্ঠানে “life achievements as musician and ambassador between cultures” নিতে যেয়ে ইউসুফ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে যে, সে নিজের স্ত্রী ছাড়া হিজাব না পরা অন্য কোন নারীর সাথে কোন প্রকার কথা/ভাব আদান প্রদান করেন না! সে কারনে ইউসুফ ইসলামের প্রতিনিধি নাকি আগেই জানিয়েছে, কোন নারী উপস্থাপিকা থাকলে ইউসুফ ইসলাম সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন না। World Entertainment News Network এর পক্ষে Contactmusic.com (প্রতি মাসে প্রায় বাইশ লক্ষ্য বার হিট) এ প্রকাশিত এক আর্টিক্যালে এই অভিযোগ জোরেসোরে ওঠে। এই মিথ্যা অভিযোগের কারনে ইউসুফ ইসলাম মামলা ঠুকে দেন। যথারীতি সত্যের জয় হয় এবং ক্ষতিপূরণ পান।  এবং ক্ষতিপূরণ থেকে প্রাপ্ত সমস্ত টাকা Small Kindness Charity তে দান করে দেন।
পরে এই বিষয়ে ইউসুফ ইসলাম বলেন, এটা সত্য যে আমার ম্যানেজার আগেই সেই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বলে রেখেছিল যেন উপস্থাপিকারা এমন কিছু না করে যাতে ইউসুফ ইসলাম কোন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেন। তার সাথে বিধর্মী কেউ হিজাব পরবে বা না পরবে সেটা নিয়ে আমার কাছ থেকে আপত্তি আসবে কেন? নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোন মর্যাদাহানিকর দাবী এখানে ছিল না যা সবাই অপপ্রচার করছে। ইসলামে নারীদের সম্মান সব থেকে বেশি। তবে ইসলাম ধর্মে যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর সাথে দৈহিক সংস্পর্শ আসে এমন কোন মেলামেশা নিষেধ আছে।
আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পর থেকে নারীর সম্মান বুঝতে শিখেছি। কারন আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি পশ্চিমা কালচারে নারীদের শুধু চকচকে ভোগ্য পণ্য হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। সেখানে ইসলামের ন্যায় নারীর সম্মান বলতে কিছু নেই।
মুসলিম হবার পর পর মায়ের কাছে ফিরে আসি আমি এবং সাথে থেকে তাঁর দেখভাল শুরু করি। আমি আমার মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করি। ব্যাপারটা ছিল এই রকম, তাকে অনেকগুলো পাত্রীর ছবি দেখানো হলো। তাদের মধ্যে বউ হিসাবে একজনকে বেছে নিতে বলি। মা এভাবে আমার জীবন সঙ্গিনী বেছে দেন। অদ্ভুত ব্যপার তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল শতভাগ সঠিক! আমি আমার স্ত্রীর সাথে সুখি জীবন যাপন করছি। পরের বছরই আমাদের কোল জুড়ে ফুটফুটে একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। আল্লাহর রহমতে আমার এখন চার মেয়ে এক পুত্র সন্তান।
আমি সব সময়ই নারী শিক্ষা বিষয়ে জোড় দিয়ে থাকি। নারীদের শিক্ষা প্রসারে আমার প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা গড়ে উঠেছে।
আমার চার কন্যা সন্তান উগ্রতা প্রকাশ পায় না এমন পোষাক ব্যাতিত সাধারণ-স্বাভাবিক সব পোষাকই পরে এবং সেই সকল পোষাক অবশ্যই তাদের শরীর ঢাকা থাকে। তবে তারা তাদের মুখমণ্ডল ঢাকে না। আমার মেয়েরা সবাই এই জীবন ব্যবস্থা থেকেই উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে। আমার বড় মেয়ে, হাসনা, দুবাইতে একটি রেকর্ড কোম্পানী চালায়। তার পরের জন আসমা যোগ্যতাসম্পন্ন আইনজীবী এবং ছোট মেয়ে ‘সু ডিজাইনার’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা হতে হিজাব কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং হিজাবের কারণে তারা পশ্চিমা বিশ্বের আর দশজন নারীর ন্যায় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা অযথা বিউটিফিকেশনে পেছনে ব্যয় না করে কনস্ট্রাকটিভ কাজে ব্যয় করতে পেরেছে বলে মনে করি।

এওয়ার্ড সম্মাননা: 

শান্তি ও মানবতায় অবদানের জন্যসম্মাননা:
■ ২০০৩ সালে “World Social Award”: মানবিক ত্রাণ কার্য এবং শিশু এবং যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্থদের সাহাযার্থ্যে।
■ 2004 সালে Man for Peace Award: শান্তি প্রতিষ্ঠায়।
■ 2005 সালে Honorary Doctorate by the University of Gloucestershire: শিক্ষা এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য।
■ 2007 সালে The Mediterranean Prize for Peace: বিশ্বময় শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য।
■ 2007 সালে honorary doctorate (LLD) by the
University of Exeter: মানবতা ও শান্তি প্রথিষ্ঠায় এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে সঠিক ইসলামকে পরিচয় করে দেবার অবদানে। ddin Ihsanoglu and guitarist Brian May.
■ 2009 সালে Special Achievement Award of the German Sustainability Award.
উপরোক্ত লেখাটি কিছু অংশ বাদ দিয়ে নেয়া হয়  এখান থেকে।

বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইউসুফ ইসলাম

লন্ডন ভিত্তিক মুসলিম এইড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক পপ সঙ্গীত শিল্পী জনাব ইউসুফ ইসলাম বলেছেন, “বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের আজকে বড় সমস্যা ইসলামের বাস্তব শিক্ষার অভাব এবং জীবনাচরণে ইসলামী আদর্শের অনুপস্থিতি। আমাদের ধর্মে যে আমাদের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে সে সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ।”
সম্প্রতি দৈনিক সংগ্রামকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। গত ২৯শে ডিসেম্বর তিনি ৪ দিনের এক সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশ আসেন। ২রা জানুয়ারি তিনি স্বদেশ যুক্তরাজ্যে ফিরে যান।
জনাব ইউসুফের সাথে আলোচনার সূচনাতেই প্রশ্ন করলাম আপনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন কেন? তিনি হেসে জবাব দিলেন, দেখুন সঙ্গীত আমাকে ঐশ্বর্য দিয়েছিল অপার। জীবন ভাগের সব আয়োজন ছিল আমার নাগালে। কিন্তু ভোগ বিলাস আমার মনকে শান্ত করতে পারেনি। আমি কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। এই অশান্তি আমাকে ধর্মের দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। আমি আমার তদানীন্তন স্বধর্ম খ্রিস্টবাদ সম্পর্কে পড়তে শুরু করি। এরপর ইহুদী, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উপর আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু আমি বিফল হই। আমার আকঙ্খিত শান্তি আমি পেলাম না। এ সময় আমার ভাই জেরুজালেম থেকে আবেগ জড়িত কণ্ঠে অনেক কথাই বলল। আমি যে অনুসন্ধানের জন্য তখন ব্যাকুল হয়ে আছি, আমার ভাই সেই খবর জানতো। আমার জন্ম দিনে সে জেরুজালেম থেকে নিয়ে কুরআন আসা একখানা পবিত্র কুরআন শরীফ উপহার দিলো। আমি পবিত্র কুরআন পড়তে শুরু করি। কুরআন সেই মহা গ্রন্থ যা আমার জীবন ও চেতনার জগতকে পালটে দিয়েছে। আমার মনের সকল প্রশ্নের জবাব এই গ্রন্থে পেলাম। আমি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। আমি মুসলমান হলাম।
প্রশ্ন: এখন আপনি আপনার বিগত জীবনকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
জনাব ইউসুফ জবাব দিলেন, দেখুন আজ আমি পরিতৃপ্ত, সুখী। আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমার লক্ষ্য, সে লক্ষ্যেই আমার জীবনকে পরিচালিত করার চেষ্টা করছি। আর আমার পূর্বের জীবন ছিল মোহাচ্ছন্ন, ভোগ বিলাসের, জীবনের কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল না।
প্রশ্ন: আপনার পুরানো বন্ধুরা আপনার সম্পর্কে কি বলে?
উত্তর: ওদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। দেখা সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় হয়। তবে আমাদের জীবনের মৌল দর্শন পালটে গেছে। আমার লক্ষ্য হচ্ছে অনন্ত জীবন আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ, আর তাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীকে ভোগের জন্য প্রাণপাত করা।
প্রশ্ন: আপনি ইসলামী সঙ্গীতের বিষয়ে কিছু ভাবছেন?
উত্তর: ইসলামের সঙ্গীতের প্রবেশাধিকার কতটুকু তা আমি জানি না। ইসলাম সঙ্গীতকে কতটুকু গ্রহণযোগ্য করেছে সে সম্পর্কে জানতে হবে। এরপরই বিষয়টি নিয়ে ভাববো।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে আপনার এই সফরের উদ্দেশ্য কি?
উত্তর: আমরা বাংলাদেশী মুসলিম ভাই বিশেষ করে এখানে অবস্থানকারী বিহারী মোহাজের মুসলিম ভাইদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে এসেছি। এছাড়া আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য তাদের হাতে তুলে দিতে আমি এখানে এসেছি। এখানে আসার আগে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহণকারী আফগান মুসলমানদের অবস্থা দেখতে আমি সে দেশে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ভারতের বাঙ্গালরে এক মুসলিম যুব সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগ দেই। সেখান থেকেই ঢাকায় আমি। আমি চট্টগ্রামও যাব।
প্রশ্ন: আপনাদের সংস্থার উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম কিএর তহবিল কিভাবে সংগৃহীত হয়।
উত্তর: আমাদের সংগঠন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবামূলক। ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে দুঃস্থ মানবতাকে সেবা আমাদের উদ্দেশ্য। যুক্তরাজ্যের মুসলিম অমুসলিম ব্যক্তিদের দান আমরা গ্রহণ করি। এছাড়া ২১টি ট্রাষ্ট আমাদের সহায়তা করছে।
প্রশ্ন: শুধু মুসলমানদেরকেই কি আপনারা সাহায্য করে থাকেন?
উত্তর: না । ইসলামী আদর্শে পরিচালিত আমাদের সংস্থা ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল দুঃস্থ মানুষকেই সহায়তা দিচ্ছে। তবে আজকে বিশ্বে মুসলমানরাই তো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। সর্বত্রই তো তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
প্রশ্ন: মুসলমানদের এই দুর্ভোগের কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: আমাদের সমস্যা তো একটি। ইসলাম সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব। ইসলামকে আমরা মুখে মুখে গ্রহণ করলেও আমাদের জীবনে এর আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে পারিনি। ইসলামকে অনুসরণ করলে আমাদের সমস্যা থাকতো না। আমি পশ্চিমের ঐতিহ্য নিয়ে যেভাবে ইসলামের সৌন্দর্য, গুরুত্ব এবং সম্পদকে উপলব্ধি করছি, আমার সন্দেহ হয় অনেকেই হয়ত সেভাবে করছেন না।
প্রশ্ন: অনেকেই তো বলেনইসলাম ১৪শ বছরের পুরাতন আদর্শএ যুগের জন্য অচল। এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন?
উত্তর: আমি বিনয়ের সাথেই বলছি, যারা এসব বলেন, তারা নিজেদের মনে স্থান করে নেয়া ইসলাম সম্পর্কে পূর্ব ধারণার বশবর্তী হয়েই ইসলামকে বিচার করে। যদি সঠিকভাবে তারা এ ব্যাপারে জানতে চাইতো তবে তাদের উক্তি হতো ইতিবাচক। এমন দায়িত্বহীন হতো না।
প্রশ্ন: যুক্তরাজ্যে ইসলামের দাওয়াতী কাজ কেমন চলছে?
উত্তর: সেখানকার পরিবেশ ও প্রচার মাধ্যমগুলো ইসলামের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। কিন্তু এরপরও কাজ হচ্ছে। নতুন নতুন লোক ইসলাম গ্রহণ করছে। আর এসব মুসলিম যেহেতু সেই দেশেরই নাগরিক, তাই সেখানকার সামাজিক জীবনে এর একটা প্রতিক্রিয়া পড়ছে। যুক্তরাজ্যে মুসলিম শিশুদের ইসলামী শিক্ষা দানের জন্য স্কুল খুলেছি।
প্রশ্ন: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
উত্তর: ১৯৩৮ সালের রমজান মাসে আমি লন্ডনে জন্মেছি। আমার পিতা ছিলেন গ্রীক সাইপ্রিয়ট, মা সুইডিশ। আমার মা এখনো জীবিত। ১৯৭৭ সালে আমার ইসলাম গ্রহণের পর আমার স্বজনদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমার স্ত্রী ফাউজিয়া আফগান ও তুর্কী বংশোদ্ভূত মুসলিম। আমাদের তিন কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। আমি ব্যবসায় কিছু পুঁজি বিনিয়োগ করেছি। এতেই আমর চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশী মুসলিম ভাইদের জন্য আপনার কি কোন বাণী রয়েছে?
উত্তর: তাদের প্রতি আমার আবেদন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে ইসলামী উম্মাহর প্রতি তাদের দায়িত্ব অপরিসীম। ইসলামকে নিজেদের জীবনে সর্বোত্তমভাবে পালনের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নেয়া। [দৈনিক সংগ্রাম, বুধবার ২২শে পৌষ ১৩৯৩ বাংলা]

No comments

Powered by Blogger.