কেউ কারও দাস নয়, সবাই আল্লাহর দাস
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
জাতিসংঘের হিসেব মতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ
থেকে তিন লক্ষাধিক নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়েছে। তবে বিভিন্ন এনজিওর
হিসেব অনুযায়ী, পাচারকৃত নারী ও শিশুর সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। টাইমস অব
ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার
নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়েছে। পাচারকারীরা
দেশের ১৮টি স্থান দিয়ে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত ব্যবহার করে পাকিস্তান,
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করছে। পাচারের শিকার অধিকাংশ
নারীর স্থান হয়েছে ভারতের যৌনপল্লীতে। উপরন্তু বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ
অধিক আয়ের আশায় নিয়মিতই সহস্রাধিক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে
স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে অভিবাসন গ্রহণ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি
নির্দেশনা না মেনে প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায় করে, জাল
কাগজপত্র ব্যবহার করে শর্ত অনুযায়ী কাজ দেয় না, বিনা মজুরিতে দাসোচিত শ্রম
দিতে বাধ্য করে, এরূপ ভাগ্যাহতদের ওপর যৌন হয়রানিও আকছার ঘটতে থাকে।
চাকরি আর মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভনে পড়ে তারা বিদেশ-বিভুঁইয়ে অমানবিক
জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)
অনেকে নবজাতক চুরি করে এনে হিজড়াচক্রের
নেতাদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৪ সাল) ঢাকা
মেডিকেল কলেজ থেকে একটি শিশু চুরির ঘটনায় তোলপাড় হয়। পুলিশের ভাষ্য মতে,
শিশুচুরিতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র আছে যারা এদের চুরি করে বিক্রি করে দেয়।
হিজড়াচক্রের হোতারা এদের কিনে নিয়ে তাদের বানিয়ে নেয় নিজেদের অঘোষিত গোলাম।
এদের দিয়ে ভবিষ্যতে ভিক্ষা ও চাঁদাবাজি করে অর্থ আয় করে।
পৃথিবীর সব দেশের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম
জাতিসংঘ এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর। প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সংবিধানে
‘মানব পাচার’ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশেও সম্প্রতি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান
রেখে মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বন্ধ হয়নি মানব
পাচার। বলাবাহুল্য, শুধু আইনের বল প্রয়োগেই মানব পাচার রোধ সম্ভব নয়। কারণ
মানুষের তৈরি আইনের গোলকধাঁধায় মানুষ সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে
প্রয়োজন, মানুষের সৃষ্টিকর্তা, খালিক্ব ও মালিক মহান আল্লাহর প্রতি
অনুগত্য, তাঁর ভয় অন্তরে লালন এবং এ সম্পর্কিত মূল্যবোধ ও চেতনা জাগ্রত
করা।
ইসলামে স্বাধীন মানুষকে দাস বানানো তথা
মানব কেনাবেচা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে
বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
قَالَ
اللَّهُ تَعَالَى: ثَلاَثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ القِيَامَةِ، رَجُلٌ
أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ، وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ،
وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ
أَجْرَهُ
‘আল্লাহ
তা‘আলা ইরশাদ করেন, আমি কেয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হব : ১. যে
আমার নামে শপথ করে অতঃপর বিশ্বাসঘাতকতা করে। ২. যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে
(ক্রীতদাস হিসেবে) বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে। ৩. যে কোনো মজুরকে
নিযুক্ত করে তার থেকে পরিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করে অথচ তার পারিশ্রমিক প্রদান
করে না।’ [ সহীহ বুখারী : ২২২৭]
বলাবাহুল্য, এ তিন অপরাধই আমাদের সমাজে
চালু আছে। শপথ ভঙ্গ করার অভ্যাস যদি প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয়ভাবে তাহলে শ্রমিক
ঠকানোর অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে! আর মানুষের মর্যাদা ও মানবাধিকারের বুলির
যুগে মানুষের কেনাবেচাও নেই থেমে।
ইসলামের দৃষ্টিতে দাসত্ব মূলত আল্লাহর
জন্য সংরক্ষিত। একজন মানুষ ইসলামের প্রথম শর্ত তাওহীদের কালেমা মেনে নেওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে সে মানতে বাধ্য যে সে একমাত্র আল্লাহরই দাস। কেবল তাঁরই
শর্তহীন আনুগত্য করবে সে। তাঁকেই একমাত্র শর্তহীন মালিক মানবে। একমাত্র
আল্লাহ তা‘আলাই সবার মালিক। শর্তহীন প্রভুত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই সংরক্ষিত।
সুতরাং মানুষ মানুষের দাস হতে পারে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক
দাসত্বের নয়; ভ্রাতৃত্বের। আদি পিতা আদমের সন্তান হিসেবে তারা সবাই মানুষ।
মানুষ হিসেবে সবাই সমান। মানুষের সঙ্গে মানুষের মর্যাদার তারতম্য হবে শুধু
তাকওয়ার নিক্তিতে। সবার স্রষ্টা মহান আল্লাহ বলেন,
[
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ
وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ
أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ
[الحجرات: ١٣
‘হে মানুষ,
আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন
জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের
মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক
তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’ [সূরা আল-হুজুরাত,
আয়াত : ১৩]
এটা জানা কথা, তাকওয়া একটি ব্যক্তিগত
অর্জন। মানুষ বা সৃষ্টি-জীবের পক্ষে পার্থিব-জীবনের কোনো নিশ্চিত গুণ দেখে
তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কাউকে তাকওয়া দান করা বা এর
উত্তরাধিকার বানানো। ফলে এ মানদণ্ডে কেউ প্রতারিত হওয়া বা বৈষম্যের শিকার
হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ইসলামের আবির্ভাবকালে বিশ্ব-সমাজে
যুদ্ধবন্দিদের দাস বানিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। ইসলামের আগমনের পরও কয়েক
শতাব্দী পর্যন্ত এ রেওয়াজ অব্যাহত ছিল। ইসলাম কেবল শত্রুদের সঙ্গে তাদেরই
অনুরূপ আচরণ করতে গিয়ে যুদ্ধবন্দিকে দাস বানানোর অনুমতি প্রদান করেছে।
অন্যথায় মৌলিকভাবে ইসলাম দাস প্রথাকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলে স্বীকার করে না।
বরং একে ব্যতিক্রমী অবস্থা বলে গণ্য করে। এ অবস্থা বদলাতে ইসলাম প্রজ্ঞার
সঙ্গে কাজ করেছে। যাতে লোক-সমাজে সম্পর্কের প্রচলিত নিয়ম ও বিদ্যমান
বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। এ কারণেই ইসলাম স্থায়ীভাবে দাস প্রথা
নির্মূলে প্রয়োজনীয় বিধি ও আইন প্রণয়ন করেছে।
দাসত্বের একমাত্র বৈধ উপায় বন্ধ হওয়ার পর
ইসলাম নানা উপায়-উপলক্ষে দাসত্বের নিয়ম তুলে দিয়েছে। এসব উপায়ের মধ্যে
রয়েছে- বিভিন্ন পাপের কাফফারাস্বরূপ (ক্ষতিপূরণ) প্রদেয় তিনটি সুযোগের একটি
করা হয়েছে দাস মুক্ত করাকে। যেমন ইসলামের দণ্ডবিধির ধারায় কেউ অনিচ্ছাকৃত
ভুলে কাউকে হত্যা করলে তার শাস্তির বিধানে বলা হয়েছে,
وَمَا
كَانَ لِمُؤۡمِنٍ أَن يَقۡتُلَ مُؤۡمِنًا إِلَّا خَطَٔٗاۚ وَمَن قَتَلَ
مُؤۡمِنًا خَطَٔٗا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مُّؤۡمِنَةٖ وَدِيَةٞ
مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦٓ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْۚ فَإِن كَانَ
مِن قَوۡمٍ عَدُوّٖ لَّكُمۡ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ
مُّؤۡمِنَةٖۖ وَإِن كَانَ مِن قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞ
فَدِيَةٞ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦ وَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ
مُّؤۡمِنَةٖۖ فَمَن لَّمۡ يَجِدۡ فَصِيَامُ شَهۡرَيۡنِ مُتَتَابِعَيۡنِ
تَوۡبَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمٗا [النساء: ٩٢
‘আর কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত (হলে ভিন্ন কথা)। যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে
এবং দিয়াত (রক্তপণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে
তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে দিতে হবে না)। আর সে যদি তোমাদের
শত্রু কওমের হয় এবং সে মুমিন, তাহলে একজন মুমিন দাস মুক্ত করবে।
আর যদি এমন কওমের হয় যাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি রয়েছে তাহলে
দিয়াত দিতে হবে, যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিবারের কাছে এবং একজন মুমিন দাস মুক্ত করতে হবে।
তবে যদি না পায় তাহলে একাধারে দু’মাস সিয়াম পালন করবে। এটি আল্লাহর পক্ষ
থেকে ক্ষমাস্বরূপ। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা আন-নিসা, আয়াত :
৯২]
কসম করে ইচ্ছাকৃতভাবে তা ভঙ্গ করলে তার কাফফারা সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশে বলা হয়েছে :
لَا
يُؤَاخِذُكُمُ ٱللَّهُ بِٱللَّغۡوِ فِيٓ أَيۡمَٰنِكُمۡ وَلَٰكِن
يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ ٱلۡأَيۡمَٰنَۖ فَكَفَّٰرَتُهُۥٓ إِطۡعَامُ
عَشَرَةِ مَسَٰكِينَ مِنۡ أَوۡسَطِ مَا تُطۡعِمُونَ أَهۡلِيكُمۡ أَوۡ
كِسۡوَتُهُمۡ أَوۡ تَحۡرِيرُ رَقَبَةٖۖ فَمَن لَّمۡ يَجِدۡ فَصِيَامُ
ثَلَٰثَةِ أَيَّامٖۚ ذَٰلِكَ كَفَّٰرَةُ أَيۡمَٰنِكُمۡ إِذَا حَلَفۡتُمۡۚ
وَٱحۡفَظُوٓاْ أَيۡمَٰنَكُمۡۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمۡ
ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ [المائدة: ٨٩
‘আল্লাহ
তোমাদের পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যাপারে, কিন্তু যে কসম
তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করেন। সুতরাং এর কাফফারা
হল দশ জন মিসকীনকে খাবার দান করা, মধ্যম ধরনের খাবার, যা তোমরা স্বীয়
পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস-দাসী মুক্ত করা।
অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটা তোমাদের কসমের
কাফ্ফারা, যদি তোমরা কসম কর, আর তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত কর। এমনিভাবে
আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।’
[সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৮৯]
যিহারে[1]র কাফফারা সম্পর্কে বলা হয়েছে :
وَٱلَّذِينَ
يُظَٰهِرُونَ مِن نِّسَآئِهِمۡ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُواْ
فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مِّن قَبۡلِ أَن يَتَمَآسَّاۚ ذَٰلِكُمۡ تُوعَظُونَ
بِهِۦۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ٣ فَمَن لَّمۡ يَجِدۡ
فَصِيَامُ شَهۡرَيۡنِ مُتَتَابِعَيۡنِ مِن قَبۡلِ أَن يَتَمَآسَّاۖ فَمَن
لَّمۡ يَسۡتَطِعۡ فَإِطۡعَامُ سِتِّينَ مِسۡكِينٗاۚ ذَٰلِكَ لِتُؤۡمِنُواْ
بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۚ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِۗ وَلِلۡكَٰفِرِينَ
عَذَابٌ أَلِيمٌ [المجادلة: ٣، ٤
‘আর যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ করে অতঃপর তারা যা বলেছে তা থেকে ফিরে আসে, তবে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাস মুক্ত করবে।
এর মাধ্যমে তোমাদেরকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে
আল্লাহ সম্যক অবহিত। কিন্তু যে তা পাবে না, সে লাগাতার দু’মাস সিয়াম পালন
করবে, একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে। আর যে (এরূপ করার) সামর্থ্য রাখে না
সে ষাটজন মিসকীনকে খাবার খাওয়াবে। এ বিধান এ জন্য যে, তোমরা যাতে আল্লাহ ও
তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন। আর এগুলো আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমা এবং
কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।’ [সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত : ৩-৪]
তেমনি যে দাস, সে যদি তার দাসত্বের মূল্য
পরিশোধ করে স্বাধীন হতে চায়, তাকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, এমনকি
বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তা পরিশোধের অবকাশ পর্যন্ত দিয়েছে।
গোলাম আজাদ করাকে বড় নেকীর কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ঘোষণা করেও দাসত্ব
নির্মূলের পথ সুগম করেছে। শুধু তাই নয়, যে বাঁদি তার মনিবের সন্তান জন্ম
দিয়েছে, মনিবের মৃত্যুর পর তার মুক্তিপ্রাপ্তিও নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
وَٱلَّذِينَ
يَبۡتَغُونَ ٱلۡكِتَٰبَ مِمَّا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡ فَكَاتِبُوهُمۡ
إِنۡ عَلِمۡتُمۡ فِيهِمۡ خَيۡرٗاۖ وَءَاتُوهُم مِّن مَّالِ ٱللَّهِ
ٱلَّذِيٓ ءَاتَىٰكُمۡۚ وَلَا تُكۡرِهُواْ فَتَيَٰتِكُمۡ عَلَى ٱلۡبِغَآءِ
إِنۡ أَرَدۡنَ تَحَصُّنٗا لِّتَبۡتَغُواْ عَرَضَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۚ
وَمَن يُكۡرِههُّنَّ فَإِنَّ ٱللَّهَ مِنۢ بَعۡدِ إِكۡرَٰهِهِنَّ غَفُورٞ
رَّحِيمٞ [النور: ٣٣
‘আর তোমাদের
মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়
তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর, যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে
জানতে পার এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে
দাও। তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের
কামনায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করো না। আর যারা তাদেরকে বাধ্য করবে,
নিশ্চয় তাদেরকে বাধ্য করার পর আল্লাহ তাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম
দয়ালু।’ [সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩৩]
তেমনি কুরআনে কারীমে দাসমুক্ত করাকে ধর্মের ঘাঁটি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
فَلَا
ٱقۡتَحَمَ ٱلۡعَقَبَةَ ١١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا ٱلۡعَقَبَةُ ١٢ فَكُّ
رَقَبَةٍ ١٣ أَوۡ إِطۡعَٰمٞ فِي يَوۡمٖ ذِي مَسۡغَبَةٖ ١٤ يَتِيمٗا ذَا
مَقۡرَبَةٍ ١٥ أَوۡ مِسۡكِينٗا ذَا مَتۡرَبَةٖ ١٦ ثُمَّ كَانَ مِنَ
ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ وَتَوَاصَوۡاْ
بِٱلۡمَرۡحَمَةِ ١٧ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡمَيۡمَنَةِ [البلد: ١١، ١٨
‘তবে সে বন্ধুর গিরিপথটি অতিক্রম করতে সচেষ্ট হয়নি। আর কিসে তোমাকে জানাবে, বন্ধুর গিরিপথটি কি? তা হচ্ছে, দাস মুক্তকরণ
অথবা খাদ্য দান করা দুর্ভিক্ষের দিনে। ইয়াতীম আত্মীয়-স্বজনকে অথবা
ধূলি-মলিন মিসকীনকে। অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে
এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের।
তারাই সৌভাগ্যবান।’ [সূরা আল-বালাদ, আয়াত : ১১-১৮]
মুক্তিকামী ক্রীতদাসের জন্য সম্পদ ব্যয় করা বড় সৎকাজ বলে গণ্য করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে,
۞لَّيۡسَ
ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ
وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ
وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّۧنَ وَءَاتَى ٱلۡمَالَ عَلَىٰ
حُبِّهِۦ ذَوِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينَ وَٱبۡنَ
ٱلسَّبِيلِ وَٱلسَّآئِلِينَ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ
وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلۡمُوفُونَ بِعَهۡدِهِمۡ إِذَا عَٰهَدُواْۖ
وَٱلصَّٰبِرِينَ فِي ٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَحِينَ ٱلۡبَأۡسِۗ
أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُتَّقُونَ
[البقرة: ١٧٧
‘ভালো কাজ
এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ
হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং
যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম,
অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং
যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা
ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই
মুত্তাকী।’ [সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৭৭]
ইসলাম রাষ্ট্রের জন্য যাকাতের অর্থ থেকে
দাস-দাসীর মুক্তির জন্য বিশেষ খাত নির্ধারণ করে দিয়েছে; এই খাতকে
আল-কুরআনুল কারীম দাসমুক্তির খাত নামে নামকরণ করেছে; মুসলিম রাষ্ট্রে
দাস-দাসীদের মুক্ত করার জন্য এই খাত সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
۞إِنَّمَا
ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا
وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي
سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ
عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٦٠ [التوبة: ٦٠
‘সদকা তো শুধু ফকীর, মিসকীন ও সদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের জন্য, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তিতে,
ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ
থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা আত-তাওবা, আয়াত :
৬০]
অন্যদিকে যেসব হাদিসে দাস-দাসী মুক্ত করার
ফযীলত ও মর্যাদা বর্ণনা এসেছে এবং দাস-দাসী মুক্তিদানকারী ব্যক্তির জন্য
পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সেগুলোর সংখ্যা অনেক বেশি, গণনার বাইরে; আমরা
উদাহরণস্বরূপ কিছু উপস্থাপন করা যাক :
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
أَيُّمَا
رَجُلٍ مُسْلِمٍ أَعْتَقَ رَجُلًا مُسْلِمًا فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ
جَاعِلٌ وِقَاءَ كُلِّ عَظْمٍ مِنْ عِظَامِهِ عَظْمًا مِنْ عِظَامِ
مُحَرَّرِهِ مِنَ النَّارِ، وَأَيُّمَا امْرَأَةٍ أَعْتَقَتِ امْرَأَةً
مُسْلِمَةً فَإِنَّ اللَّهَ جَاعِلٌ وِقَاءَ كُلِّ عَظْمٍ مِنْ عِظَامِهَا
عَظْمًا مِنْ عِظَامِ مُحَرَّرِهَا مِنَ النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে কোনো
মুসলিম পুরুষ কোনো মুসলিম পুরুষ (গোলাম) কে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার
প্রত্যেকটি অস্থির বিনিময়ে তার এক একটি অস্থিকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত
করবেন। আর যে কোনো মুসলিম নারী কোনো মুসলিম দাসীকে আযাদ করবে, আল্লাহ
তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার প্রত্যেকটি অস্থির বিনিময়ে তার এক একটি অস্থিকে
জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন।’ [আবূ দাউদ : ৩৯৬৫]
‘আমর ইবন ‘আবাসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ بَنَى
لِلَّهِ مَسْجِدًا لِيُذْكَرَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِيهِ، بَنَى اللَّهُ
لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ، وَمَنْ أَعْتَقَ نَفْسًا مُسْلِمَةً كَانَتْ
فِدْيَتَهُ مِنْ جَهَنَّمَ، وَمَنْ شَابَ شَيْبَةً فِي سَبِيلِ اللَّهِ
عَزَّ وَجَلَّ، كَانَتْ لَهُ نُورًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি
আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মাসজিদ নির্মাণ করবে যাতে আল্লাহ তা‘আলার যিকির
(স্মরণ) করা হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ
করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো একজন মুসলিম গোলামকে আযাদ করবে, তা জাহান্নাম
থেকে বাঁচার জন্য তার মুক্তিপণ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার পথে
শুভ্রকেশী (বৃদ্ধ) হবে, তা তার জন্য কিয়ামতের দিনে আলো হবে।’ [মুসনাদ আহমদ
: ১৯৪৪০]
বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
جَاءَ
أَعْرَابِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ:
يَا رَسُولَ اللَّهِ، عَلِّمْنِي عَمَلًا يُدْخِلُنِي الْجَنَّةَ، فَقَالَ:
«أَعْتِقِ النَّسَمَةَ، وَفُكَّ الرَّقَبَةَ . فَقَالَ: يَا رَسُولَ
اللَّهِ، أَوَلَيْسَتَا بِوَاحِدَةٍ؟ قَالَ: لَا، إِنَّ عِتْقَ النَّسَمَةِ
أَنْ تَفَرَّدَ بِعِتْقِهَا، وَفَكَّ الرَّقَبَةِ أَنْ تُعِينَ فِي
عِتْقِهَا
‘জনৈক
বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে আগমন করল এবং তারপর
বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজের প্রশিক্ষণ দিন, যা আমাকে
জান্নাতে প্রবেশ করাবে; তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
তুমি দাস-দাসী আযাদ কর এবং দাস মুক্ত কর। তারপর সে বলল, এই দু’টি কাজই কি
এক জাতীয় কাজ নয়? জবাবে তিনি বললেন, না। দাস-দাসী আযাদ করা মানে হলো, তুমি
তাকে মুক্ত করার মাধ্যমে পৃথক করে দেবে; আর দাস মুক্ত করা মানে হল, তুমি
তার মুক্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করবে।’ [মুসনাদ আহমদ : ১৮৬৪৭]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُضْوٍ مِنْهُ
عُضْوًا مِنَ النَّارِ، حَتَّى يُعْتِقَ فَرْجَهُ بِفَرْجِهِ»
‘যে ব্যক্তি
একজন মুমিন গোলামকে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা সেই গোলামের প্রতিটি অঙ্গের
বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন থেকে তার প্রতিটি অঙ্গকে মুক্ত করবেন; এমনকি তার
গুপ্তাঙ্গের বিনিময়ে গুপ্তাঙ্গকে মুক্ত করবেন।’ [মুসলিম : ১৫০৯]
ইসলাম দাস-দাসী মুক্ত করার ব্যাপারে
বাস্তবসম্মত ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে; আর সেই কর্মসূচী নিয়ে কমপক্ষে
সাতশ বছর পরিপূর্ণভাবে ঐতিহাসিক অগ্রগতি হয়েছে এবং এই অগ্রগতির সাথে আরও
অতিরিক্ত সংযোজন হয়েছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার মত উপাদানসমূহ, যার দিকে
বিশ্বের অন্যান্যরা কেবল আধুনিক ইতিহাসের শুরুর দিকে যেতে সমর্থ হয়েছে!!
[1]. স্ত্রীকে মায়ের সাথে অথবা মায়ের কোন
অংগের সাথে তুলনা করাকে ‘যিহার’ বলে। প্রাচীন আরব সমাজে স্ত্রীকে মায়ের
সাথে তুলনা করার মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হত। ইসলামে এর মাধ্যমে
সরাসরি বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় না। তবে অসঙ্গত কথা বলার কারণে কাফফারা
দিতে হয়।
No comments