যুদ্ধসমূহের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাঃ। রাসূল (সাঃ) এর জীবনী। ৩০ তম খন্ড

রসূলে করিম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতুত্বে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলে যে কেউ একথা স্বীকার করতে নৈতিকভাবে বাধ্য হবে যে, তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সফল সামরিক কমান্ডার। পরিবেশ পরিস্থিতি,পটভূমি প্রসঙ্গিক লক্ষণসমূহ এবং পরিণতি ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি ছিলেন অতুলনীয় মেধার অধিকারী। তাঁর বুদ্ধি বিবেচনা ছিলো নির্ভূল এবং বিবেকের জাগ্রতাবস্থায় ছিলো গভীর তাৎপর্যমন্ডিত। নবুয়ত ও রেসালাতের গুলে তিনি ছিলেন সাইয়েদুল মুরসালিন বা প্রেরিত সকল নবীর নেতা। অন্যদিকে সামরিক নেতৃত্বের গুনবৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন অসাধারণ এবং অদ্বিতীয়। যে সকল যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বা অন্যদের প্রেরণ করেছিলেন সব ক্ষেত্রেই তিনি কার্যকারণ পরিবেশ পরিস্থিতি ও পর্যালোচনা করে সঠিক কৌশল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হন। তাঁর দক্ষতাসমর কুশলতা,সাহসিকতা ছিলো অনন্য। সৈন্য সমাবেশ,যুদ্ধ পরিকল্পনা,অবস্থান নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁকে কেউ ডিঙ্গিয়ে যেতে পারেনি। তাঁর সমরকুশলতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বের সেরা যুদ্ধ বিশারদেরচেয়েও তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তার যুদ্ধ পরিকল্পনায় পরাজয় বরণের কোন সম্ভাবনায় ছিলো না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, ওহুদ এবং হোনায়েনের যুদ্ধে যা কিছু ঘটেছিলো এর কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিকল্পনার ক্রটি বা ভূল নয়। কিছু সংখ্যক মুসলিম সৈন্যের ব্যক্তিগত দূর্বলতাই দায়ী। আর ওহুদের যুদ্ধে তো তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ও সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা হয়েছিলো।

উভয় যুদ্ধেই মুসলমানরা পরাজয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিলো। সে সময়ে তিনি যে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তার উদাহরণ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি শত্রু বেষ্টনীতে ও ছিলেন অটল অবিচল এবং তুলনাহীন সমর কুশলতায় শত্রুদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিলো। এ ছাড়া হোনায়েনের যুদ্ধে তাঁর সমর কুশলতায় মুসলমানদের পরাজয় চূড়ান্ত বিজয়ে পরিণত হয়েছিলো। অথচ ওহুদের মতের বিপজ্জনক পরিস্থি এবং হোনায়েনের মতো লাগামহীন ভয়কাতরতা ও অস্থিরতা সেনানায়কদের সিদ্ধন্ত গ্রহণের শক্তি লোপ করে দেয়। তাঁদের স্নায়ুর ওপর এতো বেশী চাপ সৃষ্টি হয় যে, তথন আত্মরক্ষার চেষ্টাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
এটা তো হচ্ছে উল্লিখিত যুদ্ধের সামরকি দিক। অন্য একটি দিক আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল যুদ্ধের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন। ফেতনা ফাসাদের আগুন নিভিয়ে দেন। ইসলাম ও পৌত্তলিকতার সংঘর্ষে শত্রুর শক্তি-সামর্থ্য ও অহংকার নস্যাৎ করে দেন। ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগ সম্বর্কে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা এবং সিদ্ধন্ত গ্রহণের জন্য তাদের বাধ্য করেন। এছাড়া এসব যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি শত্রু মিত্র চিনেছেন। প্রকৃত মুসলমান এবং মোনাফেকদের পার্থ্য নির্ণিত হয়।
সামরিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম মুসলিম সেনানায়কদের এক অপারেজয় শক্তি গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্ট সেনাদল ইরাক, সিরিয়ায়, পারস্য ও রোমে যুদ্ধ করে এবং যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বড় বড় যুদ্ধবাযদের হার মানিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় শত্রুদের তাদের ভূখন্ড, ধন-সম্পদ,ক্ষেত-খামার, বাগান, জলাশয় ইত্যাদি থেকে ও বহিষ্কার করে। এইসব যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের জন্যে বাসস্থান, ক্ষেত-খামার এবং করর্মসংস্থানের মতো প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করেন। বাস্তুহীন ও ঠিকানাহীন উদ্বাস্তুদের সমস্যার সমাধান করেন। অস্ত্র, ঘোড়া, সামারিক সরাঞ্জামের বহুবিধ উপকরণের ব্যবস্থা করেন। অথচ প্রতিপক্ষের ওপর কোন প্রকার অত্যাচার উৎপীড়ন এবং বাড়াবাড়ি না করেই তিনি এসব কিছু করেছিলেন।
অন্ধকার যুগের যেসব কারণে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠতো, প্রিয় নবী সেসব কারণও পরিবর্তন করেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতে যুদ্ধ মানো ছিলো লুট-তরায,হত্যা-ধ্বংস,যুলুম-অত্যাচার, জনপদ বিরান করা, বাড়ীঘর,অট্টালিকা ভেঙ্গে ফেলা, মহিলাদের সম্মান নষ্ট করা, শিশু ও বৃদ্ধদের সাথে নিষ্ঠুর নৃশংস ব্যবহার করা। এছাড়া ক্ষেত-খামারের ফসল নষ্ট এবং পশুপালহত্যা করা মোটকথা সর্বাত্মক ক্ষতি ও ধ্বংস ছিলো সেসব যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ইসলাম যুদ্ধের এসব ঘৃণ্য কার্যকলাপ প্রতিরোধ করে যুদ্ধকে এক পবিত্র জেহাদরে পরিণত করেছে। যুক্তসঙ্গত ও ন্যায্য কারণে এ যুদ্ধ শুরু করা হয় এবং তার ফলাফল হয় সকল কালের মনুষের জন্য কল্যাণকর। পরবর্তী সকল কালে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এসব জেহাদের পরে মানুষ বুঝতে  পেরেছে যে, জেহাদ হচ্ছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া, জুলুম-অত্যাচার নির্যাতন থেকে থেকে বের করে এনে ন্যায় ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার সশস্ত্র প্রচেষ্ট। অর্থাৎ একটা ব্যবস্থা করা যাতে শক্তিশালীরা দূর্বলদের ওপর অত্যাচার নাকরতে পারে বরং সেসব স্বৈরাচারী ও অত্যাচারীদের দূর্বল করে উৎপীড়িত ও দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এমনি করে ইসলামের জেহাদের অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, সেইসব দূর্বল নারী-পুরুষ শিশুকে রক্ষা করতে হবে যারা এই বলে দোয়া করেন, হে প্রতিপালক,তুমি আমাদরেকে এই জনপদ থেকে বের করো, যেখানের অধিবাসীরা অধিবাসীরা অত্যাচারী। তুমি তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য নেতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রেরণ করো এবং নেতা এবং তার মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করো। এছাড়া মুসলমানদের যুদ্ধের অর্থ এই দাঁড়িয়েছে যে আল্লাহর যমিনকে খেয়নত,যুলুম-অত্যাচার,পাপাচার থেকে মুক্ত করে তা স্থলে শান্তি-নিরাপত্তা, দয়াশীলতা ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের জন্য উন্নত নীতিমালা প্রণয়ন করেন। মুসলিম সৈন্য এবং সেনাপতিদেরকে সেই নীতিমালার বাইরে যেতে দেননি। হযরত সালমান ইবনে যোয়ইদা বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন ব্যক্তিকে সেনাপতির দায়িত্ব দিতেন তখন তাকে তাকওয়া পরহেজগারী এবং মুসলমান সঙ্গীদের সাথে উত্তম ব্যবহারের উপদেশ দিতেন। এবপর বলতেন আল্লাহর নামে, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। লড়াই করো,খেয়ানত করো না, অঙ্গীকার লংঘন বা বিশ্বাসঘাতকতা করো না, কারো নাক, কান ইত্যাদি কেটে না, কোন শিশুকে হ্ত্যা করো না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনোনীত সেনাপতিকে আরো উপদেশ দিতেন যে, সহজ সরল ব্যবহার করবে,কঠোরতার আশ্রয় নেবে না,মানুষকে শান্তি দেবে,কাউকে ঘৃণা করবে না।১[সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃ.৮২-৮২]
রাত্রিকালে কোন এলাকায় পৌছার পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল হওয়ার আগে হামলা করতেন না। তাছাড়া তিনি আগুন লাগানো অর্থাৎ কোন জিনিসে অগ্নিসংযোগ করতে ভাবে নিষেধ করতেন। কাউকে বেঁধে হত্যা করা, মহিলাদের প্রহার করা এবং তাদের হত্যা করতেও তিনি নিষেধ করেন। লুট-তরায করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেনে, লুটের মাল মৃতজন্তুর চেয়ে বেশী হালালল নয়, ক্ষেত-খামার ধ্বংস করা, চতুষ্পদ জন্তু হত্যা করা এবং গাছপালা কেটে ফেলতেও তিনি নিষেধ করেন। তবে বিশেষ প্রযোজন দেখা দিলে সেটা ভিন্ন কথা।
মক্কা বিজয়ের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, কোন আহত ব্যক্তির ওপর হামলা করবে না,কেনা পলায়নকরী ব্যক্তিকে ধাওয়া করবে না, কোন বন্দীকে হত্যা করবে না। তিনি এ রীতিও প্রবর্তন করেন যে,  কোন দূতকে হত্যা করা যাবে না,তিনি একথাও বলেছেন যে, কোন অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করা যাবে না। এমনকি তিনি একথাও বলেছেন যে, কোন অমুসলিম নাগরিককে বিনা কারণে হত্যা করবে, সে বেহেশতের সুগন্ধও পাবে না। অথচ বেহেশেতের সুবাস চল্লিশ বছরের পথের দুরত্ব থেকে ও পাওয়া যায়।
উল্লেখিত কারণ সমূহ এবং আরো অনেক উন্নততর বীতিনীতি ছিলো যার কারণে যুদ্ধ জাহেলিয়াত যুগের নোংরামী থেকে পাকসাফ হয়ে পবিত্র জেহাদে পরিবর্তিত  হয়েছে।
দলে দলে মানুষদের আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে চিরতরে যে, মক্কা বিজয়ের ঘটনা ছিলো একটি সিদ্ধান্তমূলক অভিযান। এর ফলে মূর্তি পূজার অসারতা আরববাসীদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং মূর্তিপূজার অবসান ঘটে। সমগ্র আরবদের জন্য সত্য ও মিথ্যা চিহ্নিত হয়ে যায়। তার দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন। হযরত আমর ইবনে সালমা (রা.) বলেন, আমর একটি জলাশয়ের ধারে বাস করতাম। সেই জলাশয়ের পাশ দিয়ে লোক চলাচল করতো। পথচারীদের আমরা সেই ব্যক্তির অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। পথচারীরা বলতো, তিনি মনে করেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে পয়গাম্বর করে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে ওহী পাঠানো হয় এবং সেই ওহীতে আল্লাহ তায়াল এরূপ এরূপ বলেছেন। ইযরত আমর ইবনে সালমা (রা.) বলেন, আমি সেসব কথা শুনতাম এবং ওহীতে বর্নিত কথাগুলো মনো রাখতাম। আরবের লোকেরা ইসলাম গ্রহণের পর মক্কা বিজয়ের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা বলতো, ওকে এবং তার কওমকে ছেড়ে দাও। যদি তিনি নিজের কওমের ওপর জয়লাভ করেন তাহলে বোঝা যাবে যে, তিনি সত্য নবী। অতপর মক্কা বিজয়ের ঘটনা ঘটলো।
সকল কওম ইসলাম গ্রহণের জন্য অগ্রসর হলো। আমার পিতাও আমার কওমের কাছে ইসলাম শিক্ষা নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, আমি সত্য নবীব কাছ থেকে এসছি। নবী বলেছেন, অমুক অমুক সময়ে অমুক অমুক নামাজ আদায় করো। নামাযের সময় হলে তোমাদের মধ্যে থেকে একজন আযান দেয়। এরপর তোমাদের মধ্যেকার যে ব্যক্তি বেশী পরিমাণ কোরআন জানেন তিনি যেন ইমামতি করেন।
এই হাদীস থেকে স্পস্টত বোঝা যায় যে, মক্কা বিজয়ের ঘটনা পরিস্থিতির পরিবর্তনে ইসলামকে শক্তিশিালী করার ব্যাপারে, আরববাসীদের ভূমিকা নির্ধারণে এবং ইসলামের সামনে তাদের উৎসর্গীকৃত করার ব্যাপারে কতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তাবুকের যুদ্ধের পর এ অবস্থা আরো চরম রূপ নেয়। এ কারনে আমরা দেখতে পাই যে, সেই দুই বছরে অর্থাৎ নবম ও দশম হিজরীতে মদীনায় বহু প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটেছিলো। সেই সময়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। ফলে মক্কা বিজয়ের সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো দশ হাজার, অথচ এক বছরের ও কম সময়ের মধ্যে তবুকের যুদ্ধের সময় সেই সংখ্যা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়।
বিদায় হজ্জের সময় দেখা যায় যে, মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার মতান্তরে ১ লাখ ৪৪ হাজার। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চারপাশে তাঁরা লাব্বায়েক ধ্বনি দিচ্ছিলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা ধ্বনিতে তাঁরা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলছিলেন। পাহাড়-পর্বতে মাঠে-প্রান্তরেন তাওহীদরে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।
প্রতিনিধি দলের আগমন
ঐতিহাসিকগণ ৭০টির বেশী প্রতিনিধিদলের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে সে সম্পর্কে  বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা শুধু ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদল সম্পর্কে আলোকপাত করছি। পাঠকদের এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, মক্কা বিজয়ের পরই যদিও বিভিন্ন প্রতিনিধিদল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসলে শুরু করেছিলো কিন্তু কিছু কিছু গোত্রর প্রতিনিধিদল মক্কা বিজয়ের আগেও মদীনায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাযির হয়েছিলেন। নীচে আমরা সেসব গোত্রের পরিচয় ও আগমনের ঘটনা উল্লেখ করছি।
(১) আবদুল কায়েসের প্রতিনিধি দলঃ এ গোত্রের প্রতিনিধিদল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়েছিলো, প্রথমবার পঞ্চম হিজরীতে এবং দ্বিতীয়বার নবম হিজরীতে। প্রথমবার উক্ত গোত্রের মুনকেজ ইবনে হাব্বান নামক এক ব্যক্তি বাণিজ্যিক সরঞ্জাম নিয়ে মদীনায় এসেছিলেন। এরপরও তিনি কয়েকবার মদীনয় যাওয়া-আসা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরতের পর তিনি মদীনায় আসেন এবং ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন এবং ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেন ইসলাম গ্রহণের পর নবী করিমের (রা.) তরফ থেকে এককানি চিঠি নিয়ে তিনি নিজ গোত্রের লোকদের কাছে যান। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার গোত্রের লোকেরাও ইসলাম গ্রহণ করেন।
এরপর উক্ত গোত্রের তোরো-চৌদ্দজনের একটি প্রতিনিধি দল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হন। এই প্রতিনিধি দল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ঈমান এবং পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। এই প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন আল আশাজ্ব আল আসরি।২[মারাআতুল মাফাতিহ, প্রথম খন্ড,পৃ.৭১]। এই ব্যক্তি সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করেছিলেন, তোমার মধ্যে দু’টি গুন রয়েছে যা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। একটি হচ্ছে দূরদর্শিতা ও অন্যটি সহিষ্ণুতা।
দ্বিতীয়বার এই গোত্রের প্রতিনিধিদল নবম হিজরীতে মদীনায় এসেছিলেন। এতে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন চল্রিশ জন। এদের মধ্যে আলা ইবনে জারুদ আবদী নামে একজন খৃষ্টান এসেছিলেন। তিনি মদীনয় এসে মুসলমান হন এবং পরে ইসলামের বিশেষ খেদমত করেন।৩[সরহে সহীহ মুসলিম, প্রথম খন্ড, পৃ.৩৩, ফতহুন কারী ৮ম খন্ড, পৃ.৮৫-৮৬]।
(২)দাওস প্রতিনিধিদলঃ সপ্তম হিজরীর শুরুতে্ এই প্রতিনিধিদল মদীনায় আসে।সেই সময় নবী (সঃ) খযবরে ছিলেন। ইতিপূর্বে উল্লখ করা হয়েছে যে, তোফায়েল ইবনে আমর দাওসী (রা.) মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজ কওমের প্রতি গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু তাঁর কওম টালবাহান করতে থাকে।  হতাশ হয়ে তিনি নবী করিম(সঃ)এর দরবারে এসে আবেদন করেন যে, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমার কওমের জন্যে বদদোয়া করুন। নবী (সঃ) বদদোয়া না করে বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা দাওস কওমকে  হেদায়াত দান করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই দোয়ার পরই দাওস কওমের সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতপর হযরত তোফায়ের (রা.) তাঁর কওমের সত্তর অথবা আশিটি পরিবারের লোকদের নিয়ে সপ্তম হিজরীর শুরুতে মদীনায় হিজরত করেন। সেই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খয়বরে ছিলেন। হযরত তোফায়েল (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খয়বরে সাক্ষাৎ করেন।
(৩) ফারওয়াই ইবনে আমর জোযামির পয়গাম প্রেরণঃ ফারওয়াহ রোমক সৈন্যদরে মধ্যে একজন আরব কমান্ডার ছিলেন। রোমক সম্রাট তাকে অধিকৃত আরব এলাকার গবর্নর নিযুক্ত করেন। তাঁর রাজ্যের রাজধানী ছিলো জর্দানের দক্ষিণের মা’আন নামক জায়গায়। অষ্টম হিজরীতে সংঘঠিত মূতার যুদ্ধে মুসলমানদের অসাধারণ বীরত্ব দেখে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। একজন দূত পাঠিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের ইসলাম গ্রহণের খবর জানান এবং সেই সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে একটি সাদা খচ্চর উপহার হিসাবে প্রেরণ করেন। রোমক সম্রাটের উর্ধতন কর্মকর্তারা তাদের নিযুক্ত গভর্নরের ইসলাম গ্রহণের খবর ত্রুদ্ধ হয়। তার হযরত ফারাওয়াহকে গ্রেফতার করে পরে ইসলাম ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে কলে হুমকি দেয়। হযরত ফারওয়াহ ইসলাম ত্যাগ করার চেয়ে শহীদ হওয় সমীচীন মনে করেন। অতপর ফিলিস্তিনের আফরা নামক জায়গায় একটি ঝর্ণার তীরে শূলীকাষ্ঠে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ৪[যাদুল মায়াদ, তৃতীয় খন্ড,পৃ.৪৫]
(৪) ছাদা প্রতিনিধি দলঃ অষ্টম হিজরীতে এই প্রতিনিধিদল জেরান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার পার তাঁর কাছে হাযির হন। তাঁর আসার কারণ ছিলো এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাশত মুসলমানের একটি বহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন ইয়েমেনের সেই এলাকায় গিয়ে অভিযান চালায় যেখানে ছাদা গোত্র বসবাস করে। মুসলিম বহিনী কানাত প্রান্তরে পৌঁছে তাঁবু স্থাপন করেছিলো, সেই সময় হযরত যিয়াদ ইবনে হারেশ (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছুটে এস বললেন, আমার পেছনে যারা আসছে আমি তাদের নেতা হিসাবে হাযির হয়েছি কাজেই আপনি মুসলিম বাহিনীকে ফিরিয়ে আনুন। আমার কওমের লোকদের জন্য আমি যামিন হচ্ছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে মদীনায় ফিরিয়ে আনলেন। এরপর হযরত যিয়াদ (রা.) তাঁর কওমের কাছে হাযির হয়ে বললেন, আপনার কয়েকজন আমার সথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চলুন। অতপর সব কথা তাদের খুলে বললেন। হযরত যিয়াদের (রা.) কথা শোনার পর তাঁর কওমের পনের জন লোকের একটি প্রতিনিধিদল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তারা নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে দ্বীনের তাবলীগ করলেন এবং ইসলাম প্রচার করলেন। বিদায় হজ্জের সময় এই কওমের একশত জন মুসলমান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হন।
(৫) কা’ব ইবনে যুহাইর ইবনে আবি সালমার আগমনঃ কা’ব ছিলো কবি পরিবারের সন্তান এবং আরবের বিশিষ্ট কবি। সে ছিলো কাফের। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুৎসা রটনা করতো। ইমাম হাকেম-এর বর্ণনা মতে কা’ব সেইসব অপরাধীদের তালিকভূক্ত ছিলো, যাদের সম্পর্কে মক্কা বিজয়ের সময় নির্দেশ ছিলো যে, যদি তারা কাবা ঘরের পর্দা আঁকড়ে ধরা অবস্থায়ও থাকে তবু তাদের হত্যা করতে হবে। কিন্তু কা’ব পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর কা’ব এর ভাই রুজাইর ইবনে যুহাইর এক চিঠি লিখলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কুৎসা রটনাকারী কয়েক ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেই নির্দেশ কার্যকর করা হয়েছে। কোরয়শ বংশের স্বল্পসংখ্যক কবি এদিকে সেদিকে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। যদি জীবনের জন্যে তোমার মায়া থাকে, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরবারে আসো, কেননা তিনি তওবাকারীদের হত্যা করেন না। যদি আমার এই প্রস্তাব তোমার পছন্দ না হয়, তবে যেখানে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে মনে করো সেখানে পালিয়ে যাও। এ চিঠির পর উভয় ভাইয়ের মধ্যে একাধিক পত্র বিনিময় হয়েছে। মোটকথা কা’ব নিজের জীবনাশঙ্কা উপলব্ধি করে মদীনায়ে এসে পৌঁছলেন এবং জুহাইনা নামক এক ব্যক্তির মেহমান হলেন। পরদিন সকালে সেই ব্যক্তির সাথে ফজরের নামাজ আাদায় করলন। নামাজ শেষে জুহাইনা কা’বকে ইশারায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে চিনিয়ে দিলেন কা’ব তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বসে তাঁর হাতে নিজের হাত রাখলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’বকে চিনতেন না। কা’ব বললেন হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’ব ইবনে যুহাইর যদি তওবা করে মুসলমান হয়, নিরাপত্তার আবেদন জানায় এবং আমি যদি তাকে আপনার কাছে হাযির করি তবে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। কা’ব বললেন, আমিই কা’ব ইবনে যুহাইর। একথা শুনে একজন আনসারী ছুটে এসে কা’বকে ঝাপটে ধরে তাকে হত্যা করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুমতি চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সাহাবীকে বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। সে তওবা করেছে এবং অতীতের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত  হয়েছে।
এরপর সে জায়গাতেই কা’ব ইবনে যুহাইর তাঁর বিখ্যাত কাসীদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠ করে শোনান। সেই কাসীদায় কা’ব নিজের অতীতের কৃতকর্মের জন্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেন। কবিতার অর্থ নিম্মরূপ-
‘ছোয়াদ দূর হয়ে গেছে, কাজেই এখন আমার মনে অস্থিরতা বিদ্যমান। মনের পেছনে শিকল বাঁধ। এর ফিদিয়া দেয়া হয়নি। আমাকে বলা হয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে হুমকি দিয়েছেন। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে ক্ষমার প্রত্যাশা রয়েছে। আপনি স্থির থাকুন, চোগলখোরদের কথা কানে তুলবেন না। সেই সত্তা আপনাকে পথ প্রদর্শন করুন, যিনি আপনাকে উপদেশপূর্ণ এবং বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত কোরআন দিয়েছেন। যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু আমি অপরাধ করিনি। আমি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এবং এমন সব কথা শুনতে পাচ্ছি এবং এমন অবস্থা দেখছি যে, যদি আমার জায়গায় একটা হাতী দাঁড়ানো থাকতো তবে সেই হাতী থমকে দাঁড়াতো। অবশ্য যদি আল্লাহর অনুগ্রহে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি হতো সেটা ছিলো ভিন্ন কখা। আমি নিজের হাত অকপটে সেই সম্মানিত ব্যক্তিত্বের হাতে রেখেছি যাঁর প্রতিশোধ গ্রহনের পূর্ণ শক্তি রয়েছে এবং যার কথাই সবার ওপরে। অথচ আমাকে বলা হয়েছে তোমার নামে এরূপ এরূপ নালিশে রয়েছে এবং তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। নিশ্চয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনি একটি নূর, যে নূর থেকে আলো পাওয়া যায়। তিনি আল্লাহর তলোয়ারসমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার।’
এরপর কা’ব ইবনে যুহাইর কোরায়শ মোহাজেরদের প্রশংসা করেন। কেননা কা’ব এর আসার পর কোন মোহাজের তাঁকে বিরক্ত করেননি। মোহাজেরদের প্রশংসা করার সময় কা’ব আনসারদের প্রতি শ্লেষাত্মাক মন্তব্য করেন। কেননা একজন আনসার কা’বকে হত্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কা’ব তাঁর কবিতায় বললেন, কোরায়শরা সৌন্দর্যমন্ডিত উঠের মতো চলাচল করেন এবং ধারালো তলোয়ার তাদেরকে সেই সময় রক্ষা করে, যখন বেটে-খাটে কালো কুৎসিত লোক পথ ছেড়ে পালায়।
কা’ব মুসলমান হওয়ার পর একটি কবিতায় আনসারদের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি সেই কবিতায় লিখলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্মানজনক জীবন পছন্দ করে, সে যেন সব সময় আনসারদের কোন বাহিনীর মধ্যে থাকে। আনসাররা উত্তরাধিকার সূত্রে সৌন্দর্য লাভ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তারাই ভালো লোক, যারা ভালো লোকের সন্তান।’
(৬) আজরা প্রতিনিধ দলঃ নবম হিজরীতে এই প্রতিনিধি দল মদীনায় আসেন। তারা ১২ জন ছিলেন। এদের মধ্যে হামযা ইবনে নোমানও ছিলেন। পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বললেন, আমরা বনু আজরা, কুসইদের সথে আমদের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা কুসাইদের সাহায্য করেছি এবং খাজাআ বনু বকরকে মক্কা থেকে বের করেছিলাম। এখানে আমাদরে আত্মীয়-স্বজন  রয়েছেন। এই পরিচয় জানার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাগত জানান এবং সিরিয়া বিজিত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেন। তদেরকে জ্যোতিষী মহিলাদের কাছ থেকে কোন তথ্য জানতে নিষেধ করেন। এছাড়া শেরেক করার সময়ে ওরা যে সকল পশু যবাই করে খেতো সেই সব পশু যবাই করতে নিষেধ করেন। এই প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কয়েকদিন মদীনায় অবস্থানের পর মক্কায় ফিরে যান।
(৭) বিলি প্রতিনিধিদলঃ নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এই প্রতিনিধিদল মদীনায় আসে এবং ইসলাম গ্রহণের পর তিনদিন অবস্থান করেন। এই সময়ে প্রতিনিধদলের নেতা আবু জারির জিজ্ঞাসা করেন যে, যেয়াফতের মধ্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হ্যাঁ। কোন বিত্তবান বা গরীবের সাথে ভালো ব্যবহার করা হলে সেই ব্যবহার সদকা হিসাবে গণ্য করা হবে। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন যে, যেয়াফতের মেয়াদ কতদিনের হতে হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনদিন। তিনি বললেন, কোন লোক যদি নিরুদ্দেশ কোন বকরি পায় তথন সেই বকরির ব্যাপারে নির্দেশ রয়েছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে বকরি তোমার, তোমার ভাইদের বা নেকড়ের জন্যে। এরপর সেই লোক হারানো উট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,সেই উটের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? ওকে ছেড়ে দাও, মালিক তাকে পেয়ে যাবে।
(৮) সাকীফ প্রতিনিধিদলঃ নবম হিজরীর রমযান মাসে এই প্রতিনিধিদল তবুক থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যাবর্তনের পর হাযির হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অষ্টম হিজরীতে  যিলকদ মাসে তায়েফ যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময়ে তাঁর মদীনায় পৌঁছার আগেই এই প্রতিনিধিদলের সর্দার ওরওয়া ইবনে মাসউদ নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তারা নিজ গেত্রে ফিরে গিয়ে লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। গোত্রের লোকেরা তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতো। শোনা যায় তারা নিজ সন্তান এবং পরিবার-পরিজনের  চেয়ে ওরওয়াকে বেশী  পছন্দ করতো।ওরওয়া ধরণা করেছিলেন যে,তার দেয়া ইসলামের দাওয়াত সবাই গ্রহণ করবে এবং তার কথা মেন নেবে। কিন্তু তার এ ধারণা ভূল প্রমানিত  হলো। ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পরই তার গোত্রের লোকেরা চারিদিক থেকে তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করলো এবং মারাত্মকভাবে যখম করার পর তাকে হত্যা করলো। কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর গোত্রের লোকরা উপলব্ধি করলো যে, চারিদিকে মুসলমানদের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে এতে তাদের নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে না। মুসলমানদের মোকাবেলা করাও তাদরে সম্ভব নয়। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো যে, নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে একজন লোক পাঠাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবদে ইয়লিল ইবনে আমরকে মদীনায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো কিন্তু ওরওয়ার পরিণাম প্রত্যাক্ষ করায় আবদে ইয়ালিল মদীনায় যাওয়ার শর্ত আরোপ করলেন। তিনি বললেন, আমার সাথে আরো কয়েকজনকে দিতে হবে, আমি একা যেতে রাযি নই। গোত্রের লোকেরা প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচজনকে সঙ্গে দিলেন। অবশেষে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় রওয়ানা হলেন। এদের মধ্যে ওসমান ইবনে আবুল আস সাকফী ছিলেন সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ। এই প্রতিনিধি দল  মদীনায় পৌঁছার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীর এক কোণে তাদের থাকতে দিলেন যাতে করে তারা সাহাবাদের কোরআন পাঠ শুনতে পারে এবং নামাজ আদায় দেখতে পারে। মসজিদে অবস্থানের সময় তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাওয়া আসা শুরু করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। একদিন তাদের  নেতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, আপনি সকীফ এবং আপনার মধ্যে এ মর্মে একটি চুক্তিপত্র লিখে দিন যাতে ব্যভিচার, মদপান, সুদ খাওয়া, তাদের মাবুদ লাতকে পূজার অধিকার, নামায থেকে মুক্তি এবং তাদের মূর্তিকে তাদের হাতে না ভাঙ্গার কথা উল্লেখ থাকবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উল্লিখিত শর্তাবলীর একটিও গ্রহণ করলেন না। প্রতিনিধিদল এরপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মেনে নেয়া ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিলো না। তারা তাই করলো এবং ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিলো। তবে পুনরায় শর্তারোপ করলো যে, তাদের মূর্তি লাতকে তারা নিজের হাতে ভাঙ্গতে পারবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শর্ত মেনে নিলেন এবং এই মর্মে লিখে দিলেন। তিনি ওসমান ইবনে আবুল আস সাকফীকে প্রতিনিধি দলের নেতা নিযুক্ত করলেন। কেননা ইসলামের প্রতি তার আগ্রহই ছিলা সবার চাইতে বেশী। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রতিদিন সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে যেতো কিন্তু ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে যেতো না। দুপুরে অন্যরা যখন বিশ্রাম করতো সেই সময় হযরত ওসমান (রা.)নবী করিমের দরবারে যেতেন এবং ইসলাম সম্পর্কে খুঁটিনাটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘুমে যদি দেখতেন তখন হযরত ওসমান (রা.) দ্বীন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করতেন। হযরত ওসমানের (রা.) গভর্নন হিসাবে দায়িত্ব পালন ছিলো খুব বরকতপূর্ণ। হযরত আবু বকরের (রা.) খেলাফতের সময় কিছু লোক ধর্মান্তরিত হয়ে যায়, সেই সময় ছকিফ গোত্রের লোকেরাও ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। হযরত ওসমান ইবনে আবুল আস (রা.) সেই নাযুক সময়ে তাদের সম্বোধন করে বললেন, ছাকিফ গোত্রের লোকেরা শোনো, তোমরা সকলের শেষে ইসলাম গ্রহণ করেছ কাজেই সবার আগে মুরতাদ হয়ো না। একথা শুনে ছকিফ গোত্রের লোকেরা ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করা থোকে বিরত থাকে এবং ইসলামের ওপর অবিচল থাকে।
মোটকথা প্রতিনিধিদল নিজ কওমের কাছে ফিরে এসে প্রকৃত সত্য গোপন করে রাখে। তারা দুঃখ ভারাক্রান্তভাবে বলে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি দাবী করেছেন তারা যেন ইসলাম গ্রহণ করে এবং ব্যভিচার করা, মদ পান করা, সুদ খাওয়া ছেড়ে দেয়। যদি তা না করে তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করা হবে। ছকিফ গোত্রের লোক একথা শুনে যুদ্ধ করার কথা দু’তিন দিন যাবত চিন্তা ভাবনা করলো। পরে আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তর পরিবর্তন করে দিলেন, তারা ইসলাম গ্রহণের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। প্রতিনিধিদলকে তার বললো যে, তোমরা মদীনায় ফিরে যাও এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলো যে, আমরা তাঁর শর্তাবলী মেনে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি আছি। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা তথন নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানালেন এবং গোত্রের লোকদের ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন। ছকিফ গোত্রের লোকেরা তখনই ইসলাম গ্রহণ করলো।
এদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘লাত’ মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে হযরত খালেদ ইবনে ওলীদের (রা.) নেতৃত্বে কয়েকজন সাহাবীকে সাকিফ গোত্রে প্রেরণ করলেন। হযরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা.) মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে লৌহ নির্মিত গদা দুলে সঙ্গীদের বললেন, আমি একটু রসিকতা করে আপনাদের হাসাবো। একথা বলে মূর্তিকে আঘাত করেই তিনি হাঁটু ধরে বসে পড়লেন। কৃত্রিম এ দৃশ্য দেখে তায়েফের সাকীফ গোত্রের লোকেরা প্রভাবিত হলো। তারা বললো, আল্লাহ তায়ালা মুগিরাকে ধ্বংস করুর, ‘লাত’ দেবী তাকে মেরে ফেলেছে। হযরত মুগিরা (রা.) গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অমঙ্গল করুন, ওই মূর্তিতো পাথর আর মাটি দিয়ে তৈরী। এরপর হযরত মুগিরা (রা.) দরজায় আঘাত করলেন এবং মূর্তি ভেঙ্গে ফেললেন। হযরত মুগিরা (রা.)এরপর উঁচু দেয়ালে আরোহণ করলেন। কয়েকজন সাহাবীও উঁচু দেয়ালে আরোহণ করলেন। মূর্তি ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন এরপর মাটি খুঁড়ে মূর্তিকে দেয়া অলঙ্কার এবং পোষাক বের করলেন। এ দৃশ্য দেখে সাকীফ গোত্রের লোকেরা বিস্মিত এবং বিচলিত হলো। হযরত খালেদ (রা.) মূর্তির অলঙ্কার ও পোশাক মদীনায় নিয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবকিছু সেইদিনই বন্টন করে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ৫[যাদউল মায়াদ,৩য় খন্ড,  পৃ.২৬-২৮।
(৯) সাকীফ ইয়েমেনের বাদশাহের চিঠিঃ তবুক থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসার পর ইয়েমেনের বদশাহর চিঠি লিখলেন। হারেস ইবনে আবদে কালাল, নঈম ইবনে আবদে কালাল, রাঈন এবং হামদন ও মাআফের এর শাসনকর্তা নোমান ইবনে কাইলের চিঠি এলো। সকলের পক্ষ থেকে মালেক ইবনে মারয়া পত্র প্রেরণ করেন। এ সকল বাদশাহ ইসলাম গ্রহণ এবং শেরেক ও কুফুরী পরিত্যাগের কথা উল্লেখ করে পত্র প্রেরণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি জবাব পাঠিয়ে ইয়েমেনবাসীদের অধিকার এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য উল্লেখ করেন। যারা ইসলাম গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা এবং তার রসূল তাদের যিম্মাদর হবেন বলেও তিনি পত্রে উল্লেখ করেন। তবে শর্ত এই যে, তাদেরকে জিজিয়া পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মায়া‘য ইবনে জাবালে (রা.) নেতৃত্বে কয়েকজন সাহাবকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন।
(১০) হামদান প্রতিনিধিদলঃ এই প্রতিনিধিদল তবুক থেকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসার পর তাঁর খেদমতে হাযির হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিধি দলের কওমের জন্যে একটি নির্দেশ সম্বলিত পত্র লিখে তারা যা কিছু চেয়েছিলো তা প্রদান করেন। মালেক ইবনে নামতকে আমীর নিযুক্ত করা হয় এবং তাকে তার কওমরে ইসলাম গ্রহণকারীদের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। অন্য লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্যে হযরত খালেদ ইবনে ওলীদকে (রা.) প্রেরণ করেন। তিনি ছয়মাস হামদানে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরর হযরত আলীকে (রা.) হামদানে প্রেরণ করেন এবং হযরত খালেদকে (রা.)ফেরত পাঠাতে বলে দেন। হযরত আলী (রা.) হামদান গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি পড়ে শোনান এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে সবাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। হযরত আলী (রা.) রসূল (স.)-এর দরবারে এই খবর পাঠিয়ে দেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুসংবাদ সম্বলিত চিঠি পড়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং হামদনের উপর সালাম, হামদানের উপর সালাম।
(১১) বনি ফাজার প্রতিনিধিদলঃ নবম হিজরীদতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তবুক ফেরার পর এই প্রতিনিধিদল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করে। এই প্রতিনিধিদলে দশজন অন্তভূক্ত ছিলো। তারা তাদের এলাকায় দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে উঠে উভয় হাত উপরে তুলে মোনাজাত করেন যে, হে আল্লাহ তায়ালা নিজের সৃষ্ট যমিন এবং চতুষ্পদ প্রাণীদরে পরিতৃপ্ত করো। তোমার রহমত প্রসারিত করো। তোমার মৃত শহরকে জীবিত করো। হে আল্লাহ তায়ালা, আমাদের ওপর এমন বৃষ্টি বর্ষণ করো, যে বৃষ্টি আমাদের কাম্য। সেই বৃষ্টি দ্বারা আমাদের শান্তি দান করো আরাম দান করো। প্রসারিত কালোমেঘ যেন তাড়াতাড়ি আসে-দেরী না করে। সেই বৃষ্টি না হয়। ধ্বংসকর যেন না হয়, ক্ষতিকর না হয়। হে আল্লাহ তায়ালা, রহমতের বৃষ্টি যেন আযাবের বৃষ্টি না হয়। ধ্বংসকর যেন না হয়। হে আল্লাহ তায়ালা,আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করো এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করো।৬[যাদু-উল মা’দ,৩য় খন্ড, পৃ.৪০]
(১২) নাজরান প্রতিনিধিদলঃ মক্কা থেকে ইয়েমেনে যাওয়ার পথে এই এলাকার অধিবাসীরা বসবাস করে। ৭৩টি জনপদ অর্থাৎ বসতি নিয়ে এই নাজরান সম্প্রদায়। একজন দ্রুতগামী ঘোড়া সওয়ার পুরো একদিন সময়ে সমগ্র জনপদ প্রদক্ষিণ করতে পারে।৭(ফতহুল বারী,৮ম খন্ড, পৃ.৯৪] এই এলাকায় একলাখ যোদ্ধা পুরুষ ছিলো এরা সবাই ছিলো খৃস্টান ধর্মের অনুসারী।
নাজরান প্রতিনিধ দলও নবম হিজরীতে আসে। এতে ষাট ব্যাক্তি অন্তভূক্ত ছিলো। এদের মদ্যে চব্বিশজন ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর। তিনজন ছিলেন নাজরানবাসীদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা। আবদুল মসীহ নামে এক ব্যক্তি সরকার প্রধান,শারহাবিল নামে এক ব্যক্তি রাজনীতি বিষয়কক উপদেষ্টা পালন করতেন।
প্রতিনিধিদল মদীনায় পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করেন।  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। তারাও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। এরপর নবী (স.) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং কোরআন পাঠ করে শোনান। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি।
তারা জিজ্ঞাসা করেলে, আপনি মসীহ (আ.) সম্পর্কে কি ধরণা পোষণ করেন? তার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওহী নাযিল করলেন।
‘অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ঈসা (আ.) এর দৃষ্টান্ত আদমের সদৃশ। তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন অতঃপর তাকে বলেছিলেন হও, ফলে সে হয়ে গেলো। এই সত্য তোমার প্রতিপালকের কাছে হতে সুতরাং সংশয়বাদীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না। তোমার কাছে জ্ঞান আসবার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল, এসো আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রৃদের,আমাদের নারীদের এবং তোমাদের নারীদের, আমাদরে নিজেদের এবং তোমাদের নিজেদের। অতপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লানত।’ (সূরা আলে ইমরান,আয়াত ৫৯-৬১)
সকাল বেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত আয়াতে কারিমার আলোকে আগন্তুকদের হযরত ঈসা (আ .) সর্ম্পকে অবহিত করলেন।কিন্তু তারা হযরত ঈসা (আ .) সর্ম্পকে নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালো। তারা তাদের এ অস্বীকৃতির ওপর অটল থাকলো। পরদিন সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওদেরকে মোবাহালার অর্থাৎ দুই পক্ষের পরস্পরের জন্যে বদদোয়ার প্রস্তাব জানালেন। এই আহ্বান জানানোর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মোবাহালার জন্যে প্রস্তুত দেখে নিভৃতে গিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো। নিজেদের মধ্যে পরামর্শে এক পক্ষ বললো, মোবাহেলার ঝুঁকি নিয়ে ঠিক হবে না। আল্লাহর শফথ এই হচ্ছেন নবী। যদি আমার তাঁর সাথে মোবাহেলা করি তবে আমরা এবং আমাদের সন্তান কিছুতেই সফল হতে পারবে না। আমরা সবংশে নির্মূল হয়ে যাব। পরামর্শক্রমে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজেদের  ব্যাপারে সালিশ মানলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারা বলালো, আপনার দাবী মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এ প্রস্তাবের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করতে রাযি হলেন। দু’হাজার জোড়া কাপড়ের ওপর সমঝোতা হলো। এক হাজার জোড়া রজব মাসে এবং অন্য এক হাজার জোড়া সফর মাসে তারা দিতেও সম্মত হলো। এর বিনিময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদরেকে আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  যিম্মায় গ্রহণ করলেন। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা ছিলো স্বাধীন। উল্লিখিত বিষয়ে তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চুক্তি সম্পাদন করলেন। প্রতিনিধিদল দাবী করলো যে, তাদের সাথে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে যেন প্রেরণ করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তি অনুযায়ী মালামাল সংগ্রহের জন্যে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহকে প্রেরণ করলেন।
অতপর নাজরা গোত্রে ইসলামের বিস্তার ঘটতে থাকে। সীরাত রচয়িতরা লিখেছেন প্রতিনিধিদলের নেতা এবং তার অনুসারীরা নাজরান যাওয়ার পর ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলো। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাকাত এবং জিজিয়া গ্রহণ করতে হযরত আলীকে (রা.) প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য যে, সাদাকা মুসলমানদের থেকেই উসূল করা হয়।৮[ফতহুল বারী,৮ম খৃন্ড,পৃ.৯৪-৯৫। যাদুল মায়াদ, তয় খন্ড, পৃ.৩৮-৪১। নাজরন প্রতিনিধিদলের বিস্তারিত বর্ণনায় উল্লেখ রায়েছে যে, নাজর প্রতিনিধিদল এ ২য়বার মদীনায় গমন করলে কেউ কেউ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেননি।]
(১৩) বনি হানিফা প্রতিনিধি দলঃ এ প্রতিনিধিদল নবম হিজরীতে মদীনায় আগমন করে। এতে মোসায়লামা ইবনে কাযযাবসহ সতের ব্যক্তি ছিলেন।৯[ফতহুল বারঅ, ৮ম খন্ড, পৃ.৮৭] মোসায়লামার বংশধারা এরূপ মোসাইলাম ইবনে ছামামা ইবনে কারিব ইবনে হাবিব ইবনে হারেস।
এ প্রতিনিধিদল একজন আনসার সাহাবীর বাসভবনে গিয়ে ওঠেন। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন । তবে মোসায়লামা কাযযাব সম্পর্কে ভিন্ন কথা জানা যায়। সকল বর্ণনার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় মোসায়লামা হঠকারিতা ও অহংকার এবং ক্ষমতা পাওয়ার লোভ প্রকাশ করে। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের সাথে সে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়নি। পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শান্ত ও মধুর স্বরে থাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু লক্ষ্য করলেন যে, তার মধুর ব্যবহার কোন শুভ প্রতিক্রিয়াই দেখা যাচ্ছে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বুঝতে পারলেন যে, এ লোকটির কোন কল্যাণ হবে না। তার মনের ভিতর পঙ্কিলতা ও কালিমা রয়েছে।
এর আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাতে স্বপ্নে দেখেন যে, সমগ্র বিশ্বের ধনভান্ডার তার দরবারে এনে রাখা হয়েছে। হঠাৎ সে ধন ভান্ডার থেকে দুটি সোনার কাঁকন তার হাতে উড়ে এসে পড়লো। কাঁকন দু’খানি ছিলো বেশ ভারি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিব্রত বোধ করছিলেন। এসময় হযরত জিবরাঈলের (আ.)মাধ্যমে ওহী এলা যে, কাঁকন দুখানিতে ফুঁ দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুঁ দিনলেন। সাথে সাথে কাঁকন দু’খানি উড়ে চলে গেলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই স্বপ্নের ব্যাখ্য করলেন যে, তার পরে দুজন লোক নবুয়তের মিথ্যা দাবীদার হবে। মোসায়লামা কাযযাবের দুর্বিনীত ব্যবহার দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হলেন। সে দুর্বৃত্ত বলছিলো, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি শাসন ক্ষমতা তার পরবর্তী সময়ে আমাকে ন্যস্ত করেন তবে আমি তার আনুগত্য করতে প্রস্তুত রয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোসায়লামার কাছে গেলেন। সে সময় তার হাতে একটি খেজুর গাছের শাখা ছিলো এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখপাত্র হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস ইবনে শামাস (রা.) তার সাথে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার শিয়রের কাছে গিয়ে হাযির হলেন। মোসায়লাম বললো, যদি আপনি রাজি থাকেন, তবে শাসনক্ষমতার ব্যাপারে আমি আপনাকে ছাড় দিতে রাজি আছি। কিন্তু ক্ষমতার ব্যাপারে আপনার উত্তরাধিকারী আমাকে মনোনীত করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের খেজুর শাখার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, যদি তুমি আমার কাছে এটি চাও এটিও আমি তোমাকে দেবো না, তোমার ব্যাপারে আল্লাহর যে ফয়সালা রয়েছে তুমি তার বাইরে যেতে পারবে না। যদি তুমি পৃষ্টপ্রদর্শন করে চলে যাও তবে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করে দেবেন। আল্লাহর শপথ, আমার মনে হয় তুমিই সেই ব্যক্তি যার ব্যাপারে আমাকে স্বপ্নে দেখানে হয়েছে। ছাবেত ইবনে কয়েস এখনো রইলো সে তোমাকে আমার পক্ষ থেকে জবাব দেবে একথা বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে এলেন। ১০[সহীহ বোখারী, বনি হানিফা এবং আসওাদ আনাসির কিস্সা বিষয়ক অধ্যায়। ২য় খন্ড, পৃ. ৬২৭,৬২৮ এবং ফতহুল বারী ৮ম খন্ড ৮৬-৯৩]
অবশেষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাই সত্য প্রমাণিত হলো । মোসায়লাম কাযযাব ইয়ামামা ফিরে গিয়ে প্রথমে কযেকদিন নিজের সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলো। তারপর হঠাৎ দাবী করলো যে, নবুয়তের ক্ষেত্রে মোহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। অতপর সে প্রকাশ্যে নবুয়তের দাবী প্রচার করতে লাগলো। স্বজাতির লোকদের জন্যে সে ব্যভিচার এবং মদ্যপান বৈধ বলে প্রচার করলো।
মোসায়লাম কাযযাব দশম হিজরীতে নবুয়ত দাবী করেছিলো। দ্বাদশ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রা.) খেরাফতের সময়ে ইয়ামামায় সে নিহত হয়। হযরত হামযার (রা.) হত্যাকরী হযরত ওয়াহশী (রা.)মোসায়লাম কাযযাবকে হত্যা করেন।
নবুয়তের একজন দাবীদারের পরিণাম জানা গেলো। অন্য একজন দাবীদার আসওয়াদ আনাসী ইযেমেনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের একরাত একদিন আগে হযরত ফিরোজ (রা.) এই ভন্ড নবীকে হত্যা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহীর মাধ্যমে এ হত্যাকান্ডের খবর জেনে সাহবাদের জানিয়ে দেন। এরপর ইয়েমেন থেকে হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে যথারীতি খবর এস পৌছায়। ১৩[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ.৯৩]
(১৪) বনি আমের সা’সাআ প্রতিনিধিদলঃ প্রতিনিধিদলে আল্লাহর দুশমন আমের ইবনে তোফায়েল হযরত লাবিদের বৈমাত্রেয় ভাই আরবাদ ইবনে কয়েস, খালেদ ইবনে জাফর এবং জব্বার ইবনে আসলাম অন্তভূক্ত ছিলেন। এরা নিজ নিজ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং শয়তান স্বভাব সম্পন্ন ছিলো। আমের ইবনে তোফায়েল নামক এক ব্যক্তি বে’র মাউনায় সত্তরজন সাহাবীকে শহীদ করিয়েছিল। এই প্রতিনিধিদল মদীনা আসার ইচ্ছা করার সময়ে আমের ইবনে এবং আরবাদ ষড়যন্ত্র করেছিলো যে, তারা ধোকা দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আকস্মিকভাবে হত্যা করবে।
এ প্রতিনিধিদল মীনায় পৌঁছার পর আমের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আলাপ করছিলো। এ সময়ে আরবাদ ঘুরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে গেলো এবং তলোয়ার বের করতে লাগলো। কিন্তু তলোয়ার এক বিঘতের বেশী বের করতে সক্ষম হলো না, আল্লাহ তায়ালা তার হাত অসাড় করে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীকে হেফাজত করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় দুর্বৃত্তের জন্যে বদদোয়া করলেন। ফলো ফেরার পথে আরবাদের উপর বজ্রপাত হলো। সাথে সাথে উটসহ এই কাফের মৃত্যু ররণ করলো। এদিকে আমের একজন সেলুলিয়া মহিলার ঘরে আশ্রয় নিলো। সেখানে তার ঘাড়ে গলগন্ড রোগ দেখা দিলো। এ রোগেই  সেখানে তার মৃত্যু হল। মৃত্যুর সময় আমরে বলেছিলো হায উটের ঘাড়ের মতো গলগন্ড রোগ আর সেলুলিয়ার মহিলার ঘরে মৃত্যুবরণ?
সহীহ বোখারীর রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আমের বললো, আপনাকে আমি তিনটি শর্ত দিচ্ছি, এর যে কোন একটি মেনে নিন (১) উপত্যকার অধিবাসীরা আপনার উৎপন্ন দ্রব্য আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।(২) আমি আপনার পরে খলীফা হবো। (৩) বনি গাতফান গোত্রের এক হাজার নর এবং এক হাজার মাদী ঘোড়াসহ আপনার বিরুদ্ধে লেলিযে দেবো।
অতপর সে এক মহিলার ঘরে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হলো। সে সময় গভী হতাশায় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে সে বললো, হায় উুটের ঘাড়ের মতো গলগন্ড রোগ। তাও অমুক গোত্রের মহিলার ঘরে? তারপর বললো, আমার কাছে আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। ঘোড়া নিয়ে আসা হল। ঘোড়ার পিঠে অতপর আল্লহর এ দুশমন মৃত্যুবরণ করলো।
(১৫) তাজিব প্রতিনিধি দলঃ এই প্রতিনিধিদল নিজেদের গোত্রের গরীব লোকদের মধ্যে বন্টনের পর অবশিষ্ট সাদাকা নিয়ে মদীনায় হাযির হলো। এ প্রতিনিধিদলের মোট তেরো ব্যক্তি ছিলেন। এর কোরআন সুন্নাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাদের শিক্ষা করতেন। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু কথা জিজ্ঞেস করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের  সেসব কথা লিখে দিলেন। এর বেশীদিন মদীনায় অবস্থান করেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিধি দলের সদস্যদের কিছু জিনিস উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করেন। যাওয়ার পর ওরা পেছনে পড়ে থাকা একজন সঙ্গী যুবককে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করলো। যুকব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে বললো, হুজুর আল্লাহর শপথ, আমি নিজের এলাকা থেকে অন্য উদ্দেশ্যে আসিনি, শুধু এ উদ্দেশ্যে এসেছি যে, আপনি আমার জন্যে সর্বশক্তিমান পরম করুনাময় আল্লহার  কাছে দোয়া করুন। তিনি যেন আমাকে রহমত এবং তাঁর দ্বীনের অবিচল থাকার শক্তি দান করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবকের জন্যে দোয়া করলেন। পরবর্তীকালে বহু নওমুসলিম ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলেও এ যুবক ইসলামের ওপর ছিলো অটল অবিচল। নিজ কওমের লোকদের কাছে সে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে ওয়ায নসিহত করলো। ফলে তার কওমের লোকেরাও ইসলামের ওপর অবিচল থাকলো। দশম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সময় এই প্রতিনিধিদল পুনরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করলো।
(১৬) তাঈ প্রতিনিধিদলঃ এই প্রতিনিধিদল আরবের বিখ্যাত যায়েদ আল খায়েলও ছিলেন। এরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আলাচনায় মিলিত হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করে খুব ভালো মুসলমান হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ আল খায়েল এর প্রশংসা করলেন, তিনি বললেন, আরবের যে কোন লোকের প্রশাংসাই আমার কাছে করা হয়েছে, তারা আমার সামনে আসার পর বাস্তবে আমি তাদের খ্যাতির চেয়ে কমেই পরিচয় পেয়েছি। কিন্তু যায়েদ তার ব্যতিক্রম।তার গুন বৈশিষ্ট্য তার খ্যাতির চেয়ে অধিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম করণ করলেন যায়েদ আল খায়ের।
একই নিয়মে নবম এবং দশম হিজরীতে বহু সংখ্যক প্রতিনিধি দল আগমন করে সীরাত রচয়িতারা ইয়মান,আযাদ,কোযাআর বনু সা’দ,হোযাইম বনু আমের ইবনে কয়েস,বনু আসাদ, বাহরা, খাওলান, মাহারেব, বনু হারেস ইবনে কা’ব, গামেদ, বনু মোনতাফেতক, সালমান, বনি আবাস,মাজিনা, মোরাদ, জোবায়েদ, কুন্দাহ, জি-মাররাহ, গাস্সান, বু আয়েশ এবং নাখ প্রতিনিুধিদলের কথা উল্লেখ করেছেন। নাখ-এর প্রতিনিধি দল এসছিলো সর্বশেষে। একাদশ হিজরীর মহররহম মাসে এ প্রতিনিধি দল মদীনায় আসে।
এতে দু’শো ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অন্য প্রায় সকল প্রতিনিধিদল নবম এবং দশম হিজরীতে আগমন করেন। অল্প কয়েকটি প্রদিনিধি দল একাদশ হিজরীতে আগমন করে।
উল্লিখিত প্রতিনিধিদলসমূহের মদীনায় আগমনের ঘটনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের প্রচার প্রসার কতোটা হয়েছিলো। এছাড়া এটাও বোঝা যায় যে, আরব জনগণের দৃষ্টিতে মদীনার গুরুত্ব ছিলো কত বেশী। মদীনায় গিয়ে আত্মসমর্পন ব্যতীত তারা অন্য কোন উপায় দেখতে পায়নি। প্রকৃতপক্ষে মদীনা জাযিরাতুল আরবের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিলো। মদীনাকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। তবে, আমরা এমন কথা বলতে পারব না , আগন্তুকদের সকলের মনেই ইসলামের প্রভাব পড়েছিলো এবং বিশেষভাবে রেখাপাত করেছিলো। কেননা উল্লিখিত প্রতিনিধিদলসমূহের সদস্যদের মধ্যে বহু আরব বেদুইন এমন ও ছিলো যারা নিজেদের গোত্র সর্দারের আনুগত্য করতে মুসলমান হয়েছিলো। হত্যা,লুটতরাজ ইত্যাদি অভ্যাস তারা তখনো পুরোপুরি ত্যাগ করতে সক্ষম হয়নি। এবং ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য্যের কারণে তারা সভ্য মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতেও পারেনি। সূরা তওবায় এ ধরণের লোকদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কুফুরী ও কপটতায় মক্কাবাসীরা কঠোরতর এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি যা অবতীর্ণ  করেছেন, তারা সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার যোগ্যতা এদের অধিক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। মরুবাসীদের কেউ কেউ যা তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তা অর্থদন্ড বলে গণ্য করে এবং তোমদের ভাগ্য বিপর্যয়ের প্রতিক্ষা কর। মন্দ ভাগ্যচক্র ওদেরই হোক। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।’
তবে কিছু সংখ্যক লোকের প্রশংসাও করা হয়েছে। সূরা তওবায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মরুবাসীদের কেউ কেউ আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া লাভের উপায় মনে করে। বাস্তবিকই তা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়। আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতে দাখিল করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।’
মক্কা, মদীনা, ছাকিফ,ইয়েমেন এবং বাহরাইনের বহু নাগরিক অন্তকরণে ইসলাম দৃঢ়ভাবে গেঁথে গিয়েছিলো। তাঁদের অনেকেই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবা এবং পূণ্যশীল মুসলমান। ১৪[খাযরামি তাঁর মোহযেরাত গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ১৪৪ পৃ. একথা লিখেছেন। যেসব প্রতিনিধি দলের কথা উল্রে করা হয়েছে এবং যেসব প্রতিনিধিদল সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখূন সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ.১২, ২য় খন্ড, পৃ. ৬২৬-৬৩০। ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড পৃ. ৫০১-৫০৩। ৫৩৭-৫৪২, ৫৬০-৬০১। যাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড, পৃ.২৬-৬০, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ.৮৩-১০৩। রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ.১৮৪-২১৭]।
রসূলের দাওয়াতের ব্যাপক সফলতা
এবার আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনের শেষ দিক সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু সেদিকে অগ্রসর হওয়ার আগে নবী জীবনের অনন্য সাধারণ কার্যাবলীর প্রতি একটুখানি আলোকপাত করা দরকার। মূলত সেটাই হচ্ছে নবী জীবনের সারকথা। সেই বৈশিষ্টের কারণেই তিনি সকল নবী-পয়গাম্বরের মধ্যে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আল্লাহ রব্বুলর আলীমীন তাঁকে সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ এর অনন্য মর্যাদার মুকুট দান করেছেন। নবীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত’। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, হে বস্ত্রাচ্ছাদিত, উঠ, সতর্ক বাণী প্রচার কর।’
এরপর কি হয়েছে? রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠলেন, নিজ কাঁধে বিশ্বজগতের সবচেয়ে বড় আমানতের বোঝা তুলে নিলেন এবং একাধারে দাঁড়িয়ে রইলেন। সমগ্র মানবতার বোঝা সকল আকিদার বোঝা এবং বিভিন্ন ময়দানে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার বোঝা।
তিনি মানুষের বিবেকের ময়দানে জেহাদের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন এসব বিবেক ছিলো অজ্ঞতার যুগের কল্পনা এবং নানাবিধ উদ্ভট ধারণায় নিমজ্জিত।
মানুষের বিবেক সে সময় পৃথিবীর নানা আকর্ষনীয় বস্তুর কারণে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিলো। মানুষের বিবেক খাহেশাতে নফসানীর শেকল ও ফাঁদে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কতিপয় নিবেদিত প্রাণ সাহাবার সহযোগীতায় জাহেলিয়াত এবং বিশ্বজগতের আকর্ষণ থেকে মানুষের বিবেককে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করার পর অন্য একটি সংগ্রাম শুরু করলেন। বরং একটির পর আরেকটি সংগ্রাম শুরু হলো। অর্থাৎ দাওয়াতে এলাহীর সেসব শত্রু যারা দাওয়াত এবং তার প্রতি বিশ্বাসীরদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, দাওয়াতের পবিত্র চারাগাছকে মাটির নিচে শেকড় বিস্তারের আগে শূন্যে শাখা প্রশাখা বিস্তারের এবং ফলে ফুলে সুশোভিত হবার আগেই নিশ্চিহ্ণ করে দিতে চাচ্ছিলো। দাওয়াতের এ সকল শত্রুর সাথে নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংগ্রাম শুরু করলেন। জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রোমক সাম্রাজ্য এ নয়া জাতিকে নিশ্চিহ্ণ করার সীমান্তে প্রস্তুতি শুরু করে।
অবশেষে সকল সংগ্রাম শেষ হলো কিন্তু বিবেকের সংগ্রাম সংঘাত শেষ হয়নি। কারণ এটি হচ্ছে চিরস্থায়ী সংঘাতের বিষয়। এতে শয়তানের সাথে মোকাবেলা করতে হয়। শয়তান মানব মনের গভীরে প্রবেশ করে তার তৎপরতা অব্যাহত রাখে এবং মুহুর্তের জন্যেও তা বন্ধ করে না। মোহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত থেকে বিভিন্ন ময়দানে যথোচিত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দুনিয়া তাঁর চরণে এসে লুটিয়ে পড়েছিলো কিন্তু তিনি দুঃখকষ্ট এবং দারিদ্রের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিলেন। ঈমানদাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারিপাশে শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়া বিস্তার করে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি দুঃখ দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের পথে সাধনা অব্যাহত রাখেন। যে কোন অবস্থায় দুঃখ কষ্টের মধ্যে তিনি অভূতপূর্ব ধৈর্যধারণ করছিলেন। রাত্রিকালে তিনি নামাযে দাঁড়াতেন। প্রিয় প্রতিপালকের এবাদাত এবং পবিত্র কোরআন ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। সমগ্র বিশ্ব থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর প্রতি তিনি মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য  তাঁকে এ রকম করতে নির্দেশও প্রদান করা হয়েছিলো।১[সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, ২৯তম খন্ড, পৃ-১৬৮-১৬৯]।
**এমনিভাবে সুদীর্ঘ বিশ বছরের সময় যাবত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংগ্রাম চালিয়ে যান। এই সময়ের মধ্যে একটি কাজে আত্মনিয়োগ করে অন্য কাজ তিনি ভুলে থাকেননি। পরিশেষে ইসলামী দাওয়াত এমন ব্যাপক সাফল্য লাভ করলো যে, সাবইকে অবাক হতে হলো। সমগ্র জাযিরাতুল আরব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগত হলো। আরবে দিগন্ত থেকে জাহেলিয়াতের মেঘ কেটে গেলো। অসুস্থ বিবেকসমূহ সুস্থ হয়ে গেলো। এমনকি মূর্তিসমূহকে তারা ছেড়ে দিল বরং ভেঙ্গে ফেলল। তওহীদের আওয়াযে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। ঈমানের তেজে নতুন জীবনীশক্তি লাভ করে মরু বিয়াবার আযানের সুমধুর ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো। দিক দিগন্তে আল্লাহ আকবর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো। কোরআনের ক্বারীরা প্রবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহর হুকুম আহকাম কায়েম করতে উত্তর দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়লেন।
বিচ্ছিন্ন গোত্রসমূহ একত্রিত হলো, মানুষ মানুষের দাসত্ব ছেড়ে আল্লাহর দাসত্বে আত্মনিয়োগ করলো। এখন আর কেউ শোষক নয়,কেউ শোষিত নয়,কারো রক্তচক্ষু কাউকে এখন আর ভীতসন্ত্রস্ত করে না, কেউ যালেম নয়, কেউ মযলুম নয়, কেউ মালিক নয়, কেউ গোলাম নয়, কেউ শাসক নয়, কেউ শাসিত নয় বরং সকল মানুষ আল্লাহর বান্দা এবং পরস্পর ভাই ভাই। তারা একে অন্যাকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর হুকুম আহকাম পালন করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্য থেকে জাহেলিয়াতের সময়ের গর্ব অহংকার এবং পিতা পিতামহের নামে আত্মম্ভরিতার অবসান ঘটালেন। এখন আর অনারবদের ওপর আরবদের এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতঙ্গদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। অন্যথায় সকল মানুষ আদমের সন্তান। আর আদম হচ্ছে মাটির তৈরী।
মোটকথা এই দাওয়াতের ফলে আরব ঐক্য মানবীয় ঐক্য সম্মিলিত ন্যায়নীতি ও সুবিচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। মানব জাতি দুনিয়ার বিভিন্ন সমস্যা এবং আখেরাতের বিভিন্ন কাজে সৌভাগ্যের পথের সন্ধান পেলো। অন্য কথায় ইতিহাসের ধারাই পাল্টে গেলো।
এই দায়ওয়াতের আগে পৃথিবীতে জাহেলিয়াতের জয়-জয়কার চলছিলো। মানুষের বিবেক অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আত্মা দুগন্ধময় হয়ে পড়েছিলো। মূলোবোধে চরম অবক্ষয় ঘটেছিলো। অত্যাচার এবং দাসত্বের প্রবল প্রতাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। উচ্ছৃঙ্খলাতপূর্ণ এবং লজ্জাকর সাচ্ছন্দ্য এবং ধ্বংসাত্মক বঞ্চনার ঢেউ বিশ্বকে অবনতির অতলে পৌঁছে দিয়েছিলো। এর ওপর কুফুরী এবং পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে মোটা পর্দা হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। অথচ সময় ও আসমানী মাযহাব এবং ধর্ম বিশ্বাস বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু মানুষ সেসবকে বিকৃত করে দিয়েছিলো। ফলে ধর্ম বিশ্বসের ক্ষেত্রে দূর্বলতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিলো। ধর্মের বন্ধন ছিলো শিথিল। ধর্ম হয়ে পড়েছিলো প্রাণহীণ দেহের মতো দূর্বল এবং অল্পকিছু আচার অনুষ্ঠানসর্বস্ব।
উল্লিখিত দাওয়াত যখন মান জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করলো, তখন মানবাত্মা অলীক ধ্যান-ধারণা, প্রবৃত্তির দাসত্ব নোংরামি, অন্যায়, অত্যাচার,নৈরাজ্য এবং অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভ করলো। মানব সমাজকে যুলুম, অত্যাচার, হঠকারিতা, ঔদ্ধত্য, ধ্বংস, শ্রেণী বৈষম্য, শাসকদের অত্যাচার, জ্যোতিষীদের অবমাননাকর ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্তি দান করলো। বিশ্ব তখন দয়া, ক্ষমা, বিনয়, নম্রতা, আবিষ্কার, নির্মাণ, স্বাধীনতা, সংস্কার, মারেফাত, ঈমান, ন্যায়পরায়ণতা,সুবিচার এবং আমালের ভিত্তিতে জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি এবং হকদারের অধিকার লাভের নিশ্চয়তার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হলো। ২[সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, ১ম খন্ড, পৃ-১৪]।
এসকল পরিবর্তনের কারণে জাযিরাতুল আরব এমন একটি বরকতপুর্ণ জনবসতিতে পরিণত হলো যার উদাহরণ মানব ইতিহাসের কোন যুগে অথবা কোন দেশে দেখা যায়নি এবং যাবেও না। জাযিরাতুল আরব তার ইতিহাসে এমন জৌলুসপূর্ণ এবং ঝলমলে হয়ে উঠলো যে, এর আগে কখনোই, কোথাও ওরকম দেখা যায়নি।
সূত্রঃ- আর-রাহিকুল মাখতুম
৩১ তম খন্ড

No comments

Powered by Blogger.