হোদায়বিয়ার সন্ধির পর সামরিক তত্পরতা। রাসূল (সাঃ) এর জীবনী। ২৪ তম খন্ড

গোযওয়ায়ে যী কারাদ
এ অভিযান বনু ফাজারার একটি অংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পশুপালের উপর হামলা করেছিলো। এই হামলার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই সাহাবাদেরসহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ অভিযান পরিচালনা করেন।

হোদায়বিয়ার সন্ধির পর এবং খয়বর অভিযানের আগে এটি ছিলো প্রথম ও  একমাত্র অভিযান। ইমাম বোখারী (রা) উল্লেখ করেছেন, খয়বর অভিযানের মাত্র তিন দিন আগে এটি পরিচালিত হয়। ইমাম সালমা ইবনে আকওয়া (রা) থেকে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ রয়েছ। সহীহ মুসলিম শরীফেও তার উল্লেখ রয়েছ। সীরাত রচয়িতারা লিখেছেন, এ ঘটনা ঘটেছিলো হোদায়বিয়া সন্ধির আগে। কিন্তু একথা ঠিক নয়। বরং হাদীস সঙ্কলনসমূহে উল্লেখিত বিবরণই যথার্থ। [সহীহ বোখারী, বাবে গোযওয়ায়ে জাতে কারদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৩, সহীহ মুসলিম, বাবে গোযওয়ায়ে যি কারদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৩,১১৪,১১৫ ফাতহুর বারী, সপ্তম খণ্ড পৃ. ৪৬০,৪৬১,৪৬২, যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২০]
এ অভিযানে হযরত সালমা বিনতে আকওয়া (রা) যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার বিবরণ তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, হযরত সালমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সওয়ারীর উট তাঁর নওকর রেবাহ-এর হাতে দিয়ে চারণভূমিতে পাঠিয়েছিলেন। আমিও আবু তালহার ঘোড়াসহ তাদের সাথে ছিলাম। হঠাৎ ভোরের দিকে আবদুর রহমান ফাজারি উটগুলোর উপর হামলা চালায়, রাখালকে হত্যা করে এবং উটগুলো তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি রেবাহকে বললাম রেবাহ, এই ঘোড়া নাও, এটি আবু তালহাকে পৌছে দিয়ো এবং ঘটনা আল্লাহর রাসূলকে জানিয়ে দিয়ো। অতপর  আমি একটি টিলার উপর উঠে মদীনার দিকে মুখ করে চিত্কার করে তিনবার আওয়াজ দিলাম, ইয়া ছাবাহাহ্ অর্থাৎ হায় সকাল বেলার হামলা। এরপরই আমি হামলাকারীদের পিছনে ছুটে চললাম। তাদের উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ করছিলাম আর আবৃত্তি করছিলাম,
            ‘আনা ইবনুল আকওয়ায়ে অলইয়াওমু ইয়াওমুররুজ্জয়ে‘
            আর কেহ নই আমি আকওয়ার সন্তান, আজকে  হবে মায়ের দুধ পানের প্রমাণ।
সালমা ইবনে আকওয়া বলেন, আমি তাদের প্রতি ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করেত লাগলাম। কোন সওয়ার আমার দিকে প্রতি আক্রমণের উদ্দেশ্যে আসতে থাকলে আমি কোন গাছের আড়ালে আত্মগোপন করতাম। গাছের আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করে তাকে আহত করে দিতাম। ওরা পাহাড়ের সরু পথে প্রবেশ করলে আমি পাহাড়ের উপর উঠে পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলাম। এমনি করে ক্রমাগত তাদের অনুসরণ করছিলাম। এক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবগুলো উট নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এলাম। এরপরও তাদের ধাওয়া অব্যাহত রাখলাম।তারা তখন বোঝা হালকা করতে ৩০টি চাদর এবং ৩০টিরও বেশী বর্শা ফেলে রেখে সামনে অগ্রসর হলো। তারা যা কিছুই ফেলে রেখে যেতো আমি তার পাশে চিহ্ন স্বরূপ কয়েকটি পাথর জড়ো করে রাখতাম। আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সঙ্গীদের চেনার সুবিধার্থে এরূপ করতাম। এরপর ওরা একটি ঘাঁটির সংকীর্ণ মোড়ে বসে দুপুরের খাবার খেতে লাগলো। আমিও এক জায়গায় বসলাম। ওদের মধ্যে চারজন আমার দিকে আসছিলো। আমি তাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি তাদের বললাম, তোমরা আমাকে চেনো? আমার নাম সালমা ইবনে আকওয়া। তোমাদের যে কাউকে ধাওয়া করতে শুরু করলে অনায়াসে ধরে ফেলবো। তোমারা যদি আমাকে ধাওয়া করো কিছুতেই ধরতে পারবে না। আমার একথা শুনে ওরা চারজন ফিরে চলে গেলো। আমি নিজের জায়গায় বসে রইলাম। কছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহর রাসূলের সওয়ারদের গাছের ফাঁক দিয়ে আসতে দেখলাম। সবার আগে ছিলেন আখরাম। তার পেছনে যথাক্রমে আবু কাতাদা এবং মেকদাদ ইবনে আসওয়াদ। হঠাৎ করে আবদুর রহমান এবং আখরামের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে গেলো। হযরত আখরাম আবদুর রহমানের ঘোড়াকে আহত করে ফেললেন। আবদুর রহমান ক্রুদ্ধ হয়ে বর্শা দিয়ে হযরত আখরামকে হত্যা করলেন। ইতিমধ্যে হযরত আবু কাতাদা আবদুর রহমানের মাথার কাছে গিয়ে পৌছলেন এবং তাকে বর্শা দিয়ে আহত করলেন। অন্য আততায়ীরা পালিয়ে গেল। ওদের দিকে আমি দ্রুত দৌড়াতে লাগলাম। সূর্য অস্ত যাওয়ার একটু আগে ওরা একটি ঘাঁটির দিকে মোড় দিলো। সেখানে যি কারদ নামক জলাশয় ছিলো। ওরা ছিলো পিপাসার্ত এবং সেখানে পানি পান করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি তাদের জলাশয় থেকে দূরে রাখলাম। ফলে তারা এক ফোটা পানিও পান করতে সক্ষম হলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম সূর্যাস্তের পরে আমার কাছে পৌছলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, ওরা সবাই পিপাসিত ছিল। আপনি যদি একশত জন সাপাবাকে আমার সঙ্গে দেন তবে আমি জিনসহ ওদের ঘোড়া কেড়ে নিতে পারবো। এছাড়া ওদের সবাইর ঘাড় আপনার কাছে হাযির করবো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আকওয়ার পুত্র তুমি কাবু করে ফেলেছ, এবার একটু সহনশীল হও। এরপর তিনি বললেন, বনু গাতফানে এক্ষণে ওদের মেহামানদারি করা হচ্ছে।
এ অভিযান সম্পর্কে পর্যালোচনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আজ আমাদের শ্রেষ্ঠ সওয়ার হচ্ছে আবু কাতাদা, আর শ্রেষ্ঠ পদাতিক সৈন্য হচ্ছে সালমা। রাসূল (সা) আমাকে দুই অংশ প্রদান করলেন, একটি পদাতিকের, অন্যটি সওয়ারীর। রাসূল (সা) ফেরার সময় আমাকে সম্মানিত করলেন। তিনি আজবা নামক উটনীর পেছনে বসিয়ে আমাকে নিয়ে মদীনায় এলেন।
এ সামরিক অভিযানের সময় রাসূল (সা) মদীনার দায়িত্ব হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। এ অভিযানের পাতাকা বহন করছিলেন হযরত মেকদাদ ইবনে আমর (রা)।
খয়বর এবং ওয়াদিউর কুরার যুদ্ধ
সপ্তম হিজরীর মহরম মাস। মদীনা থেকে ৬০ অথবা ৮০ মাইল দূরে খয়বর শহর অবস্থিত। বেশ বড় শহর। এখানে দুর্গ এবং খেত খামারও ছিলো। আবহাওয়া তেমন স্বাস্থ্যকর নয়। বর্তমানে এটি একটি জনপদ।
রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে খন্দকের যুদ্ধের ত্রিমুখী শক্তির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কোরায়শদের ব্যাপারে সম্পুর্ণ নিশ্চিত হলেন। অন্য দুটি শাখা ছিলো শক্তিশালী ইহুদী এবং নজদ এর কয়েকটি গোত্র। রাসূল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের সাথেও হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে নেয়া প্রয়োজন মনে করলেন। এতে সব দিক থেকে নিরাপত্তা লাভ সম্ভব হবে। সমগ্র এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার পরিবেশ কায়েম হবে। ফলে মুসলমানরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাদ দিয়ে আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে এবং তাঁর দ্বীনের দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হবে।
খয়বর ছিলো ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের ও চক্রান্তের আখড়া। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীদের সামরিক প্রস্তুতির কেন্দ্রস্থলও ছিলো এই স্থান। এ কারণে সর্বপ্রথম মুসলমানরা এদিকে মনোযোগী হলেন।
খয়বর প্রকৃতই কি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের আখড়া ছিলো? এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, খয়বরের অধিবাসীরাই খন্দকের যুদ্ধে মোশরেকদের সকল দলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে সমবেত করেছিলো। এরাই বনু কোরায়যা গোত্রের লোকদের বিশ্বসঘাতকতায় উদ্দীপিত করেছিলো। এরাই ইসলামী সমাজের পঞ্চম বাহিনী মোনাফেকদের সাথে এবং খন্দকের যুদ্ধের সময় বনু গাতফান ও বেদুঈনদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো। এরা নিজেরাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মুসলামানদের তারা নানা ভাবে উত্যক্ত ও বিরক্ত করেছিলো। এরাই রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্রও করেছিলো। এ সকল কারণে বাধ্য হয়েই মুসলমানদের সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছিলো। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে নেতৃত্বদানকারী সালাম ইবনে আবুল হাকিক এবং উসাইর ইবনে যারেমকে নিশ্চিহ্ন করতে হয়েছিলো। ইহুদীদের ব্যাপারে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো প্রকৃতপক্ষে এর চেয়েও বেশী। কিন্তু এ কর্তব্য পালনে দেরী করা হচ্ছিলো। কেননা কোরায়শরা ছিলো ইহুদীদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী, সংগঠিত যুদ্ধবাজ এবং দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষ।
কোরায়শদের উপেক্ষা করে ইহুদীদের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিলো না। কোরায়শদের সাথে সন্ধি স্থাপনের পর ইহুদীদের সাথে যোগাযোগ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। এবার তাদের হিসাব-নিকাশের দিন ঘনিয়ে এলো।
খয়বরের পথে যাত্রা
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হোদায়বিয়া থেকে ফিরে এসে জিলহজ্জ মাস পুরো এবং মহররম মাসে কয়েকদিন মদীনায় অবস্থান করেন। এরপর মহররম মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে খয়বরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
তাফসীরকাররা লিকেছেন, খয়বর বিজয় ছিলো আল্লাহর ওয়াদা। তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যদ্ধেলব্ধ বিপুল সম্পদের, যার অধিকারী হবে তোমরা। তিনিতো তোমাদের জন্য ত্বরান্বিত করেছিলেন।“ (সূরা ফাতহ, আয়াত ২০)
তা তোমাদের জন্য ত্বরান্বিত করেছেন বলে হোদায়বিয়ার সন্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। আর যুদ্ধলভ্য বিপুল সম্পদ বলতে খয়বরের কথা বোঝানো হয়েছে।
ইসলামী সৈন্যদের সংখ্যা
মোনাফেক ও দুর্বল ঈমানের অধিকারী লোকেরা হোদায়বিয়ার সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে না গিয়ে নিজেদের ঘরে বসে থাকে। এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলকে সে সম্পর্কে আদেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে, তখন যারা ঘরে রয়ে গিয়েছিলো, তারা বলবে, আমাদেরকে তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও। ওরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করতে চায়। বল, তোমরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা পূর্বেই এরূপ ঘোষণা করেছেন। ওরা বলবে, তোমরা তো আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছো। বস্তুত ওদের বোধশক্তি সামান্য।“ (সূরা ফাতহ, আয়াত ১৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খয়বর অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার সময় ঘোষণা করলেন যে, তাঁর সাথে শুধু ওসকল লোকই যেতে পরবে, যাদের প্রকৃতই জেহাদের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। এ ঘোষণার ফলে শুধুমাত্র যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো, যারা হোদায়বিয়ার গাছের নিচে বাইয়াতে রেযোয়ানে অংশ নিয়েছিলো। এদের সংখ্যা ছিলো চৌদ্দশত।
এ অভিযানের সময় মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছাবা ইবনে আরফাতা গেফারীর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিলো। অন্যদিকে ইবনে ইসহাক বলেন, নুমাইলা ইবনে আবদুল্লাহ লায়ছীর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে প্রথমোক্ত কথাই অধিক নির্ভরযোগ্য।[ফাতহুল বারী, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৫, যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৩]
এ সময় হযরত  আবু হুরায়রা (রা) ও মদীনায় আগমন করিছিলেন। হযরত ছাবা ইবনে আরাফাতা (রা) ফযরের নামায পড়ছিলেন। নামায শেষে আবু হোরায়রা (রা) তার কাছে যান। তিনি পাথেয় ব্যবস্থা করে দিলেন। হযরত আবু হোরায়রা (রা) প্রিয় নবীর কাছে যাওয়ার জন্য খয়বর রওনা হলেন। সেখানে গিয়ে শুনতে পেলেন যে, খয়বর মুসলমানদের অধিনে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের সাথে আলোচনা করে আবু হোরায়রা এবং তাঁর সঙ্গীদের গনীমতের অংশ দিলেন।
ইহুদীদের জন্যে মোনাফেকদের তত্পরতা
এ সময় ইহুদীদের সাহায্যার্থে মোনাফেকরা যথেষ্ট ছুটোছুটি করেছে। মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগেই খয়বরে খবর পাঠিয়েছিলেন যে, মোহাম্মদ তোমাদের ওদিক যাচ্ছেন, সতর্ক হয়ে যাও। প্রস্তুত হও, ভয় পেয়ো না যেন। তোমাদের সংখ্যা এবং অস্ত্র শস্ত্র তো অনেক। মোহাম্মদের সঙ্গীদের সংখ্যা বেশী নয়, তাও তারা নি:**স্ব, তাদের কাছে যেসব অস্ত্র রয়েছে, তাও খুব সামান্য। খয়বরের অধিবাসীরা এই খবর পাওয়ার পর বনু গাতফান গোত্রের কাছে কেননা ইবনে আবুল হাকিক এবং হাওজা ইবনে কায়েসকে সাহায্য লাভের জন্য প্রেরণ করলো। বনু গাতফান গোত্র ছিলো খয়বরের ইহুদীদের মিত্র এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিত্রদের মদদগার। ইহুদীরা বনু গাতফানকে এ ধরণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলো যে, মুসলমানদের ওপর জয়লাভে সক্ষম হলে খয়বরের মোট উত্পাদনের অর্ধেক বনু গাতফানকে দেয়া হবে।
পথের অবস্থার বিবরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খয়বর যাওয়ার পথে “এছর“ পাহাড় অতিক্রম করলেন। এটি “আছর“ পাহাড় নামেও পারিচিত। এরপর ছাবহা প্রান্তর অতিক্রম করে রাজিঈ প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। কিন্তু এই রাজিঈ সেই রাজিঈ নয় যেখানে আদল ও কারাহর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বনু লেহইয়ানের হাতে আটজন সাহাবা শাহাদাত বরণ করেন।
রাজিঈ থেকে বনু গাতফান গোত্রের রসতি এলাকা একদিন ও একরাতের পথের দূরত্বে অবস্থিত। বনু গাতফান ইহুদীদের ডাকে সাড়া দিয়ে খয়বরের পথে রওয়ানাও হয়েছিলো। তারা চলে আসার পর পিছনের দিকে শোরগোল শোনা গেলো। তারা ভেবেছিলো যে, মুসলমানরা তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপালের উপর হামলা করেছে। এ কারণে তারা ফিরে যায় এবং খয়বরকে মুসলমানদের জন্য খালি রেখে দেয়।
পথ-নিদের্শক দুইজন সাহাবীকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসতে বললেন। এদের একজনের নাম হুছাইল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের কাছে এমন সমীচীন পথের সন্ধান জানতে চাইলেন, যে পথ ধরে খয়বরে মদীনার পরিবর্তে সিরিয়ার দিক থেকে প্রবেশ করা যায়। এতে করে ইহুদীদের সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হবে। অন্যদিকে বনু গাতফানের কাছ থেকে সম্ভাব্য সাহায্যও এদিক দিয়েই আসবে। এরূপ অবস্থায় বনু গাতফান এবং ইহুদীদের মাঝখানে মুসলমানরা থাকবেন এবং বনু গাতফানের সাহায্য এলেও তা ইহুদীদের কাছে পৌছতে পারবে না।
একজন পথপ্রদর্শক বললো, হে আল্লাহর রাসূল, আপনাকে আমি আপনার ঈপ্সিত পথেই নিয়ে যাব। সেই পথ প্রদর্শক আগে আগেই যেতে লাগলেন। এক চৌরাস্তায় গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ চারটি পথের প্রত্যেকটিই খায়বারে গিয়ে মিলিত হয়েছে। যে কোন পথ ধরেই আপনি সেখানে পৌছতে পারবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পথ গুলোর নাম জানতে চাইলেন। হুছাইল বললেন, একটি পথের নাম হাজন, দ্বিতীয়টির নাম শাশ, তৃতীয়টির নাম হাতব এবং চতুর্থটি হলো মারহাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ নাম অর্থাৎ** মারহাব পছন্দ করলেন। অন্য তিনটি পথের নামের অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে সেসব পথ বাদ দিলেন। অবশেষে মারহাব পথেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।
পথের কতিপয় ঘটনা
এক) হযরত সালমা ইবনে আকওয়া (রা) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খয়বর রওয়ানা হয়েছি। রাত্রিকালে সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। একজন লোক এসে আমেরকে বললেন, আমের, কিছু শোনাও তো। আমের ছিলেন কবি। তিনি সওয়ারী থেকে নিচে নেমে এসে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন।
“তুমি যদি না থাকিতে ওগো আল্লাহ
আমরাতো কেউ পেতাম না হেদায়াত
নামায আদায় করতাম না, দিতাম না যাকাত।
তোমার জন্য এ জীবন কোরবান
ক্ষমা করে দিও তুমি আমাদের
অটল চরণ রাখবে মোকাবেলায় শত্রুদের।
তুমি আমাদের শান্তি দাও ওহে আল্লাহ তায়ারা
রণ হুঙ্কার দিলে দুশমন কাঁপে না তো মন
এ বিষয়ে আস্থা আমরা করেছি অর্জন।“
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কবিতা শুনে কবির পরিচয় জানতে চাইলেন। তাঁকে জানানো হলো যে, তিনি আমের ইবনে আকওয়া। আল্লাহর রাসূল বললেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে রহমত করুন। একজন সাহাবা মন্তব্য করলেন, এবার তো আমেরের শাহাদাত অনিবার্য**। কিন্তু আমরা তো আরো বেশীদিন তার সহচার্য** লাভের জন্য আগ্রহী। [সহীহ বোখারী, বাবে গাজওয়ায়ে খয়বর ২য় খণ্ড ৬০৩, সহীহ মুসলিম বাবে গোযওয়ায়ে যি কারদ, ২য় খণ্ড পৃ. ১১৫] সাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সাহাবার জন্য বিশেষভাবে মাগফেরাতের দোয়া করলে তিনি শহীদ হয়ে যান। [সহীহ মুসলিম ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৫] খয়বরের যুদ্ধে হযরত আমেরের (রা) ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। এ কারণেই সাহাবারা বলেছেন, তাঁর দীর্ঘায়ুর জন্য দোয়া করলেই তো আমরা আরো বেশীদিন আমাদের মধ্যে পেতাম।
দুই) খয়বরের খুব কাছে ছাবহা প্রান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আছরের নামায আদায় করেন। পরে খাবার খান। শুধু ছাতু দেয়া হয়। তাঁর আদেশে ছাতু খাদ্যোপযোগী করা হয়। তারপর তিনি নিজে আহার করলেন এবং সাহাবাদেরও খেতে দিলেন। আহারের পর মাগরেবের নামাযের জন্য উঠলেন। সে সময় তিনি নতুন করে ওযু করলেন না, শুধু কুলি করলেন। সাহাবারাও তাই করলেন। [সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ৬০৩] এরপর তিনি এশার নামায আদায় করলেন।
খয়বরের উপকণ্ঠে ইসলামী বাহিনী
যুদ্ধ সকালের আগের রাতে মুসলমানরা খয়বরের উপকণ্ঠে যাপন করেন। ইহুদীরা তা জানতেও পারেনি। রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিলো, তিনি যখন রাতের বেলা কোন কওমের কাছে পৌছেতেন, তখন  অপেক্ষা করতেন, সকাল হওয়ার আগে তাদের কাছে যেতেন না। সেদিন খুব ভোরে কিছুটা অন্ধকার থাকতে তিনি ফজরের নামায আদায় করেন। এরপর মুসলমানরা সওয়ার হয়ে খয়বরের দিকে অগ্রসর হন। খয়বরের অধিবাসীদের অনেকেই কাঁধে কোদাল নিয়ে খেতে খামারে করতে বেরিয়েছিলো। হঠাৎ মুসলিম সেনাদের দেখে চিত্কার করে পালাতে লাগলো। চিত্কার করে করে তারা বলছিলো, খোদার কসম, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সসৈন্যে হাজির হয়েছেন। [মাগাযি, আল ওয়াকেদী, খয়বর যুদ্ধ পৃ. ১১২; সহীহ বোখারী, খয়বরের যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৩,৬০৪]
এই অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহু আকবার, খয়বর বরবাদ হয়েছে, আল্লাহু আকবার, খয়বর বরবাদ হয়েছে। আমরা যখন কোন কওমের ময়দানে নেমে পড়ি, তখন কওমের ভয়ার্ত লোকদের সকাল মন্দ হয়ে যায়। [সহীহ বোখারী, খয়বরের যুদ্ধ অধ্যায়, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৩,৬০৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের অবতরণের জন্য একটি জায়গা নির্ধারণ করলেন। হাব্বাব ইবনে মুনজের এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর আদেশে আপনি এখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নাকি রণ-কৌশলগত কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।? তিনি বললেন, রণ-কৌশলগত কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একথা  শুনে হযরত হাব্বাব (রা) বললেন, এই স্থান নাজাত দুর্গের খুব কাছে। খয়বরের সকল যোদ্ধা এই দুর্গেই থাকে। ওরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারবে, অথচ আমরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবো না। ফলে তারা তাদের কৌশল আমাদের উপর প্রয়োগ করতে পারবে, তাদের নিক্ষিপ্ত তীর আমাদের কাছে পৌছবে অথচ আমাদের নিক্ষিপ্ত তীর তাদের কাছে পৌছবে না। রাতের বেলা তারা আমাদের ওপর আকস্মিক হামলা চালাতে পারে, এ আশঙ্কাও পুরোপুরি থেকে যাবে। এছাড়া এ জায়গার চারিদিকে খেজুর বাগান, জায়গাটা নিচু। কাজেই এই সব সমস্য যেখানে নেই, সেই রকম একটা জায়গায় অবস্থানের ব্যবস্থা করলে ভালো হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যে অভিমত প্রকাশ করেছো তা সঠিক। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের থামতে বললেন। এরপর তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে এ মোনাজাত করলেন যে আল্লাহ তায়ালা, তুমি সাত আসমান এবং যেসব জিনিসের ওপর সেই আকাশসমূহ ছায়া বিস্তার করে রয়েছে, সেসব কিছুর প্রতিপালক। সাত যমিন এবং তার উপরে নিচে যা কিছু রয়েছে, সেসব কিছুর প্রতিপালক, শয়তানসমূহ এবং যাদেরকে তারা পথভ্রষ্ট করেছে তাদের প্রতিপালক, তোমার কাছে আমরা এই জনপদের কল্যাণ এবং জনপদের অধিবাসীদের কল্যাণ এবং এতে যা কিছু রয়েছে সেসব কিছুর কল্যাণের আবেদন জানাচ্ছি। এই জনপদের অকল্যাণ এবং এর অধিবাসীদের অকল্যাণ এবং এতে যা কিছু রয়েছে সেসব কিছুর অকল্যাণ থেকে তোমার কাছে আশ্রই চাই।“
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর বললেন, আল্লাহর নাম নিয়ে সামনে অগ্রসর হও। [এই চোখের অসুখের কারণে তিনি পিছিয়ে পড়েন এবং পরে সকলের সাথে মিলিত হন]
যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং খয়বরের দুর্গ
খয়বরের সীমানায় যে রাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবেশ করেছিলেন, সে রাতে তিনি বললেন, আমি আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেব যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ এবং তাঁর রসূলও তাকে ভালোবাসেন। সকলে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রসূলের সামনে হাযির হলেন। সবাই পতাকা পাওয়ার জন্যে মনে মনে আকাঙ্খা করছিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আলী ইবনে আবু তালেব কোথায়? সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রসূল তার চোখ উঠেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে নিয়ে এসো। হযরত আলী (রা) কে নিয়ে আসা হলো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চোখে সামান্য থু থু লাগিয়ে দোয়া করে দিলেন। হযরত আলী (রা) এমন সুস্থ হয়ে গেলেন যে, কখনো তার চোখের অসুখ ছিলোই না। এরপর হযরত আলীকে (রা) পতাকা প্রদান করা হয়। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমি ওদের সাথে ততোক্ষণ পর্যন্ত লড়বো, যতক্ষণ তারা আমাদের মতো হয়ে যায়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চিন্তে যাও, যতোক্ষণ পর্যন্ত তাদের ময়দানে অবতরণ না করো। এরপর তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ো। ইসলামে আল্লাহর যে অধিকার ওদের ওপর ওয়াজিব হয়, সে সম্পের্কে ওদের অবহিত কর। যদি তোমার  মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ওদের একজনকেও হেদায়াত দেন তবে তোমার জন্যে সেটা হবে বহুসংখ্যক লাল উটের চেয়ে উত্তম। [সহীহ বোখারী, খয়বর যুদ্ধ অধ্যায়, পৃ. ৬০৫,৬০৬, কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, খয়বরের একটি দুর্গ বিজয়ে একাধিকবার চেষ্টা ব্যর্থ হয় এরপর হযরত আলীর হাতে পতাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু সেটা সত্য]
খয়বরের জনবসতি ছিলো দুইভাগে বিভক্ত। এক ভগে নিচে উল্লেখিত পাঁটি দুর্গ ছিলো। ১) হেছনে নায়েম। ২) হেছনে ছা‘বা ইবনে মায়া‘য। ৩) হেছনে কিল্লা যোবায়ের। ৪) হেছনে উবাই। এবং ৫) হেছনে নাজার।
উল্লেখিত পাঁটি দুর্গের মধ্যে প্রথম তিনটি দুর্গসম্বলিত এলাকাকে “নাতাত“ বলা হয়। অন্য দুটি দুর্গসম্বলিত এলাকা “শেক“ নামে পরিচিত।
খয়বরের দ্বিতীয় ভাগের জনবসতি কোতায়রা নামে পরিচিত ছিলো। এর মধ্যে ছিলো তিনটি দুর্গ। এক, হেছনে কামুম। এ দুর্গের অধিবাসীরা বনু নাযির গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং বনু নাযিরের আবুল হাকিক দুর্গে তারা অবস্থান করতো। দুই, হেছনে অতীহ। তিন, হেছনে সালালেম।
উল্লেখিত আটটি দুর্গ ছাড়া খয়বরে অন্যান্য দুর্গ এবং ভবনও ছিরো। কিন্তু সেগুলো ছিলো অপেক্ষাকৃত ছোট। শক্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পূর্বোক্ত দুর্গগুলোর মতো সুরক্ষিত ছিলো না।
প্রথম ভাগের দুর্গগুলোতেই যুদ্ধ হয়েছে। অন্যান্য দুর্গের তিনটি দুর্গ যোদ্ধা থাকা সত্তেও যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিলো।
সংঘাতের সূচনা এবং নায়েম দুর্গ বিজয়
উল্লেখিত আটটি দুর্গের মধ্যে প্রথম নায়েম দুর্গের ওপর হামলা করা হয়। এ সকল দুর্গ অবস্থান এবং কৌশলগত দিক থেকে ইহুদীদের প্রথম লাইনের প্রতিরক্ষাব্যুহ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ দুর্গের মালিক ছিলো মারহাবে নামে এক দুর্ধর্ষ ইহুদী তাকে এক হাজার পুরুষের শক্তি-সামর্থসম্পন্ন বীর মনে করা হতো।
হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা) মসলমান সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে এ দুর্গের সামনে গিয়ে ইহুদীদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো। নিজেদের বাদশাহ মারহাবের নেতৃত্বে তারা মুসলামনদের মোকাবেলায় এস দাঁড়ালো।
রণাঙ্গনে এসে মারহাব নামের এক বীর এককভাবে মুখোমুখি যুদ্ধের আহ্বান জানালো। সালমা ইবনে আকওয়া  বর্ণনায় এভাবে উল্লেখ রয়েছে, আমরা খয়বরে পৌছার পর খয়বরের অধিবাসীদের বাদশাহ মারহাব তলোয়ার নিয়ে অহংকার প্রকাশ করতে করতে এগিয়ে এলো। তার কণ্ঠে ছিলো স্পর্ধিত আবৃত্তিসম্বলিত এ কবিতা,
“খয়বর জানে মারহাব আমি
অস্ত্র সাজে সজ্জিত অনন্য আমি বীর রণকৌশলে
অভিজ্ঞতা কাজে লাগাই যুদ্ধের আগুনে উঠলে জ্বলে।“
তা মোকাবেলায় আমার চাচা হযরত আমের (রা)এগিয়ে গেলেন। তিনি আবৃত্তি করলেন,
“খয়বর জানে আমার নাম আমের
অস্ত্র সাজে সজ্জিত বীর সেনানী যু্দ্ধের।“
মুখোমুখি হওয়ার পর একজন অন্যজনের ওপর আঘাত হানলো। মারহাবের শাণিত তরোয়ার আমার চাচা আমেরের ঢালের ওপর আঘাত করলো। ইহুদী মারহাবকেও আমার চাচা নীচের দিকে আঘাত করতে চাইলেন কিন্তু তলোয়ার ছিলো ছোট। তিনি মারহাবের উরুতে আঘাত করতে চাইলে তলোয়ার ধক্কা খেয়ে তাঁর নিজের হাঁটুতে লাগলো। অবশেষে এই আঘাতেই তিনি ইন্তেকাল করেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দুটি পবিত্র আঙ্গুল তুলে বললেন, ওর জন্য রয়েছে দুই রকমের পুরষ্কার। হযরত আমের (রা) ছিলেন অনন্য রণকুশল মোজাহিদ। তার মতো আরব বীর পৃথিবীতে কমই এসেছেন। [সহীহ মুসলিম, খয়বর যুদ্ধ অধ্যায়, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২২- গাজওয়া জিকারদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৫, সহীহ বোখারী খয়বর যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খণ্ড, ৬০৩]
হযরত আমের (রা) আহত হওয়ার পর মারহাবের মোকাবেলায় এগিয়ে গেলেন হযরত আলী (রা)। তিনি আবৃত্তি করছিলেন এ কবিতা,
“জানো আমি কে, আমার নাম আমার মা
রেখেছেন হায়দার
বনের বাঘের মতই আমি ভয়ঙ্কর
হানবো আমি আঘাত পূর্ণতর।“
এরপর হযরত আলী (রা) মারহাবের ঘাড় রক্ষ্য করে এমন আঘাত করলেন যে, কমিনা ইহুদী সেখানেই শেষ হলো। হযরত আলীর (রা) হাতেই বিজয় অর্জিত হলো। [মারহাবের হত্যাকারী সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। সে কত তারিখে নিহত হয়েছিলো এবং সে দুর্গ কত তারিখে জয় হয়েছিলো সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। বোখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনার প্রক্রিয়ার পার্থক্য বিদ্যমান। উপরোল্লিখিত বিবরণ সহীহ বোখারী অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়েছে]
যুদ্ধের সময় হযরত আলী (রা) ইহুদীদের একটি দুর্গের কাছে গেলে একজন  ইহুদী দুর্গের ওপর থেকে জিজ্ঞাসা করলো যে, তুমি কে? হযরত আলী (রা) বললেন, আমি আলী ইবনে আবু তালেব। ইহুদী বললো, হযরত মূসার ওপর অবতীর্ন কেতাবের শপথ, তোমরা বলন্দ হয়েছ। এরপর মারহাবের ভাই ইয়াসের এগিয়ে এসে বললো, কে আছো যে আমার মোকাবেলা করবে? এ চ্যালেঞ্জে সাড়া দিলেন হযরত যোবায়ের (রা)।
এ দৃশ্য দেখে হযরত যোবায়েরের (রা) মা হযরত ছফিয়া (রা) বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমার পুত্র কি নিহত হবে? আল্লাহর রসূল বললেন, না বরং তোমার পুত্র তাকে হত্যা করবে। অবশেষে হযরত যোবায়ের (রা) ইয়াসারকে হত্যা করলেন।
এরপর হেছনে নায়েমের কাছে তুমুল যুদ্ধ হলো। অন্য ইহুদীরা মুসলমানদের মোকাবেলায়া সাহসী হলো না। কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, এ যুদ্ধ কয়েকদিন ব্যাপি চলেছিলো এবং মুসলমানদের যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছিলো। তবুও ইহুদীরা মুসলমানদের পরাস্ত করতে ব্যর্থ হলো। ফলে চুপিসারে তারা দুর্গ ছেড়ে ছা‘ব দুর্গে পালিয়ে গেলো। মুসলমানরা তখন সহজেই নায়েম দুর্গ অধিকার করলেন।
সায়াব ইবনে মোয়ায দুর্গ জয়
নায়েম দুর্গ জায়ের পর সায়াব দুর্গ ছেলো নিরাপত্তা ও শক্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দুর্ভেদ্য দুর্গ। মুসলমানরা হযরত হোবাব ইবনে মুনযের আনসারীর (রা) নেতৃত্বে এ দুর্গ হামলা করেন এবং তিনদিন যাবত অবরোধ করে রাখেন। তৃতীয় দিনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুর্গ জয়ের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন।
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আসলাম গোত্রের শাখা বনু ছাহামের লোকেরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হয়ে আরজ করলো যে, আমরা চূর চূর হয়ে গেছি, আমাদের কাছে কিছু নাই। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরম করুণাময়ের কাছে বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, তুমি ওদের অবস্থা জানো। তুমি জানো যে, ওদের মধ্যে শক্তি নেই, আর আমার কাছে এমন কিছু নেই যে ওদের দেবো। হে আল্লাহ তায়ালা, ইহুদীদের এমন দুর্গ জয় করিয়ে আামদের সাহায্য করো যে দুর্গ জয় আমাদের জন্যে সর্বাধিক ফলপ্রসূ হয়, যে দুর্গে সবচেয়ে বেশী খাদ্য-সামগ্রী ও চর্বি পাওয়া যায়। আল্লাহর রসূলের এই দোয়ার পর সাহাবারা হামলা করলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ছা‘ব ইবনে মায়া‘য দুর্গ জয়ের গৌরব মসলমানদের দান করলেন। এ দুর্গের চেয়ে অধিক খাদ্যদ্রব্য এবং চর্বি খয়বরের অন্য কোন দুর্গে ছিলো না। [ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২]
দোয়া করার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদেরকে এই দুর্গের ব্যাপারে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পালনে বনু আসলাম গোত্রের লোকেরা ছিলেন অগ্রণী। এখানে দুর্গের সামনে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। তবুও সেদিনই সূর্যাস্তের আগে জয় করা সম্ভব হয়। মুসলমানরা সেই দুর্গে ক্ষেপনাস্ত্র এবং কাঠের তৈরী ট্যাঙ্ক লাভ করেন। [এখানে ‘দাবাবে‘ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দের হচ্ছে ট্যাঙ্ক। কাঠের তৈরী নিরাপদ বন্ধ গাড়ীর ভেতর দিয়ে লোক প্রবেশ করে দুর্গের দেয়ালের কাছে পৌছাতে পারে এবং শত্রুর  হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এছাড়া দেয়ালে বড় ছিদ্র করারও ব্যবস্থা রয়েছে]
ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এক্ষেত্রে প্রচন্ড লড়াই এর বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্গ জয়ের পর মুসলমানরা গাধা যাবাই করেন এবং উনুনে কড়াই চাপিয়ে দেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পাওয়ার পর পালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেন।
যোবায়ের দুর্গ জয়
নায়েম এবং ছাবা দুর্গ জয়ের পর ইহুদীরা নাজাতের সকল দুর্গ থেকে বেরিয়ে যোবায়ের দুর্গে সমবেত হয়। এটি ছিলো একটি নিরাপদ ও সংরক্ষিত দুর্গ। পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত এই দুর্গে উঠার পথ ছিলো খুবই বন্ধুর। কোন সওয়ারী নিয়ে ওঠাতো সম্ভবই ছিলো না পায়ে হেঁটে ওঠাও ছিলো খুবই কষ্টসাধ্য। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনদিন পর্যন্ত দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। এরপর একজন হৃদয়বান ইহুদী এসে বললো, হে আবুল কাশেম, আপনি যদি একমাস যাবত দুর্গ অবরোধ করে রাখেন তবুও ইহুদীরা পরোয়া করবে না। তবে তাদের পানিয় ঝর্ণা নীচে রয়েছে। রাতের বেলা তারা এসে পানি পান করে এবং সারাদিনের প্রয়োজনীয় পানি তুলে নিয়ে যায়। আপনি যদি ওদের পানি বন্ধ করে দিতে পারেন, তবে তারা নত হবে। এ খবর পেয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওদের পানি বন্ধ করে দিলেন। ইহুদীদের তখন টনক নড়লো। তারা নীচে নেমে এসে প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হলো। এতে  কয়েকজন মসলমানও শাহাদাত বরণ করলেন এবং দশজন ইহুদী দুর্বৃত্ত নিহত হলো। সবশেষে এ দুর্গেরও পতন হলো।
উবাই দুর্গ জয়
যোবায়ের দুর্গ পতনের পর ইহুদীরা উবাই দুর্গে গিয়ে সমবেত হয়। মুসলমানরা সেই দুর্গও  অবরোধ করেন। এবার শক্তি গর্বে গর্বিত দুইজন ইহুদী পর্যায়ক্রমে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার আহ্বান জানায়। উভয়েই মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। দ্বিতীয় ইহুদীর হত্যাকারী ছিলেন লাল পট্টিধারী বিখ্যাত যোদ্ধা সাহাবী  হযরত আবু দোজানা সাম্মাক ইবনে খারশা আনসারী (রা)। তিনি দ্বিতীয় ইহুদীকে হত্যা করে দ্রুত বেগে দুর্গে প্রবেশ করেন।
তাঁর সাথে সাহাবারাও ভেতরে গিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে। কিছুক্ষণ তুমুল যুদ্ধের পর ইহুদীরা দুর্গ থেকে সরে যেতে শুরু করে। অবশেষে সবাই গিয়ে নেযার দুর্গে সমবেত হয়। নেযার দুর্গ ছিলো খয়বরের প্রথম ভাগের সর্বশেষ দুর্গ।
নেজার দুর্গ জয়
এ দুর্গও ছিলো সুরক্ষিত ও নিরাপদ। ইহুদীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, মুসলমানরা মর্বাত্মক চেষ্টা করেও এ দুর্গে প্রবেশ করেত পারবে না। তাই এতে তারা নারী ও শিশুদের সমবেত করেছিলো, অন্য  কোন দুর্গে রাখেনি।
মুসলমানরা এ দুর্গে কঠোর অবরোধ আরোপ এবং ইহুদীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। একটি উঁচু পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত এ দুর্গে প্রবেশে মুসলমানরা সুবিধা করতে পারলেন না। ইহুদীরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে মুসলমানদের সাথে মোকাবেলা করতেও সাহস পাচ্ছিল না। তবে উপর থেকে তীর নিক্ষেপ এবং পাথর নিক্ষেপ করে তীব্র মোকাবেলা করে যাচ্ছিলো।
নেজার দুর্গ জয় কঠিন হওয়ায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েনের নির্দেশ দেন। কয়েকটি গোলা নিক্ষেপও করা হয়। এত দুর্গ দেয়ালে ছিদ্র হয়ে যায়। সেই ছিদ্রপথে মুসলমানরা ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর দুর্গের ভেতরে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। দুদ্ধে ইহুদীরা পরাজিত হয়। অন্যান্য দুর্গের মতোই এ দুর্গ থেকেও ইহুদীরা চুপিসারে সটকে পড়ে। নারী ও শিশুদেরকে মসলমানদের দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে তারা নিজেদের প্রাণ রক্ষা করে।
এ মজবুত দুর্গ জয়ের মাধ্যমে মুসলমানরা খয়বরের প্রথম অর্ধেক অর্থাৎ নাজাত ও শেক  এলাকা জয় করেন। এখানে ছোট ছোট অন্য কয়েকটি দুর্গও ছিলো। কিন্তু এ দুর্গের  পতনের পর ইহুদীরা অন্যান্য দুর্গও খালী করে দেয় এবং খয়বরের দ্বিতীয় অংশ কাতীবার দিকে পালিয়ে যায়।
খয়বরের দ্বিতীয় ভাগ জয়
নাতাত এবং শেক এলাকা  জয়ের পর  রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোতায়বা, অতীহ এবং সালালেম এলাকা অভিমুখে রওয়ানা হন। সালালেম ছিলো বনু নাজিরের কুখ্যাত ইহুদী আবুল হাকিকের দুর্গ। এদিকে নাতাত এবং শেত এলাকা থেকে পরায়নকারী সকল ইহুদীও এখানে এসে পৌছে দুর্গদ্বার বন্ধ করে দিয়েছিলো।
যুদ্ধ বিষয়ক বিবরণ সম্বলিত গ্রন্থাবলীতে মতভেদ রয়েছে যে, এখানের তিনটি দুর্গের কোন দুর্গে যুদ্ধ হয়েছিলো। ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, কামুস দুর্গ জয় করতে যুদ্ধ হয়েছিলো। বর্ণনা দ্বারাও বোঝা যায় যে, এ দুর্গ যুদ্ধের মাধ্যেমে জয় করা হয়েছে। ইহুদীদের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের জন্যে এখানে আলাপ আলোচনাও হয়নি। [ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩১, ৩৩৬, ৩৩৭]
ওয়াকেদী সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, এ এলাকার তিনটি দুর্গই আলাপ-আলোচনার মাধ্যেমে মুসলমানদের হাতে অর্পণ করা হয়। সম্ভবত কামুস দুর্গ অর্পণের জন্যে কিছুটা যুদ্ধের পর আলাপ-আলোচনা হয়। অবশ্য অন্য দুটি দুর্গ যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানদের হাতে দেয়া হয়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই এলাকায় অর্থাৎ কোতায়বায় আগমনের পর সেখানের অধিবাসীদের কঠোভাবে অবরোধ করেন। চৌদ্দদিন যাবত এ অবরোধ অব্যাহত থাকে। ইহুদীরা তাদের দুর্গ থেকে বেরোচ্ছিলো না। পরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের নির্দেশ দেন। ইহুদীরা যখন বুঝতে পারলো যে, ক্ষেপণাস্ত্র গোলা বর্ষণে তাদের ধ্বংস অনিবার্য**, তখন তারা আল্লাহর রসূলের সাথে সন্ধির জন্যে আলোচনায় এগিয়ে আসে।
সন্ধির আলোচনা
প্রথমে ইবনে আবুল হাকিক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পয়গাম পাঠায় যে, আমি কি আপনার কাছে এসে কথা বলতে পারি? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। অনুমতি পাওয়ার পর আবুল হাকিক এই শর্তে সন্ধি প্রস্তাব পেশ করে যে, দুর্গে যেসকল সৈন্য রয়েছে তাদের প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাও তাদের কাছেই থাকবে। অর্থাৎ তারা মুসলমানদের দাস-দাসী হিসেবে বন্দী থাকবে না। তারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ সোনা-রূপা, জায়গা-জমি, ঘোড়া, বর্ম ইত্যাদি সব কিছু আল্লাহর রসূলের কাছে অর্পণ করবে, শুধু পরিধানের পোশাক নিয়ে বেরিয়ে যাবে। [সুনানে আবু দাউদে উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহর রসূল এ শর্তে রাজি হয়েছিলেন যে, ইহুদীরা তাদের সওয়ারীর উপর যতোটা সম্ভব অর্থ-সম্পদ নিয়ে যাবে। দেখুন আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, খয়বর প্রসঙ্গ। পৃ. ৭৬] রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রস্তাব শুনে বললেন, যদি তোমরা কিছু লুকাও, তবে সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা এবং তার রসূল দায়ী হবেন না। ইহুদীরা এ শর্তে মেনে নেয় এবং সন্ধি হয়ে যায়। এভাবে খয়বর জয় চূড়ান্তরূপ লাভ করে।
বিশ্বাসঘাতকতা ও তার শাস্তি
সন্ধির শর্ত লংঘন করে আবুল হাকিকের উভয় পুত্র প্রচুর ধন-সম্পদ লুকিয়ে রাখে। একটি চামড়া তারা লুকিয়ে রাখে, সেই চামড়ার সম্পদ এবং হুয়াই ইবনে আখতারের অলংকার সমূহ ছিলো। হুয়ই ইবনে আখতার মদীনা বনু নাযিরের বহিষ্কারের সময় এসব অলংকার নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আল্লহর রসূলের সামনে কেনানা ইবনে আবুল হাকিকের হাযির করা হয়। তার কাছে ছিলো বনু নাযিরের ধন-ভান্ডার। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে সরাসরী অস্বিকার করে। ধন-সম্পদ কোথায় লুকানো রয়েছে জানতে চাইলে সে বলে, সে জানে না। পরে একজন ইহুদী এসে জানায় যে, আমি কেনানাকে প্রতিদিন একটি পরিত্যক্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। এ খবর পাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেনানাকে বললেন, যদি তোমার কাছে ধন-ভান্ডার পাওয়া যায়, তবে আমরা তোমাকে হত্যা করবো, বলো, এতে তুমি রাজি কিনা। কেনানা বললো, হাঁ রাজি। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট পরিত্যক্ত এলাকা খননের নির্দেশ দিলেন। সেখানে কিছু অর্থ-সম্পদ পাওয়া গেলো। অবশিষ্ট ধন-সম্পদ সম্পর্কে আল্লাহর রসূলের জিজ্ঞাসার জবাবে সে কিছু জানে না বলে জানালো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেনানাকে হযরত যোবায়ের এর (রা) হাতে দিয়ে বললেন, ওকে শাস্তি দাও, যাতে কারে ওর কাছে যা কিছু রয়েছে, সব আমাদের হাতে আসে। হযরত যোবায়র (রা) কেনানাকে কঠোর শাস্তি দিলেন। প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো, তবু সে মুখ খুলল না। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুর্বৃত্তকে মোহাম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে দিলেন। তিনি তাঁর ভাই মাহমুদ ইবনে মাসলামার হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে তাকে হত্যা করলেন। উল্লেখ্য মাহমুদ নায়েম দুর্গের কাছে এক গাছের ছায়ায় বসেছিলেন, হঠাৎ এই দুর্বৃত্ত ইহুদী কেনানা ওপর থেকে চাক্কি ফেলে মাহমুদকে হত্যা করে।
ইবনে কাইয়েম বর্ণনা করেছেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবুল হাকিকের উভয় পুত্রকে হত্যা করিয়াছিলেন উভয়ের বিরুদ্ধে সম্পদ লুকানোর সাক্ষি দিয়েছিলেন কেনানার চাচাতো ভাই।
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুয়াই ইবনে আখতারের কন্যা সাফিয়্যাকে বন্দি করেন। তিনি কেনানা ইবনে আবুল হাকিকের অধীনে ছিলেন। তখনো সে ছিলো নববধূ। সেই অবস্থায়ই তাকে বিদায় দেয়া হয়েছিলো। [১৬১৬]
গনীমদের সম্পদ বন্টন
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের খয়বর থেকে বহিস্কারের ইচ্ছা করেন। চুক্তির মধ্যেও এটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ইহুদীরা বললো, হে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি আমাদের এই যমিনেই থাকতে দিন আমরা এর তত্ত্বাবধান করবো। এই ভূখণ্ড সম্পর্কে আমরা আপনাদের চেয়ে বেশী অবগত।
এদিকে আল্লাহর রসূলের কাছে পর্যাপ্তসংখ্যাক দাস ছিলো না, যারা এ জমি আবাদ এবং দেখাশোনা করতে পারে। এ কাজ করার মতো সাহাবায়ে কেরামেরও ছিলো না। এসব কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের কছে খয়বরের জমি বর্গা হিসেবে দেন। উত্পন্ন ফসলের অর্ধেক মুসলমানরা পাবেন এ শর্তে দেয়া হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতোদিন চাইবেন, ততোদিন ইহুদীরা এ সুযোগ দেবেন। আবার যখন ইচ্ছা করবেন তখন বহিস্কার করবেন। এরপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহাকে খয়বরের জমির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়।
খয়বরের বন্টন এভাবে করা হয়েছিলো যে, মোট জমি ৩৬ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতি অংশ ছিলো একশত ভাগের সমন্বয়। এভাবে মোট জমি তিন হাজার ছয়শত অংশে ভাগ করা হয়। এর অর্ধেক অর্থাৎ আঠরশ ভাগ ছিলো  মুসলমানদের। সাধারণ মুসলমানদের মতোই আল্লাহর রসূলেরও শুধু একটিমাত্র অংশ ছিলো। বাকি আঠারশ ভাগ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের জাতীয় প্রয়োজন এবং আকস্মিক কোন সমস্যা মোকাবেলার জন্য পৃথক করে রেখেছিলেন। আঠারশত ভাগে বিভক্ত করার উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, খয়বরের জমি ছিলো হোদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের জন্যে আল্লাহর বিশেষ দান।
উপস্থিত অনুপস্থিত সকলের জন্যেই এ দান ছিলো প্রযোজ্য। হোদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিলো চৌদ্দশত। খয়বরে আসার সময় তারা দুইশত ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সওয়ার ছাড়া ঘোড়ার জন্যেও একাংশ বরাদ্দ থাকে। ঘোড়ার অংশ একজন সৈনিকের দ্বিগুণ। এ কারণে খয়বরকে আঠারশত ভাগে ভাগ করা হয়। এর ফলে প্রত্যেক ঘোড়া সওয়ার তিনভাগ হিসেবে ছয়শত ভাগ পান। আর বারোশত পদব্রজের সৈনিক বারোশত অংশ পান। [যাদুল মায়দ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৭-১৩৮]
খয়বরে প্রাপ্ত গনীমতের প্রাচুর্যের বিবরণ বোখারী শরীফের একটি হাদীসে পাওয়া যায়। মারবি ইবনে ওমর (রা) বলেন, খয়বর জয়ের আগ পর্যন্ত আমরা পরিতৃপ্ত হতে পরিনি। হযরত আয়শা (রা) বলেন, খয়বর বিজয়ের পর আমরা বলাবলি করলাম যে, এখন থেকে আমরা পেটভরে খেজুর খেতে পারবো।[সহীহ বোখারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬০৯]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় ফিরে আসার পর মোহাজেররা তাদেরকে আনসারদের প্রদত্ত খেজুর গাছ ফিরিয়ে দেন। কেননা খয়বরে তারা ধন-সম্পদ এবং খেজুর গাছের মালিকানা লাভ করেছিলো। [যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৮ সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড পৃ. ৯৬]
কতিপয় সাহাবার আগমন
এই যুদ্ধে হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হযির হন। তাঁর সাথে আশআরি মুসলমান অর্থাৎ হযরত আবু মুসা আশআরি (রা) এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধবও ছিলেন।
হযরত আবু মুসা আশআসি (রা) বলেন, ইয়েমেনে থাকার সময়ে আমি আল্লাহর রসূলের আবির্ভাবের খবর পেয়েছিলাম। আমি এবং আমার দুই ভাই আমাদের গোত্রের ৫০ জন সহ একটি নৌকায় আরোহণ করে আল্লাহর রসূলের কাছে হাযির হওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম। কিন্তু নৌকা আমাদেরকে হাবশায় নিয়ে পৌছাল। সেখানে হযরত জাফর (রা) এবং তাঁর বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। তারা জানালেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পঠিয়েছেন এবং হাশায় থাকতে বলেছেন, আপনারাও আমার সাথে থাকুন। আমরা তখন সেখানে থাকলাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খয়বর জয় করার পর তাঁর কছে হাযির হলাম। তিনি আমাদেরকেও অংশ দিলেন। আমরা ব্যতীত খয়বরে অনুপস্থিত অন্য কোন মুসলমান খয়বরের অংশ পাননি। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরাই শুধু গনীমতের মালের অংশ পেয়েছিলেন। হযরত জাফর এবং তাঁর সঙ্গীদের সাথে আমাদের নৌকার মাঝিরাও ভাগ পেয়েছিলেন। এদের সকলের মধ্যেই গনীমতের মাল বন্টন করা হয়েছিলো। [বোখারী, ১ম খণ্ড, ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড]
হযরত সফিয়্যার সাথে বিবাহ
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বামীকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে হত্যা করার পর হযরত সফিয়্যা বন্দী মহিলাদের অন্তর্ভূক্ত হন। বন্দী মহিলাদের একত্রিত করার পর হযরত দেহইয়া ইবনে খলিফা কালবী (রা) আল্লাহর রসূলের কাছে একজন দাসী চান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যাও একজনকে পছন্দ করো। হযরত দেহিয়া হযরত সফিয়্যাকে পছন্দ করলেন। এরপর একজন লোক এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি বনু কোরায়যা এবং বনু নাযির গোত্রর নেত্রীকে দেহিয়্যার জন্যে মনোনীত করেছেন অথচ তিনি একমাত্র আপনারই উপযুক্ত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, উভয়কে ডেকে নিয়ে এসো। উভয় হাযির হলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত দেহইয়াকে বললেন, অন্য কোন দাসীকে তুমি পছন্দ করো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সফিয়্যাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি হৃষ্ট চিত্তে ইসলাম কবুল করেন। এরপর তিনি হযরত সফিয়্যাকে আযাদ করে দেন এবং তার আযাদীকে মোহরানা নির্ধারণ করে তাকে বিবাহ করেন। মদীনায় পৌছার পথে  হযরত উম্মে ছুলাইই (রা) হযরত সফিয়্যাকে সজ্জিত করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরদিন সকালে খেজুর, ঘি এবং ছাতু দিয়ে সাহাবাদের মেহমানদারী করেন। [সহীহ বোখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৪ যাদুল মায়াদ ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৭] হযরত সফিয়্যার চেহেরায় দাগ দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কারণ জানতে চান। হযরত সফিয়্যা বলেন, হে আল্লাহর রসূল আপনার খয়বর যাওয়ার আগে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, চাঁদ আকাশ থেকে আমার কোলে এসে পড়েছে। আমার স্বামীর কাছে সকালে এই স্বপ্নের কথা বললে তিনি আমাকে চড় দিয়ে বললেন, তুমি কি মদীনার বাদশাহকে পেতে চাও।[সহীহ বোখারী, যাদুল মায়াদ ইবনে হিশাম]
বিষ মিশ্রিত গোশতের ঘটনা
খয়বর বিজয়ের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিশ্চিত হলেন। এ সময় সালাম ইবনে মুশকিম এর স্ত্রী যয়নব বিনতে হারেছ তাঁর কাছে বকরির ভুনা গোশত উপঢৌকন হিসেবে পাঠায়। সেই মহিলা আগেই খবর নিয়েছিলো যে, আল্লাহর রসূল বকরির কোন অংশ বেশী পছন্দ করেন। শোনার পর  পছন্দনীয় অংশে বেশী করে বিষ মেশায়। অন্যান্য অংশেও বিষ মেশায়। এরপর আল্লাহর রসূলের সামনে এনে সেই বিষ মিশ্রিত গোশত রেখে দেয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দনীয় অংশের এক টুকরো মুখে দেন। কিন্তু চিবিয়েই তিনি ফেলে দেন। তিনি এরপর বললেন, এই যে হাড় দেখছো এই হাড় আমাকে বলছে যে, আমার মধ্যে বিষ মেশানো রয়েছে। যয়নবকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করা হলো, সে স্বীকার করলো। তিনি বললেন, তুমি কেন একাজ করেছ? মহিলা বললো, আমি ভেবেছিলাম যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন, তবে আমরা তার শাসন থেকে মুক্তি পাবো, আর যদি এই ব্যক্তি নবী হন, তবে আমার বিষ মেশানোর খবর তাকে জানিয়ে দেয়া হবে। এ নির্জলা স্বীকারোক্তি শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই মহিলাকে ক্ষমা করে দিলেন।
এ ঘটনার সময় আল্লাহর রসূলের সাথে হযরত বাশার ইবনে বারা ইবনে মারুরও ছিলেন। তিনি এক লোকমা খেয়েছিলেন। এতে তিনি বিষক্রিয়ায় ইন্তেকাল করেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই মহিলাকে ক্ষমা না হত্যা করেছিলেন, এ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। একাধিক বর্ণনার সমন্বয় এভাবে করা হয়েছে যে, প্রথমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ক্ষমা করলেও, হযরত বাশার এর ইন্তেকালের পর কেসাসরূপ তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৯, ফতহুল বারী, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ৪৯৭ ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৭]
খয়বরের যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিরা
এ অভিযানে বিভিন্ন সময়ে ১৬ জন শহীদ হয়েছিলেন। তন্মধ্যে ৪ জন কোরায়শ, একজন আশজা গোত্রের, একজন আসলাম গোত্রের, একজন খয়বরের অধিবাসী এবং ৯ জন আনসার।
অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী এ অভিযানে মোট ১৮জন শহীদ হন। আল্লামা মনসুরপুরী ১৯ জনের কথা লিখেছেন। অবশ্য তিনি কোথাও উল্লেখ করেছেন যে, সীরাত রচয়িতারা ১৫ জনের কথা লিখেছেন। অনসন্ধান করে আমি ২৩ জনের নাম পেয়েছি। জানিফ ইবনে ওয়ায়েলার নাম শুধু ওয়াকেদী উল্লেখ করেছেন। আর  জানিফ ইবনে হানিফের নাম তিবরি উল্লেখ করেছেন। বাশার ইবনে বারা ইবনে মারুর এর ইন্তেকাল হয়েছিলো যুদ্ধশেষে বিষ মেশানো গোশতে খাওয়ায়। বাশার ইবনে আবদুল মোনযের সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি বদর যুদ্ধে শহীদ হন, অন্য বর্ণনায় রয়েছে তিনি খয়বর যুদ্ধে শহীদ হন। আমার মতে প্রথমোক্ত বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য। [যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৯, ফতহুল বারী, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ৪৯৭ ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৭] আর নিহত ইহুদীদের সংখ্যা ছিলো ৯৩।
ফেদেক
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খয়বর পৌছে মোহাইয়াসা ইবনে মাসউদকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্যে মোহাইয়াসা পাঠান। কিন্তু ফেদেকের অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করতে দেরী করে। খয়বর মুসলমানদের অধিকারে আসার পর ফেদেকের অধিবাসীদের মধ্যে এর প্রভাব বিস্তার করে, তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে প্রতিনিধি পাঠিয়ে খয়বরের মতো উত্পন্ন ফসলের অর্ধেক প্রদানের শর্তে সমঝোতার প্রস্তাব পেশ করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা গ্রহণ করেন। এতে করে ফেদেকের জমি বিশেষভাবে আল্লাহর রসূলের জন্যে নির্ধারিত থাকে। কেননা, মুসলমানরা ফেদেক অভিযানের জন্যে যাননি অর্থাৎ তলোয়ারের জোরে ফেদেক জয় করা হয়নি। [ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৭]
ওয়াদিউল কোরা
খয়বর অভিযান শেষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদিউল কোরা অভিমুখে রওয়ানা হন। সেখানেও ছিলো একদল ইহুদী। তাদের সাথে একদল আরবও যোগ দেয়। মুসলমানরা সেখানে পৌছার পর ইহুদীরা তীর দিয়ে অভ্যর্থানা জানায়। তারা আগে থেকেই সারিবদ্ধ অবস্থায় ছিলো। ইহুদীদের তীর নিক্ষেপে আল্লাহর রসূলের একজন ভৃত্য মারা যান। সাহাবারা বললেন, তার জন্যে জান্নাত মোবারক হোক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কিছুতেই নয়। সেই জাতের শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যে ভৃত্য খয়বর যুদ্ধের গনীমতের মাল বন্টন হওয়ার আগে যে চাদর চুরি করেছিলো সেই চাদর আগুন হয়ে তাকে ঘিরে আছে। [সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, পৃ.৬০৭]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর যুদ্ধের জন্যে সাহাবাদের বিন্যস্ত করেন। হযরত সা‘দ ইবনে ওবাদাকে সেনাপতি করা হয়। হোবার ইবনে মানযারকে পকটি পতাকা এবং উবাদা ইবনে বাশারকে অপর একটি পতাকা প্রদান করা হয়। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের কছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তারা গ্রহণ করেনি। ওদের একজন যুদ্ধের জন্যে এগিয়ে আসে। মুসলমানদের পক্ষ থেকে হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা) এগিয়ে যান এবং ইহুদীকে হত্যা করেন। অন্য একজন ইহুদী এগিয়ে এলে হযরত যোবায়ের তাকেও হত্যা করেন। তৃতীয় একজন ইহুদী এগিয়ে এলে তার সাথে মোকাবেলার জন্যে হযরত আলী (রা) এগিয়ে তাকেও হত্যা করেন। এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে ১১ জন ইহুদী নিহত হয়। একজন ইহুদী নিহত হলেই আল্লাহর রসূল অন্য ইহুদীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন।
নামাযের সময় হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে নামায আদায় করতেন এরপর ইহুদীদের মুখোমুখি হয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এমনিভাবে লড়াই করতে করতে সন্ধা হয়ে যায়। পরদিন সকালে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে ইহুদীদের সাথে মোকাবেলার জন্যে পুনরায় হাযির হন। সূর্য তখনো বেশী ওপরে ওঠেনি। এ সময়ই ইহুদীরা আত্মসমর্পণ করে। গনীমতের মাল দান করে।
আল্লাহর রসূল ওয়াদিউল কোরায় চারদিন অবস্থান করেন। যুদ্ধলব্ধ অর্থ-সম্পদ সাহাবাদের মধ্যে বন্টন করে দেন। তবে, জমি এবং খেজুর বাগান ইহুদীদের কাছে রেখে দেন। সেই বিষয়ে খয়বরের ইহুদীদের অনরূপ চুক্তি করা হয়। [যাদুল মায়াদ ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৬-১৪৭]
তায়মা
তায়মার ইহুদীরা খয়বর ফেদেক ওয়াদিউল কোরা বা কোরা প্রান্তরে ইহুদীদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের খবর পায়। এরপর তারা নিজেরাই প্রতিনিধি পাঠিয়ে সন্ধির প্রস্তাব করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। [একই গ্রন্থ একই পৃষ্ঠা] আল্লাহর রসূল এ সম্পর্কে একটি চুক্তিও লেখান। চুক্তির কথা ছিলো এই যে, এই লেখা আল্লাহর রসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে বনু তায়মার জন্যে। তাদের জন্যে দায়িত্ব রয়েছে। তাদেরকে জিযিয়া কর দিতে হবে। তাদের সাথে বাড়াবাড়ি করা হবে না এবং দেশ থেকে বহিষ্কারও করা হবেনা। এ চুক্তি স্থায়ি বলে বিবেচিত হবে। চুক্তিপত্রের কথাগুলো লিখেছিলেন খালেদ ইবনে সাঈদ (রা)।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পথে রওয়ানা হন। ফেরার সময়ে এক প্রান্তরের কাছে পৌছে সাহাবারা উচ্চস্বরে তকবির ধ্বনি দেন। তারা বলেন, আল্লহু আকবর, আল্লহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লহু। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অতো বলার দরকার নাই। তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছো না বরং এমন এক সত্তাকে ডাকছো, যিনি শোনেন এবং কাছেই রয়েছেন।
ফেরার পথে সারারাত সফর শেষে শেষরাতে একস্থানে বিশ্রাম নেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত বেলালকে বলেছিলেন, তুমি জেগে থাকবে এবং ফজরের নামাযের সময় আমাদের জাগিয়ে দিবে। হযরত বেলাল (রা) পূর্বদিকে মুখ করে তাঁর সওয়ারীর সাথে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু পথশ্রমের ক্লান্তিতে এক সময় তিনিও ঘুমিয়ে পড়েন। কেউই নামাযের সময় জাগতে পারেননি। সর্বপ্রথম আল্লাহর রসূলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি সাহাবাদের জাগিয়ে সেই স্থান থেকে কিছু সামনে এগিয়ে যান। এরপর সাহাবাদের নিয়ে ফজরের নামায আদায় করেন। বলা হয়ে থাকে যে, এ ঘটনা দ্বিতীয় সফরের সময় ঘটেছিলো।[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৪০]
খয়বরের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর রসূল সপ্তম হিজরীর সফর মাসের শেষ দিকে রবিউল আউয়াল মাসে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
ছারিয়্যা আবান ইবনে সাঈদ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা ভালোভাবে জানতেন যে, হারাম মাসসমূহ শেষ হওয়ার পর মদীনাকে অরক্ষিত অবস্থায় রাখা দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। কেননা মদীনার আশে পাশে এমন অনেক বেদুইন রয়েছে, যারা লুটতরাজ এবং ডাকাতির জন্যে মুসলমানদের অমনোযোগিতার অপেক্ষায় থাকে। এ কারণে খয়বর অভিযানে যাওয়ার সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেদুইনদের ভীত সন্ত্রস্ত্র রাখার জন্যে আবান ইবনে সাঈদের (রা) নেতৃত্বে নজদের দিকে এক সামরিক বাহিণী প্রেরণ করেন। আবান ইবনে সাঈদ তার দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার সময়ে আল্লাহর রসূলের সাথে খয়বরে মোলাকাত হয়। সেই সময় খয়বর জয় হয়েছিলো।
ছারিয়্যা বা ছোট ধরনের এ সামরিক অভিযান সপ্তম হিজরীর সফর মাসে পাঠানো হয়েছিলো। সহীহ বোখারীতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। [বোখারী খয়বর যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড, পৃ. ৬০৮,৬০৯] অবশ্য, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি লিখেছেন, এই সামরিক অভিযান সম্পর্কে আমি কিছু জানতে পারিনি।[ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৪৯১]
যাতুর রেকা অভিযান
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহা আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের তিনটি শক্তির মধ্যে দু’টি শক্তি নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর তৃতীয় শক্তির প্রতি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ পেলেন। এরা ছিলো বেদুইন। নজদের প্রান্তরে তাঁবুতে কারা জীবন কাটাতো। লুটতরাজই ছিলো তাদের জীবিকার উৎস।
বেদুইনরা কোন জনপরদ বা শহরের অধিবাসী ছিলো না। বাড়ীঘর বা দুর্গের মধ্যে তারা বসবাস করতো না। এ করণে মক্কা এবং খয়বরের অধিবাসীদের মতো তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং দস্যুবৃত্তির আগুন পুরোপুরি নির্বাপিত করা ছিলো কষ্টসাধ্য। তারেদ শুধু ভীত-সন্ত্রস্ত করার মতো কাজ ছিলো প্রয়োজনীয়।
এ সকল বেদুইনকে প্রভাবিত মদীনার আশে পাশে সমবেত বেদুইনদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক শিক্ষাদানমূলক অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানই যাতুর রেকা অভিযান নামে পরিচিত।
সীরাত রচয়িতারা উল্লেখ করেছেন যে, চতুর্থ হিজরীতে এঅভিযনা পরিচালিত হয়েছিলো। কিন্তু ইমাম বোখারী (রা) উল্লেখ করেছেন যে, সপ্তম হিজরীতের এ অভিযান চালানো হয়। এ অভিযান আবু হোরায়রা (লা) এবং হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) অংশগ্রহণ করেছিলেন এ কারণে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে, খয়বর যুদ্ধের পর এ ঘটনা ঘটেছিলো। কেননা হযরত আবু হোরায়রা ৯রা) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খয়বর অভিযানে রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর মদীনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি খয়বরে গিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করেন। ততোদিনে খয়বর বিজয় সমাপ্ত হয় গেছে। হযরত আবু মূসা আশয়ারীও হাবশা থেকে সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খয়বরে পৌঁছেছিলেন যখন খয়বর বিজয়ের পর কোন এক সময় ঘটেছিলো।
সীরাত রচয়িতারা এ অভিযান সম্পর্কে যা কিছু উল্লেখ করেছেন তার সার কথা হচ্ছে এই যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসার বা বনরু গাতফানের দু’টি শাখা বনি ছালাবা এবং বনি মাহারেবের সমবেত হওয়ার খবর পেয়ে মদীনায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হযরত আবু যর গেফারী (রা) মতান্তরে হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা)-এর ওপর ন্যস্ত করেন। পরে চারশত মতান্তরে সাতশত সাহাবাকে নিয়ে নজদ অভিমুখে যাত্রা করেন। মদীনা থেকে দুইদিনের পথের নাখলা নামক জায়গায় পৌঁছার পর তারা বনু গাতফানের একদল লোকের মুখোমুখি হন। কিন্তু তাদের সাথে যুদ্ধ হয়নি। তবে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে খওফ নামায আদায় করেন।
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বেরুলাম। আমরা ছিলাম ছয়জন। মাত্র একটি উট ছিলো। পালাক্রমে আমরা সেই উটের পিঠে সওয়ার হচ্ছিলাম। ফলে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। আমার নিজের দুই পা যখম হয়ে যায়, নখে আঘাত পাই। ফলে আমরা পায়ে পট্টি বেঁধেছিলাম। যাতুর রেকা মানে হচ্ছে পট্টিওয়ালা। কেননা এ অভিযানের সময় আমরা পায়ে পট্টি বেঁধেছিলাম। [সহীহ বোখারী, যাতুর রেকা অভিযান অধ্যায়, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯২, সহীহ মুসলিম যাতুর রেকা অধ্যায় ২য় কন্ড, পৃ. ১১৮]
সহীহ বোখারীতে হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আমরা যাতুর রেকা অভিযানের সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙেগ ছিলাম। নিয়ম ছিলো যখন আমরা কোন ছায়াদানকারী গাছের নীচে যেতাম তখন সেই গাছের ছায়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে রাখতাম। একবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছায়াদানকারী গাছের নীচে বিশ্রাম করছিলেন, সাহাবারা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাছের শাখায় তলোয়ার ঝুলিয়ে বিশ্রাম নেয়ার এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। হযরত যাবের বরেন, আমরা সকলেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ইত্যবসরে একজন পৌত্তলিক এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তহলোয়ার হাতে নিয়ে বললো, তুমি আমাকে ভয় পাও? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবিচলিত কণ্ঠে বললেন, না, মোটেই না। পৌত্তলিক বললো, তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা।
হযরত জাবের (রা) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের ডাকলেন। আমরা তাঁর কাছে গিয়ে দেখি েএকজন অপরিচিত লোক তলোয়ার হাতে নিয়ে বসে আছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি শুয়েছিলাম, এমন সময় এই লোকটি আমার তলোয়ার  হাতে নিয়েছে এরপর আমাকে বলেছ, তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? আমি বলেছি, আল্লাহ রক্ষা করবেন। এই সেই লোক। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোন কটু কথা বলেননি।
আবু আওয়ানার বর্ণনায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই বললেন যে, আল্লহ তায়ালা রক্ষা করবেন তখনেই তার হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ে যায়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তলোয়ার হাতে নিয়ে লোকটিকে বললেন, এবার বলো তোমাকে  কে রক্ষা করবে? লোকটি বললো, আপনার দয়াই আমার ভরসা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রসূল। লোকটি বললো, আমি আপনার সাথে অঙ্গীকার করছি যে, আপনার সথে লড়াই করবো না এবং যারা আপনার সাথে লড়াই কের তাদের কোন প্রকার সাহায্য করবো না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরে লোকটিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন বল জাবের (রা) উল্লেখ করেছেন। লোকটি নিজের কওমের কাছে গিয়ে বললো, আমি সবচেয়ে ভালো মানুষের কাছ থেকে তোমাদের কাছে এসেছি।[ মুখতাছারুছ সিরাত, শেখ আবদুল্লাহ নজদী। পৃ. ২৬৪, ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৪১৬]
সহীহ বোখারীর এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, নামাযের একামত বলা হয়েছে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদল সাহাবাকে দুই রাকাত নামায পড়ালেন। এরপর তারা পেছনে চলে যান এবং তিনি অন্য একদল সাহাবাকে দুই রাকাত নামায পড়ান। এতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চার রাকাত এবং সাহাবাদের দুই রাকাত নামায আদায় হয়।[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৪০৭, ৪০৮, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯৩] এই বর্ণনার বর্ণনাক্রম থেকে বোঝা যায় যে, এই নামায উল্লিখিত ঘটনার পরেই আদায় করা হয়।
সহীহ বোখারীর বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, এ লোকটির নাম গোওরেস ইবনে হারেছ। উক্ত বর্ণনা মোসাদ্দাদ আবু আওয়ানা থেকে এবং আবু আওয়ানা আবু বিশর থেকে উল্লেখ করেছেন। [সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯৩]
ইবনে হাজার আসকালানি বলেন, ওয়াকেদী এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, সেই বেদুইনের নাম ছিলো দাসুর এবং সে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। কিন্তু ওয়াকেদীর কথা থেকে বোঝা যায় যে, ঘটনা দু’টি পৃথক সময়ে ঘটেছিলো। পৃথক পৃথক দু’টি যুদ্ধের সময় এ ঘটনা দু’টি ঘটে। আল্লাহই ভালো জানেন।[ ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৪২৮]
এ অভিযান থেকে ফিরে আসার সময় সাহাবায়ে কেরাম একজন মোশরেক নারীকে আটক করেন। এ খবর পেয়ে সেই মহিলার স্বামী প্রতিজ্ঞা করে যে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে থেসে সে একজনের রক্ত প্রবাহিত করবে। প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্যে যে রাত্রিকালে এলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদেরকে শত্রুদের হাত থেকে হেফাযত করতে ওব্বাত ইবনে বাশার এবং আম্মার ইবনে ইয়াসেরকে নিযুক্ত রেখেছিলেন। লোকটি আসার সময়ে হযরত ওব্বাদ নামায আদায় করছিলেন। সে অবস্থায় শত্রু তাঁকে তীর নিক্ষেপ করে। তিনি নামায না ছেড়ে এক ঝটকায় তীর বের করে ফেলেন। লোকটি দ্বিতীয়বার তীর নিক্ষেপ করলো এরপর তৃতীয়বর তীর নিক্ষেপ করলো। প্রতিবারই তিনি তীর খুলে ফেলেন। ছালাম ফিরায়ে নামায শেষ করার পর সঙ্গীকে জাগালেন এবং সব কথা জানালেন। সঙ্গী হযরত আম্মার  ইবনে ইয়াসের বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি আমাকে কেন জাগালেন না? তিনি বললেন, আমি একটি সূরা তেলাওয়াত করছিলাম, সূরা তেলাওয়াত করছিলাম, সূরাটি শেষ না করে নামায শেস করতে আমার ইচ্ছা হচ্ছিলো না। [যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১২, এই যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২০৩, ২০৯, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১০. ১১১, ১১২, ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৪১৭, ৪২৮]
কঠিন হৃদয় আরব বেদুইনদের অর্থাৎ যাযাবরদের প্রভাবিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত করতে এ যুদ্ধ ছিলো খুবই কার্যকর। এই অভিযানের পরবর্তী সময়ের অভিযানসমূহের প্রতিলক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই অভিযানের পর গাতফানের গোত্রসমূহ মাথা তোলার সাহস পায়নি। তারা ধীরে ধীরে নিস্তেজ এবং হীনবল হয়ে এক সময় ইসলাম গ্রহণ করে। এ সকল আরব গোত্রের কয়েকটিকে মক্কা বিজয় এবং হোনায়েনের যুদ্ধের সময় মুসলমানদের সাথে দেখা গেছে। তাদেরকে গনীমতের মালের অংশও প্রদান করা হয়েছে। মক্কা বিজয় থেকে ফিরে আসার পর তাদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করতে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মচারীদের প্রেরণ করা হয়েছিলো এবং তারা যতারীত যাতাক পরিশোধ করেছিলো। মোটকথা, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মপদ্ধতির ফলে খন্দকের যুদ্ধের সময়ে মুসলমানরেদ বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তিনটি শক্তিই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। এর ফলে সমগ্র এলাকায় শান্তি ও নিরাপত্তার বিস্তার ঘটে। এরপরে বিভিন্ন এলাকায় কিছু কিছু গোত্র হৈ চৈ করেছিলো কিন্তু মুসলমানরা সহজেই তাদেরকে কাবু করে ফেলেন। এই অভিযানের পরই বড় বড় শহর ও দেশ জয়ের অভিযানের পথ মুসলমানদের জন্যে প্রসশস্ত হতে শুরু করে। কেননা, এ অভিযানের পর দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা ইসলাম ও মুসলমানদের অনুকূলে আসে।
স্পতম হিজরীর কয়েকটি ছারিয়্যা
উল্লিখিত অভিযান থেকে ফিরে আরসা পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সপ্তম হিজরীর সওয়াল মাসে মদীনায় অবস্থান করেন এবং এ সময়ে কয়েকটি ছ্যারিয়্যায় সাহাবাদের প্রেরণ করেন। ছারিয়্যা ক’টির বিবরণ নিম্নরূপ।
১. ছারিয়্যা কোদাইদ
সপ্তম হিজরীর সফর বা রবিউল আউয়াল মাস
গালিব ইবনে আবদুল্লাহ লাইসি (রা)-এর নেতৃত্বে এই ছারিয়্যা কোদাইদ এলাকায় বনি মালুহ গোত্রের লোকদের কৃতকর্মের শিক্ষা দেয়ার জন্যে প্রেরণ করা হয়। বনি মালুহ বিশর ইবনে ছুয়াইদের বন্ধদের হত্যা করেছিলো। এই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধের জন্যে এ অভিযান প্রেরণ করা হয়। প্রেরিত সাহাবার রাতের বেলা আকস্মিক অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু লোককে হত্যা করেন। শত্রুরা এক বিরাট দল নিয়ে মুলমানদের মোকাবেলায় অনুসরণ করেছিলো কিন্তু তারা মুসলমানদের জাছে এলে বৃষ্টি শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর পানির সয়লাব দেখা দেয়। এই সয়লাব উভয় দলের মাঝে হওয়ায় শত্রুরা কাছে আসতে পারেনি। ফলে মুলমানরা নিরাপদে বাকি পথ অতিক্রম করে।
২. ছারিয়্যা হাছমি
সপ্তম হিজরীর জমাদিউস সানি মাস
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নামে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি শীর্ষক অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
৩. ছারিয়্যা তোরবা
সপ্তম হিজরীর শাবান মাস
এ ছারিয়্যা হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর নেতৃত্বে পরিচালনা করা হয়। তাঁর সাথে ছিলেন তিরিশ জন সাহাবা। তারা রাতের বেলা সফর এবং দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকতেন। বনু হাওয়াযেন গোত্রের  লোকেরা এ খবর পাওয়ার পর পালিয়ে যায়। হযরত ওমর (রা) এবং তাঁর সঙ্গীরা তখন মদীনায় ফিরে আসেন।
৪. ফেদেক অঞ্চলে ছারিয়্যা
সপ্তম হিজর শাবান মাস
হযরত বশীর ইবনে সা’দ আনসারী (রা)-এর নেতৃত্বে তিরিশজন সাহাবার একটি দল অভিযানে বের হন। বনু মাররা গোত্রের লোকদের শিক্ষা দিতেই এটি প্রেরণ করা হয়।
হযরত বশীর তাঁর এলাকায় পৌঁছে ভেড়া, বকরি এবং অন্য পশুপাল তাড়িয়ে নিয়ে আসেন। রাতে শত্রুরা এসে তাদের ঘিরে ধরে। মুসলমানরা তীর নিক্ষেপ করেন। একপর্যায়ে বশীর এবং তার সঙ্গীদের তীর শেষ হয়ে যায়। ফলে নিরস্ত্র মুসলমানদের শত্রুরা একে একে হত্যা করে। একমাত্র বশীর বেঁচেছিলেন। তাকে আহত অবস্থায় উঠিয়ে ফেদেকে নিয়ে আসা হয় এবং তিনি ইহুদীদের কাছেই অবস্থান করেন। দুই মাস পর ক্ষত শুকালে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন।
৫. ছারিয়্যা মাইফাআ
সপ্তম হিজরীর রমযান মাস
গালিব ইবনে আবদুল্লাহর নেতৃত্বে এই ছারিয়্যা বনু আউয়াল এবং বনু আবদ ইবনে ছালাবা গোত্রকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে পাঠানো হয়। অপর এক বর্ণনায় জুহাইন গোত্রের হারকাত শাখার লোকদের শিক্ষা দেয়ার জন্যে পাঠানো হয় বলে উল্লেখ রয়েছে। এতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো একশত ত্রিশ। এরা শত্রুদের ওপর একযোগে হামলা করেন। যারা মাথা তুলছিলো তাদেরই হত্যা করা হচ্ছিলো। এরপর ভেড়া ও বকরিসহ পশুপাল হাঁকিয়ে নিয়ে আসেন। এই অভিযানেই হযরত উছামা ইবনে যায়েদ (রা) নহায়েক ইবনে মারদাস মানক এক ব্যক্তিকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা সত্তেও হত্যা করেছিলেন। এ খবর শুনে রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তুমি কেন তার বুক চিরে জেনে নাওনি, সে সত্য ছিলো, নাকি মিথ্যা ছিলো?
৬. ছারিয়্যা খয়বর
সপ্তম হিজরীর শাওয়াল মাস
ত্রিশ সাহাবার সমন্বয়ে এই ছারিয়্যা প্রেরণ পরিচালনা করা হয়েছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা) এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। কারণ ছিলো এই যে, অসীর মতান্দরে বশীর ইবনে যারাম বনু গাতফান গোত্রের লোকদেরকে মুসলমানদের ওপর হামলা করতে সমবেত করেছিলো। মুলমানরা আসীরকে আশ্বাস দেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে খয়বরের গভর্নর নিযুক্ত করবেন। এ আশ্বাস দেয়ায় আসীল এবংতা তিরিশ জন সঙ্গী মুসলমানদের সাথে মদীনায় যেতে রাজি হয়। কারকারানিয়ার নামক জায়গায় পৌঁছে উভয় পক্ষে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এর ফলে আছির এবং তার সঙ্গীদের প্রারণ হারাতে হয়েছিলো।
৭. ছারিয়্যা ইয়ামান আজাবার
সপ্তম হিজরীর শওয়াল মাস
জাবার বনু গাতফান, মতান্তরে বনু ফাজায়া এবং বনু আজারার এলাকার নাম। হযরত বশীর ইবনে কা’ব আসারীকে তিনশত মুসলমানসহ সেখানে প্রেরণ করা হয়। মদীনায় হামলা করতে সমবেত এক বিরাট শত্রুর সৈন্যের মোকাবেলার জন্যে এদের প্রেরণ করা হয়। মুসলমানরা রাতে সফর করতেন এবং দিনে আত্মগোপন করে থাকতেন। শত্রুরা হযরত বশীরের (রা) আগমনের খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। হযরত বশীর (রা) বহু পশু মদীনায় নিয়ে আসেন। এছাড়া দু’জন লোককে বন্দী করে মদীনায় এনেছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে নেয়ার পর তারা ইসলাম গ্রহণ করেন।
৮. ছারিয়্যা গাবা
ইমাম ইবনে কাইয়েম ওমরায়ে কাজার আগে সপ্তম হিজরীতে সংঘটিত ছারিয়্যা অর্থাৎ শুধু মাত্র সাহাবায়ে কেরামের সমন্বয়ে প্রেরিত সামরিক অভিযানসমূহের মধ্যে এই অভিযানকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। এই অভিযানের সারকথা এই যে, জাশম ইবনে মাবিয়া গোত্রের একজন লোক বহুসংখ্যক লোককে সঙ্গে নিয়ে গাবায় এসেছিলেন। সে বনু কায়েসকে মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে সমবেত করতে চাচ্ছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু হাদরাওকে মাত্র দুইজন লোকসহ প্রেরণ করেন। হযরত হাদরাও এমন সামরিক কৌশল গ্রহণ করেন যে, শত্রুরা পরাজয় বরণ করে এবং বহু উট বকরি মুসলমানদের অধিকারে আসে।] যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১৪৯, ১৫০, রহমাতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৯, ২৩০, ২৩১, তালকিহুল ফুহুম পৃ. ৩১, মুখতাছারুছ সিয়ার শেখ আবদুল্লাহ নজদী, পৃ. ৩২২, ৩২৩, ৩২৪]
কাজা ওমরাহ পালন
ইমাম হাকেম বলেছেন, এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, যিলকদ এর চাঁদ  ওঠার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের কাজা ওমরাহ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণের নের্দেশ দেন। হোদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে যে সকল সাহাবা উপস্থি ছিলেন,তাদের কেউ যেন অনুপস্থিত না থাকেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে কথাও উল্লেখ করেন। সন্ধির পর শাহাদাত বরণকারীরা ব্যতীত অন্যসব সাহাবা এবং সন্ধির সময়ে অনুপস্থিত ছিলেন এমন বেশ কিছু সাহাবাও ওমরাহ পালনের প্রস্তুতি নেন। মহিলা ও শিশু ছাড়া সাহাবাদের সংখ্যা ছিলো দুই হাজার।[ ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৫০০]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু রেহম গেফারীকে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। ষাটটি উট সঙ্গে নেয়া হয় এবং  সেসব উটের দেখাশোনার দায়িত্ব নাজিয়া ইবনে জুন্দব আসলামির ওপর ন্যস্ত করা হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবয়ে কেরাম যুল হোলাইফা থেকে ওমরাহর এহরাম বাঁধেন এবং লাব্বায়েক ধ্বনি দেন। কোরায়শদের বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় মুসলমানরা অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নেন। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিলো ঢাল, তীর, বর্শা তলোয়ার। ইয়াজেজ প্রান্তরে পৌঁচার পর সকল অস্ত্র আউস ইবনে কাওলি আনসারীর নেতৃত্বে রেখে মুসলমানরা অগ্রসর হন। মুসলমানরা তাদের তলোয়ার কোষবদ্ধ রেখেছিলেন।[ ফহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৫০০,যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ১৫১]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় প্রবেশের সময় তাঁর কাসওয়া নামক উটনীতে আরোহণ করেন। মুসলমানরা কোষবদ্ধ তলোয়ার তুলে ধরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মাঝখানে নিয়ে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক ধ্বনি দিচ্ছিলো।
মক্কার পৌত্তলিকরা তামাশা দেখার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে অবস্থিত কায়াইকায়ান পাহাড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলো যে, তোমাদের কাছে এমন এক দল লোক আসছে, যাদের মদীনায় জ্বর কাবু করে ফেলেছে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা শুনে সাহাবাদের বললেন, তারা যেন তিনবার খুব জোরে দৌড় দেন। তবে রুকনে ইয়ামনী এবং হাজরে আসওয়াদের মাঝামাঝি এলাকায় স্বাভাবিক গতিতে যেতে হবে। সাত সাঈম মধ্যে পুরো সাতবারই দৌড় না দেয়ার জন্যে বলা হয়নি। আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের প্রত্যাশাই ছিলো এর কারণ। মোশরেকদের মুসলমানদের শক্তি দেখানোই ছিলো এর উদ্দেশ্য।[ সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, ২১৮, ২য় খন্ড, ৬১০, ৬১১, সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ. ৪১২ ]এছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদেরকে এজতেবা করারও আদেশ প্রদান করেন। এর অর্থ হচ্ছে ডান কাঁদ খোলা রেখে চাদর ডান বগলের নীচে দিয়ে নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে দেয়া। সামনে পিছনে উভয় দিক তে েচাদরের অপর প্রান্ত বাঁ কাঁধের ওপর ফেলে রাখা।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার পাহাড়ী ঘাঁটির পথ ধরে অগ্রসর হন। তাঁকে দেখার জন্যে মোশরেকরা লাইন লাগিয়ে রেখেছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্রমাগতভাবে লাব্বায়ক ধ্বনি দিচ্ছিলেন। হারাম শরীফে পৌঁছে তিনি নিজের ছড়ি দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করেন। এরপর তওয়অফ করলেন। মুসলমানরাও তাওয়াফ করেন। সেই সময় আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা) তলোয়ার উঁচু করে ধরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং এই কবিতা আবৃত্তি করছিলেন,
‘কাফেরে সন্তানরা ছেড়ে দাও তাঁর পথ
তাঁকে ঘিরে রেখেছে আল্লাহর রহমত।
রহমানুর রহীমের কেতাবে রয়েছে তাঁর কথা
সেই সকল সহীফা তেলাওয়াত করা হয় সদা।
হে আল্লাহ, তাঁর এ কথায় করেছি বিশ্বাস
 আল্লাহর রাহে দেবো কোরবান আমার নিশ্বাস
আল্লাহর নির্দেশ মেনে দেবো এমন মার
মাথার খুলি যাবে উড়ে বন্ধুর খবর রবে না আর।;
হযরত আনাস (রা)-এর বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, কবিতা আবৃত্তি শুনে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন, ওহে রওয়াহার পুত্র, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হারাম শরীফে কবিতা আবৃত্তি করা হচ্ছে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওহে ওমর, তাকে আবৃত্তি করতে দাও। ওদের মধ্যে এর প্রভাব তীরের চেয়ে অধিক কার্যকর। [জামে তিরমিযি ২য় খন্ড, পৃ. ১০৭]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানরা তিন চক্কর দৌড় দিলেন। মোশরেকরা দেখে বললো, মদীনার জ্বর যাদের কাবু করেছে মনে করেছিলাম, ওরা তো এমন এমন লোকের চেয়েও বেশী শক্তি রাখছে দেখছি।[ সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১২]
তওয়াফ শেষ করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করলেন। সেই সময় তাঁর তাদী অর্থাৎ কোরবানীর পশু মারওয়া পাহাড়ের কাছ দাঁড়ানো ছিলো। সাঈ শেষ করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটি কোরবানীর জায়গা, মক্কার সকল জায়গাই কোরবানীর জায়গা এরপর মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে সবাই পশু কোরবানী করেন। কোরবানীর পর সেখানেই মাথার চুল কামিয়ে ফেলেন। সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করেন। এরপর অস্ত্র পাহারা দেয়ার জন্যে কিছুসংখ্যক সাহাবাকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াজেজে প্রেরণ করেন। সেখানে যারা অস্ত্র পাহারা দিচ্ছিলো এরা যাওয়ার পর তাদের ওমরাহর জন্যে পাঠিয়ে দিতে বলে দেন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় তিনদিন অবস্থান করেন। চতুর্দিন সকালে মোশরেকরা হযরত আলী (রা)-কে বললো, তোমাদের সাথীকে যেতে বলো, কারণ সময় শেষ হয়ে গেছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে বেরিয়ে সরফ নামক জায়গায় গিয়ে অবস্থান করলেন।
মক্কা থেকে তাঁর রওয়ানা হওয়ার সময় হযরত হামযা (রা)-এর কন্যা চাচা বলতে বলতে তাঁর পিছনে যাচ্ছিল। হযরত আলী (রা) তাকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। তাকে লালন-পালন করার প্রসঙ্গ নিয়ে হযরত আলী (রা), হযরত জাফর (রা) এবং হযরত যায়েদ (রা)-এর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। কারণ প্রত্যেকে দাবী করছিলেন, তিনি লালন-পালনের অধিক হকদার। অবশেষে আল্লাহর রসূল হযরত জাফরের পক্ষে ফয়সালা দেন। কেননা, এই শিশুর খালা ছিলেন হযরত জাফরের সহধর্মিণী।
এই ওমরা পালনের সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মায়মুনা বিনতে হারেছ আমেরিয়াকে বিয়ে করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় পৌঁছার আগেএ উদ্দেশ্যে জাফর ইবনে আবু তালেবকে মায়মুনার কাছে পাঠান। মায়মুনা হযরত আব্বাসের ওপর এ দায়িত্ব ন্য করেন। কেননা, তিনি ছিলেন মায়মুনার দুলাভাই। তার স্ত্রী উম্মুল ফযল ছিলেন মায়মুনার বোন। হযরত আব্বাস (রা) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মায়মুনার বিয়ে দেন। মায়মুনাকে আনতে আবু রাফেকে দায়িত্ব দেয়া হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সরফ নামক জায়গায় পৌছার পর মায়মুনাকে তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।[ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১৫২]
এই ওমরাহর নাম ওমরাহে কাযা কেন রাখা হয়েছে? এর কারণ হচ্ছে, এই ওমরাহ ছিলো হোদায়বিয়ার সন্ধির সময়ের কাজা ওমরাহ। হোদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী এই ওমরাহ পালন করা হয়। উল্লেখিত কারণটিই প্রণিধানযোগ্য।[ যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭২, ফতহুল বরী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৫০০] এছাড়া, এই ওমরাহকে চারটি নামে অভিহিত করা হয়। যথা ওমরায়ে কাযা, ওমরায়ে কাযিয়া, ওমরায়ে কেছাছ এবং ওমরায়ে ছোলেহ।[ ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৫০০]
সূত্রঃ- আর-রাহিকুল মাখতুম
২৫তম খন্ড

No comments

Powered by Blogger.