মহাবিজয়ের দার প্রান্তেঃ আজ কোনো প্রতিশোধ নয়। রাসূল (সাঃ) এর জীবনী। ২৭ তম খন্ড

মক্কা বিজয়
ইমাম ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, এটা সেই মহান বিজয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীনের আমানতদারদের মর্যাদা দান করেছেন। এছাড়া তাঁর শহর ও ঘর-যে ঘরকে দুনিয়ার মানুষের হেদায়তের মাধ্যম করেছিলেন, সেই ঘরকে কাফের, মোশরেকদের হাত থেকে মুক্ত করেন। এই বিজয়ের দরুন আকাশের অধিবাসীদের মধ্যে আনন্দের ঢল বয়ে যায়। এই বিজয়ের ফলে আল্লাহর দ্বীনে মানুষ দলে দলে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং বিশ্বজগতের চেহারা খুশীতে চক চক করে ওঠে।১[যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ.১৬০]


অভিযানের কারণ
হোদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কিত আলোচনায় একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সন্ধির একটি ধারা এরূপ ছিলো যে, যে কেউ ইচ্ছা করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা কোরায়শদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে।
যিনি যে দলে যুক্ত হবেন তিনি সেই দলের অংশ বলেই বিবেচিত হবেন। কেউ যদি হামলা বা অন্য কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করে তা সে দলের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে।
এই চুক্তির মাধ্যমে বনু খোজাআ গোত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। আবু বকর গোত্র আবদ্ধ হয়েছিলো কোরায়শদের মিত্রতার বন্ধনে। এমনি করে উভয় গোত্র পরস্পর থেকে নিরাপদ হয়েছিলো। কিন্তু আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় থেকেই উভয় গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিবাদ বিসম্বাদ চলে আসছিলো। পরবর্তীকালে ইসলামের আবির্ভাব এবং হোদায়বিয়ার সন্ধির পর বিবদমান উভয় গোত্র পরস্পরের ব্যাপারে নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। বনু বকর গোত্র এই চুক্তির সুযোগকে গণীমত মনে করে বনু খোযাআ গোত্রের ওপর থেকে পুরানো শত্রুতার প্রতিশোধ গ্রহণে প্রস্তুত হলো। নওফেল ইবনে মাবিয়া দয়লি বনু বকরের একটি দলের সাথে শাবান মাসের ৮ তারিখে বনু খোযাআ গোত্রের ওপর হামলা চালায়। সেই সময় বনু খোযাআ গোত্রের লোকেরা ওয়াতের নামে একটি জলাশয়ের পাশে অবস্থান করছিলো। আকস্মিক হামলায় বনু খোযাআ গোত্রের কয়েকজন লোক মারা যায়। উভয়ের মধ্যে পরে সংঘর্ষ ও হয়। কোরায়শরা এই হামলায় বনু বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। কোরাইশদের কিছু লোক রাতে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে বনু বকর গোত্রের সাথে মিশে গিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলাও করে। আততায়ীরা বনু খোযাআ গোত্রের লোকদের তাড়িয়ে হরমের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সেখানে বনু বকর গোত্রের লোকেরা বললো, হে নওফেল, এবার তো আমরা হরম শরীফে প্রবেশ করবো। তোমদের মাবুদ, তোমাদের ইবাদত। একথার জবাবে নওফেল বললো,‘আজ কোন মাবুদ নেই। তোমাদের প্রতিশোধ নিয়ে নাও। আমার বয়সের কসম তোমরা হরম শরীফে চুরি করতে পারো, তবে কি নিজেদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারো না?
এদিকে বনু খোজাআ গ্রোত্রের লোকেরা মক্বায় পৌঁছে বুদায়েল ইবনে ওরাকা, খোযায়ী এবং তার একজন মুক্ত করা ক্রীতদাস রাফের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করলো। আমর ইবনে সালেম খাযায়ী সেখান থেকে বেরিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই সময় তিনি মসজিদে নববী সাহাবাদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। আমর ইবনে সালেম বললেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁর চুক্তি এবং তাঁর পিতার প্রাচীন অঙ্গীকারের ২[বনু খোজাআ এবং বনু আবদুল মুত্তালবের মধ্যে বহু পূর্ব থেকে চলে আসা অঙ্গীকারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে] দোহাই দিচ্ছি। হে রসূল,  আপনারা ছিলেন সন্তান আর আমর ছিলাম জন্মদানকারী। ৩[এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আবদে মান্নাফের মা অর্থাৎ কুসাই এর স্ত্রী হাব্বি ছিলেন বুন খোজাআ গোত্রের মেয়ে। এ কারণে সমগ্র নবী পরিবারকে বনু খোজাআ গোত্রের সন্তান বলা হয়েছে ।]  এরপর আমরা আনুগত্য গ্রহণ করেছি এবং কখনো অবাধ্যতা  প্রদর্শন করিনি। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে হেদায়াত দান করুন। আপনি সর্বাত্মক সাহায্য করুন, আল্লাহর বান্দাদের ডাকুন, তার সাহায্যের জন্যে আসবে। এদের মধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও থাকবেন, উদিত চতুর্দশীর চাঁদের মতো সুন্দর। যদি তাঁর ওপর অত্যাচার করা হয়, তবে তাঁর চেহারা রক্তিম থমথমে হয়ে যায়। আপনি এমন এক দুর্ধর্ষ বাহিনীর মধ্যে যাবেন, যারা ফেনিল উচ্ছ্বাস সমুদ্রের মতো তরঙ্গায়িত থাকবে। নিশ্চিত জেনে রাখুন, কোরায়শরা আপনদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বরখেলাফ করেছে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। তারা আমার জন্যে কোদা নামক জায়গায় ফাঁদ পেতেছে এবং ধারণা করেছে যে, আমি কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকব না। অথচ তারা বড়ই কমিনা  এবং সংখ্যায় অল্প। তারা আতর নামক জায়গায় রাতের অন্ধকারে হামলা করেছে এবং আমাদেরকে রুকু সেজদারত অবস্থায় হত্যা করেছে। অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, অথচ আমদের হত্যা করা হয়েছে।
রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অভিযোগ শোনার পর বললেন, হে আমর ইবনে সালেম, তোমায় সাহায্য করা হয়েছে। এরপর আকাশে এক টুকরো মেঘ দেখ গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই মেঘ বনু কা’ব এর সাহায্যের সুসংবাদ স্বরূপ আবির্ভূত হয়েছে।
এরপর বুদাইল ইবনে ওরাকা খোযায়ীর নেতৃত্বে বনু কোযাআ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানাই, কারা কারা নিহত হয়েছে। তারা আরো জানায় যে, কিভাবে কোরায়শরা বনু বকর গোত্রকে সাহায্য করেছে। এরপর তারা মক্কায় ফিরে যায়।
সন্ধি নবায়নের চেষ্টা
কোরায়শ এবং তার মিত্ররা যা করেছিলো সেটা ছিলো হোদায়বিয়ায় সন্ধির সুস্পষ্ট লংঘন এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এর কোন বৈধতার অজুহাত দেখানো যাবে না। কোরায়শরাও সন্ধির বরখেলাফ করার কথা খুব শীঘ্র বুঝতে পেরেছিলো। তারা এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম চিন্তা করে এক পরামর্শ সভা আহ্বান করলো। সেই সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, তারা তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে হোদায়বিয়ার সন্ধির নবায়নের জন্যে মদীনায় পাঠাবে।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরায়শদের সন্ধি লংঘন পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে সাহাবাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে, আবু সুফিয়ান সন্ধি পোক্ত এবং মেয়াদ বাড়ানোর জন্যে মদীনায় এসে পৌঁছেছে।
এদিকে আবু সুফিয়ান মদীনার উদ্দেশ্যে ওসফান নামক জায়গায় পৌঁছার পর বুদাইল ইবনে ওরাকার সাথে তার দেখা হলো। বুদাইল মদীনা থেকে মক্বা যাচ্ছিলো।
আবু সুফিয়ান ভেবেছিলো বুদাইল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে আসছে। তবু জিজ্ঞাসা করলো, কোথা থেকে আসছো বুদাইল? বুদাইল বললেন, আমি খোযাআর সাথে ওই উপকূলে গিয়েছিলাম। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাস করলো, ‘তুমি কি মোহাম্মদের কাছে যাওনি?’ বুদাইল বললেন,‘না তো।‘ বুদাইল মক্কার পথে যাওয়ার পর আবু সুফিয়ান বললো, বুদাইল যদি মদীনায় গিয়ে থাকে, তবে তো তার উটকে মদীনার খেজুর খাইয়েছে। এরপর আবু সুফিয়ান বুদাইলের উট বসানোর জায়গায় গিয়ে উটের পরিত্যক্ত মল ভেঙ্গে সেখানে মদীনার খেজুরের বীচি দেখতে পেলো। এরপর বললো, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, বুদাইল মোহাম্মদের কাছে গিয়েছিলো।
মোটকথা আবু সুফিয়ান মদীনায় গেলো এবং তার কন্যা উম্মে হাবিবার ঘরে গিয়ে উঠলো। আবু সুফিয়ান রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় বসতে যাচ্ছিলো। এটা লক্ষ্য করে হযরত উম্মে হাবিবা (রা.) সাথে সাথে বিছানা গুটিয়ে ফেললেন। আবু সুফিয়ান বললো, মা, তুমি আমাকে এ বিছানার উপযুক্ত মনে করোনি না এ বিছানাকে আমার উপযুক্ত মনে করোনি? আমার কাছ থেকে আসার পর তুমি খারাপ হয়ে গেছো।
হযরত উম্মে হাবিবা (রা.)বললেন, এটি হচ্ছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানা আর আপনি হচ্ছেন একজন নাপাক মোশরেক। আবু সুফিয়ান বললেন, খোদার কসম, আমার কাছে থেকে আসার পর তুমি খারাপ হয়ে গেছো।
এরপর আবু সুফিয়ান সেখান থেকে বেরিযে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোন জবাব দিলেন না। আবু সুফিয়ান হযরত আবু বকরের কাছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলো, তিনি যেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাতে আলোচনা করেন। হযরত আবু বকর (রা.) অসম্মতি প্রকাশ করলেন। আবু সুফিয়ান হযরত ওমর (রা.)-এর কাছে গিয়ে তাকে বললো তিনি যেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাদের ব্যাপারে কথা বলেন। হযরত ওমর (রা.) বললেন, আমি কেন তোমাদের জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ করবো। আল্লাহর শপথ, যদি আমি কাঠের টুকরো ছাড়া অন্য কিছু নাও পাই তবু ও সেই কাষ্টখন্ড দিয়ে তোমদের সাথে জেহাদ করবো। আবু সুফিয়ান এরপর হযরত আলীর (রা.) কাছে গেলেন । হযরত ফাতেমা (রা.) সেখানে ছিলেন। হযরত হাসানও ছিলেন। তিনি ছিলেন তখন ছোট। হাঁটাচলা করছিলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, হে আলী, তোমার সাথে আমার বংশগত সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আমি একটা প্রয়োজনে এসেছি। হতাশ হয়ে এসেছি, হতাশ হয়ে ফিরে যেতে চাইনা। তুমি আমার জন্যে মোহাম্মদের কাছে একটু সুপারিশ করো। হযরত আলী (রা.) বললেন, আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে আফসোস হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা ব্যাপারে সংকল্প করেছেন, এ ব্যাপারে আমরা তাঁর সাথে কোন কথা বলতে পারি না। আবু সুফিয়ান বিবি ফাতেমার (রা.) প্রতি তাকিয়ে বললেন, তুমি কি তোমার এ সন্তানকে এ মর্মে আদেশ করতে পারো যে, সে লোকদের মধ্যে আশ্রয়দানের ঘোষণা দিয়ে সব সময়ের জন্য আরবদের সর্দার হবে? হযরত ফাতেমা (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমার সন্তান লোকদের মধ্যে নেতা হওয়ার মতো ঘোষণা দেয়ার যোগ্য হয়নি। তাছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে কেউ আশ্রয় দিতে পারে না।
সকল চেষ্টার ব্যর্থতার পর আবু ‍সুফিয়ানের দু’চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেলো। তিনি সংশয় দোলায়িত চিত্তে কম্পিত কন্ঠে হযরত আলীকে (রা.) বললেন, আবুল হাসান আমি লক্ষ্য করছি যে, বিষয়টা জটিল হয়ে পড়েছে। কাজেই আমাকে একটা উপায় বলে দাও। হযরত আলী (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি তোমার জন্যে কল্যাণকর কিছু জানি না। তুমি বনু কেনানা গোত্রের নেতা। ‍তুমি দাঁড়িয়ে লোকদের মধ্যে নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করে দাও, এরপর নিজের দেশে ফিরে যাও। আবু সুফিয়ান বললেন, তুমি কি মনে করো যে, এটা আমার জন্যে কল্যাণকর হবে? হযরত আলী (রা,) বললেন না, আমি তা মনে করি না। তবে, এছাড়া অন্য কোন উপায়ও আছে বলে মনে হয় না। এরপর আবু সুফিয়ান মসজিদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, হে লোকসকল, আমি তোমাদের মধ্যে নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করছি। এরপর নিজের উটের পিঠে চড়ে মক্কায় চলে গেলেন।
কোরায়শদের কাছে গেলে তারা তাকে ঘিরে ধরে এবং মদীনার খবর জানতে চাইল। আবু সুফিয়ান বললেন, কথা বলেছি কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি। আবু কোহাফার পুত্রের কছে গেছি তার মধ্যে ভাল কিছু পাইনি। ওমর ইবনে খাত্তাবের কাছে গেছি, তাকে মনে হয়েছে সবচেয়ে কট্টর দুশমন। আলীর কাছে গেলাম, তাকে সবচেয়ে নরম মনে হলো। তিনি আমাকে একটা পরামর্শ  দিলেন আমি সে অনুযায়ী কাজ করলাম। জানিনা সেটা কল্যাণকর হবে কিনা? লোকেরা জানতে চাইল সেটা কি? আবু সুফিয়ান বললেন, আলী পরামর্শ দিলেন আমি যেন নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করি, অবশেষে আমি তাই করলাম।
কোরায়শরা বললো, মোহাম্মদ কি তোমার নিরাপত্তার ঘোষণাকে কার্যকর বলে ঘোষণা করেছে? আবু সুফিয়ান বললো, না তা করেনি। কোরায়শরা বললো তোমার সর্বনাশ হোক। আলী তোমার সাথে স্রেফ রসিকতা করেছে। আবু সুফিয়ান বললো, আল্লাহর শপথ, এছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি তিবরানির বর্ণনা থেকে জানা যায়, কোরায়শদের বিশ্বাসঘাতকতার খবর আসার তিনদিন আগেই রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.) –কে তাঁর সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুত করতে বলেছিলেন। তবে, বিষয়টি গোপন রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) হযরত আয়েশার (রা.) কাছে বললেন, মা এ প্রস্তুতি কিসের? হযরত আয়েশা (রা.) বললেন, আমি জানি না আব্বা। হযরত আবু বকর বললেন, এটাতো রোমকদের সাথে যুদ্ধের সময় নয়। তাহলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন দিকে যাওয়ার ইচ্ছা করেছেন? হযরত আয়েশা (রা.) বললেন, আমি জানিনা আব্বা। তৃতীয় দিন সকালে হযরত আমর ইবনে সালেম খাযায়ী ৪০ জন সওয়ারসহ এসে পৌঁছলেন। তিনি কয়েক লাইন কবিত আবৃতি করলেন। এতে শ্রোতারা বুঝতে পারলেন যে, কোরায়শরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এরপর বুদাইল এলেন। এরপর এলো আবু সুফিয়ান। এর ফলে সাহাবারা পরিস্থিতি উপলব্ধি করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, মক্কায় যেতে হবে। সাথে সাথে এ দোয়া করলেন, হে আল্লাহ তায়ালা গোয়েন্দা এবং কোরায়শদের কাছে আমাদের যাওয়ার খবর যেন পৌঁছাতে না পারে, তুমি তার ব্যবস্থা করো। আমরা যেন মক্কাবাসীদের কাছাকাছি যাওয়ার আগে তারা যেন বুঝতে না পারে, জানতেও না পারে।
গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অষ্টম হিজরীর রমজান মাসে হযরত আবু কাতাদা ইবনে রাবঈর নেতৃত্বে আটজন সাহাবীকে এক ছারিয়্যায় বাতনে আযাম নামক জায়গায় প্রেরণ করেন। এই জায়গা যি-খাশাব এবং যিল মাররার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এর দূরত্ব মদীনা থেকে ৩৬ মাইল।
এই ক্ষুদ্র সেনাদল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, যারা বোঝার তার বুঝবে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত জায়গায় যাবেন। চারিদিকে এই খবরই ছড়িয়ে পড়বে। এ ক্ষুদ্র সেনাদল উল্লিখিত জায়গায় পৌঁছার পর খবর পেলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা অভিমুকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। এ খবর পাওয়ার পর তারাও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কাফেলার সাথে গিয়ে মিলিত হলো।৪[এটি সেই ছারিয়্যা যার সাথে আমের ইবনে আজবাতের সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমের ইসলামী  রীতি অনুযায়ী সালাম করেছিলেন। কিন্তু পূর্বতন কোন শত্রুতার কারণে মাহলাম ইবনে জাশামা আমেরকে হত্যা করেন এবং তার উট ও অন্যান্য জিনিস আত্মসাৎ করেন। এরপর কোরআনের এই আয়াত নাযিল হয়, ‘যে তোমাকে সালাম করে, তাকে বলো না যে, তুমি মোমেন নও।’ এরপর সাহবায়ে কেরাম আল্লাহর রসূলের কাছে মাহলাম ইবনে জাশামের মাগফেরাতের দোয়া করার আবেদন জানান। আল্লাহর রসূলের কাছে মাহলাম ইবনে জাশামের নাগফেরাতের দোয়া করার আবেদন জানান। আল্লাহর রসূলের সামনে মাহলাম হাযির হলে তিনি বলে, হে আল্লাহ পাক, মাহলাম যেন ক্ষমা না পায়। তিনি এ কথা তিনবার উচ্চারণ করেন। এ কথা শুনে মাহলাম কাপড়ে চোখ মুছে উঠে পড়েন। ইবনে ইসহাক  বলেন, মাহলামের গোত্রের লোকেরা বলেছে, পরবর্তীকালে আল্লাহর রসূল মাহলামের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করেছিলেন। দেখুন, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ.১৫১]
এদিকে হাতেব ইবনে আবু বালতাআ কোরায়শদের এক খানি চিঠি লিখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা জানানোর চেষ্টা করেন। সেই চিঠি মক্কায় কোরায়শদের হাতে পৌঁছানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে একজন মহিলাকে নিয়োগ করেন। সেই মহিলা খোঁপার ভেতর চিঠিখানি লুকিয়ে মক্কায় রওয়ানা হন। এদিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রসূলকে এ খবর জানিয়ে দেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী, হযরত মেকদাদ,হযরত যোবয়ের এবং হযরত আবু মারছাদ গুনুবিকে ডেকে বলেন, তোমরা চারজন রওজা খাখ-এ যাও। সেখানে উঠের পিঠে আরোহণকারিনী একজন মহিলাকে পাবে। তার কাছে একখানি চিঠি পাবে। সেই চিঠি কোরায়শদের কাছে পাঠানো হয়েছে। চারজন সাহাবী রওযা খাখ-এ পৌঁছে সেই মহিলাকে পেলেন। মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হলো তোমার কাছে কি কোন চিঠি আছে? মহিলা অস্বীকার করলো। সাহবারা উটের হাওদাজে খুঁজে দেখলেন কিন্তু চিঠি পেলেন না। এরপর হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও মিথ্যা বলেননি, আমরা ও মিথ্যা বলছি না। তুমি হয়তো চিঠি দাও, না হয় আমরা তোমাকে উলঙ্গ করবো। একথা শুনে মহিলা বললো, আচ্ছা আপনারা একটু ঘুরে দাঁড়ান। সাহাবার ঘুরে দাঁড়ালে মহিলা তার খোঁপা খুলে চিঠি বের করে সাহাবদের হাতে দিলেন। তারা চিঠি নিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিঠিখানা পড়িয়ে দেখলেনে যে, ‘ওতে লেখা রয়েছে, হাতেব ইবনে আবু বালতাআর পক্ষ থোকে কোরায়শদের প্রতি।’ এতে কোরায়শদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা অভিযানের কবর দেয়া হয়েছিল।৫[ইমাম সোহায়লী বিভিন্ন যুদ্ধের ঘটনার উল্লোখ করেছেন। তিনি চিঠির বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করেছেন। চিঠিতে লেখা ছিল, আম্মা বাদ, হে কোরায়শরা, আল্লাহর রসূল তোমাদের উদ্দেশ্যে সৈন্যসহ হাযির হচ্ছেন। যদি তিনি একা ও  হাযির হন তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সাহায্যে করবেন এবং তাঁকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবেন। কাজেই তোমরা নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করো। ওয়াসসালাম।
ওয়াকেদী লিখেছেন, হাতেব সোহায়েল ইবনে আমর সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং একরামার কাছে একথা লিখেছেন যে, আল্লাহর রসূল লোকদের মধ্যে যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছেন। বুঝতে পরি না তোমাদের উদ্দেশ্যে যাবেন, নাকি অন্য কোথাও। আমি চাই ডে, তোমাদের প্রতি এটা আমার এহসান হিসাবে গণ্য হবে।]
 রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হাতেব, এটা কি? হাতেব বললেন, আমার ব্যাপারে তাড়াহুড়া  করবেন না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর ররসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আমার ঈমান রয়েছে। আমি মোরতাদ হয়ে যাইনি বা আমার মধ্যে কোন পরিবর্তনও আসেনি। কথা হচ্ছে যে, আমি কোরায়শ বংশের লোক নই। আমি তাদের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলাম। বর্তমানে আমার পরিবার-পরিজন তাদের কাছে রয়েছে। কোরায়শদের সাথে আমার এমন কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, যে কারণে তারা আমার পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধান করবে। তাই আমি চিন্তা করলাম যে, তাদের একটা উপকার করবো এর ফলে তারা আমার পরিবার-পরিজনের হেফাজত করবে। আমি ছাড়া আপনার সঙ্গে অন্য যারা রয়েছেন মক্কায় তাদরে প্রত্যেকেরই  আত্মীয়-স্বজন  রয়েছেন। সেসব আত্মীয়-স্বজন তাদের পরিবার-পরিজনের হেফাজত করবেন। হযরত ওমর (রা.) হযরত হাতেবের কথা শুনে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি অনুমতি দিন, আমি তার শিরশ্চেদ করবো। এই লোকটি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেয়ানত করেছে। সে মোনাফেক হয়ে গেছ। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম বললেন, দেখো, সে বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। হে ওমর (রা.) তুমি কি করে জানবে, এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এসে বলবেন, তোমরা যা ইচ্ছা করো, আমি তোমাদের মাফ করে দিয়েছি। একথা শুনে হযরত ওমরের (রা.) দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জানেন। ৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ.৪২২]
এমনি করে আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন গুপ্তচরদের ধরিয়ে দিলেন। ফলে মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতির কোন খবরই কোরায়শদের কাছে পৌঁছুতে পারেনি।
মক্কা অভিমুখে মুসলিম বাহিনী
অষ্টম হিজরীর ১০ই রমযান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ১০ হাজার সাহাবা। মদীনার তত্ত্বাবধানের জন্যে আবু রাহাম গেফরীকে নিযুক্ত করা হয়।
জাহাফা বা তার আরো কিছু এগিয়ে যাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমের চাচা হযরত আব্বাসের সাথে দেখা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে সপরিবারে মদীনায় হিজরত করে যাচ্ছিলেন। আবওয়া নামক জায়গায় পৌঁছে তাঁর চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস এবং ফুফাতো ভাই আবদুল্রাহ ইবনে উমাইয়ার সাথে দেখা হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এরা উভয়ে তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছিলো এবং কবিতা রচনা করে তাঁর নিন্দা করে বেড়াতো। এ অবস্থা দেখে হযরত উম্মে সালমা (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমকে বললেন, আপনার চাচাতো ভাই ফুফাতো ভাই আপনার কাছে সবচেয়ে খারাপ হবে এটা সমীচীন নয়।
হযরত আলী (রা.) আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়াকে বললেন, তোমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমের কাছে যাও এবং হযরত ইউসুফকে তাঁর ভাইয়েরা যে কথা বলেছিলেন সে কথা বলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম নিশ্চয় এট পছন্দ করবেন না যে, অন্য কারো জবাব তাঁর চেয়ে উত্তম হবে। হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা তাঁকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় আপনাকে আমাদের ওপর প্রধান্য দিয়েছেন এবং আমরা নিশ্চয় অপরাধী ছিলাম।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৯১)
আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস তাই করলেন। এই আয়াত শুনে রসূল আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস এরপর কয়েক লাইন কবিতা আবৃতি করলেন, তার অর্থ হচ্ছে, ‘তোমার বয়সের শপথ, আমি যখন লাত-এর শাহ সওয়ারকে মোহাম্মদের শাহ সওয়ারের ওপর বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে পতাকা তুলেছিলাম সে সময়  আমার অবস্থা ছিলো রাতের পথহারা পথিকের মত। কিন্তু এখন আমাকে হেদায়াত দেয়ার সময় এসেছ, এখন আমি হেদায়াত পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছি। আমার প্রবৃত্তির পরিবর্তে একজন হাদী আমাকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং তিনি আমাকে আল্লাহর পথ দেখিয়েছেন। অথচ এই পথকে আমি ইতিপূর্বে সব সময় উপেক্ষা করেছিলাম।’
একথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবেগে আবু সুফিয়ানের বুকে চাপড় মেরে বললেন, তুমি আমাকে সব ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেছিলে।৭[পরবর্তীকালে আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস একজন ভালো মুসলমান হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে ইসলাম গ্রহণের পর লজ্জার কারণে তিনি রসূলের প্রতি চোখ তুলে তাকাননি। আল্লাহর রসূল ও তাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে বেহেশেতের সুসংবাদ দিতেন। তিনি বলতেন, আমি আশা করি আবু সুফিয়ান হামজার মতো হবে। ইন্তেকালের সময় উপস্থিত হলে বললেন, আমার জন্য কেঁদো না। ইসলাম গ্রহণের পর আমি পাপ হ্ওয়ার মতো কোন কথা বলিনি।(যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ.১৬২-১৬৩)]
মাররুজ যাহারানে মুসলিম সেনাদলঃ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সফর অব্যাহত রাখলেন। তিনি এবং সাহবায়ে কেরাম সকলেই রোযা রেখেছিলেন। আসফান কোদায়দের মধ্যবর্তী কোদায়েল জলশায়ের কাছে পৌঁছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ভেঙ্গে ফেললেন।৮[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড] তাঁর দেখাদেখি সাহাবায়ে কেরাম ও রোযা ভাঙ্গলেন।
 এরপর পুনরায় তাঁরা সফর করতে শুরু করেন। রাতের প্রথম প্রহরে তাঁরা মারুরুজ জাহারান অর্থাৎ ফাতেমা প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে সাহাবারা পৃথকভাবে আগুন জ্বালালেন। এত দশ হাজার চুলায়  রান্না হচ্ছিলো। আল্লাহর রসূল পাহারার কাজে হযরত ওমরকে (রা.) নিযুক্ত করলেন।
আল্লাহর রসূলের সমীপে আবু সুফিয়ানঃ
মাররুজ জাহরানে অবতরণের পর হযরত আব্বাস (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদা খচ্চরের পিঠে আরোহণ করে ঘোরাফেরা করতে বেরোলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যে, কাউকে পেলে মক্কায় খবর পাঠাবেন, যাতে করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কায় প্রবেশের আগেই কোরায়শরা তাঁর কাছে এসে নিরাপত্তার আবেদন জানান।
এদিকে আল্লাহ তায়ালা, কোরায়শদের কাছে কোন প্রকার খবর পৌঁছা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে মক্কাবসীরা কিছুই জানতে পারেনি। তবে তারা ভীতি-বিহ্বলতার মধ্যে এবং আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। আবু সুফিয়ান বাইরে এসে কোন নতুন খবর জানা যায় কিনা সে চেষ্টা করছিলো। সে সময় তিনি হাকিম বিন হাজাম এবং বুদাইল বিন ওরাকাকে সঙ্গে নিয়ে নতুন খবর সংগ্রহের চেষ্টায় বেরিয়েছিলেন।
হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি হযরত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আবু সুফিয়ান এবং বুদাইল ইবনে ওরাকার কথা শুনতে পেলাম। আবু সুফিয়ান বলছিলেন, আল্লাহর শপথ, আমি আজকের মতো আগুন এবং সৈন্যবাহিনী অতীতে কখনো দেখিনি। বুদাইল ইবনে ওরাকা বললো, আল্লাহর শপথ, ওরা হচ্ছে বনু খোযাআ। যুদ্ধ ওদের লন্ড ভন্ড করে দিয়েছে। আবু সুফিয়ান বললেন, এতো আগুন এবং এতো বিরাট বাহিনী বনু খোযাআর থাকতেই পারে না।
হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি আবিু সুফিয়ানের কন্ঠস্বর শুনে বললাম, আবু হানজালা নাকি? আবু সুফিয়ান আমার কন্ঠস্বর চিনে বললেন , আবুল ফযল নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ। আবু সুফিয়ান বললেন, কি ব্যাপার? আমার পিতামাতা তোমার জন্যে কোরবান হোক। আমি বললাম,রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে এসছেন। হায়রে কোরায়শদের সর্বনাশা অবস্থা। আবু সুফিয়ান বললেন, এখন কি উপায়? আমার পিতামাতা তোমার জন্যে কোরবান হোক। আমি বললাম, ওরা তোমাকে পেলে তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবে। তুমি এই খচ্চরের পিছনে উঠে বসো। আমি তোমাকে বললাম,রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাবো। তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেবো। আবু সুফিয়ান তখন খচ্চরে উঠে আমার পিছনে বসলেন। তার অন্য দু’জন সাথী ফিরে গেলো।
হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে চললাম, কোন জটলার কাছে গেলে লোকেরা বলতো, কে যায়? কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরের পিঠে আমাকে দেখে বলতো, ইনি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা, তাঁরই খচ্চরের পিঠে রয়েছেন। ওমর ইবনে খাত্তাবের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেন , কে? একথা বলেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার পিছনে আবু সুফিয়ানকে দেখে বললেন, আবু সুফিয়ান?  আল্লাহর দুশমন? আল্লাহর প্রশংসা করি, কোন প্রকার সংঘাত ছাড়াই আবু সুফিয়ান আামদের কবযায় এসে গেছে। একথা বলেই হযরত ওমর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে গেলেন। আমিও খচ্চরকে জোরে তাড়িয়ে নিলাম। খচ্চর থেকে নেমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। ইতিমধ্যে হযরত ওমর (রা.) এলেন। তিনি এসেই বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ওই দেখুন আবু সুফিয়ান। আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি সুফিয়ানকে নিরাপত্তা দিয়েছি। পরে আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথা স্পর্শ করে বললাম, আল্লাহর শপথ, আজ রাতে আমি ছাড়া আপনার সাথে কেউ গোপন কথা বলতে পারবে না। আবু সুফিয়ানকে হত্যা করার অনুমতির জন্যে হযরত ওমর বারবার আবেদন জানালে আমি বললাম,  থামো ওমর।  আবু সুফিয়ান যদি বনি আদী ইবনে কা’ব এর লোক হতো, তবে এমন কথা বলতে না। হযরত ওমর বললেন, আব্বাস থামো। আল্লাহর শপথ, তোমার ইসলাম গ্রহণ আামর কাছে আামর পিতা খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় এবং এর একমাত্র কারণ এই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তোমার ইসলাম গ্রহণ আমার পিতা  খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আব্বাস, আবু সুফিয়ানকে তোমার ডেরায় নিয়ে যাও। সকালে আমার কাছে নিয়ে এসো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  নির্দেশ মতো আমি আবু সুফিয়ানকে আমার তাঁবুতে নিয়ে গেলাম। সকাল বেলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আবু সুফিয়ানকে নিয়ে গেলাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে আফসোস, তোমার জন্যে কি এখনো একথা বোঝার সময় আসেনি যে, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই? আবু সুফিয়ান বললো, আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কোরবান হোন, আপনি কতো উদার, কতো মহানুভব, কতো দয়ালু। আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ থাকলে এই সময়ে কিছু কাজে আসতো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে কি এখনো একথা বোঝার সময় আসেনি যে, আমি আল্লাহ রাসূল? আবু সুফিয়ান বললো, আমার পিতামাতা আপনার ওপর নিবেদিত হোন। আপনি কতো মহৎ, কতো দয়ালু আত্মীয়-স্বজনের প্রতি কতো যে সমবেদনশীল। আপনি যে প্রশ্ন করলেন, এ সম্পর্কে এখনো আমার মনে কিছু খটকা রয়েছে। হযরত আব্বাস (রা.) বললেন, আরে শিরশ্চেদ হওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার আগে ইসলাম কবুল করো। একথা সাক্ষী দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত এবাদতের যোগ্য কেউ নেই এবং হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। হযরত আব্বাস (রা.)-এর একথা বলার পর আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করে এবং সত্যের সাক্ষী হলেন।
হযরত আব্বাস বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আবু সুফিয়ান মর্যাদাবান লোক, কাজেই তাকে কোন মর্যাদা দেয়ার আবেদন জানাচ্ছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেলেন, ঠিক আছে, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে ব্যক্তি নিজের ঘরে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ রাখেবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ।
মক্কা অভিমুকে ইসলামী বাহিনীঃ
অষ্টম হিজরীর ১৭ই রমযান সকাল বেলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররুজ জাহারান থেকে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, আবু সুফিয়ানকে যেন প্রন্তরের পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড় করিয়ে রখে। এতে সেপথ অতিক্রমকারী আল্লাহর সৈনিকদের আবু সুফিয়ান দেখতে পাবে। হযরত আব্বাস (রা.) তাই করলেন। এদিক বিভিন্ন গোত্র তাদের পতাকা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কোন গোত্র অতিক্রমের সময় আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করতেন, আব্বাস এরা কারা? জবাবে হযরত আব্বাস (রা.) যেমন বলতেন, ওরা বনু সালিম। আবু সুফিয়ান বলতেন, বনু সালিমের সাথে আমার কি সম্পর্ক? অন্য কেউ সেই পথ অতিক্রমের সময় আবু সুফিয়ান বলতেন, এরা কারা?  হযরত আব্বাস যেমন বলতেন, এরা মোযায়না গোত্র। আবু সুফিয়ান বলতেন, মাজনিয়াহ  গোত্রের সাথে আমার কি সম্পর্ক? একে একে সকল গোত্র আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে অতিতক্রম করলো্। যে কোন গোত্র  যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান  তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং পরিচয় জানার পর বলতেন, ওদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? এর পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোহাজের ও আনসারদের  সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে দেখা যাচ্ছিল শুধু লৌহ শিরস্ত্রাণ। আবু সুফিয়ান বললেন, সুবহানাল্লাহ, এরা কারা? হযরত আব্বাস বললেন, আনসার ও মোহাজেরদের  সঙ্গে  নিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচ্ছেন। আবু সুফিয়ান বললেন, এদের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি কার আছে? আবুল ফযল, তোমার ভাতিজার বাদশাহী তো জবরদস্ত হয়ে গেছে। হযরত আব্বাস বললেন, আবু সুফিয়ান এটা হচ্ছে নবুয়ত। আবু সুফিয়ান বললেন, হাঁ এখন তো তাই বলা হবে।
এ সময় আরো একটা ঘটনা ঘটলো। আনসারদের পতাকা হযরত সা’দ (রা.) বহন করছিলেন। আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হযরত সা’দ (রা.) বললেন, আজ রক্তপাত এবং মারধর করার দিন। আজ হারামকে হালাল করা হবে। আল্লাহ তায়ালা আজ কোরায়শদরে জন্যে অবমাননা নির্ধারণ করে রেখেছেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সা’দ যা বলেছে, আপনি কি সে কথা ‍শুনেছেন? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন যে, সা’দ কি  বলেছে? আবু সুফিয়ান বললেন, এই এই কথা বলেছে। একথা শুনে হযরত ওসমান এবং  হযরত আবদুর রহমান আওফ বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমরা আশঙ্কা করছি যে, সা’দ কোরায়শদের মধ্যে খুন-খারাবি শুরু না করে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না আজতো এমন দিন যে, কাবার  তাযিম করা হবে। আজ এমন দিন যে, আল্লাহ তায়ালা কোরায়শদের সম্মান দেবেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সাহাবীকে পাঠিয়ে হযরত সা’দ এর হাত থেকে পতাকা নিয়ে এলেন এবং তাঁর পুত্র কয়েস এর হাতে দিলেন। এতে মনে হলো পতাকা যেন হযরত সা’দ এর হাতেই রয়ে গেছে। অন্য বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পতাকা হযরত যোবয়ের (রা.) এর হতে দিয়েছিলেন।
কোরায়শদের দোরগোড়ায়ঃ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে যাওয়ার পর হযরত আব্বাস (রা.) বললেন, আবু সুফিয়ান, এবার তুমি কওমের কাছে যাও। আবু সুফিয়ান দ্রুত মক্কায় গিয়ে পৌঁছলো এবং উচ্ছ কন্ঠে বললো, হে কোরায়শরা, মোহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কাছে এতো সৈন্য নিয়ে এসেছেন যে, মোকাবেলা করা অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানে ঘরে প্রবেশ করবে, সি নিরাপত্তা পাবে। একথা শুনে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দ বিনতে ওতব উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এসে আবু সুফিয়ানে গোঁফ নেড়ে বললো, তোমরা এই বুড়োকে মেরে ফেলো। খারাপ খবর নিয়ে আসা এই বুড়োর অকল্যাণ হোক।
আবু সুফিয়ান বললেন, তোমাদের সর্বনাশ হোক। দেখো তোমাদের জীবন বাঁচানেরা ব্যাপারে এই মেয়েলোক তোমাদের যেন ধোঁকায় না ফেলে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এতো বিরাট বাহিনী নিয়ে এসছেন যার মোকাবেলা করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কাজেই, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, তারা নিরাপদ। লোকেরা বললো, আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। আমরা কয়জন তোমার ঘরে যেতে পারবো? আবু সুফিয়ান বললেন, যারা নিজের ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ  করে রাখবে, তারা ও নিরাপত্তা পাবে। যারা মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে, তারাও নিরাপত্তা পাবে। একথা শুনে লোকেরা নিজেদের ঘর এবং মসজিদে হারাম অর্থাৎ কাবাঘরের দিকে দৌড়াতে লাগলো। তবে মতলববাজ কোরায়শরা কিছু সংখ্যক মাস্তানজাতীয় উচ্ছৃঙ্খল লোককে লেলিয়ে দিয়ে বললো, তবে আমরা এদের সমেনে ঠেলে দিলাম। যদি কোরায়শরা কিছুটা সাফল্য লাভ করে, তবে আমরা এদের সাথে গিয়ে মিলিত হব। যদি এরা আহত হয়, তবে আমদের কাছে তারা যা কিছু চাইবে, আমরা তাই দেবো। মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে কোরায়শদরে যেসব মাস্তান ও উচ্ছৃঙ্খল লোকেরা প্রস্তুত হলো সেসব নির্বোধ লোকের নেতা মনোনীত করা হলো একরামা ইবনে আবু জেহেল, সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং সোহায়েল ইবনে আমরকে। এ তিনজনের নেতৃত্বে একদল কোরায়শ খান্দামায়  সমবেত হলো। এদের মধ্যে বনু বকর গোত্রের হাম্মাস ইবনে কায়েস নামে একজন লোকও ছিলো। এর আগে সে অস্ত্র মেরামতের কাজ করতো। একদিন নিজ অস্ত্র মেরামতের সময় তার স্ত্রী বললো, তোমার এ প্রস্তুতি কিসের গো? হাম্মাস বললো, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি। একথা শুনে স্ত্রী বললো, আল্লাহর শপথ, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। হাম্মাস বললো, আল্লাহর শপথ, আমি আশা করি যে, তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে আমি তোমার দাস হিসেবে হাযির করতে পারব। ওরা যদি আজ মোকাবেলার জন্যে আসে, তবে ওদের মোকাবেলার জন্যে আমার কোন অজুহাত থাকবে না। পূণাঙ্গ হাতিয়ার রয়েছে। ধারালো বর্শা, দু’ধারি তলোয়ার। খান্দামার যুদ্ধে এ লোকটিও উপস্থিত হয়েছিলো।
যি-তুবায়
এদিকে রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররাজ জাহরান থেকে রওয়ানা হয়ে যি-তুবায় পৌঁছলেন। এ সময়ে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মর্যাদার কারণে বিনয় ও কৃতজ্ঞতায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  মাথা নীচু করে রেখেছিলেন। যি-তুবায় তিনি সৈন্য সমাবেশ করলেন। খালেদ ইবনে ওলীদকে  নিজের ডানদিকে রাখলেন। এখানে আসলাম, সোলায়েম, গেফার, মোজাইনা এবং কয়েকটি আরব গোত্র ছিলো। খালেদ ইবনে ওলীদকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন মক্কার ঢালু এলাকায় প্রবেশ করেন। খালেদকে বললেন, যদি কোরাইশদের কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাকে হ্ত্যা করবে। এরপর তুমি সাফায় গিয়ে আমার সাথে দেখা করবে।
হযরত যোবয়ের ইবনে আওয়ামকে বামদিকে রাখলেন। তাঁর হাতে ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ দিলেন, তিনি যেন মক্কার উঁচু এলাকা অর্থাৎ কোদায় প্রবেশ করেন এবং হাজুনে তাঁর দেয়া পতাকা স্থাপন করে তাঁর আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
পদব্রজে যারা এসেছিলেন তাদের পরিচালনা দায়িত্ব পালন করছিলেন হযরত আবু ওবায়দা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ দিলেন, তিনি যেন প্রান্তরের প্রান্তসীমার পথ অগ্রসর হন এবং মক্কায় তাঁরা অবতরণ করেন।
ইসলামী বাহিনীর মক্কায়  প্রবেশঃ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পাওয়ার পর সেনাপতিরা নিজ নিজ সৈন্যদের নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেলেন।
হযরত খালেদ এবং তাঁর সঙ্গীদের পথে যেসব পৌত্তলিক আসছিলো, তাদের সাথে মোকাবেলা করে তাদের হত্যা করা হলো। হযরত খালোদের সাথী কারয ইবনে জাবের ফাহরি এবং খুনায়েস ইবনে খালেদ ইবনে রবিয়া শাহাদাত বরণ করেন। এরা দু’জন সেনাদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের হত্যা করা হয়। খান্দামায় হযরত খালেদ এবং তাঁর সঙ্গীদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল কোরায়শরা মুখোমুখি হলো। কিছুক্ষণ উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হলো। এতে ১২ জন পৌত্তলিক নিহত হলো। এ ঘটনায় কোরায়শদের মনে আতঙ্ক ছেয়ে গেলো। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে সংকল্পবদ্ধ হাম্মাস ইবনে কয়েস দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার স্ত্রীকে বললো, দরোজা বন্ধ রাখো, খুলবে না। তার স্ত্রী বললো, আপনার সেই বাগাড়ম্বর গেলো কোথায়? হাম্মাস ইবনে কয়েস বললো, হায়রে,  সফওয়ান আর একরামা ছুটে পলায়ন করলো। নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করা হলো। সেই তলোয়ার গলা এবং মাথা এমনভাবে কাটছিলো যে, নিহতদের হৃদয়বিদারক চিৎকার এবং হৈহল্লা ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।
হযরত খালেদ (রা.) খান্দামায় শত্রুদের মোকাবেলার পর মক্কার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সাফায় ‍গিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হলেন।
এদিকে হযরত যোবয়ের (রা.) সামনে অগ্রসর হয়ে হাজুল-এর মসজিদে  ফতেহ-এর কাছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা স্থাপন করলেন এবং তাঁর অবস্থানের জন্যে একটি কোব্বা তৈরী করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করলেন।
বায়তুল্লায় প্রবেশ এবং মূর্তি অপসারণঃ
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আনসার ও মোহজেরদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে হারাম-বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করলেন। প্রথমে তিনি হাজরে আসওয়াদ চম্বুন করলেন। এরপর কাবাঘর তওয়াফ করলেন। সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে একটি ছড়ি ছিলো।
কাবাঘরের আশেপাশে এবং ছাদের ওপর সেই সময় তিনশত ষাটটি মূর্তি ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে সেসব মূর্তিকে গুঁতো দিচ্ছিলেন আর উচ্চারণ করছিলেন, সত্য এসছে, অসত্য চলে গেছে, নিশ্চয় অসত্য চলে যাওয়ার মতো।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতও তিনি উচ্চারণ করছিলেন, ‘সত্য এসেছে এবং অসত্যের চলাফেরা শেষ হয়ে গেছে।’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উটনীর উপর বসে তওয়াফ করলেন এবং এহরাম অবস্থায় না থাকার কারণে শুধু তওয়াফই করলেন। তওয়াফ শেষ করার পর হযরত ওসমান ইবনে তালহা (রা.)-কে ডেকে তাঁর কাছে থেকে কাবা ঘরের চাবি নিলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে কাবাঘর খোলা হলো। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন অনেকগুলি ছবি। এ সব ছবির মধ্যে হযরত ইবরাহীম এবং হযরত ইসমাইলের ছবিও ছিলো। তাঁদের হাতে ছিলো ভাগ্য গননার তীর। এ দৃশ্য দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা এই সব পৌত্তলিককে ধ্বংস করুন। আল্লাহর শপথ, এই দুই জন পয়গম্বর কখনোই গণনায়-এর তীর ব্যবহার করেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবাঘরের ভেতর কাঠের তৈরী একটি কবুতর ও দেখলেন। নিজ হাতে তিনি সেটি ভেঙ্গে ফেললেন। তাঁর নির্দেশে ছবিগুলো নষ্ট করে ফেলা হলো।
কাবাঘরে নামায আদায় এবং কোরায়শদের উদ্দেশ্যে ভাষণঃ
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভেতর থেকে  কাবাঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। হযরত উসামা এবং হযরত বেলাল ভেতরেই ছিলেন। দরজা বন্ধ করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দরজার মুখোমুখি দেয়ালের কাছে গিয়ে দেয়াল থেকে তিন হাত দূরে দাঁড়ালেন। এ সময় দুটি খাম্বা ছিলো বাম দিকে। একটি খাম্বা ছিলো ডানদিকে। তিনটি খাম্বা ছিলো পেছনে। সেই সময়ে কাবাঘরে ছয়টি খাম্বা বা খুঁটি ছিলো। এরপর তিনি সেখানে নামায আদায় করলেন। নামায শেষে তিনি কাবাঘরের ভেতরের অংশ ঘুরলেন। সকল অংশে তকবীর এবং তাওহীদের বাণী উচ্চারণ করলেন। এরপর পুনরায় কাবা ঘরের দরজা খুলে দিলেন। কোরায়শরা সামনে অর্থাৎ মসজিদে হারামে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলো। তারা অপেক্ষা করছিলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি করেন। দুহাতে দরজার দুই পাল্লা ধরে তিনি কোরায়শদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে তিনি বললেন, ‘আল্লহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্য করে দেখিয়েছেন। তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে তিনি একাই সকল বিরুদ্ধ শক্তিকে পরাজিত করেছেন। শোনো, কাবাঘরের তত্ত্বাবধান এবং হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া অন্য সকল সম্মান বা সাফল্য আমার এই দুই পায়ের নীচে। মনে রেখো, যে কোন রকমের হত্যাকান্ডের দায়িত্ব বা ক্ষতিপূরণ একশত উট। এর মধ্যে চল্লিশটি উট হতে গর্ভবতী।
হে কোরায়শরা, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের মধ্যে থেকে জাহেলিয়াত এবং পিতা ও পিতামহের অহংকার নিঃশেষ করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদমের সন্তান  আর আদম মাটি থেকে তৈরী। এরপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘হে মানুষ,আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে করে, তোমরা এক অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যানাসম্পন্ন, যে অধিক মোত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।
আজ কোন অভিযোগ নেইঃ
এরপর তিনি বললেন, হে কোরায়শরা, তোমাদের ধারণা, আমি তোমদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো? সবাই বললো, ভালো ব্যবহার করবেন, এটাই আমদের ধারণা। আপনি দয়ালু। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। এরপর তিনি বলেন, তাহলে আমি তোমাদেরকে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের বলেছিলেন, ‘লা তাছরিবা আলাইকুমুল ইয়াওমা।’ আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। তোমরা সবাই মুক্ত।
কাবাঘেরের চাবিঃ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এরপর মসজিদে হারামে বসলেন। হযরত আলীর হাতে ছিলো কাবাঘরের চাবি। তিনি বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাজীদের পানি পান করানোর মর্যাদার পাশাপাশি কাবাঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও আমাদের ওপর ন্যস্ত করুন। আল্লাহ তায়ালা আপনার ওপর রহমত করুন। অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী এই আবেদন হযরত আব্বাস জানিয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওসমান ইবনে তালহা কোথায়? তাঁকে ডাকে হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওসমান এই নাও চাবি। আজকের দিন হচ্ছে আনুগত্যের দিন। তবাকতে ইবনে সা’দ-এর বর্ণনা অনুযায়ী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই চাবি সব সময়ের জন্যে নাও। তোমাদের কাছ থেকে এ চাবি সেই কেড়ে নেবে যে যালেম। হে ওসমান (রা.), আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তার ঘরের তত্ত্বাধায়ক নিযুক্ত করেছেন। কাজেই রায়তুল্লাহ থেকে যা কিছু পাও, তা ভক্ষণ করবে।
কাবার ছাদে বেলালের আযানঃ
নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলালকে কাবার ছাদে উঠে আযান দেয়ার আদেশ দিলেন। সে সময় আবু সুফিয়ান ইবনে হরব, আত্তাব ইবনে আছিদ এবং হাবেছ ইবনে হেশাম কাবর আঙ্গিনায় বসেছিলো। সেখানে অন্য কেউ ছিলো না। আত্তাব বললো, আল্লাহ তায়ালা আছিদকে এ মর্যাদা দিয়েছেন যে, তাকে এই শুনতে হয়নি। নতুবা তাকে এক অপ্রতীকর জিনিস শুনতে হতো। একথা শুনে হারেস বললো শোনো, আল্লাহর শপথ, যদি আমি শুনতে পারি যে, তিনি সত্য তবে তার আনুগত্যকারী হয়ে যাব। আবু সুফিয়ান বললেন, দেখো, আমি কিছু বলব না। যদি কিছু বলি আল্লাহর শপথ, তবে এই পাথরের টুকরোগুলো ও আমার সম্পর্কে কবর দেবে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সামনে হাযির হয়ে বললেন, এ মাত্র তোমরা যা বলেছ, আমি সব জানি। এরপর তিনি তাদের কথা তাদের শোনালেন। এ বিস্ময়কর ঘটনায় হারেছ এবং আত্তাব বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিতেছি যে, আপনি আল্লাহর রসূল। আল্লাহর শপথ, আমাদের কথা শোনার মতো কেউ আমাদের সঙ্গে ছিলো না। আমরা বলছি যে, আপনাকে আমাদের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিজয় বা শোকরানার নামাযঃ
সেদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানি বিনতে আবু তালেবের ঘরে গিয়ে গোসল করলেন। এরপর সেখানে আট রাকাত নামায আদায় করলেন।
তখন ছিলো চশত-এর সময়। এ কারণে কেউ কবললো, এটা চাশত-এর নামায, কেউ বললো, ফতেহ বা বিজয়ের পর শোকরানার নামায। উম্মে হানি তার দু’জন দেবরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উম্মে হানি, তুমি যাদের আশ্রয় দিয়েছো, তাদের আমিও আশ্রয় দিলাম। একথা বলার কারণ ছিলো এই যে, উম্মে হানির দুই দেবরকে হযরত আলী (রা.) হত্যা করতে চাচ্ছিলেন। উম্মে হানি ছিলেন হযরত আলীর বোন। উম্মে হানি তার দুই দেবরকে লুকিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গেলে উম্মে হানি তকে দেবরদের সমস্যা সম্পর্কে বললে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
চিহ্ণিত কয়েকজন শত্রুঃ
মক্কা বিজয়ের দিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয়জন কুখ্যাত চিহ্নিত অপরাধীকে হত্যা তালিকায় অন্তভূক্ত করলে এদের ব্যাপারে বলা হয় যে, এরা কাবাঘরের পর্দার নীচে আত্মগোপন করলেও যেন হত্যা করা হয়। এরা হলো:
১. আবদুল ওজ্জা ইবনে খাতাল ২. আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবু ছারাহ ৩. একরামা ইবনে আবু জেহেল ৪. হারেছ ইবনে নুফায়েল ইবনে ওয়াহাব ৫. মাকিছ ইবনে ছাবাবা ৬. হাব্বার ইবনে আসওয়াদ ৭. ইবনে খাতালের দুই দাসী, যারা কবিতার মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদনাম রটাতো ৯. সারাহ সে ছিলো আবদুল মোত্তালেবের সন্তানদের একজন দাসী। সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুৎসা রটনা করতো অধিকিন্তু তার কাছেই মক্কায় প্রেরিত হাতেবের চিঠি পাওয়া গিয়েছিলো।
আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবু ছারাহকে হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.)  রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে তার প্রাণ ভিক্ষার সুপারিশ করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণভিক্ষা দিয়ে তার ইসলাম গ্রহণ মেনে নিলেন। কিন্তু এর আগে তিনি কিছুক্ষণ নীরব ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলিনে যে, ইতিমধ্যে কোন একজন সাহবী আবদুল্লাহকে হ্ত্যা করুক। কেননা এই লোকটি আগেও একবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলো কিন্তু পরে মোরতাদ অর্থাৎ ধর্মান্তরিত হয়ে মক্কায় পালিয়ে এসেছিলো। দ্বিতীয়বার ইসলাম গ্রহণের পর অবশ্য তিনি ইসলামের ওপর অটল অবিচল ছিলেন।
একরামা ইবনে আবু জেহেল ইয়েমেনের পথে পালিয়ে গিয়েছিলো। তার স্ত্রী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মঞ্জুর করলেন। এরপর সেই মহিলা স্বামীর পথের অনুসরণ করে তাকে ফিরিয়ে আনলো। একরামা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তার ইসলাম খাঁটি ইসলামই প্রমাণিত হয়েছিলো।
ইবনে খাতাল কাবাঘরের পর্দা ধরে ঝুলছিলো। একজন সাহবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস খবর দিলেন। তিনি বললেন, ওকে হত্যা করো। সেই সাহবী গিয়ে তাকে হত্যা করলেন।
মাকিছ ইবনে ছাবাবাকে হযরত নোমাইলা ইবনে আবদুল্লাহ হত্যা করলেন। মাকিছ প্রথমে মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু পরে ধর্মান্তরিত হয় এবং একজন আনসার সাহবীকে হত্যাও করে। এরপর মক্কায় মোশরেকদের কাছে ফিরে যান।
হারেছ মক্কায় রসূলকে নানাভবে কষ্ট দিতো। হযরত আলী (রা.) তাকে হত্যা করেন।
হাব্বাব ইবনে আসওয়াদ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা হযরত যয়নব (রা.)-কে তাঁর হিজরতের সময় এমন জোরে ধাক্কা মেরেছিলেন যে, তিনি হাওদায থেকে শক্ত প্রান্তরে গিয়ে পড়ে যান। এতে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। মক্কা বিজয়ের দিন এ লোকটি পালিয়ে যায়। পরে মুসলমান হয়ে ফিরে আসে। পরবর্তীতে তার ইসলামও যথার্থ প্রমাণিত হয়েছিল।
ইবনে খাতালের দুইজন দাসীর মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়। অন্যজনের জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রাণভিক্ষা করা হয় এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে।
হাতেবের পত্রবাহক সারাহর জন্যেও প্রাণভিক্ষা চাওয়া হয় এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে।
বাকি পাঁচজনের প্রাণভিক্ষা দেয়া হয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে।
 ইবনে হাজার লিখেছেন, যাদেরকে হত্যা তালিকায় রাখা হয়েছিলো তাদের প্রসঙ্গে আবু মা’শাব আরো একজনের নাম উল্লেখ করেন। সে হচ্ছে  হারেস ইবনে তালাল খযায়ী। হযরত আলী (রা.) তাকে হত্যা করেন।   ইমাম হাকেম এই তালিকায় কা’ব ইবনে যুহাইর-এর নামও উল্লেখ করেন। কা’ব এর ঘটনা বিখ্যাত। তিনি পরে এসে ইসলাম গ্রহণ করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন।  এই তালিকায় ওয়াহশী ইবনে হারব এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দ বিনতে ওতবার নামও ছিলো। তারা পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।  ইবনে খাতালের দাসী আরনবকে হত্যা করা হয়।  উম্মে সা’দকেও হত্যা করা হয়। ইবনে ইসহাক এরূপ উল্লেখ করেছেন। এই হিসাবে পুরুষদের সংখ্যা আট এবং মহিলাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়। এমনও হতে পারে যে, আরনব এবং উম্মে সা’দ একই দাসীর নাম। লকব এবং কুনিয়তের ক্ষেত্রেই শুধু পার্থক্য রয়েছে।
 সফওয়ান ইবনে উমাইয়াকে যদিও হত্যা তালিকায় রাখা হয় নাই কিন্তু বিশিষ্ট কোরায়শ নেতা হিসাবে তার মনে নিজের জীবনের আশঙ্কা ছিলো। এ কারণে সে পালিয়ে গিয়েছিলো। ওমায়ের ইবনে ওহাব জুহমি  রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাযির হয়ে তার নিরাপত্তার আবেদন জানান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিরাপত্তা দেন। নিরাপত্তার ‍নিদর্শন স্বরূপ তিনি ওমায়েরকে নিজের পাগড়ি প্রদান করেন। উল্লেখ্য মক্কায় প্রবেশের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পাগড়ি মাথায় দিয়েছিলেন। ওমায়ের সওয়ানের কাছে গেলেন। সে সময় সফওয়ান জেদ্দা থেকে থেকে ইয়েমেনে সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে নৌকায় আরোহণ করতে যাচ্ছিলেন। ওমায়ের সেখান থেকে সফওয়ানকে নিয়ে এলেন। রসূলুল্লাহর কাছে এসে সফওয়ান দুই মাসের সময় চাইলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চার মাস সময় দিলেন। এরপর সফওয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার স্ত্রী আগেই মুসলমান হয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়কে প্রথম বিয়ের ওপর অটুট রাখলেন।
 ফোযালা ছিলো অপরাধী। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তওয়াফ করার সময় সে তাঁকে হত্যার কুমতলবে তাঁর কাছে এসে দাঁড়ায়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার মনের ষড়যন্ত্রের কথা বলে দিলেন। এতে ফোযালার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সাথে সাথে সে পাঠ করলো লা-ইলাহা ইল্লাহল্লাহু মোহাম্মদুর রসূলুল্লাহ।
মক্কা বিজয়ের পরদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণঃ
মক্কা বিজয়ের পরদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দেয়ার জন্যে দাঁড়লেন। তিনি আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা করার পর বললেন, ‘হে লোকসকল, আল্লাহ তায়ালা যে তারিখে আসমান যমিন সৃষ্টি করেছিলেন সেদিনই মক্কাকে মর্যাদা সম্পন্ন শহর হিসেবে নির্ধারণ করেন। একারণে এই শহরের মর্যাদা কেয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে। আল্লাহ তায়ালা এবং রোজ কেয়ামতের ওপর বিশ্বাসী কোন মানুষের জন্যেই এই শহরে রক্তপান করা বা কোন গাছ কাটা বৈধ নয়। যদি কেউ প্রশ্ন তোলে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে রক্তপাত করেছেন তবে তাকে বলবে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তোমাদের সে অনুমতি দেয়া হয়নি। আর আমার জন্যে নির্দিষ্ট সময়েই রক্তপাত বৈধ করা হয়েছিলো। অতীতের যেমন এখানে রক্তপাত খুন খারাবি নিষিদ্ধ ছিলো ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। যারা এখানে উপস্থিত রয়েছে তারা অনুপস্থিতিদের এ খবর জানিয়ে দেবে।
এক বর্ণনায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে, এখানের কাঁটা যেন কাটা না হয়, শিকার যেন তাড়ানো না হয়, পথে পড়া পরিত্যক্ত জিনিস যেন তোলা না হয়। তবে, সেই ব্যক্তি তুলতে পারবে, যে সেই জিনিসের পরিচয় করাবে। এখানে ঘাস যেন তোলা না হয়। হযরত আব্বাস (রা.) ইযখির ঘাসের প্রসঙ্গ তুললে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ ইযাখির ঘাস তোলা যাবে। বনু খাযাআ গোত্রের লোকেরা সেদিন বনু খযাআ গোত্রের একজন লোককে হত্যা করেছিলো। রসূলে খোদা এ সম্পর্কে বললেন, খাযাআ গোত্রের লোকেরা তোমরা হত্যাকান্ড থেকে নিজেদের বিরত রাখো। হত্যাকান্ড যদি কল্যাণকর প্রমাণিত হতো, তবে আগেই হতো। অনে হত্যাকান্ড ঘটেছে। তোমরা এমন একজন লোককে হত্যা করেছো, যার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই আমি আদায় করবো। এখন থেকে কেউ যদি লোককে হত্যা করে তবে নিহত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন ইচ্ছা করলে ঘাতকদের কাউকে হত্যা করতে পারবে আর ইচ্ছা করলে ক্ষতিপূরণ নিতে পারবে।
এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণার পর আবু শাহ নামে ইয়েমেনের একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনার এই ঘোষণা আমার জন্যে লিখিয়ে দিন। তিনি লিখে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ১০[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ.২২,২১৬]
আনসারদের সংশয়ঃ
মক্কা বিজয়ের পর আনসাররা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাতৃভূমি অধিকার করার পর কি মক্কায় থাকবেন? সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতে হাত তুলে দোয়া করছিলেন। দোয়া শেষ করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে কি কথা বলাবলি করছিলে?’ আনসাররা অস্বীকার করলেন। বার বার জিজ্ঞাসার পর তারা নিজেদের সংশয়ের কথা জানালেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর পানাহ, এখন জীবন মরণ তোমাদের সাথে।
বাইয়্যাতঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানদের মক্কা বিজয় দেয়ার পর মক্কার অধিবাসীদের সামনে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারা বুঝতে পারলো যে, ইসলাম ব্যতীত সাফল্যের কোন পথ নেই। এ কারণে ইসলামের অনুসারী হওয়ার উদ্দেশ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে বাইয়াতের জন্যে হাযির হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফার ওপরে বসে লোকদের কাছ থেকে বাইয়াত নিতে শুরু করলেন। হযরত ওমর (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীচে ছিলেন এবং লোকদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করছিলেন। উপস্থিত লোকেরা এ মর্মে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হলো যে, তারা যতোটা সম্ভব তাঁর কথা শুনবে এবং মেনে চলবে।
তাফসীরে মাদারেকে উল্লেখ রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের পর মহিলাদের কাছ থেকেও বাইয়াত নেন। হযরত ওমর (রা.) নীচে ছিলেন এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে বাইয়াত নিচ্ছিলেন, মহিলাদের তাঁর কথা শোনাচ্ছিলেন।
সে সময় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দা ভিন্ন পোশাকে হাযির হলেন। আসলে হযরত হামযার (রা.) লাশের সাথে তিনি যে আচরণ করেছিলেন সে কারণে ভীত ছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনে ফেলেন কিনা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে বাইয়াত নিচ্ছিলেন যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। হযরত ওমর (রা.) সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে বললেন, মহিলারা তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তোমরা চুরি করবে না। একথা বলার পরই হেন্দা বললো, আবু সুফিয়ান আস্ত কৃপণ, আমি যদি তার ধন-সম্পদ থেকে কিছু নেই , তখন কি হবে? আবু সুফিয়ান সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন, তুমি যা কিছু নেবে সেসব তোমার জন্যে হালাল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন। এরপর বললেন, আচ্ছা তুমি কি হেন্দা? আবু সুফিয়ানের স্ত্রী বললো, হাঁ, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যা কিছু হয়ে গেছে, সেসব মাফ করে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাকে মার্জনা করুন।’
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যেনা করবে  না। একথা শুনে হেন্দা বললেন, স্বাধীন কোন নারীর কি যেনা করতে পারে? এরপর তিনি বললেন, নিজের সন্তানকে হত্যা করবে না। হেন্দা বললেন, শৈশবে আমি তাদের লালন-পালন করেছি, বড় হওয়ার পর আপনার লোকেরা তাদের হত্যা করেছে। কাজেই তাদের বিষয়ে আপনি এবং তারা ভালো জানেন।
উল্লেখ্য, হেন্দার পুত্র হানযালা ইবনে ইবু সুফিয়ান বাদরের যুদ্ধের দিনে নিহত হয়েছিলো। হেন্দার কথা শুনে হযরত ওমার (রা.) হেসে কুটি ‍কুটি হলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- ও হাসলেন।
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কারো নামে অপবাদ দেবে না। হেন্দা বললেন, আল্লাহর শপথ, অপবাদ বড় খারাপ জিনিস। আপনি প্রকৃতই হেদায়ত এবং উন্ন চরিত্রের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোন স্তিরিকৃত বিষয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানি করবেন না। হেন্দা বললেন, আল্লাহর শপথ, এই মজলিসে  আমি মনে  এমন ভাব নিয়ে বসিনি যে, আপনার নাফরমানী করবো।
এরপর ফিরে এসে হেন্দা তার বাড়ীর মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললো। মূর্তি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হেন্দা বলছিলেন, ‘তোমাদরে ব্যাপারে আমরা ধোঁকার মধ্যে ছিলাম।’১১[মাদাবেকুত তানযিল।]
মক্কায় নবী (স.)-এর অবস্থানঃ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় উনিশ দিন অবস্থান করেন। এই সময়ে ইসলাম শিক্ষা, তাকওয়া ও হেদায়াত সম্পর্কে পথ নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সেই সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে আবু উছয়েদ খাযারি (রা.) নতুন করে হরম শরীফের খুঁটি স্থাপন করলেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লিখিত সময়ে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ছারিয়্যা অর্থাৎ ছোট ধরনের সেনাদল প্রেরণ করলেন। এমনি করে সকল মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে একজন ঘোষণা করলেন যে, কেউ যদি আল্লাহ তায়ালা এবং আখেরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন নিজের ঘরে মূর্তি না রাখে, বরং মূর্তি যেন ভেঙ্গে ফেলে।
সেনাদল এবং প্রতিনিধি দল প্রেরণঃ
১. মক্কা বিজয়ের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ম হিজরীর রমযানের ২৫ তারিখে খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি ছারিয়্যা প্রেরণ করেন। ওযযা নির্মূল করতে এ অভিযান প্রেরণ করা হয়। ওযযা ছিলো নাখালায়। কোরায়শ এবং সমগ্র বনু কেনানা গোত্র  এ মূর্তির পূজা করতে। এটি ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় মূর্তি। বনু শায়বান গোত্র এ মূর্তির তত্ত্বাবধান করতো। হযরত খালেদ ত্রিশ জন সওয়ারী সৈন্যসহ নাখলায় গিয়ে এ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। ফিরে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালেদকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু দেখেছ? তিনি বলেন, কই না তো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বললেন, তবে তো তুমি মূর্তিই ভাঙ্গতে পারোনি?
হযরতে খালেদ পুনরায় নাঙ্গা তলোয়ার উঁচিয়ে গেলেন। এবার তিনি দেখলেন তাঁর দিকে এক কালো নগ্ন মাথা ন্যাড়া মহিলা এগিয়ে আসছে। হযরত খালেদ এরপর তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। এতে সেই মহিলা দুই টুকরো হয়ে গেলো। হযরত খালেদে এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসে খবর দিলেন। তিনি বলেলেন, হাঁ সেই ছিলো ওযযা। এবার সে তোমাদের দেশে পূজার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে।
২. এরপর সেই মাসেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  সোয়া নামক অন্য একটি মূর্ত ধ্বংস করতে আমর ইবনু আসকে পাঠালেন। এটা ছিলো মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে। রেহাত এলাকায় বনু হোযাইল গোত্র এর পূজা করতো। হযরত আমর সেখানে যাওয়ার পর পুরোহিত বললো, তুমি কি চাও? তিনি বলেলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে এ মূর্তি ধ্বংস করতে এসেছি। পুরোহিত বললো, তুমি সেটা পারবে না। তিনি বললেন, কেন? পুরোহিত বললো, অদৃশ্য থেকে তোমাকে বাধা দেয়া হবে। তিনি বললেন, তোমার জন্যে আফসোস। এই মূর্তি কি দেখতে পায়? শুনতে পায়? তুমি এখনো মিথ্যার ওপর রয়েছো? এরপর তিনি মূর্তি ভেঙ্গে সঙ্গীদের মূর্তিঘরে অনুসন্ধান চালাতে বললেন। কিন্তু কোন জিনিস পাওয়া গেলো না। হযরত আমরের নির্দেশে মূর্তিঘরও ধ্বংস করে দেয়া হলো। এরপর তিনি পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করলেন কি, কেমন বুঝলে, পুরোহিত বললো, আমি লা শারিক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম।
৩. সেই মাসেই হযরত সা’দ ইবনে যায়েদ আশহালির নেতৃত্বে বিশজন সৈন্য প্রেরণ করা হলো। এরা মানাত মূর্তি ধ্বংস করতে গেলেন। কোদায়েদের কাছে মাশাল নামক এলাকায় এ মূর্তি ছিলো। গাসসান, আওস  এবং খাযরাজ গোত্রে এর পূজা করতো। হযরত সা’দ সেখানে পৌছার পর পুরোহিত বললো, কি চাও? তিনি বললেন মানাতকে ধ্বংস করতে চাই।
পুরোহিত বললো, তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে। হযরত সা’দ লক্ষ্য করলেন, বীভৎস চেহারার কালো ন্যাড়া মাথা এক মহিলা বেরিয়ে এসেছে। সে বুক চাপেড়াতে চাপড়াতে সে হায় হায় করছিলো। পুরোহিত বললো, মানাত তোমার কিছু নাফরমানকে ধারো। ইত্যবসরে হযরত সা’দ তলোয়ার দিয়ে মানাতকে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। এরপর মূর্তিঘর ধ্বংস করা হলো। কিন্তু সেখানে কোন কিছু পাওয়া গেলো না।
৪. ওজ্জা ধ্বংস করে ফিরে আসার পর সেই মাসেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালেদ (রা.) কে বনু জাজিমার কাছে পাঠালেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। হযরত খালেদ (রা.) মোহজের আনসার এবং বনু সালিম গোত্রের সাড়ে তিন শত লোক নিয়ে রওয়ান হলেন। বনু জাজিমা গোত্রের কাছে পৌঁছে তারা ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তার ‘আসলামনা ’ অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম বলার পরিবর্তে বললো, ছাব্বানা ছাব্বানা অর্থাৎ আমরা নিজেদের দ্বীন ত্যাগ করলাম। এতে হযরত খালেদ তাদের হত্যা এবং গ্রেফতার শুরু করলেন। তারপর  একজন করে বন্দীকে নিজের প্রত্যেক  সঙ্গীর কাছে দিয়ে তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং তাঁর সঙ্গীরা  সেনাপতির আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস এ ঘটনা উল্লেখ করা হলো । তিনি দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দুই বার বললেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা খালেদ যা ‍কিছু করেছে, আমি তা থোকে তোমার কাছে পানাহ চাই।’ ১২[সহীহ বোখারী, ১ম, খন্ড, পৃ.৪৫০]
হযরত খালেদের নির্দেশে বনু সালিম গোত্রের লোকেরা নিজেদের বন্দীদের হত্যা করেন। আনসার এবং মোহাজেররা তাদের বন্দীদের হত্যা করেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনার পর হযরত আলী (রা.)-কে পাঠিয়ে নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং তাদের অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করেন। এই ঘটনায় হযরত খালেদ এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)-এর মধ্যে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। এ খবর শোনার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খালেদ, থামো, আমার সাথীদের কিছু বলা থেকে বিরত হও। আল্লাহর শপথ, যদি ওহুদ পাহাড় সোনা হয়ে যায় এবং তার সবটুকু ‍তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করো তবু আমার সাথীদের মধ্যে কারো এক সকাল বা এক বিকেলের এবাদাতের সমমর্যাদাতেও তুমি পৌঁছুতে পারবে না। ১৩[ইবনে হিশাম, সহীহ বোখারী, ফতহুল বারী, সহীহ মুসলিম, যাদুল মায়াদ।]
মক্কা বিজয়ের যুদ্ধই ছিলো প্রকৃত মীমাংসা কারী যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয়ই ছিলো প্রকৃত বিজয়, যা মোশরেকদের শক্তিমত্তা ও অহংকারকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিলো। আরব উপদ্বীপে শেরক বা মূর্তিপূজার আর কোন অবকাশই থাকলো না। কেননা মুসলমান ও মোশরেক ছাড়া সাধারণ শ্রেণীর মানুষরা অত্যন্ত কৌতুহলের সঙ্গে ব্যাপারটি দেখতে চাচ্ছিল যে, এই সংঘাতের পরিণতিটা কি রূপ নেই। সাধারণ মানুষ এটা ভালভাবেই জানতো যে, যে শক্তি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, কেবলমাত্র সেই শক্তির কাবার ওপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সক্ষম হবে। তাদের বিশ্বাসকে অধিক বলীয়ান করেছিলো অর্ধশতাব্দী পূর্বে সংঘটিত আবরাহা ও তার হস্তী বাহিনীর ঘটনা। আল্লাহর ঘরের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে অগ্রসরমান হস্তীবাহিনী কিভাবে ধ্বংস নিচিহ্ন হয়েছিলো তা তৎকালীন আরববাসীরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলো।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিলো মক্কা বিজয়ের সূচনা বা ভূমিকা স্বরূপ। এ সন্ধির ফলে শান্তি ও নিরাপত্তার ঝর্ণা চারিদেকে প্রবাহিত হচ্ছিলো। মানুষ একে অন্যের সাথে খোলাখুলি আলাপ করার সুযোগ পাচ্ছিলো। ইসলাম সম্পর্কে তারা মতবিনিময় ও তর্ক বিতর্ক করছিলো। মক্কায় যেসব লোক গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তারাও দ্বীন সম্পর্কে মত বিনিময়ের সুযোগ পেলো। ফলে বহু লোক ইসলামে দীক্ষিত হলো। ইতিপূর্বে বিভিন্ন যু্দ্ধে মুসলমানদের  সংখ্যা তিন হাজারের বেশী ছিলো না। অথচ মক্কা বিজয়ের সময় তাদের সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার।
এ সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধে লোকদের দৃষ্টি খুলে গেলো। তাদের চোখের ওপর পড়ে থাক সর্বশেষ পর্দাও অপসারিত হলো। দ্বীন ইসলাম গ্রহণের পথে আর কোন বাধাই রইল না। মক্কা বিজয়ের পর মক্কার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আকাশে মুসলমানদের সূর্য চমকাতে লাগলো। দ্বীনী কর্তৃত্ব দুনিয়াবী অধিপত্য উভয়েই পুরোপুরি মুসলমানদের হাতে এসে গেলো।
হোদয়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানদের যে অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো মক্কা বিজয়ের পর তা পূর্ণতা লাভ করলো। পরবর্তী অধ্যায় ছিলো শুধু মুসলমানদের জন্যে এবং পরিস্থিতি ছিলো মুসলমানদের একক নিয়ন্ত্রণে। এরপর আরবদের বিভিন্ন গোত্রের সামনে একটা পথই খোলা ছিলো তারা প্রতিনিধিদলসহ গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর বাস্তবে পরবর্তী দু’বছর ধরে একাজই চলেছিলো।
সূত্রঃ- আর-রাহিকুল মাখতুম
২৮ তম খন্ড

No comments

Powered by Blogger.