নবী পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। রাসূল (সাঃ) এর জীবনী। ৩৩তম খন্ড

(১) হযরত খাদিজা (রা)
হিজরতের আগে মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার ছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর সমন্বয়ে গঠিত। এই বিয়ের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঁচিশ এবং বিবি খাদিজার বয়স ছিলো চল্লিশ বছর। হযরত  খাদিজা (রা.) ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথমা স্ত্রী। তাঁর জীবদ্দশায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য কোন বিয়ে করেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তানদের মধ্যে হযরত ইবরাহিম ছাড়া অন্য সবাই ছিলেন বিবি খাদিজার গর্ভজাত। পুত্রদের মধ্যে কেউ জীবিত ছিলেন না। তবে কন্যারা জীবিত ছিলেন। তাঁদের নাম হচ্ছে হযরত যয়নব, হযরত রোকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম এবং হযরত ফাতেমা (রা.)। যয়নবের বিয়ে হিজরতের আগে তাঁর ফুফাত ভাই হযরত আবুল আস ইবনে রবির সাথে হয়েছিলো। রোকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমের বিয়ে পর্যায়ক্রমে হযরত ওসমান (রা.) এর সাথে হয়েছিলো। হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে বদর ও ওহুদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.)-এর সাথে হয়। তাঁদের চার সন্তান হলেন হযরত হাসান, হযরত হোসাইন, হযরত যয়নব এবং উম্মে কুলসুম (রা.)।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের চেয়ে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন।তিনি বিভিন্ন উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে চারটি বিয়ে করার অনুমতি পান,একথা সকলেরই জানা আছে। যে সকল মহিলার সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁদের সংখ্যা ছিল এগারো। নবী (স.)-এর ইন্তেকালের সময় তাদের নয়জন জীবিত ছিলেন। দু’জন তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। এঁরা হচ্ছেন হযরত খাদিজা এবং উম্মুল মাসাকিন হযরত যয়নব বিনতে খোজায়মা (রা.)। এছাড়া অন্য দু’জন মহিলার সথেও তিনি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়েছিলো কিনা সে ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, উল্লিখিত দু’জন মহিলাকে তাঁর কাছে রোখসত করা হয়নি। নীচে আমরা হযরত খাদিজার পর নবী সহধর্মিনীদের নাম এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পর্যায়ক্রমে তুলে ধরছি।
(২) হযরত সওদা বনতে জামআ
বিবি খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের কয়েকদিন পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের দশম বছরের শাওয়াল মাসে এ বিধবার সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। উল্লেখ্য এর আগে হযরত সওদা তাঁর চাচাতো ভাই সাকরান ইবনে আমবের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
(৩) হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.)
নবুয়তের একাদশ বর্ষের শাওয়াল মাসে তাঁর সথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়। অর্থাৎ হযরত সওদার বিয়ের এক বছর পর  এবং হিজরতের দুই বছর পাঁচ মাস আগে। সে সময় হযরত আয়েশার বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর। হিজরতের সাত মাস পরে শওয়াল মাসের পয়লা তারিখে হযরত আয়েশাকে স্বামীর বাড়ীতে পাঠানো হয়। সে সময় নয় বছর এবং তিনি ছিলেন কুমারী। হযরত আয়েশা (রা.) ব্যতীত অন্য কোন কুমারী মেয়েকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করেননি। হযরত আয়েশা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী। উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞান সম্পন্ন ফকীহ।
(৪) হযরত হাফসা বিনতে ওমর (রা.)
তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন খুনায়েস ইবনে হাযাফা সাহমি (রা.)। বদর ও ওহুদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তার স্বামী ইন্তেকাল করেন।এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেসরা হিজরী সালে তাঁর সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন।
(৫)হযরত যয়নব বিনতে  খোযায়মা (রা.)
তিনি ছিলেন বনু হেলাল ইবনে আমের ইবনে সাআসাআর সাথে সম্পর্কিত। গরীব মিসকিনদের প্রতি তাঁর অসামান্য মমত্ববোধ এবং ভালোবাসার কারণে তাঁকে উম্মুল মাসাকিন উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-এর স্ত্রী। জঙ্গে ওহুদে উক্ত সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চতুর্থ  হিজরীতে তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। আট মাস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী থাকার পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
(৬) উম্মে সালমা হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া (রা)
তিনি আবু সালমা (রা.) এর স্ত্রী ছিলেন। চতুর্থ  হিজরীর জমাদিউস সানিতে তিনি বিধবা হন। একই হিজরী সালের শওয়াল মাসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।
(৭) যয়নব বিনতে জাহাশ ইবনে রিয়াব (রা.)
তিনি ছিলেন বনু আছাদ ইবনে খোযায়মা গোত্রের মহিলা এবং রসূলে খোদার ফুফাতো বোন। তাঁর বিয়ে প্রথমে হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)-এর হয়েছিলো। হযরত যায়েদকে মনে করা হতো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলে। কিন্তু হযরত যায়েদের সাথে যয়নবের  বনিবনা হয়নি, ফলে হযরত যায়েদ তাঁকে তালাক দেন। যয়নবের ইদ্দত শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন এই আয়াত নাযিল করেন। ‘অতপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করলো, তখন আমি তাকে আপনার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম। (সূরা আহযাব, আয়াত,৭)
এ সম্পর্কে সূরা আহযাবে আরো কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছে। এসব আয়াতে পালক পুত্র সম্পর্কিত বিতর্কের সুষ্ঠ ফয়সালা করে দেয়া হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা পরে করা হবে। হযরত যয়নবের সাথে পঞ্চম হিজরীর জিলকদ মাসে বা এর কিছু আগে রসূলের বিয়ে হয়।
(৮) যুয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রা.)
তার পিতা ছিলেন খোযআ গোত্রের শাখা বনু মুস্তারিকের সর্দার। বনু মুস্তারিকের যুদ্ধবন্দীদের সাথে হযরত জুয়াইরিয়াকেও হাযির করা হয়। তিনি হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস ইবনে শাম্মাস (রা.)-এর ভাগে পড়েছিলেন। হযরত ছাবেত (রা.) শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তি দেয়ার কথা জানান। শর্ত হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর জানার পর হযরত জুয়াইরিয়ার পক্ষে থেকে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করে তার মুক্তির ব্যবস্থা করে তাকে বিয়ে করেন। এট পঞ্চম হিজরীর শাবান মাসের ঘটনা।
(৯) উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান (রা.)
তিনি ছিলেন উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী। স্বামীর সাথে হিজ করে তিনি হাবশা অর্থাৎ আবিসিনিয়া গমন করেন। সেখানে যাওয়ার পর উবায়দুল্লাহ ধর্মান্তরিত হয়ে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়।কিন্তু উম্মে হাবিবা নিজের ধর্ম বিশ্বাস ও হিজরতে ওপর অটল থাকেন। সপ্তম হিজরীর মহররম মাসে রসূল (স.) আমার ইবনে উমাইয়া জামিরিকে একখানি চিঠিসহ আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে প্রেরণ করেন। সে চিঠিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। নাজ্জাশী উম্মে হাবিবার সম্মতি সাপেক্ষে রসূল (স.) এর সাথে তার বিয়ে দেন এবং তাকে শরহাবিল ইবনে হাসানার সথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করেন।
(১০)হযরত সফিয়া বিনত হুয়াই (রা.)
তিনি ছিলেন বনু ইসারাইল সম্প্রদায়ের এবং তিনি খয়বরে বন্দী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিজের পছন্দ করায় মুক্ত করে বিয়ে করেন। সপ্তম হিজরীতে খয়বর বিজয়ের পর এ ঘটনা ঘটে।
(১১) হযরত মায়মুন বিনতে হারেস (রা.)
তিনি ছিলেন উম্মুল ফযল লোবাবা বিনতে হারেসের বোন। সপ্তম হিজরীর যিলকদ ‘মাসে ওমরায়ে কাযা’ শেষ করে এবং সঠিক কথা অনুযায়ী এহরাম থেকে হালাল হওয়ার পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ে করেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত ১১জন মহিলাকে বিয়ে করেন। অন্য দু’জন মহিলা যাদেরকে তাঁর কাছে রোখসত করা হয়নি তাদের একজন বনু কেলাব গোত্রের এবং অন্যজন কেন্দাহ গোত্রের অধিবাসী ছিলেন। কেন্দহ গোত্রের এ মহিলার সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়েছিলো কিনা এবং তাঁর প্রকৃত নাম ও বংশ পরিচয় কি সে সম্পর্কে সীরাত রচয়িতাদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। সেসব উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
দাসীদের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু’জন দাসী ছিলেন। এদের একজন হচ্ছেন মারিয়া কিবতিয়া। মিসরের শাসনকর্তা মোকাওকিস তাকে উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। তার গর্ভ থেকে রসূল (স.) এর সন্তান  হযরত ইব্রাহিম জন্ম নেন। তিনি দশম হিজরীর ২৮ অথবা ২৯শে শওয়াল মোতাবেক ৬৩২ ঈসায়ী সালের ২৭শে জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন।
অন্য একজন দাসীর নাম ছিলো রায়হানা, তিনি বনু নাযির বা বনু কোরায়যা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। বনু কোরায়যা গোত্রের যুদ্ধবন্দীদের সাথে মদীনায় আসেন। রসূল (স.) রায়হানাকে পছন্দ করে পছন্দ করে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তাঁর সম্পর্কে গবেষকদের ধারণা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মুক্ত করে বিয়ে করেন। আল্লামা ইবনে কাইয়েম লিখেছেন যে, রায়হানাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাসী হিসাবেই রেখেছিলেন। আবু ওবায়দা লিখেছেন, উল্লিখিত দু’জন দাসী ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরো দুজন দাসীও ছিলো, এদের একজন দাসীকে নবী সহধর্মিনী হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেবা করে দেন। ১[দেখুন যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ-২৯]
এখানে আমরা রসূল খোদান এর জীবনের একটি বিশেষ দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা খুবই প্রয়োজন মনে করছি। যৌবনের এক বিরাট অংশ অর্থাৎ প্রায় তিরিশ বছরকাল তিনি মাত্র একজন স্ত্রীর সাথে অতিবাহিত করেন। তাও তিনি ছিলেন এমন এক স্ত্রী, যাকে বলা হয় প্রায় বৃদ্ধা। তার মৃত্যুর পর আরেজন বৃদ্ধা মহিলাকে বিয়ে করেন। প্রথমে হযরত খাদিজা এরপর হযরত সওদা (রা.)। এভাবে জীবন কাটানোর পর বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর হঠাৎ করে কি তাঁর মধ্যে যৌনশক্তি এতো বেড়ে গিয়েছিলো যে, তাকে এতোগুলো বিয়ে করতে হলো? নায়ুযুবিল্লাহ তা নয়। নবী জীবনের উল্লিতি দু’টি অধ্যায়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো মানুষই এমন অপবাদ দিতে পারবে না।আসলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বিশেষ বিশে উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতেই এতোগুলো বিয়ে করেছিলেন। সাধারণ বিয়ের নির্দিষ্ট সংখ্যার উদ্দেশ্যের চাইতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য ছিলো অনেক মহৎ।
এর ব্যাখ্যা এই যে,রসূল (স.)হযরত আয়েশা এবং এবং হযরত হাফসাকে বিয়েকরে হযরত  আব বকর এবং হযরত ওমরের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছিলেন। একই ভাবে হযরত ওসমান (রা.)-এর হাতে পরপর দুই কন্যাকে তুলে দিয়ে এবং হযরত আলীর সাথে প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমার বিয়ে দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত চারজন সাহবীর সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হন। কেননা উক্ত চারজন সাহাবী ইসলামের  ক্রান্তিকালে ইসলামের সৈনিকা হিসাবে অতুলনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় দিয়েছিলেন। ইসলামের জন্যে তাঁদের সেবা ও আত্মত্যাগের ঘটনা তো সবার জানা।
আরবের নিয়ম ছিলো যে, তারা আত্মীয়তার সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জামাতা সম্পর্ক আরবদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। জামাতার সাথে যুদ্ধ করাকে তার মনে করে লজ্জাজনক। এই নিয়মের করণে রসূলে খোদা বিভিন্ন গোত্রের ইসলামের প্রতি শত্রুতার শক্তি খর্ব করতে বিভি্ন গোত্রের মহিলাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, হযরত উম্মে সালমা ছিলেন বনু মাখযুম গোত্রের অধিবাসী। এই গোত্রের অধিবাসী ছিলো আবু জেহেল এবং খালেদ ইবনে ওলীদ। এই গোত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর খালেদ ইবনে ওলীদের মধ্যে ইসলামের প্রতি তেমন প্রবল শত্রুতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং কিছুকাল পর তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এমনিভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করার পর আবু সুফিয়ান ইসলামের শত্রুতা করলেও কখনো রসূলে খোদার সামনে আসেননি। হযরত যোয়াইরিয়া এবং হযরত সফিয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিয়ে পর বনু মুস্তালেক এবং বনু গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয়। এই দু’টি গোত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর এরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
হযরত যোয়াইরিয়া তো তাঁর গোত্রের মধ্যে সকল মহিলার চেয়ে অধিক বরকতসম্পন্ন বলে বিবেচিত হন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ে করার পর সাহাবায়ে কেরাম উক্ত গোত্রের একশত যুদ্ধবন্দী পারিবারকে বিনাশর্তে মুক্তি দেন। তারা বলছিলেন যে, এরা তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুর পক্ষের লোক। গোত্রের লোকদের মনে এই দয়ার অসামান্য প্রভাব পড়েছিলো।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মানসিক পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা করে সভ্যতা-সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। ওরা ছিলো সভ্যতা-সংস্কৃতির সকল উপায় উপকরণ এবং সমাজ বিকাশের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। যে সকল নীতির ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গড়ে তোলা দরকার ছিলো তার ক্ষেত্রে নারা-পুরুষ ভেদাভেদ করার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ভেদাভেদমুক্ত চিন্তাধারার আলোকে মহিলাদের সরাসরি শিক্ষা দেয়াও সম্ভব ছিলো না। অথচ তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কোন অংশেই পুরুষদের চেয়ে কম ছিলো না বরং বলা যায় বেশীই ছিলো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এ উদ্দেশ্যের একটি পথই খোলা ছিলো, তা হচ্ছে  বিভিন্ন বয়স ও যোগ্যতার মহিলাদের মনোনীত করা এবং তাদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বৃহত্তর উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন করা। মনোনীত মহিলাদেরকে তিনি শিক্ষা দিতে এবং মানসিক পরিশুদ্ধি ঘটাতে পারবেন। তাদের  শরীয়তের হুকুম-আহকাম শেখাবেন। তাছাড়া তাদেরকে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি এমনভাবে শিক্ষা দেবেন যাতে করে তারা গ্রাম ও শহরের যুবতী বৃদ্ধা নির্বিশেষে সকল মহিলাকে শরীয়তের বিধি-বিধান শেখাতে পারেন। ফলে মহিলাদের মধ্যে তাবলীগে দ্বীনের পূর্ণতা লাভ করবে।
এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করি যে, দাম্পত্য জীবন তথা পারিবারিক জীবনের রীতিনীতি শিক্ষা দিতে উম্মুল মোমেনীনরা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষত যাঁরা দীর্ঘায়ু হয়েছিলেন তার এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ বেশী পেয়েছিলেন। যেমন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কথা উল্লেখ করা যায়।  তিনি নবী জীবনের কথা ও কাজের বর্ণনা ব্যাপকভাবে উল্লেখ করেছেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিষয় জাহেলী যুগের রীতি-নীতি নস্যাৎ করে দিয়েছিলো।  আরব সমাজে এইকুসংস্কার যুগ যুগ ধরে চলে আসছিলো। নিয়ম ছিলো যে, পালকপুত্র হিসাবে কাউকে গ্রহণ করলে সে আসল পুত্রের মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে। এই নিয়ম আরব সমাজে এমন দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে বসেছিলো যে, তা বিলোপ করা মোটেই সহজ ছিলো না। অথচ এই নিয়ম ইসলামের বিয়ে, তালাক, সম্পত্তি আইন এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে ছিলো মারাত্মকভাবে সংঘাতপূর্ণ। এছাড়া জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার এমন সব নির্লজ্জ কার্যকলাপ এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিলো যে, সেসব থেকে সমাজদেহকে মুক্ত করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত যয়নব বিনতে জাহশের বিয়ে করান।
উল্লেখ্য হযরত যয়নব প্রথমে হযরত যায়েদের স্ত্রী ছিলেন। আর যায়েদ ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালকপুত্র। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় হযরত যায়েদ স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিলো সে সময়ের কথা যখন সকল কাফের ছিলো আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। কাফেররা সেই সময় খন্দকের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এদিকে পালকপুত্র বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্যে আল্লাহর নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধারণা করলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক দেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যদি যায়েদের পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিয়ে করতে হয় তাহলে বিধর্মীরা সুযোগা পাবে। মোনাফেক মোশরেক এবং ইহুদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে প্রবল প্রোপাগান্ডা শুরু করবে ও সরল প্রাণ মুসলমানদের মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এ চেষ্টাই করলেন যেন হযরত যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক না দেন। এতে যায়েদের স্ত্রীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে করার প্রশ্নও উঠবে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এটা পছন্দ করলেন না। আল্লাহ তায়ালা তার রসূলের প্রতি রুঢ় বক্তব্য সম্বলিত এই আয়াত নাযিল করলেন, ‘স্মরণ কর, আল্লাহ তায়ালা যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছো তুমি তাকে বলছিলে, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছো আল্লাহ তায়ালা তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন, তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত।’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৭)
অবশেষে হযরত যায়েদ হযরত যয়নবকে তালাক দেন। এরপরে ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তখন হযরত যয়নবকে বিয়ে করতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি নিজ ফয়সালা জানিয়ে দেন। আল্লাহ তায়ালা তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে এই বিয়ে অত্যাবশ্যকীয় করেন। দেরী করার কোন অবকাশ রাখা হয়নি। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য এরূপ, ‘অতপর যায়েদ যখন তার সাথে বিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলো তথন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে মোমেনদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিয়ে ছিন্ন করলে সেই সব রমণীকে বিয়ে করা মোমেনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৭)
এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, পারিতপুত্রের ব্যাপারে জাহেলী যুগের রীতিনীতি তথা বদ্ধমূল কুসংস্কারের মুলোৎপাটন। এর আগেই কোরআনের আয়াতে এই কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওদের ডাকো ওদের পিতৃ পরিচয়ে, আল্লাহর দৃষ্টিতে এটাই ন্যায় সঙ্গত।’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৫)
আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘মোহাম্মদ তোমাদের মধ্যেকার পুরুষদের কারো পিতা নন, বরং তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খাতামুন নবী।’
এখানে একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, সমাজ জীবনে কোন রেওয়াজ বদ্ধমূল হয়ে গেলে তখন শুধুমাত্র কথা দিয়ে তার মূলোউৎপাটন করা যায় না। সেই রেওয়াজের পরিবর্তন সাধনের জন্যে শুধু কথাই যথেষ্ট নয় বরং যিনি পরিবর্তন চান তাকে কাজের মাধ্যমে বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে হয়। এপর্যায়ে একটা উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় মুসলামনদের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা প্রকাশ পেয়েছিলো তার দ্বারা প্রকৃত সত্য উপলদ্ধি করা যায়। সেই সময়ে মুসলমাদের নিবেদিত চিত্ততা ছিলো বিস্ময়কর। ওরওয়া ইবনে মাসউদ ছাকাফি লক্ষ্যে করেছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখের থুথু কফ মুসলমানরা মাটিতে পরতে দিচ্ছিলেন না। কেউ না কেউ হাত পেতে নিচ্ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওযু করার সময়ে পরিত্যক্ত পানি গ্রহণের জন্যে সাহাবাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেতো। এই সাহাবারাই বাইয়াতে রেদোয়ানের সময় গাছের ছায়ায় মৃত্যুবরণ করা এবং পলায়ন না করার জন্যে বাইয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করছিলেন, এসব সহাবাদের মধ্যে হযরত আবু বকর এবং হযরত ওমরের মতো বিশিষ্ট সহাবারাও ছিলেন। এসব সহাবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে জীবন দেয়াও তার জন্যে বেঁচে থাকাকে সৌভাগ্য এবং সাফল্য মনে করছিলেন। অথচ হোদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সহাবাদের বললেন তাদের নিজ নিজ কোরবানীর পশু যবাই করতে, তখন কেউ সাড়া দিলেন না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ভীষণ মনোকষ্টে ভুগছিলেন। নবীপত্নী হযরত উম্মে সালমা (রা.) তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরামর্শ দিলেন যে, আপনি নিজের কোরবানীর পশূ চুপচাপ যবাই করুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই করলেন। সাহাবরা তখন রসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণের জন্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলেন। তারা ছুটে গিয়ে নিজেদের  কোরবানীর পশু যবাই করলেন। এঘটনা  থেকে স্পষ্টতই একথা বোঝা যায় যে, প্রচলিত নিয়মের পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে কথা ও কাজের পার্থক্য কতো বেশী।  আর জাহেলী যুগের প্রচলিত পালিতপুত্র বিষয়ক জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যেই আল্লাহ তায়ালা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালিত পুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে দেন।
এ বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর মোনাফেকরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। তারা নানা ধরণের গুজব রটাতে থাকে । এর কিছুটা প্রভাব সরলপ্রাণ মুসলমানদের ওপরও এসে পড়ে। এ প্রোপাগান্ডাকে শক্তিশালী করতে মোনাফেকরা শরীয়তের একটি যুক্তিও খুঁজে নেয়। তারা প্রচার করে যে, ইসলাম চারটি বিয়ে বৈধ করেছে অথচ রসূল তার পালিত পুত্র যায়েদের তালকাপ্রাপ্তা স্ত্রীকে পঞ্চম স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। একজন মুসলমানের জন্যে চারের বেশী গ্রহণ তো ইসলামেই বৈধ নয়। প্রচার-প্রোপাগান্ডার মূল বিষয় ছিলো এই যে, হযরত যাযেদ তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালিতপুত্র, নিজের পালিতপুত্রের স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাতো নির্লর্জতাপূর্ণ ঘৃণ্য কাজ। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবে উল্লিখিত উভয় বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে আয়াত নাযিল করেন। সাহাবারা তখন বুঝতে পারেন যে, ইসলোমে পালিতপুত্রেরে কোন মূল্য নেই। এছাড়া আল্লাহ  মহৎকোন উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতেই  নিজ রসূলকে বিয়ের সংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যাপকতা দিয়েছেন। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অন্য কাউকে দেয়া হয়নি।
উম্মাহাতুল মোমেনীনদের সাথে প্রিয় নবী অত্যন্ত অভিজার্ত্যপূর্ণ, সম্মানজক  উচ্চ পর্যায়ের এবং উন্নত জীবন যাপন করেন। নবী সহধর্মিনীরা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সেবা পরায়নতা, স্বামীর অধিকার পূরণ ইত্যাদি সকল বিষয়েই ছিলেন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারিণী। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড়ই নীরস নির্বিলাস জীবন যাপন  করতেন। সে জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা অন্যদের মোটেই সহজ ছিলো না।
হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি জানিনা যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ময়দার নরম রুটি খেয়েছেন। এমন করেই তিনি আল্লাহর সাথে মিলিত হয়েছেন। এছাড়া  তিনি কখনো ভূনা করা বকরি চোখে দেখেননি। ২[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৯৫৬]
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)বলেন, দুই দুই মাস কেটে যেতো, তৃতীয় মাসের চাঁদ দেখা যেতো অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের চুলোয় আগুন জ্বলতো না। হযরত ওরওয়া জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আপনারা কি খেতেন? তিনি বললেন ব্যস, দুটি কালো জিনিস। খেজুর এবং পানি। ৩[একই পৃষ্ট, একই গ্রন্থ]
এই বিষয়ে হাদিস বহু রয়েছে। এমন  কঠোর দারিদ্রতা সত্তেও নবী সহধর্মিনীদের কোন আপত্তিকর আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি।
সহজাত স্বভাব দূর্বলতার কারণে একবা কিছু ক্রটি হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন ছিলো। একারণে এই আয়াত নাযিল হয়, ‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদের বলে দাও, তোমরা যদি পার্থিব জীবন  ও তার ভূষণ কামন করো তবে এসো আমি তোমাদের ভোগ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদের বিদায় দিই। আর যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রসূল ও আখেরাতের কামনা করো তবে তোমাদের মধ্যে যার সৎকর্মশীল, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। ’(সূরা আহযাব, আয়াত-২৮-২৯)
নবী সহধর্মীনীরা সকলেই আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদা এ থেকেই, অনুমান করা যায়, তাদের মধ্যে কেউই দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েননি ।
সতীনদের মধ্যে যেসব ঘটনা সচরাচর প্রকাশ পায়, নবী সহধর্মীনীরা অধিক সংখ্যক হওয়া সত্তেও ওই ধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। সামান্য কিছু ঘটে থাকলেও যখন সাবধান করে দেয়া হয়েছে তখন কারো পক্ষ থেকেই প্রশ্ন তোলার মত কোন ঘটনা প্রকাশ পায়নি।সূরা তাহরীমের প্রতম পাঁচটি আয়াতে এই সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।
পরিশেষে একথা বলা অসমীচীন হবে না যে, এখানে আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের সংখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করি না। কেননা এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী সোচ্চার হচ্ছে পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা। তারা কি ধরনের জীবন যাপন করছে? দুর্ভাগ্যও তিক্ততার শিকার তারা অহরহ হচ্ছে। অবমাননাকর জীবন যাপন এবং অপরাধের মধ্যে তারা আগাগোড়া ডুবে আছে। স্ত্রীদের সংখ্যাধিক্যের নীতি থেকে মুখ ফিরিয়েও এ ব্যাপারে সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে তারা যে দুঃখ,কষ্ট ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে , সে ব্যাপারে কি আলোচনায় কোন প্রয়োজন আছে?৪[একাধিক স্ত্রীর তুলনায় একাধিক গার্লফ্রেন্ড কি অধিক রুচিসম্মত] তাদের দুর্ভাগ্যজনক জীবন যাপন পদ্ধতি দেখেই প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী সংখ্যাধিক্যের ইসলামী নীতি বিজ্ঞান সম্মত। জ্ঞানী, গুণী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকাদের জন্যে  এতে রয়েছে চমৎকার মীমাংসা
সূত্রঃ- আর-রাহিকুল মাখতুম

No comments

Powered by Blogger.