বদরের যুদ্ধ। রাসূল সাঃ এর জীবনী। ১৬ তম খন্ড

ইসলামের প্রথম সিদ্ধান্তকর সামরিক অভিযান
উশায়রায় গৃহীত সামরিক অভিযানের বর্ণনায় আমরা উল্লেখ করেছি যে, কোরায়শদের এটি বাণিজ্য কাফেলানমক্কা থেকে সিরিয়ায় যাওয়ায় পথে অল্পের জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহীত অভিযান থেকে রক্ষা পায়। এই  কাফেলাই সিরিয়া  থেকে মক্কায় ফেরার পথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরেকটি উদ্যোগ গ্রহন করেন। হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ এবং সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা.)-কে কাফেলা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে উত্তর দিকে পাঠানো হয়। উভয় সাহাবী প্রথমে হাওরা নামক স্থানে পৌছে অবস্থান নিয়ে আবু সুফিয়ানের বাণিজ্যের কাফেলার অতিক্রমের অপেক্ষায় থাকেন। ঐ কাফেলা সেই স্থান অতিক্রমের সাথে সাথে সাহাবাদ্বয় দ্রুতবেগে মদীনায় ছুটে গিয়ে এ সম্পর্কে রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করেন।

এই কাফেলায় মক্কাবাসীদের অনেক সম্পদ ছিলো। এক হাজার উঠের পিঠে পঞ্চাশ হাজার দীনারের বিভিন্ন ব্যবসায়িক জিনিসপত্র ছিলো। পঞ্চাশ হাজার দীনার হচ্ছে দুশো সাড়ে বাষট্রি কিলোগ্রাম সোনার তূল্য। এসব জিনিসের হেফাযতে কাফেলায় মাত্র ৪০ জন লোক ছিলো।
মদীনাবাসীদের জন্যে এটা ছিলো সুবর্ণ সুযোগ। পক্ষন্তরে এসব জিনিস থেকে বঞ্চিত হওয়া মক্কাবাসীদের জন্যে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতি হয়ে দেখা দেবে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার মুসলমানদের মধ্যে  ঘোষনা করলেন যে, কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা বহু সম্পদ নিয়ে আসছে। এই কাফেলার উদ্দেশ্যে তোমরা বেরিয়ে পড়ো। এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা সমুদয় সম্পদ তোমাদের গণিমতের মাল হিসাবে প্রদান করবেন।
ঘোষনা প্রচার করা হলেও এত যোগদান বাধ্যতামূলক ছিলো না। বিষয়টি ব্যক্তিগত উৎসাহ উদ্দীপনা এবং আগ্রহের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো। কেননা ঘোষনার সময় ধারণা করা যায়নি যে, কাফেলার পরিবর্তে বদরের প্রান্তরে কোরায়শদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে। এরূপ ধারণা না থাকায় বহু সংখ্যক সাহাবী মদীনায় থেকে যান। তারা মনে করেছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই অভিযান অতীতের অভিযানের মতোই হবে। এসব কারণেই এই যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেনি, তাদের সমালোচনাও করা হয়নি।
ইসলামী বাহিনীর সংখ্যা ও দ্বায়িত্বভার
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের উদ্দেশ্যে রওয়ানাকালে তাঁর সঙ্গে তিনশতের কিছু বেশী সংখ্যক সাহাবী ছিলেন। এ সংখ্যা কারো মতে ৩১৩, কারো মতে ৩১৪ এবং কারো মতে ৩১৭। এদের মধ্যে ৮২, মতান্তরে ৮৩, মতান্তরে ৮৬ জন ছিলেন মোহাজের, বাকী সকলেই আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আওস আর ৭০ জন খাযরাজ গোত্রের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। এরঅ যুদ্ধের জন্যে তেমন কোন প্রস্তুতিও নেননি। সমগ্র সেনাদলে ঘোড়া ছিলো মাত্র ২ টি। একটি হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.)-এর অন্যটি হয়রত মেকদাদ ইবনে আসওয়াদ কিন্দি (রা.)-এর। ৭০টি উট ছিলো, প্রতিটি উটে দুই বা তিনজন পর্যায়ক্রমে আরোহণ করছিলেন।
একটি উটে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আলী (রা.) এবং হযরত মারশাদ ইবনে আবু মারশাদ গানাভির পালাক্রমে আরোহন করছিলেন।
মদীনার ব্যবস্থাপনা এবং নামাযে ইমামতির দ্বায়িত্ব প্রথমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-এর উপর ন্যস্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাওহা নামক জায়গায় পৌছে হযরত আবু লোবাবা আবদুল মানযার (রা.)-কে মদীনার ব্যবস্থাপক হিসাবে প্রেরণ করেন। সেনাবিন্যাস এভাবে করা হয়েছিলো যে, একদল ছিলো মোহাজের এবং অন্য দল আনসারদের। মোহাজেরদের পতাকা হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) এবং আনসারদের পতাকা হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) বহন করছিলেন। উভয দলের সম্মিলিত পতাকা ছিলো সাদা। এই পতাকা বহনের দ্বায়িত্ব হযরত মোসায়াব ইবনে ওমায়ের আবদীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। অধিনায়ক ছিলেন ডান দিকের হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.), আর বাম দিকে হযরত মেকদাদ ইবনে আমর (রা.)। সমগ্র বাহিনীতে এই দু’জন ছিলেন সর্বাধিক রণনিপুণ। হযরত কয়েস ইবনে আবি সা’আ (রা.)-কেও অন্যত্তম অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। প্রধান সিপাহসালারের দ্বায়িত্ব রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে গ্রহন করেন।
বদর অভিমুখে অগ্রযাত্রা
রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অসম্পূর্ণ সেনাদলকে সঙ্গে নিয়ে মদীনা থেকে মক্কাভিমুখী প্রধান সড়ক ধরে ‘বিয়ে রাওহা’ (রাওহা কূপ)-তে গিয়ে উপনীত হন। সেখান থেকে আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মক্কার রাস্তা বামদিকে রেখে ডানদিকের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। এই পথে তিনি প্রথমে নাযিয়াহ এবং পরে রাহকান উপত্যকা অতিক্রম করেন। পরে সাফরার মেঠোপথ ধরে এক সময় দররাহ প্রান্তরে উপনীত হন। সাফর-এ উপনীত হওয়ার পর স্থানীয় জুহাইনা গোত্রের দু’জন লোককে কোরায়শদের কাফেলার খবর সংগ্রহে বদর প্রান্তরে প্রেরণ করেন। এরা ছিলো বাশিশ ইবনে ওমর এবং আদী ইবনে আবু যাগবা।
মক্কায় বিপজ্জনক অবস্থার খবর প্রেরণ
কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলার নেতৃত্বে ছিলো আবু সুফিয়ান্ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সে অগ্রসর হচ্ছিলো। সে জানতো যে, মক্কার রাস্তা ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে প্রতিটি কাফেলার কাছে পথের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতো। আবু সুফিয়ান চলতি পথেই খবর পেল যে, মদীনায় মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরায়শদের কাফেলার ওপর হামলা করার জন্যে দাওয়াত দিয়েছেন। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে আবু সুফিয়ান জামজাম ইবনে আমর গেফারীকে মোটা অর্থের বিনিময়ে মক্কায় প্রেরণ করলে সে মক্কা পৌছে বাণিজ্য কাফেলার হেফাযতে মক্কাবাসীদের উদ্বুদ্ধ করে। জামজাম অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মক্কায় পৌছে আবরদের রীতি অনুযায়ী উটের পিঠে দাঁড়িয়ে নিজের পোশাক ছিঁড়ে চিৎকার করে জরুরী সংবাদ জানালো। সে বললো, কোরায়শরা শোনো, কাফেলা, কাফেলা। তোমাদের যেসব ব্যবসায়িক জিনিস আবু সুফিয়ানের কাছে রয়েছে, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীরা সেই সব জিনিসের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার বিশ্বাস, তোমরা ওদের পেয়ে যাবে। সাহায্য-সাহায্য-সাহায্য।
যুদ্ধের জন্যে মক্কাবাসীদের প্রস্তুতি
বিপদের খবর শুনে মক্কার বিশিষ্ট লোকেরা চারিদিক থেকে ছুটে আসলো। তারা বলছিলো, মোহাম্মদ বুঝি মনে করেছেন যে, আবু সুফিয়ানের কাফেলাও ইবনে হাদরামির কাফেলা মতো। না মোটেই তা নয়। আমাদের ব্যাপারটা যে অন্যরকম, এটা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। মক্কায় সক্ষম লোকদের মধ্যে প্রত্যেকেই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহন করলো। কেউ নিজে প্রস্তুত হলো, কেউ বা নিজের পরিবর্তে অন্য কাউকে প্রেরণ করলো। মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আবু লাহাব ব্যতীত অন্য কেউই এ যুদ্ধে যোগদানের প্রস্তুতি থেকে বাদ পড়েনি। আবু লাহাব নিজের পরিবর্তে তার কাছ থেকে ন্ঝণ গ্রহীতা একজন লোককে প্রেরণ করলো। আশেপাশের বিভিন্ন গোত্রের যুবকদেরও কোরায়শরা সেনাদলে ভর্তি করলো। কোরায়শী গোত্রসমূহের মধ্যে একমাত্র বনু আদী ব্যতীত অন্য কোন গোত্র পেছনে থাকেনি। বনু আদী গোত্রের কেউ এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি।
শত্রু বাহিনীর সংখ্যা
প্রথমদিকে মক্কার বাহিনীর সংখ্যা ছিলো তেরোশ। এদের কাছে একশত ঘোড়া এবং ছয়শত বর্ম ছিলো। উটের সংখ্যা ছিলো অনেক, সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি।
সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলো আবু জেহেল ইবনে হিশাম। কোরায়শদের নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তি খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহন করেন্ একদিন নয়টি, অন্যদিন দশটি এভাবে উট যবাই করা হতো।
মক্কার সেনাদল রওয়ানা হওয়ার সময় হঠাৎ কোরায়শদের মনে পড়লো যে, বনু বকর গোত্রের সাথে তাদের শত্রুতা ও যুদ্ধ চলছে। এরা তো পেছন থেকে তাদের ওপর হামলা করতে পারে। এতে তারা তো দুই আগুনের মাঝখানে পড়ে যাবে! এ প্রসঙ্গে আলোচনা পর্যালোচনার ফলে কোরায়শদের সামরিক অভিযান স্থগিত হওয়ার উপক্রম হলো। ঠিক সেই সময় অভিশপ্ত ইবলিশ বনু কেনানা গোত্রের সর্দার ছোকরা ইবনে মালেক ইবনে জাশাম মাদলাজির চেহারা ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে কোরায়শ নেতাদের বললো, আমি তো তোমাদের বন্ধু। বনু কেনানা তোমাদের অনুপস্থিতিতে আপত্তিকর কোন কাজই করবে না, তোমাদের এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
শত্রুদের অগ্রযাত্রা
মক্কার সৈন্যবাহিনী অতপর পথে বেরিয়ে পড়লো। কিভাবে বেরোলো? আল্লাহ তায়ালা বলেন, লোকদের নিজেদের শান দেখিয়ে আল্লাহর পথ থেকে বিরত করে গর্ভভরে এগিয়ে চললো্ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওরা বেরোলো নিজেদের অস্ত্র শস্ত্র, আল্লাহর প্রতি বিরক্তি এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অসন্তুষ্টি নিয়ে। তারা প্রতিশোধ গ্রহণের ক্রোধে অধীর হয়ে উঠেছিলো। তারা দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিলো, মোহাম্মদ এবং সাহাবাদের মক্কার বাণিজ্য কাফেলার প্রতি চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো কি করে?
মোটকথা খুবই দ্রুতগতিতে তারা উত্তর দিকে অর্থাৎ বদর প্রান্তরের  দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। উসফান এবং কুদাইদ প্রান্তর অতিক্রম করে তারা যোহাফা নামক জায়গায় পৌছেুলো। সেখানে আবু সুফিয়ানের প্রেরিত নতুন এক খবর পাওয়া গেল যে, আপনারা কাফেলা  এবং নিজেদের সম্পদ রক্ষল জন্যে বেরিয়ে ছিলেন, আল্লাহ যেহেতু সব কিছু হেফাযত করেছেন, কাজেই আপনাদের আর প্রয়োজন নেই, আপনারা এবার ফিরে যান।
বাণিজ্য কাফেলার অন্তর্ধান
আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যাওয়ার সময় খুবই সতর্কতার সাথে পথ চলছিলো। চারিদিকের খোঁজ খবর সংগ্রহ করে পরিস্থিতির ওপর নযর রাখছিলো। বদর প্রন্তরের কাছাকাছি পৌছার পর কিছুটা সামনে এগিয়ে মাজদি ইবনে আমরের সাখে সাক্ষাৎ করে এবং তার কাছ মদীনার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। মাজদি বললো, তেমন কিছু তা চোখে পড়েনি, তবে দুইজন লোক দেখেছি। তারা পাহাড়ী টিলার কাছে উট বসিয়েছে, এরপর কুয়া থেকে পানি তুলে চলে গেছে। আবু সুফিয়ান এগিয়ে যেয়ে উটের পরিত্যক্ত মল পরীক্ষা করে খেজুরের বীচি পরীক্ষা করে বললো, নিসন্দেহে এই খেজুর ইয়াসরেবের। একথা বলা পরপরই সে নিজের কাফেলার কাছে ছুটে গেলো এবং পশ্চিম দিক নিয়ে সমুদ্র সৈকত ধরে পথ চলতে শুরু করলো। বদর প্রান্তরে যাওয়ার প্রধান সড়ক বাঁ দিকে পড়ে রইল। এমনি করে আবু সুফিয়ান তার বাণিজ্য কাফেলা মদীনার বাহিনীর কবলে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করলো। নিরাপদ পথে মক্কাভিমুখে যাওয়ার সময়ে আবু সুফিয়ান মক্কা থেকে আগত সৈন্যদের খবর পাঠালো যে, তোমরা ফিরে যাও। বাণিজ্য কাফেলা আক্রান্ত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই, আমি নিরাপদে মক্কা ফিরে যাচ্ছি।
শত্রু বাহিনীর অনৈক্য ও মতবিরোধ
এই খবর পেয়ে মক্কার সাধারণ সৈন্যরা ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলো। কিন্তু আবু জেহেল রুখে দাঁড়ালো। নিতান্ত অহংকারের সাথে বললো, খোদার কসম, বদর প্রান্তরে গিয়ে তিনদিন অবস্থান না করে আমরা ফিরে যাব না। এই সময়ে উট যবাই করবো, লোকদের ডেকে এনে আহার করাব, মদ পান করবো, দাসীরা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যে গান গাইবে। এর ফলে সমগ্র আরবে আমাদের এই সফরের খবর ছড়িয়ে পড়বে এবং চিরকালের জন্যে সবার মনে আমাদের সফর বিবরণী উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আখনাস ইবনে শোরাইক নামে একজন বিশিষ্ট নেতা আবু জেহেলকে বললেন, চলো আমরা মক্কায় ফিরে যায়। কিন্তু তার কথায় আবু জেহেল কর্ণপাত করল না। আখনাস না পেরে বনু যোহারা গোত্রের লোকসহ তার অনুসারী তিনশত সৈন্য নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন। বনু যোহারা গোত্রের কোন লোক বদরের যুদ্ধের অংশ নেয়নি। পরবর্তী সময়ে বনু যোহরা গোত্র আখনাস ইবনে শোরাইকের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করলো এবং তার মর্যাদা সেই গোত্রে স্থায়ীভাবে বসে গেলো।
বনু যোহারা গোত্রের লোকেরা ফিরে যাওয়ার পর বনু হাশেম গোত্রের আবু জেহেল ক্রুদ্ধকন্ঠে বললো, আমাদের ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত অন্য কেউ ফিরে যেতে পারবে না।
বনু যোহরা গোত্রের লোকদের ফিরে যাওয়ার পর আবু জেহেলের সঙ্গে এক হাজার লোক থাকলো। তারা বদর প্রান্তর অভিমুখে রওয়ানা হলো। বদর প্রান্তরে পৌছে তারা পাহাড়ী টিলার পেছনে তাঁবু স্থাপন করলো। এই টিলা বদরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত।
মুসলিম বাহিনীর জন্যে নাযুক পরিস্থিতি
মদীনার দূতের মাধ্যমে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীরা জাফরান প্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। তিনি কোরায়শদের সম্পর্কে বিশদ খবর পাওয়ার পর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে পারলেন যে, কোরায়শদের সাথে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উটেছে। কাজেই এখন সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ মক্কার বাহিনীকে যদি বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হয়, তবে পরিণামে কোরায়শদের দাপট বেড়ে যাবে এবং তাদের জয় জয়কার মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হবে। এতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপত্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের আওয়ায দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ইসলাম হয়ে পড়বে প্রাণহীন ও শক্তিহীন। ইসলামের শত্রুরা এবং ইসলাম সম্পর্কে যারা ভালোভাবে জনা ও বোঝার সুযোগ পায়নি, তারা ইসলামের প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণ করবে এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামের শত্রুতায় নেমে পড়বে।
তাছাড়া মক্কার উন্মক্ত সৈন্যরা মদীনা অভিমুখে যে রওয়ানা হবে না, তাঁরও কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। তারা মদীনায় গিয়ে মুসলমানদের ঘরে প্রবেশ করে অত্যাচার নির্যাতন করার সুযোগও হাতছাড়া করতো না। মদীনার বাহিনী যদি কিছুমাত্র শিথিল মনোভাব পোষণ করতো এবং মোকাবেলা না করে শান্তিরক্ষার চিন্তায় মদীনায় ফিরে যেতো, তবে উল্লিখিত সব কিছুই হয়ে উঠতো অবধারিত। তাছাড়া কাফেরদের বিনা চ্যালেঞ্জ ছেড়ে দিলে ইসলামের গৌরব ও মর্যাদার ওপর মন্দ প্রভাব পড়তো।
মজলিসে শুরার বৈঠক
পরিস্থিতির আলোকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজলিশে শূরার বৈঠক আহব্বান করলেন। বৈঠকে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সেনা অধিনায়ক এবং সাধারণ সৈন্যদের মতামত নেয়া হয়। কিছুসংখ্যক মুসলমান রক্তাক্ত সংঘর্ষের কথা শুনে কাঁপতে শুরু করে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘এটি এরূপ যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে ন্যায়ভাবে তোমার গৃহ থেকে বের করেছিলেন অথচ বিশ্বাসীদের একদল তা পছন্দ করেনি। মনে হচ্ছিলো কারা যেন মৃত্যুর দিকে চালিত হচ্ছে, আর তারা যেন তা প্রত্যক্ষ করছে।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ৫-৬)
নেতাদের মতামত চাওয়া হলো। হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত উমর (রা.) চমৎকার মনোভাব প্রকাশ করলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নিবেদিত চিত্ততার পরিচয় তাঁদের কথার মাধ্যমে ফুটে উঠলো। এরপর উঠে দাঁড়ালেন হযরত মেকদাদ ইবনে আমর (রা.)। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে যে পথ দেখিয়েছেন, তার ওপর আপনি অবিচল থাকুন আমরা আপনার সঙ্গে রয়েছি। আল্লাহর শপথ, বনী ইসরাঈল হযরত মূসা (আ .)-কে যে ধরনের কথা বলেছিলো, আমরা আপনাকে ওরকম কথা বলব না। উল্লেখ্য বনী ইসরাঈল হযরত মূসা (আ .)-কে বলেছিলো, ‘হে ‘মূসা, তারা যতোদিন সেখানে থাকবে, ততোদিন আমরা সেখানে প্রবেশই করবো না।সুতরাং তুমি আর তোমার প্রতিপালক যাও এবং যুদ্ধ করো, আমরা এখানে বসে থাকবো।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৪)
বরং আমরা বলবো ‘আপনি এবং আপনার পরওয়ারদেগার লড়াই করুন, আমরাও আপনার সাথে লড়বো। সেই মহান সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আপনি যদি আমাদের বারকে গেমাদ পর্যন্তও নিয়ে যান, তবুও আমরা সারা পথ লড়াই করতে করতে আপনার সাথে সেখানে পৌছুবো।
হযরত মেকদাদ (রা.)-এর কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশংসা করে কার জন্যে দোয়া করলেন।
মোহাজেরদের মতামত নেয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের মতামত নেয়া প্রয়োজন মনে করলেন। কারণ আনসাররাই ছিলো সংখ্যায় বেশী। যুদ্ধের দায়দ্বায়িত্ব তাদের উপরই বেশী ন্যস্ত হবে। অথচ বাইয়াতে আকাবার আলোকে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার জন্যে তারা বাধ্য ছিলো না। হযরত আবু বকর, হযরত ওমর এবং হযরত মেকদাদ (রা.)-এর মতামত শোনার পর প্রিয় নবী আনসারদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও। আনসারদের অধিনায়ক হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) বললেন,’হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাদের মতামত জানতে চেয়েছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হাঁ। হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য বললেন, আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি, আপনাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছি। আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, সবই সত্য আমরা আপনার আনুগত্যের জন্যে আপনার সাথে অঙ্গীকার করেছি। কাজেই আপনি যা ভালো মনে করেন, সেদিকে অগ্রসর হউন। সেই আল্লাহর শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আপনি যদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান, তবে আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজন লোকও পেছনে পড়ে থাকবে না। আগামীকাল আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমাদের মনে কোন প্রকার দ্বিধাদন্দ্ব নেই। আমরা রণনিপুণ। এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাধ্যমে এমন বীরত্বের প্রকাশ ঘটাবেন, যা দেখে আপনার চক্ষু শীতল হয়ে যাবে। আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের যাত্রা পথে বরকত দিন।
এক বর্ণনায় এরূপ উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, আপনি সম্ভবত ভাবছেন যে, আনসাররা নিজেদের এলাকায় আপনাকে সাহায্য করবে এবং এটাকেই দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করে। এ কারণেই আমি আনসারদের পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছি এবং বলছি। বস্তুত আপনি যেখানে চান চলুন, যার সাথে ইচ্ছা সম্পর্ক স্থাপন করুন। আমাদের অর্থ-সম্পদের যতটা ইচ্ছা গ্রহণ করুন। যতোটুকু গ্রহণ করবেন, সেটা আমাদের কাছে পরিত্যক্ত অংশের চেয়ে অধিকতর পছন্দনীয় হবে। এ ব্যাপারে আপনার ফায়সালা আমরা চুড়ান্ত বলে মেনে নিবো। আল্লাহর শপথ, আপনি যদি সামনে অগ্রসর হয়ে বার্কে গেমাদ পর্যন্ত যান, তবুও আমরা আপনার সঙ্গে যাব। আর যদি আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলেও আমরা আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো।’
হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.)-এর একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব খুশী হলেন। তিনি বললেন, চলো এবং আনন্দের সাথে চলো। আল্লাহ তায়ালা আমার সাথে দুইটি দলের মধ্যে একটির ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর শপথ, আমি যেন বধ্যভূমি দেখতে পাচ্ছি।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাফরান থেকে সামনে অগ্রসর হলেন। কয়েকটি পাহাড়ী মোড় অতিক্রম করে তিনি আসফের নামক জায়গায় পৌছুলেন। হেমান নামক পাহাড় ডানদিকে রেখে পরে তিনি বদর প্রান্তরের কাছাকাছি এসে তাঁবু স্থাপন করলেন।
গোপনে সংবাদ সংগ্রহের উদ্যোগ
এখানে অবতরণের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ‘গারে ছুরের’ সাথী হযরত আবু বকর (রা.)- কে নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে বেরোলেন। দূর থেকে মক্কার সৈন্যদের তাঁবু পর্যবেক্ষন করছিলেন। এমন সময় আরবের একজন বৃদ্ধের দেখা পেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোরায়শ এবং মোহাম্মদের সাহাবীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। উভয় বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসার কারণ ছিলো এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু বুড়ো বেঁকে বসলেন। বললেন, আপনারা নিজেদের পরিচয় দিন, আপনারা কোন দলের অন্তর্ভূক্ত সেকথা বলুন, অন্যথায় আমি কিছু বলব না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনার কাছে যা জানতে চেয়েছি, আপনি আমাদের বলুন, এরপর আমারা আপনাকে নিজেদের পরিচয় দেবেো। বৃদ্ধ বললেন, মোহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীরা যদি আমাকে সত্য কথা জানিয়ে থাকে, তবে আজ  তাদের অমুক জায়গায় থাকার কথা। একথা বলে বৃদ্ধ ঠিক সেই জায়গার কথা উল্লেখ করলো, যেখানে সাহাবারা আবস্থান করছিলেন। বৃদ্ধ আরো বললেন, কোরায়শ অমুক দিন বেরিয়েছে। সংবাদ বাহক যদি আমাকে সত্য কথা জানিয়ে থাকে, তবে কোরায়শদের আজ  অমুক জায়গায় থাকার কথা। এ কথা বলে বৃদ্ধ ঠিক সেই জায়গারই উল্লেখ করলো, যেখানে আবু জেহেল এবং তার সঙ্গীরা অবস্থান করছিলো।
বৃদ্ধ কথা শেষ করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সঙ্গীর পরিচয় জানতে চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরলেন, আমরা একই পানি থেকে উদ্ভুত। এ কথা বলেই চলে এলেন। বৃদ্ধ বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘কোন পানি থেকে? ইরাকের পানি থেকে?’
মক্কার বাহিনী সম্পর্কে গুরত্বপূর্ণ তথ্য
সেইদিন শেষ বিকেলে শত্রুদের অবস্থান ও অন্যান্য খবর সংগ্রহের জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদল গুপ্তচর প্রেরণ করলেন। এই দলে ছিলেন মোহাজেরদের তিনজন নেতা। এরা হলেন, হযরত আলী (রা.), হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) এবং হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)। এই তিনজন বিশিষ্ট সাহাবী অন্য কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে কোরায়শ বাহিনীর খবর সংগ্রহ করতে বেরোলেন। প্রথমে তারা বদরের জলাশয়ের কাছে গেলেন। সেখানে দুইজন ক্রীতদাস কোরায়শ বাহিনীর জন্যে পানি তুলছিলো। সাহাবীরা তাদের পাকড়াও করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন নামায আদায় করছিলেন। সাহাবারা গ্রেফতারকৃত ক্রীতদাসদের কাছে কোরায়শদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বললো, আমরা কোরায়শদের লোক। তারা আমাদের পানি তুলে নেয়ার জন্য পাঠিয়েছে। সাহাবাদের এই জবাব পছন্দ হলো না। তারা ধারণা করেছিলেন যে, এরা আবু সুফিয়ানের লোক হবে। কেননা এদের মনে এখনো একটা ক্ষীণ আশা ছিলো যে, বাণিজ্য কাফেলা অধিকার করা যাবে। সাহাবারা উভয় ক্রীতদাসকে মারাত্বক প্রহার করলেন। প্রহারের চোটে ওরা বাধ্য হয়ে বললো, হাঁ আমরা আবু সুফিয়ানের লোক। একথা শুনার পর প্রহারকারীরা প্রহার বন্ধ করলো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায শেষে সাহাবাদের রুক্ষভাবে বললেন, ওরা যখন সত্য কথা বলছিলো তখন তোমরা তাদের প্রহার করেছো আর যখন মিথ্যা কথা বলেছে তখন ছেড়ে দিয়েছো। আল্লাহর শপথ, এরা উভয়েই সত্য কথা বলেছে। ওরা কোরায়শদেরই লোক।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর ক্রীতদাসদের বললেন, আচ্ছা তোমরা এবার আমাকে কোরায়শদের সম্পর্কে কিছু বলো। তারা বললো, প্রান্তরের শেষ সীমায় যে টীলা দেখা যাচ্ছে, কোরায়শরা তার পেছনে রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতে চাইলেন লোক কতো? ওরা বললো, আমরা জানি না। দৈনিক কয়টি করে উট যবাই করে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন। ওরা বললো, একদিন নয়টি এবং একদিন দশটি। একথা শুনে তিনি বললেন, লোকসংখ্যা নয়শত থেকে এক হাজারের মধ্যে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পর জিজ্ঞাসা করলেন, ওদের মধ্যে কোরায়শদের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কারা রয়েছে? তারা বললো, রবিয়ার উভয় ছেলে ওতবা এবং শায়বা আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকেম, ইবনে হাজাম, নওফেল ইবনে খুলাইলাহ, হারেস ইবনে আমর, তুমাইমা ইবনে আদী, নযর ইবনে হারেস, জাময়া ইবনে আসওয়াদ, আবু জেহেল ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ। এছাড়া উভয় ক্রীতদাস আরো কয়েকজনের নাম বললো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, মক্কা তাদের বড় বড় টুকরাগুলোকে তোমদের সামনে এনে ফেলেছে।
রহমতের বৃষ্টিপাত এবং মুসলমানদের অগ্রাভিযান
সেই রাতেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন বৃষ্টি বর্ষণ করেন। সেই বৃষ্টি কাফেরদের ওপর মুষলধারে বর্ষিত হয়, এতে তাদের অগ্রাভিযানে বাধার সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের জন্যে তা ছিলো রহমতের ঝর্ণাধারা। এতে শয়তান সৃষ্ট নোংরামী থেকে মুসলমানরা পাকছাফ হওয়ার সুযোগ পান, পায়ের নীচের বালুকা শক্ত হয় এবং পা রাখার মতো চমৎকার অবস্থার সৃষ্টি হয়, মন মযবুত হয়ে যায়।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর মুসলিম নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সামনে অগ্রসর হন। মোশরেকদের আগেই বদরের জলাশয়ের কাছে পৌছার জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সচেষ্ট ছিলেন। এ সময় হযরত হাকাব ইবনে মুনযির (রা.) একজন বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী সেনা নায়কের মতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটি পরামর্শ দেন। প্রথমে তিনি জানতে চান যে, হে আল্লাহর রসূল, আপনি কি এখানে আল্লাহর  এমন আদেশে সমবেত হয়েছেন যে, সামনে পেছনে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই? নাকি রণকৌশল হিসাবে আপনি এই জায়গা পছন্দ করেছেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা স্রেফ রণকৌশলগত কারণ। একথা শোনার পর হযরত খাব্বাব (রা.) বললেন, এই জায়গায় অবস্থান আমি সমীচীন মনে করি না। আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে এবং কোরায়শদের অবস্থানের সবচেয়ে নিকটবর্তী জলাশয় আমাদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। অন্যান্য জলাশয়ের ওপর আমরা নযর রাখবো। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা পানি পান করবো, কিন্তু কোরায়শরা পানির অভাবে ছটফট করবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যথার্থ পরামর্শই দিয়েছো। এরপর তিনি সৈন্যদের নিয়ে এগিয়ে চললেন। রাতের মাঝামাঝি সময়ে শত্রুদের কাছাকাছি জলাশয়ের কাছে পৌছে তাঁবু ফেললেন। এরপর সাহাবারা হাউজ বানালেন এবং বাকি সব জলাশয় বন্ধ করে দিলেন।
নেতৃত্বের কেন্দ্রস্থল
সাহবারা জলাশয়ের কাছে অবস্থান নেয়ার পর হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.)একটি প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন যে, মুসলমানরা নিজেদের নেতার জন্যে একটি অবস্থান কেন্দ্র তৈরি করতে পারে। এর ফলে আল্লাহ না করুন জয়ের বদলে মুসলমানদের পরাজয় অথবা অন্য কোন ধরনের জরুরী পরিস্থিতি দেখা দিলে আমরা আগে থেকেই সতর্ক থাকতে পারব। এরূপ আলোচনার পর হযরত সা’দ (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনার জন্যে আমরা একটা বিশেষ খাট তৈরি করতে চাই। আপনি সেখানে অবস্থান করবেন। আপনার পাশেই আমরা আপনার সওয়ারীও রেখে দিবো। এরপর শত্রুদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সম্মান দিলে এবং শত্রুদের ওপর বিজয়ী করলে আপনার এরূপ অবস্থানস্থল আমাদের জন্যে পছন্দনীয় হবে। আমরা পরাজিত হলে আপনি সওয়ারীতে আরোহন করে সেইসব লোকের কাছে যেতে পারবেন, যারা পেছনে রয়েছেন। হে আল্লাহর নবী, আপনার পেছনে এমন লোকেরাই রয়েছে, যারা আপনাকে আমাদের চেয়ে বেশী ভালোবাসে। আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা তাদের মতো বেশী ও গভীর নয়। তারা যদি জানতেন যে, আপনি যুদ্ধের মুখোমুখি হবেন, তাহলে তারা কিছুতেই পেছনে থাকতেন না। আল্লাহ তায়ালা তাদের মাধ্যমে আপনার হেফাযত করবেন, ওরা আপনার কল্যাণকারী হবেন এবং আপনার সঙ্গে জেহাদ করবেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা শুনে হযরত সা’দ (রা.) এর প্রশংসা করে তাঁর জন্যে দোয়া করলেন। মুসলমানরা যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর পূর্ব দিকে একটি উঁচু টিলায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে একটি খাট তৈরি করেন। সেখানে বসে পুরো রণাঙ্গন চোখে পড়ে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি লক্ষ রাখার জন্যে হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.)-এর নেতৃত্বে একদল আনসার যুবককে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়।
যুদ্ধের জন্যে সেনা বিন্যাস
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর সেনা বিন্যাস করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রওয়ানা হয়ে যান। [জামে তিরমিযি, আবওয়াবুল জেহাদ, ১ম খন্ড, পৃ. ২০১)। সেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের ইশারা করে দেখিয়ে বলেছিলেন যে, আগামীকাল ইনশাল্লাহ এই জায়গা হবে অমুকের বধ্যভূমি এবং এই জায়গা হবে অমুকের বধ্যভূমি।
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে একটি গাছের শেকড়ের কাছে রাত্রিযাপন করেন। সাহাবারাও নিরুদ্বেগ প্রশান্তির সাথে রাত কাটান। তাদের অন্তর ছিলো আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিশ্চিয়তার সাথে সময় অতিবাহিত করেন। তাদের মনে প্রত্যাশা ছিলো যে, সকালে নিজ চোখে মহান প্রতিপালকের সুসংবাদের প্রমাণ দেখতে পাবেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্বরণ কর, তিনি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর বারি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা তিনি পবিত্র করবেন, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণ করবেন, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করবেন এবং তোমাদের পা স্থির রাখবেন।’ ( সূরা আনফাল, আয়াত ১১)
এটি ছিলো দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমযানের রাত। এই মাসের ৮ বা ১২ তারিখ তিনি মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন।[ মেশকাত ২য় খন্ড, পৃ. ৫৪৩]
শত্রুদের পারস্পারিক মতবিরোধ
কোরায়শরা বদরের শেষ প্রান্তে টিলার ওপাশে নিজেদের তাঁবুতে রাত্রিযাপন করে। সকালে টিলার এ পাশে বদর প্রান্তরে এসে সমবেত হয়। একদল লোক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাউযের দিকে অগ্রসর হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন ওদের বাধা দিও না। পরে দেখা গেছে যে, লোকদের মধ্যে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাউয থেকে পানি পান করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলো, তারা সবাই নিহত হয়েছিলো। একমাত্র হাকিম ইবনে হিযাম বেঁচে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হাকিম ইসলাম গ্রহন করে একজন ভালো মুসলমান হয়েছিলেন। তার নিয়ম ছিলো যে, তিনি যখনই কসম ক্ষেতেন, তখনই বলতেন, ‘লায়াল্লাযি নাজ্জানি মিন ইয়াওমে বাদরিন।’ অর্থাৎ সেই সত্তার শপথ যিনি আমাকে বদরের দিন মুক্তি দিয়েছেন।
কোরায়শরা মুসলমানদের সৈন্য সমাবেশ লক্ষ্য করার পর এদের শক্তি পরিমাপ করার জন্যে ওমায়ের ইবনে ওয়াহাব জাহামীকে প্রেরণ করলো। ওমায়ের এক চক্কর দিয়ে ফিরে গিয়ে বললো, মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা তিনশত বা তার কিছু কম বেশী হবে। আমি একটু দেখে আসি তাদের কোন সহায়ক সৈন্য বাহিনী আছে কিনা। বেশ কিছুদূরে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এসে ওমায়ের বললো সহায়ক কোন সৈন্য মুসলমানেরা পশ্চাতে রেখে আসেনি। তবে একটা ব্যপার লক্ষ্য করেছি যে, ইয়াসরেবের উটগুলো নির্ভেজাল মৃত্যু বহন করে নিয়ে এসেছে। ওদের সমুদয় শক্তি তলোয়ারের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর শপথ, আমি যা বুঝেছি, এতে মনে হয়েছে যে, ওরা কেউ তোমাদের না মেরে মরবে না। যদি তোমাদের বিশিষ্ট লোকদের ওরা মেরেই ফেলে, তবে তোমরা বিশিষ্ট সঙ্গীহারা হয়ে যাবে। কাজেই যা কিছু করবে, ভেবে চিন্তে করাই সমীচীন।
এ সময় আরো একদল যুদ্ধবিরোধী লোক আবু জেহেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলো। কিন্তু আবু জেহেল যুদ্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যুদ্ধবিরোধী লোকেরা চাচ্ছিলো যে, যুদ্ধ না করেই মক্কায় ফিরে যাবে। যেমন হাকিম ইবনে হিযাম যুদ্ধ চাচ্ছিলেন না। তিনি এখানে ওখানে ছুটোছুটি করমে লাগলেন। প্রথমে ওতবা ইবনে রাবিয়ার কাছে গেলেন। বললেন, হে আবুল ওলীদ, আপনি কোরায়শদের বিশিষ্ট ব্যক্তি। আপনার আনুগত্য সবাই বিনাবাক্যে মেনে নেয়। আপনি একটি ভালো কাজ করুন। এর ফলে সব সময় আপনার আলোচনা মানুষের মুখে মুখে থাকবে। ওতবা বললেন সেটা কি কাজ হাকিম? হাকিম বললেন, আপনি সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। নাখলার ছারিয়্যায় নিহত আপনার মিত্র আমর ইবনে হাদমারির হত্যার ক্ষতিপূরণের দ্বায়িত্ব আপনি নিজের ওপর নিন। ওতবা বললো, আমি রাযি আছি। তুমি আমার পক্ষ থেকে যামানত লও। আমর ইবনে হাদমারি আমার মিত্র, তার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব আমার উপরই বর্তায়। তার যে সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, আমি তা পুষিয়ে দিব।
এরপর ওতবা হাকিম ইবনে হিযামকে বললো, তুমি হানজালিয়ার ছেলে (আবু জেহেলের মায়ের নাম ছিলো হানজালিয়া) অর্থাৎ আবু জেহেলের কাছে যাও। সেই সব কিছু বিগরাচ্ছে, লোকদের উস্কানি দেয়ার মূলে তার হাতই সক্রিয় রয়েছে।
এরপর ওতবা ইবনে রাবিয়া দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ভঙ্গিতে বললো, হে কোরায়শরা, তোমরা মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের সাথে লড়াই করে বিশেষ কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারবে না। খোদার কসম, যদি তারা তোমাদের মেরে ফেলে, তবে এমন সব চেহারাই দেখতে পাবে, যাদের নিহত অবস্থায় তোমরা দেখতে চাইবে না। কারণ তোমরা তো চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই অথবা নিজের গোত্রের অন্য কাউকেই হত্যা করবে। আরবের অন্য লোকেরা যদি মোহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের মেরে ফেলে তবে তোমাদের ইচ্ছাই পূরণ হব্ আর যদি অন্য  কোন পরিস্থিতি দেখা দেয়, তবে মনে রেখো, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের হাতে তোমরা এমন অবস্থায় পড়বে যে, তাদের সাথে অতীতে যা হয়েছে, সবই তারা মনে রেখেছে। কাজেই চলো আমরা ফিরে যাই, আমরা নিরপেক্ষ থাকবো।
হাকিম ইবনে হিযাম আবু জেহেলের কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলো যে, সে নিজেদের বর্ম পরিস্কার করছে। হাকিম বললো, হে আবুল হাকাম, ওতবা আমাকে আপনার কাছে এই পয়গাম নিয়ে পাঠিয়েছেন। আবু জেহেল বললো, খোদার কসম, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের দেখে ওতবার বুক শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আমি কিছুতেই মক্কায় ফিরে যাবো না। খোদাতায়া’লা মোহাম্মদ এবং আমাদের মধ্যে একটা ফয়সালা না করা পর্যন্ত আমরা মক্কায় ফিরে যাবো না। ওতবা যা কিছু বলেছে, সেটা এ জন্যেই বলেছে যে, সে মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে। ওতবার পুত্রও ওদের সঙ্গে রয়েছে এ কারণে সে ওদের ব্যাপারে তোমাদের ভয় দেখাচ্ছে। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওতবার পুত্র হোযায়ফা অনেক আগেই ইসলাম গ্রহণ এবং হিজরত করে মদীনায় চলে যান)।ওতবা যখন খবর পেলো যে, আবু জেহেল তার সম্পের্কে বলেছে যে, খোদার কসম, ওতবার বুক শুকিয়ে গেছে, তখন সে বললো, আবু জেহেল শীঘ্রই জানতে পারবে যে, কার বুক শুকিয়ে গেছে, আমার না তার। আবু জেহেল ওতবার এই প্রতিক্রিয়ার খবরে ভয় পেয়ে গেলো। এটা যেন দীর্ঘায়িত যেন না হয়, এজন্যে সে নাখলার ছারিয়্যায় নিহত আমর ইবনে হাদমারীর ভাই আমের ইবনে হাদমারিকে ডেকে পাঠালো। আমের আসার পর আবু জেহেল বললো, তোমাদের মিত্র ওতবা লোকদের ফিরিয়ে নিতে চায়। অথচ তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম নিজেদের চোখে দেখছ। কাজেই ওঠো, তোমাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে, তোমরা যে মযলুম একথা জোর গলায় বলো, তোমার ভাইদের নিহত হওয়ার ঘটনা সবাইকে নতুন করে জানাও। একথা শুনে আমের উঠে দাঁড়ালো এবং নিজের পাছার কাপুড় খুলে চিৎকার করতে লাগলো। সে বললো, হায় আমর , হায় আমর , হায় আমর । এই চিৎকার শুনে সবাই জড়ো হলো, যুদ্ধ করার ইচ্ছা সবার মনে প্রবল ভাবে দেখা দিলো। মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহনের ব্যপারে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। ওতবা যে আহব্বান জানিয়েছিলো, সেটা ব্যর্থ হলো। এমনি করে হুশের ওপর জোশ জয়ী হলো, যুদ্ধ না করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলো।
উভয় বাহিনী একে অপরের মুখোমুখি
অমুসলিমরা দলে দলে বেরিয়ে এলো এবং উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হতে শুরু করলো। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, কোরায়শরা পরিপূর্ণ অহংকারের সাথে তোমার বিরোধিতায় এবং তোমার রসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ তায়ালা, আজ তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্যে বড় বেশী প্রয়োজন। হে আল্লাহ তায়ালা,তুমি আজ  ওদের ছিন্ন ভিন্ন করে দাও।’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওতবাকে তার লাল উটের ওপর দেখে বললেন, কওমের কারো কাছে যদি কল্যাণ থাকে তবে উটের আরোহীর কাছে রয়েছে। অন্যরা যদি তার কথা মেনে নিতো, তবে সঠিক পথ প্রাপ্ত হতো।’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সময় মুসলমানদের কাতারবন্দী করলেন।তখন একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো।
নবী (সা.)-এর হাতে ছিলো একটি তীর। সেটির সাহায্যে তিনি কাতার  সোজা করছিলেন। এ সময়ে তীরের ফলা ছাওয়াদ ইবনে গাযিয়ার পেটে একটু খানি লাগলো। তিনি কাতার থেকে একটুখানি সামনে এগিয়ে এসেছিলেন, ছাওয়াদ, সোজা হয়ে যাও। ছাওয়াদ তাৎক্ষনাৎ বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, বদলা নিতে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পেটের উপর থেকে জামা সরিয়ে বললেন, নাও প্রতিশোধ নাও। ছাওয়াদ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জড়িয়ে ধরে তাঁর পবিত্র পেটে চুম্বুন করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ছাওয়াদ তুমি এমন কাজ করতে কিভারে উদ্বুদ্ধ হলে? ছাওয়াদ বললেন, হে আল্লার রসূল, যা কিছু ঘটতে চলেছে, আপনি সবই দেখেছেন। আমার একান্ত ইচ্ছা হলো যে, আপনার ঘনিষ্টতা যেন আমার জীবনের শেষ স্বরণীয় ঘটনা হয়ে থাকে। আপনার পবিত্র দেহের সাথে আমার দেহের দেহের সংস্পর্শ যেন আমার জীবনের শেষ ঘটনা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা শুনে ছাওয়াদকে দোয়া করলেন।
কাতার সোজা করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের বললেন, তাঁর পক্ষ থেকে নির্দেশ না পেয়ে কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর যুদ্ধ পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ পথনির্দেশ প্রদান করেন। তিনি বললেন, পৌত্রলিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে, তখন তাদের প্রতি তীর নিক্ষপে করবে। তীরের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে [ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬৮] । ওরা তোমাদের ঘিরে না ফেলা পযর্ন্ত তরবারি চালনা করবে না [সুনানে আবু দাউদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩]। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে অবস্থান কেন্দ্রে চলে গেলেন। হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাহারায় নিযুক্ত হলেন।
অন্যেদিকে পৌত্তলিকদের অবস্থা ছিলো এই যে, আবু জেহেল আল্লাহর কাছে ফয়সালার জন্যে দোয়া করলো। সে বললো, হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে দল আত্মীয়তার সম্পর্ক অধিক ছিন্ন করেছে এবং ভূল কাজ করেছে, আজ  তুমি তাদের ধ্বংস করে দাও। হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে দল তোমার কাছে অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয়, আজ  তুমি তাদের সাহয্যে করো। পরবর্তী সময়ে আবু জেহেলের এই কথার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমরা মীমাংসা চেয়েছিলো, তা-তো তোমাদের কাছে এসেছে। যদি তোমরা বিরত হও, তবে সেটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, যদি তোমরা পুনরায় তা করো, তবে আমিও তোমাদের শাস্তি দেবো এবং তোমাদের দল অধিক হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবে না এবং আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ১৯)
যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন
এ যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন ছিলো আসওয়াদ ইবনে আবদুর আছাদ মাখযুমি। এই লোকটি ছিলো নিতান্ত দুর্বৃত্ত এবং অসচ্চরিত্রের। ময়দানে বেরোবার সময় বলেছিলো, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করছি যে, ওদের হাউজের পানি পান করেই ছাড়ব। যদি তা না পারি, তবে সেই হাউজকে ধ্বংস বা তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবো।
এ কথা বলে আসওয়াদ এগিয়ে এলো। অন্যদিকে প্রিয় নবী নসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে থেকে হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব এগিয়ে এলেন। জলাশয়ের কাছেই উভয়ের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। হযরত হামযা (রা.) তলোয়ার দিয়ে  এমন ভাবে আঘাত করলেন যে, কাফের আসওয়াদের পা হাঁটুর নীচে দিয়ে কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো। কর্তিত পা থেকে অবিরাম ধারায় রক্ত বেরোতে লাগলো। সেই রক্তধারা তার সঙ্গীদের দিকে প্রবাহিত হচ্ছিলো। আসওয়াদ হামাগুড়ি দিয়ে জলাশয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। জলাশয়ের কাছে পৌছে জলাশয়ের পানি পান করে তার কসম পূর্ণ করতে চাচ্ছিলো। এমন সময় হযরত হামযা (রা.) আসওয়াদের ওপর পুনরায় আঘাত করলেন। এই আঘাতের ফলে সে জলাশয়ের ভেতর পড়ে মরে গেলো।
সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু
আসওয়াদ ইবনে আবুল আছাদের হত্যাকান্ড ছিলো বদরের যুদ্ধের প্রথম ঘটনা। এই হত্যার পর যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়লো। কোরায়শ বাহিনীর মধ্য থেকে তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধা বেরিয়ে এলো। এরা ছিলো একই গোত্রের লোক; তন্মধ্যে রবিয়ার দুই পুত্র ওতবা ও শায়বা এবং ওতবার পুত্র ওলীদ। এরা কাতার থেকে বেরিয়ে এসেই প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার জন্যে আহব্বান জানালো। তিনজন আনসার যুবক অগ্রসর হলেন। এরা ছিলেন, আওফ ,মোয়াওয়েয এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। প্রথমোক্ত দুইজন ছিলেন হারেসের পুত্র। তাদের মায়ের নাম ছিলো আফরা। কোরায়শরা জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের পরিচয় কি? তারা বললো, আমরা মদীনার আনসার। কোরায়শরা বললো, আপনারা অভিজাত প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরা চাই আমাদের চাচাতো ভাইদের। এরপর তিন কোরায়শ যুবক চিৎকার করে বললো, হে মহাম্মদ, আমাদের কাছে আমাদের রক্তসম্পর্কীয়দের পাঠাও। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওবায়দা ইবনে হারেস, হামযা, এবং আলী এগিয়ে যাও। এরা এগিয়ে যাওয়ার পর তিনজন কোরায়শ যুবক না চেনার ভান করে এদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। এরা নিজেদের পরিচয় দিলেন। কোরায়শ যুবকত্রয় বললো, হাঁ, আপনারা অভিজাত প্রতিদ্বন্দ্বী। এরপর শুরু হলো সাধারণ যুন্ধ। হযরত ওবায়দা ইবনে হারেস (রা.) ওতবা ইবনে রাবিয়ার সাথে, হযরত হামযা (রা.) শায়বার সাথে এবং হযরত আলী (রা.) ওলীদ ইবনে ওতবার সাথে মোকাবেলা করলেন [ইবনে হিশাম,মোসনাদে আহমেদ। আবু দাউদের বর্ণনায় পার্থক্য রয়েছে। মেশকাত, ২য় খন্ড; পৃ. ৩৪৩]
হযরত হামযা (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করে ফেললেন কিন্তু হযরত ওবায়দা ইবনে হারেস (রা.) এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওতবার মধ্যে আঘাত বিনিময় হলো। তারা একে অন্যকে মারাত্বকভাবে আহত করে ফেললেন। ইতিমধ্যে হযরত হামযা এবং হযরত হযরত আলী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাজ শেষ করে হযরত ওবায়দার সাহায্যে এগিয়ে এলেন এবং ওতবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করে ফেললেন। এরপর তারা হযরত ওবায়দাকে উঠিয়ে নিয়ে এলেন। হযরত উবায়দা (রা.)-এর পা কেটে গেয়েছিলো এবং কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তার মুখে আর কথা ফুটেনি। চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে মুসলমানেরা মদীনায় ফিরে যাওয়ার পথে সফরা প্রান্তর অতিক্রম করার সময় হযরত ওবায়দা (রা.) ইন্তেকাল করেন। হযরত আলী বলতেন, এই আয়াত আমাদের সম্পর্কে নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ, তারা তাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্ক করে।’ (সূরা হজ্জ, আয়াত ১৯)
পৌত্তলিকদের দুর্ভাগ্য সূচিত হয়ে গেলো। একত্রে তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধাকে তারা হারালো। ক্রোধে দিশাহারা হয়ে তারা সবাই একত্রে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
অন্যদিকে মুসলমানরা তাদের মহান প্রতিপালকের কাছে সাহায্যের জন্যে দোয়া করে এবং দৃঢ়তার সাথে কাফেরদের হামলা মোকাবেলা করছিলেন। তারা ‘আহাদ, আহাদ’ শব্দ উচ্চারণ করে বিধর্মী কাফেরদের ওপর পাল্টা হামলায় তাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছিলেন।
বদর প্রান্তরে নবী (স.)-এর দোয়া
এদিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোহাজেরদের কাতার সোজা করার পর সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা পরওয়ারদেগারের কাছে সাহায্যের জন্যে কাতর কন্ঠে আবেদন জানাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা, তুমি আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছো তা পূরণ কর। হে আল্লাহ তায়ালা, আমি তোমার কাছে তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্যের আবেদন  জানাচ্ছি।
উভয় পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, আজ  যদি মুসলমানদের এই দল নিশ্চহ্ন হয়ে যায়, তবে দুনিয়ায় এবাদত করার  মতো কেউ থাকবে না। হে আল্লাহ তায়ালা, তুমি কি এটা চাও যে, আজকের পরে কখনোই তোমার এবাদত না করা হোক?’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতিশয় বিনয় ও নম্রতার সাথে সকাতর কন্ঠে এই মোনাজাত করছিলেন। তাঁর কাতরোক্তির এক পর্যায়ে উভয় স্কন্ধ থেকে চাদর পড়ে গেলো। হযরত আবু বকর (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর ঠিক করে দিলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এবার থামুন। আপনি তো আপনার প্রতিপালকের কাছে অতিশয় কাতরতার সাথে মোনাজাত করেছেন। এদিকে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের প্রতি আদেশ পাঠালেন যে, ‘স্বরণ করো, তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যে, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি্ সুতরাং তোমারা মোমেনদের অবিচলিত রাখো, যারা কুফরী করে, আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো সুতরাং তাদের স্কন্ধ ও সর্বাঙ্গে আঘাত করো।’ ( সূরা আনফাল, আয়াত ১২)
এদিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ মর্মে ওহী  পাঠলেন, ‘আমি তোমাদের সাহায্যে করবো, এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা একের পর এক আসবে। ( সূরা আনফাল, আয়াত ৯ )
ফেরেশতাদের অবতরণ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামরে কাছে এ সময় হযরত জিবরাঈল (আ.) এলেন। তিনি চকিতে মাথা তুলে বললেন, আবু বকর, খুশি হও, জিবরাঈল এসেছেন, ধুলোবালির মধ্যে এসেছেন। ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আবু বকর, খুশি হও, তোমাদের কাছে আল্লাহর সাহায্যে এসে পৌছেছে। জিবরাঈল ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়ার আগে আগে আসছেন। ধুলোবালি উড়ছে।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কামরার বাইরে এলেন। তিনি বর্ম পরিহিত ছিলেন। তিনি উদ্দিপনাময় ভঙ্গিতে সামনে অগ্রসর হতে হতে বলছিলেন, ‘এই দল শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে।’ ( সূরা কামার, আয়াত ৪৫)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর এক মুঠো ধূলি কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপের সময় বললেন, ‘শাহাতিল উজুহ’ অর্থাৎ ওদের চেহেরা আচ্ছন্ন হোক। একথা বলেই ধুলো কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করলেন।এই নিক্ষিপ্ত ধূলি প্রত্যেক কাফেরের চোখ, মুখ, নাক ও গলায় প্রবেশ করলো। একজনও বাদ গেলো না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তখন তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং আল্লাহ তায়ালাই নিক্ষেপ করেছিলেন।’ ( সূরা আনফাল, আয়াত ১৭)
জবাবী হামলা
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবী হামলার নির্দেশ এবং যুদ্ধের তাগিদ দিয়ে বলেন, তোমরা এগিয়ে যাও। সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে মোহাম্মদের প্রাণ এবং ওদের সঙ্গে তোমাদের যে কেউ দৃঢ়তার সাথে পুণ্যের কাজ মনে করে অগ্রগামী হয়ে পেছনে সরে না এসে যুদ্ধ করবে এবং মারা যাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই জান্নাত দান করবেন। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘সেই জান্নাতের প্রতি ওঠো যার দিগন্ত ও বিস্তৃতি আকাশ ও মাটির সমপরিমাণ।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথা শুনে ওমায়ের ইবনে হাম্মাম বললেন, চমৎকার, চমৎকার! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে একথা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল অন্য কোন কারণে নয়, আমি আশা করেছিলাম যে, আমিও সেই জান্নাতের অধিবাসীদের মধ্যে যদি হতে পারতাম। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সেই জান্নাতীদের মধ্যে তুমিও রয়েছো। এরপর ওমায়ের ইবনে হাম্মাম কয়েটি খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। হঠাৎ উচ্ছ্বসিতকন্ঠে বললেন, এই খেজুরগুলো ক্ষেতে অনেক সময় প্রয়োজন। জীবনকে এত দীর্ঘায়িত কববো কেন। এ কথা বলে তিনি খেজুর ছুঁড়ে ফেলে বিধর্মীদের সাথে লড়ায় করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জবাবী হামলার নির্দেশ দেন তখন শত্রুদের তখন শত্রুদের হামলার তীব্রতা কমে আসে। তাদর উৎসাহ-উদ্দীপনাতেও ভাটা পড়ে। এটা মুসলমানদের অবস্থান দৃঢ় করার ক্ষেত্রে সহায়ক প্রমাণিত হয়। কেননা সাহাবায়ে কেরাম যখন জবাবী হামলার আদেশ লাভ করেন এবং তাঁদের জোস যখন তুঙ্গে তখস তাঁরা প্রচন্ডবেগে হামলা করেন। এসময় তাঁরা কাফেরদের কাতার এলোমেলো করে তাদের শিরচ্চেদ করতে করতে এগিয়ে যান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বর্ম পরিধান করে রণক্ষেত্রে এসেছেন দেখে সাহাবাদের উদ্দীপনা আরো বেড়ে গেলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘শীঘ্রয় ওরা পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালায়ন করবে।’
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দীপনায় সাহাবারা বিপুল বিক্রমে লড়াই করেন। এ সময়ে ফেরেশতারাও মুসলমানদের সাহায্যে করেন [মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩৯, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৩১ ]।
ইবনে সা’দ এর বর্ণনায় হযরত ইকরামা (রা.) তেকে বর্ণিত আছে যে, সেই দিন মানুষের মাথা কর্তিত হয়ে পড়েছিলো। অথচ বোঝা যাচ্ছিলো না যে, কে তাকে মেরেছে। মানুষের কর্তিত হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যেত অথচ কে কেটেছে তা বোঝা যেত না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একজন আনসারী মুসলমান একজন মোশরেককে দৌড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ সেই মোশরেকের উপর চাবুকের আঘাতের শব্দ শোনা গেলো কে যেন বলছিলো, যাও, সামনে এগোও। সাহাবী লক্ষ্য করলেন যে, পৌত্তলিক চিৎকাত হয়ে পড়ে গেছে। তার নাকে মুখে আঘাতের চিহ্ন। চেহারা রক্তাক্ত। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো যে, তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয়েছে অথচ আঘাতকারীকে দেখা যাচ্ছিলো না, সেই আনসারী সাহাবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সত্য বলেছো। এটা ছিলো তৃতীয় আসমানের  সাহায্যে [ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৩]
আবু দাউদ মাযানি বলেন, আমি একজন মোশরেককে মারার জন্যে দৌড়াচ্ছিলাম। তার গলায় আমার তলোয়ার পৌছার আগেই কর্তিত মস্তক মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। আমি বুঝতে পাড়লাম যে, এই কাফেরকে অন্য কেউ হত্যা করেছে।
একজন আনসারী হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তলেবকে গ্রেফতার করে নিয়ে এলেন। হযরত আব্বাস তখনো ইসলাম গ্রহন করেননি। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমাকে তো এই লোকটি কয়েদ করে নিয়ে আসেনি। আমাকে মুন্ডিত মস্তকের একজন লোক কয়েদ করে নিয়ে এসেছে। সুদর্শন সেই লোকটি একটি চিত্রল ঘোড়ার পিঠে আসীন ছিলো। এখন তো সেই লোকটি এইসব লোকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। আনসারী বললেন, হে আল্লাহর রসূল, তাকে তো আমি গ্রেফতার করেছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, চুপ করো। আল্লাহ তায়ালা একজন সম্মনিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্যে করেছেন।
রণক্ষেত্র থেকে ইবলিসের পলায়ন
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিলো যে, অভিশপ্ত ইবলিস ছোরাকা ইবনে মালেক ইবনে জাশআম মুদলিজীর আকৃতি ধারণ করে এসেছিলো। মোশরেকদের কাছ থেকে সে তখনো পৃথক হয়নি। কিন্তু পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে ফেরেশতাদের ব্যবস্থা দেখে সে ছুটে পালাতে লাগলো। কিন্তু হারেস ইবনে হিশাম তাকে ধরে ফেললেন। তিনি ভেবেছিলেন, লোকটি প্রকৃতই ছোরাকা ইবনে মালেক। কিন্তু ইবলিস হযরত হারেসের বুকে প্রচন্ড ঘুষি মারল। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। ইত্যবসরে ইবলিস পালিয়ে গেলো। মোশরেকরা বলতে লাগল, ছোকরা কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বলো নাই যে, আমাদের সাহায্যে করবে, আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে না? ছোকরা বললো, আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা তোমরা দেখতে পাওনা। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা্ এরপর ইবলিস সমুদ্রে গিয়ে আত্মগোপন করলো।
কাফেরদের পরাজয়
কিচুক্ষণের মধ্যেই অমুসলিমদের বাহিনী ব্যর্থতা ও হতাশার সুস্পষ্ট নক্ষণ ফুটে উঠলো। মুসলমানদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। যুদ্ধের পরিণাম হয়ে উঠলো সুস্পষ্ট। কাফের কোরায়শরা পশ্চাদপ্রসারণ করতে লাগলো এবং তাদের মনে হতাশা ছেয়ে গেলো। মুসলমানরা কাউকে হত্যা করছিলেন, কাউকে যখম করছিলেন, কাউকে ধরে নিয়ে আসছিলেন। ফলে কাফেররা সুস্পষ্ট পরাজয় বরণ করলো।
দুর্বৃত্তদের নেতা আবু জেহেল কোরায়শ কাফেরদের ছত্রভঙ্গ হতে দেখে সেই সয়লাভ প্রতিরোধের চেষ্টা করলো। নিজের অনুসারীদের উদ্দীপিত করার জন্যে চিৎকার করে সে বলতে লাগলো, ছোকরার পলায়নে তোমরা সাহস হারিও না। মোহাম্মদের সাথে ছোকরার যোগসাজগ ছিলো। ওতবা, শায়বা, ওলিদ নিহত হয়েছে দেখে তোমরা হিম্মত হারিও না। ওরা তাড়াহুড়ো করেছে। লাত ও ওযযার শপথ, ততক্ষণ আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষন না ওদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলব। দেখো, তোমরা ওদের কাউকে করবে না, বরং পাকড়াও করো। পরে আমরা ওদের অশুভ তৎপরতার মজা টের পাইয়ে দেবো।
আবু জেহেল তার এ অহংকারের মজা শিগগির টের পেলে গেলো। কেননা অল্পক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের জবাবী হামলার মুখে তাদের ছত্রভঙ্গ অবস্থা দেখা দিলো। আবু জেহেল তার কিছু সংখ্যক অনুসারীকে নিয়ে তখনো ঘেরাও অবস্থায় ছিলো। দুর্বৃত্ত নেতা আবু জেহেলের চারিদিকে ছিলো তীর আর তলোয়ারের পাহারা। মুসলিম মোজাহেদের প্রচন্ড হামলায় সেই পাহারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। মুসলমানরা লক্ষ্য করলেন যে, আবু জেহেল একটি ঘোড়ার পিঠে রয়েছে। তার মৃত্যু তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিলো।
আবু জেহেলের হত্যাকান্ড
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)বলেন, বদর যুদ্ধের দিনে মুসলমানদের কাতারের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখি যে, ডানে বাঁয়ে দ’জন আনসার কিশোর। তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আমি চিন্তা করছিলাম, হঠাৎ একজন চুপিসারে আমাকে বললো, চাচাজান, আবু জেহেল কে তা আমাদের দেখিয়ে দিন। আমি বললাম, ভাতিজা, তুমি কার কি করবে? সে বললো, আমি শুনেছি, আবু জেহেল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি আমরা আবু জেহেল দেখতে পাই তবে ততক্ষণ পর্যন্ত পর্যন্ত তার কাছ থেকে আলাদা হব না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার এবং আমাদের মৃত্যু যার আগে লেখা রয়েছে, তার মৃত্যু না হয়। হযরত আবদুর রহমান (রা.) বলেন, একথা শুনে আমি অবাক হলাম। অন্যজন আনসার কিশোরও আমাকে চুপিসারে একই কথা বললো। কয়েক মুহুর্ত পরে আমি আবু জেহেলকে লোকদের মধ্যে বিচরণ করতে দেখছিলাম। আমি উভয় আনসার কিশোরকে বললাম, ওই দেখো তোমাদের শিকার। যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছো। একথা শোনামাত্র উভয় আনসার কিশোর আবু জেহেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলল। এরপর উভয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামরে কাছে এলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের মধ্যে কে আবু জেহেলকে হত্যা করেছ? উভয়ে বললো, আমি করেছি, আমি করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কি তলোয়ারের রক্ত মুছেছো? তারা বললো, না মুছিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ের তলোয়ার দেখে বললেন, তোমরা দু’জনেই হত্যা করেছ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্য আবু জেহেলের পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র মায়া’য ইবনে আমর জামুহাকে প্রদান করলেন। উভয় কিশোরের নাম ছিলো মা’য ইবনে আমর জামুরা এবং মা’উয ইবনে আফরা [সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, প্র. ৪৪৪, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬৮, মেশকাত ২য় খন্ড,৩৫২। অন্যান্য বর্ণনায় দ্বিতীয় কিশোরের নাম মাউয ইবনে আফরা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৬৩৫। আবু জেহেলের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র একজনকে এ কারণেই দেয়া হয়েছিলো, যেহেতু মা’য অথবা মাউয ইবনে আফরা সেই যুদ্ধে পরবর্তী সময়ে শহীদ হন। আবু জেহেলের তরবারি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে দেয়া  হয়েছিলো। কেননা তিনি আবু জেহেলের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। দ্রষ্টব্য, সুনানে আবু দাউদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৭৩]
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, মায়া’য ইবনে আমর ইবনে জামুহ বলেছেন, আবু জেহেল কাফেরদের তীর তলোয়ারের দুর্ভেদ্য পাহারার ভেতর ছিলো। কাফেররা বলছিলো আবু জেহেলের কাছে কেউ যেন পৌছুতে না পারে। মায়’য ইবনে আমর বলেন, একথা শুনে আবু জেহেলকে চিনে রাখলাম এবং তার কাছাকাছি থাকতে লাগলাম। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমি তার ওপর হামলা করলাম। তাকে এমন আঘাত করলাম যে, তার পা হাঁটুর নীচে দিয়ে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ঝরে পড়া খেজুরের মত তার পা উড়ে গেলো। এদিকে আবু জেহেলকে আমি আঘাত করলাম আর ওদিকে তার পুত্র একরামা আমার কাঁধ বরাবর তরবারি দিয়ে আঘাত করলো। এত লড়াই করতে অসুবিধা হচ্ছিলো। কর্তিত হাত পেছনে রেখে অপর হাতে তরবারি চালাচ্ছিলাম। এতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো। আমি তখন হাতের কার্তিত অংশ পায়ের নীচে রেখে এক ঝটকায় হাত থেকে পৃথক করে ফেললাম [হযরত মা’য ইবনে আমর জামুহ (রা.) হযরত ওসমানের (রা.) খেলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন] । এরপর আবু জেহেলের ওপর এমন আঘাত করলেন যে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমন সেখানেই ঢলে পড়লো। আবু জেহেলের শেষ নিঃশ্বাস তখনো বের হয়নি। শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল করছিলো। এরপর হযরত মাউয ইবনে আফরা লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবু জেহেলের পরিণাম কে দেখবে দেখে আসো। সাহাবারা তখন আবু জেহেলের সন্ধান করতে লাগলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) আবু জেহেলকে এমতাবস্থায় পেলেন যে, তা নিঃশ্বাস চলাচল করছিলো। তিনি আবু জেহেলের ধড়ে পা রেখে মাথা কাটার জন্যে দাড়ি ধরে বললেন, ওরে আল্লাহর দুশমন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তোকে অপমান অসম্মান করলেন তো? আবু জেহেল বললো, কিভাবে আমাকে অসম্মান করলেন? তোমরা যাকে হত্যা করেছো তার চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কোন মানুষ আছে নাকি? তার চেয়ে বড় আর কে? আহা, আমাকে যদি কিশোর ছাড়া অন্য কেউ হত্যা করতো। এরপর বলতে লাগলো, বলো তো আজ  জয়ী হয়েছে কারা? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) আবু জেহেলের কাঁধে পা চাপিয়ে দিয়ে রেখেছিলেন। আবু জেহেল তাঁকে বললো, ওরে বকরির রাখাল, তুই অনেক উঁচু জায়গায় পৌছে গেছিস। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) মক্কায় বকরি চরাতেন।
এ কথোপকথনের পর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) আবু জেহেলের মাথা কেটে রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামরে সামনে হাজির করে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এই হচ্ছে আল্লাহর দুশমন আবু জেহেলের মাথা। নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হাঁ সত্যই, সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, হাঁ, সত্য, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, হাঁ সত্য, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। এরপর নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা সুমহান। সকল প্রসংশা তাঁরই জন্যে নিবেদিত, তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি সত্য করেদেখিয়েছেন, নিজের বান্দাদের সাহায্য করেছেন এবং একাকীই সকল দলকে পরাজিত করেছেন।
নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর বললেন, চলো। আমাকে তার লাশ দেখাও। আমরা নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবু জেহেলের লাশের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ও হচ্ছে এই উম্মতের ফেরাউন।
ঈমানের কিছু বিস্ময়কর নিদর্শন
হযরত ওমায়ের ইবনে হাম্মাম এবং আওফ  ইবনে হারেস ইবনে আফরার ঈমান সজীব করার মতো কার্যাবলীর উল্লেখ ইতিপূর্বে করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই অভিযানে পদে পদে এমন সব দৃশ্য চোখে পড়েছে, যার মধ্যে ঈমানের শক্তি এবং নীতির পরিপক্কতা প্রসারিত হয়েছে। এই অভিযানে পিতা-পুত্রের মুখোমুখি এবং ভাই ভাইয়ের মুখোমুখি হয়েছে। নীতির প্রশ্নে তলোয়ারসমূহ কোষমুক্ত হয়েছে এবং মযলুম ও অত্যাচারিতরা যালেম ও অত্যাচারির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ক্রোধের আগুন নির্বাপিত করেছে। যেমন-
এক) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)রর্ণনা করেছেন যে, নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, আমি জানি বনু হাশেমসহ কয়েকটি গোত্রের লোককে জোর করে যুদ্ধের ময়দানে নেয়া হয়েছে। আমাদের যুদ্ধের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। কাজেই হাশেম গোত্রের কোন লোক যদি কারো সামনে পড়ে যায়, তাকে যেন হত্যা না করা হয়। আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম যদি কারো সামনে পড়ে যায়, তাকে যেন হত্যা না করা হয়। আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেব যদি কারো নিয়ন্ত্রনে এসে যায়, তবে তাঁকেও যেন হত্যা না করা হয়। কেননা তাঁকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। একথা শুনে ওতবার পুত্র হযরত আবু হোযায়ফা (রা.) বললেন, আমরা নিজেদের পিতা পুত্র ভাই এবং গোত্রের। অন্যান্য লোকদের হত্যা করবো আর আব্বাসকে ছেড়ে দেবো? আল্লাহর শপথ, যদি আব্বাসের সাথে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়, তবে আমি তাকে তলোয়ারের লাগাম পরিধান করাবো। এ খবর রাসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছুলে তিনি ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-কে বললেন, আল্লাহর রসূলের চাচার চেহারায়ও কি তলোয়ার মারা যায়? হযরত ওমর (রা.)বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি এ লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেবো। কেননা সে মোনাফেক হয়ে গেছে।
পরবর্তী সময়ে হযরত হোযায়ফা (রা.) বলতেন, সেদিন আমি যেকথা বলেছিলাম, সে কারণে কখোনই আমি স্বস্তি পায়নি, নিশ্চিন্ত হতে পারিনে। সব সময় ভয় হতো। শুধু মনে হতো যে, আমার শাহাদাতই সেদিনের বেফাঁস মন্তব্যের কাফফারা হতে পারে। অবশেষে ইয়ামামার যুদ্ধে হযরত হোযায়ফা (রা.) শহীদ হন।
দুই) আবুল বাখতারিকে হত্যা না করার জন্যে এ কারণেই বলা হয়েছে যে, মক্কায় এই লোকটিই কখনো নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছুমাত্র কষ্ট দেননি। তার পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে বা আল্লাহ বা তাঁর প্রিয় রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে কোন অপ্রীতিকর কোন কথাও শোনা যায়নি। এ ছাড়া বনু হাশেম এবং বনী মোত্তালেবের বয়কট প্রত্যাহারকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
কিন্তু এতোসব গুন সত্তেও বদরের দিনে মুজযির ইবনে বালভীর সাথে তার মুধোমুখি হয়। আবুল বাখতারির সাথে তাঁর একজন সঙ্গীও ছিলেন। উভয়ে পাশাপাশি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আবুল বাখতারিকে দেখে হযরত মুজযির বললেন, হে আবুল বাখতারি, নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। আবুল বাখতারি বললেন, খোদার শপথ, তাহলে আমরা দু’জনেই মরবো। এরপর উভয়ে হযরত মুজযির এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন। হযরত মুজযির (রা.) বাধ্য হয়ে উভয়কেই হত্যা করলেন।
তিন) মক্কায় জাহেলিয়াতের সময় থেকেই হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) এবং উমাইয়া ইবনে খালফের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। বদর যুদ্ধের দিনে উমাইয়া তার সন্তান আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলো। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কয়েকটি বর্ম নিয়ে যাচ্ছিলেন। উমাইয়া তাকে বললো, আমি কি তোমার প্রয়োজনে আসতে পারি? আমি তোমার বর্মগুলোর চেয়ে উত্তম। আজকের মতো দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। তোমাদের কি দুধের প্রয়োজন নেই? অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমাকে বন্দী করবে মুক্তিপণ বা ফিদয়া হিসাবে আমি তাকে অনেক দুধেল উঠনী দেবো। একথা শুনে হযরত আবদুর রহমান বর্মগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং উমাইয়া ও তার পুত্র আলীকে গ্রেফতার করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন।
হযরত আবদুর রহমান (রা.) বলেন, আমি উমাইয়া এবং তার সন্তানের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় উমাইয়া বললো, আপনাদের মধ্যে ওই লোকটি কে ছিলেন যিনি বুকে উট পাখীর পালক লাগিয়ে রেখেছিলেন? আমি বললাম, তিনি হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব। উমাইয়া ইবনে খালফ বললো, এই লোকটিই আমাদের ধ্বংসলীলা ঘটিয়েছে।
হযরত আবদুর রহমান(রা.) বলেন, আমি উভয়কে নিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় হযরত বেলাল (রা.) উমাইয়াকে আমার সঙ্গে দেখে ফেললেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, উমাইয়া হযরত বেলাল (রা.)-কে মক্কায় ব্যপকভাবে নির্যাতন করেছিলো। হযরত (রা.) উমাইয়াকে দেখে বললেন, ওহে কাফেরদের সর্দার উমাইয়া ইবনে খালফ, হয়তো আমি বাঁচবো আথবা সে বাঁচবে। এরপর উচ্চকন্ঠে বললেন, ওহে আল্লাহর আনসাররা, এই দেখো কুফরের সর্দার উমাইয়া ইবনে খালফ, এবার হয়তো আমি থাকবো অথবা সে থাকবে। হযরত আবদুর রহমান (রা.) বলেন, ততক্ষণে লোকেরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। আমি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু একজন সাহাবী তলোয়ার তুলে উমাইয়ার পুত্র আলীর পায়ে আঘাত করলেন। সাতে সাথে সে ঢলে পড়লো। এদিকে উমাইয়া এমন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো যে, আমি অতো জোরে চিৎকার কখনো শুনিনি। আমি বললাম, পালাও, পালাও! কিন্তু আজ তো পালানোর পথ নেই। খোদার শপথ, আমি আজ তোমার কোন উপকারে আসতে পারবো না।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বলেন, উত্তেজিত সাহাবারা উমাইয়া এবং তার পুত্র আলীকে ঘিরে ফেলে আঘাতে আঘাতে হত্যা করে ফেললো। এরপর আবদুর রহমান (রা.)বললেন,আল্লাহ তায়ালা হযরত বেলালের উপর রহমত করুন। আমার বর্মগুলোও গেলো, আমার গ্রেফতার করা বন্দীদের ব্যাপারেও তিনি আমাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে দিলেন।
যাদুল মায়া’দে আল্লামা ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)উমাইয়া ইবনে খালফকে বললেন, হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ুন। সে বসে পড়লো। হযরত আবদুর রহমান উমাইয়ার দেহের উপর ঝুঁকে পড়ে তাকে আড়াল করে রাখলেন। কিন্তু সাহাবারা নীচে থেকে তরবারি চালিয়ে উমাইয়াকে হত্যা করলেন। একজন সাহাবীর তরবারির আঘাতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফেরও পা কেটে গিয়েছিলো [যাদুল মায়া’দ, ২য় খন্ড, পৃ.৮৯, সহীহ বোখারী কিতাবুল ওকালা, ১ম পৃ. ৩০৮। এতে এ ঘটনা আরো বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে]।
চার) হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)তাঁর মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন।
পাঁচ) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁর পুত্র তদানীন্তন মোশরেক আবদুর রহমানকে ডেকে বললেন, ওরে খবিস, আমার অস্ত্রশস্ত্র কোথায়? আবদুর রহমান বললো, হাতিয়ার, দ্রুতগামী ঘোড়া আর সেই তলোয়ার ছাড়া কিছু বাকি নেই, যা বাধ্যক্যের বিভ্রান্তি শেষ করে দেয়।
ছয়) মুসলমানরা যে সময় মোশরেকদের গ্রেফতার করছিলেন, সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্যে তৈরী হুজরায় অবস্থান করছিলেন। হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) তলোয়ার উঠিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, হযরত সা’দ (রা.) এর চেহারা বিমর্ষ। তিনি বললেন, সা’দ মুসলমানদের কাজ মনে হয় তোমার পছন্দ নয়। তিনি বললেন, হাঁ; হে আল্লাহর রসূল। অমুসলিমদের সাথে এটি আমাদের প্রথম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সুযোগ আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। কাজেই আমি মনে করি মোশরেকদের ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে তাদের হত্যা করাই সমীচীন, তাদের নির্মূল করা দরকার।
সাত) এই যুদ্ধে হযরত উকাশা ইবনে মোহাসেন আসাদীর তলোয়ার ভেঙ্গে যায়। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এক টুকরো কাঠখন্ড দিয়ে বললেন, আকাশা, এটি দিয়ে লড়াই করো। আকাশা সেই কাষ্টখন্ড হাত দিয়ে সোজা করতেই সেটি একটি ধারালো চকচকে তলোযারে পরিণত হলো। এরপর তিনি সেই তলোয়ার দিয়ে লড়াই করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে মুসলমানরা জয়লাভ করলেন। সেই তলোয়ারের নাম রাখা হলো ‘আওন’ অর্থাৎ সাহায্য। সেটি হযরত আকাশার কাছেই ছিলো। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে এই তলোয়ার ব্যবহার করতেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সময় ধর্মান্তরিত লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সেই সময়েও তলোয়ার তাঁর কাছে ছিলো।
আট ) যুদ্ধ শেষে হযরত মসয়াব ইবনে ওমাইর আবদারি (রা.) তাঁর ভাই আবু উজাইর ইবনে ওমাইর আবদারির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আবু উযায়ের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। সেই সময় একজন আনসারি সাহাবীর হাতে তার হাত কেটে গেলো। হযরত মসয়াব সেই সাহাবীকে বললেন, এই লোকটির মাধ্যেমে হাত মযবুত করো। তার মা বড় ধনী। তিনি সম্ভবত তোমাকে ভালো মুক্তিপণ দেবেন। এতে আবু উযায়ের তাঁর ভাই মাসআবকে বললেন, আমার ব্যাপারে কি তোমার এটাই অসিয়ত? হযরত মসআব (রা.) বললেন, হাঁ, তুমি নও. বরং এই আনসারী হচ্ছে আমার ভাই।
নয়) মোশরেকদের লাশ যখন কূয়োর ভেতর ছুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হলো, তখন ওতবা ইবনে রাবিয়ার লাশ কূয়োর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। সেই সময় রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওতবার পুত্র হোযায়ফার মুখের দিকে তাকালেন। লক্ষ্য করলেন, আবু হোযায়ফা বিমর্ষ গম্ভীর। তাকে কেমন যেন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো। নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হোযায়ফা, সম্ভবত তোমার পিতার ব্যাপারে তোমার মনে কষ্ট হচ্ছে? তিনি বললেন, জ্বীনা, হে আল্লাহর রসূল। আমার মনের মধ্যে আমার পিতা এবং তার হত্যাকান্ড সম্পর্কে কোন শিহরন নেই। তবে আমি ধারণা করছিলাম যে, আমার পিতার মাথায় বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে, দূরদর্শিতা আছে। এ কারণে আশা করছিলাম যে, তাঁর বুদ্ধি-বিবেক এবং দূরদর্শিতার কারণে তিনি ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নেবেন। কিন্তু এখন তাঁর পরিণাম দেখে, কুফুরীর ওপর তার জীবন শেষে হতে দেখে খুব খারাপ লাগছে। রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হোযায়ফা (রা.)-এর জন্যে দোয়া করলেন এবং তাঁর সম্পর্কে উত্তম মন্তব্য করলেন।
উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এবং কাফেরদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হলো। এই যুদ্ধে ১৪ জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন। ৬ জন মোহাজের আর ৮ জন আনসার। যুদ্ধে কাফেরদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিলো। তাদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিলো। এরা ছিলো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং গোত্রের সর্দার।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহতদের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমরা তো সবাই ছিলে নেতৃস্থানীয় লোক। তোমরা আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করোনি অথচ অনেকেই আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। তোমরা আমাকে নিঃসঙ্গ সহায়হীন অবস্থায় ফেলেছিলে, অথচ অনেকে আমাকে সাহয্য করেছে। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছিলে, অথচ অনেকে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।’ এরপর নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহতদের মৃত দেহ টেনে বদরের একটি কূয়োর বেতর ছুড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন।
হযরত আবু তালহা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে বদরের দিন কোরায়শদের ২৪ জন বড় বড় সর্দারের লাশ বদরের একটি নোংরা কূয়োয় নিক্ষেপ করা হয়। তখন নিয়ম ছিলো যে, কোন কাওমের ওপর জয়ী হলে তিনদিন যুদ্ধক্ষেত্রে কাটানো হতো। বদরের মাঠে তিনদিন কাটানোর পর নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সওয়ারীর পিঠে আসন সাঁটা হলো। এরপর তিনি পদব্রজে চললেন, সাহাবারা তাঁকে অনুসরণ করলেন।হঠাৎ কূয়োর তীরে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। এরপর তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে সম্বোধন করে  বলতে লাগলেন, ‘হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করতে, তবে সেটা কি তোমাদের জন্যে ভালো হতো না? আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন, আমরা তার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি, তোমরা কি আমাদের প্রতিপালকের কৃত ওয়াদার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছো।’ হযরত ওমর (রা.) আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি এমনসব দেহের সাথে কি কথা বলছেন, যাদের রূহ নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে সত্তার শপথ যার হাতে মোহাম্মদের প্রাণ আমি যা কিছু বলছি, তোমরা ওদের চেয়ে বেশি শুনতে পাও না। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তোমরা ওদের চেয়ে বেশী শ্রবণকারী নও। কিন্তু ওরা জবার দিতে পারে না [বোখারী, মুসলিম, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৪৫]
মক্কায় পরাজয়ের খবর
পরাজয়ের পর মক্কার মোশরেকরা বিশৃঙ্খল অবস্থায় ভীতবিহব্বল হয়ে মক্কার পথে পালালো। লজ্জায় তারা এমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যে, বুঝতে পারছিলো না, কিভাবে মক্কায় প্রবেশ করবে।
ইবনে ইসহাক বলেন, সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কোরায়শদের পরাজয়ের খবর নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে, তার নাম ছিলো হায়ছুমান ইবনে আবদুল্লাহ খোযাঈ। লোকজন তাকে পেছনের খবব জিজ্ঞাসা করলো। তিনি বললেন, ওতবা ইবনে রবিয়া, শায়বা ইবনে রবিয়া, আবুল হাকাম ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং আরো অমুক অমুক সর্দার নিহত হয়েছে। নিহতদের তালিকায় নেতৃস্থানীয় কোরায়শদের নাম শুনে কাবার হাতীমে উপবিষ্ট সফওয়ান ইবনে উমাইয়া বললেন, ঐ দেখো, তিন কাবার হাতীমে বসে আছেন। খোদার কসম, কার বাপ এবং তার ভাইকে নিহত হতে আমি নিজে দেখেছি।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্রীতদাশ আবু রাফে বর্ণনা করেন যে, সেই সময় আমি হযবত আব্বাসের ক্রীতদাস ছিলাম। আমাদের পরিবারে ইসলাম প্রবেশ করেছিলো। হযরত আব্বাস (রা.) ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। আমিও মুসলমান হয়েছিলাম। হযরত আব্বাস (রা.) তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখেছিলেন। আবু লাহাব বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের জয়ের খবর শুনে আবু লাহাব মুষড়ে পড়লো। আমরা নবতর শক্তি ও সম্মান অনুভব করলাম। আমি ছিলাম দুর্বল প্রকৃতির লোক। আমি তীর তৈরি করতাম। যমযম এর হুজরায় বসে তীরের ফলা সরু করতাম। সেই আমি এক মনে তীর তৈরী করছিলাম। উম্মুল ফযল আমার কাছে বসেছিলেন। যুদ্ধজয়ের খবর পেয়ে আমরা বেশ আনন্দিত ছিলাম। এমন সময় আবু লাহাব পা টেনে টেনে অনেকটা খোঁড়ানোর ভঙ্গিতে এসে হুজরার কাছে বসলো। তার পিঠ ছিলো আমার পিঠের দিকে। এমন সময় আবু সুফিয়ান ইবনে হাবর ইবনে আবদুল মোত্তালেব এসে পৌছুলো। আবু লাহাব তাকে বললো, আমার কাছে এসো, আমার জীবনের শপথ, তোমার কাছ খবর আছে। আবু সুফিয়ান আবু লাহাবের সামনে এসে বসলো। বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে রইলো। আবু লাহাব বললো, বলো ভাতিজা, লোকদের কি খবর। আবু সুফিয়ান বললো, কিছুই না। লোকদের সাথে আমাদের মোকাবেলা হলো, আমরা নিজেদের কাঁধ তাদের হাতে ছেড়ে দিলাম। তারা যেভাবে ইচ্ছা আমাদের হত্যা করছিলো, যেভাবে ইচ্ছা আমাদের বন্দী করছিলো। খোদার কসম, এসব সত্তেও আমি লোকদের দোষ দেই না। প্রকৃতপক্ষে এমন সব লোকদের সাথে আমাদের মোকাবেলা হয়েছিলো, যারা আকাশ যমিনের মাঝামাঝি চিত্রল ঘোড়ায় সওয়ার ছিলো। খোদার কসম, তারা কোন কিছু ছাড়ছিলো না এবং কোন জিনিস তাদের মোকাবেলায় টিকতেও পারছিলো না।
আবু রাফে বলেন, আমি নিজ হাতে তাঁবুর কিনারা তুললাম। এরপর বললাম, খোদার কসম, তারা ছিলেন ফেরেশতা। একথা শুনে আবু লাহাব আমার মুখে সজোরে চড় দিলো। আমি তার সাতে লেগে গেলাম। সে আমাকে তুলে আছাড় দিলো। এরপর আমাকে প্রহার করতে লাগলো। আমি ছিলাম দুর্বল। ইতিমধ্যে উম্মুল ফযল উঠে তাঁবুর একটি কঞ্চি দিয়ে আবু লাহাবকে প্রহার করতে লাগলেন। আবু লাহাব আঘাত পেলো। উম্মুল ফযল তাকে প্রহার করতে করতে বলছিলেন, ওর কোন মালিক নেই, এ জন্যে ওকে দুর্বল মনে করেছো? আবু লাহাব অপমানিত হয়ে উঠে চলে গেল। এই ঘটনার মাত্র সাতদিন পর আবু লাহাব প্লেগে আক্রান্ত হয়ে সে রোগেই প্রাণ ত্যাগ করলো। প্লেগের গুটিকে আরবে খুব অপয়া মনে করা হতো। মৃত্যুর পর তিনদিন পর্যন্ত আবু লাহাবের লাশ পড়ে রইলো্ তার সন্তানরাও কাছে গেলো না। কেউ তার দাফনের ব্যবস্থা করেনি। তার সন্তানরা তিনদিন পর ভেবে দেখলো যে, এভাবে লাশ ফেলে রাখলে অন্য লোকেরা তাদের নিন্দা সমালোচনা করবে, তখন তারা একটি গর্তে কঠোর মাধ্যমে ধাক্কা দিয়ে লাশ ফেলে দিলো। তারপর দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিলো।
মক্কায় বদর যুদ্ধের পরাজয়ের খবর পৌছার পরে কোরায়শদের মেজায খারাপ হয়ে গেলো। মৃতদের স্মরণে তারা কোন শোক প্রকাশমূলক কোন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেনি। তারা ভেবেছিলো যে, এতে করে মুসলমানরা সমালোচনা করবে। আর মুসলমানদের কোন প্রকার সমালোচনার সুযোগ দিতে তারা রাযি নয়।
একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে। বদরের যুদ্ধে আসওয়াদ ইবনে আবদুল মোত্তালেবের তিন পুত্র নিহত হয়েছিলো। এ কারণে পুত্রদের স্বরণে সে কান্নাকাটি করতে চাচ্ছিলো। আসওয়াদ ছিলো অন্ধ। একরাতে সে একজন বিলাপকারিনী মহিলার কান্নার আওয়ায শুনলো। এই আওয়ায শুনে আসওয়াদ দ্রুত নিজের ক্রীতদাসকে সেই মহিলার কাছে খবর আনতে পাঠালো যে, শোক প্রকাশের অনুমতি পাওয়া গেছে কিনা জেনে এসো । কোরায়শরা কি তাদের নিহতদের স্বরণে কান্নাকাটি করছে? তাহলে আমি আমার তিনপুত্রের মধ্যে অন্তত আবু হাকিমার জন্যে একটু কাঁদতাম। কেননা আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে। ক্রীতদাস ফিরে এসে বললো, সে তার হারিয়ে যাওয়া উটের শোকে বিলাপ করছে। আসওয়াদ একথা শুনে আত্মসস্বরণ করতে পারলো না। নীচে উল্লিখিত কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো।
সে মহিলা কাঁদছে হায় উট হারালো তাই, উটের শোকে তার বুঝি চোখে ঘুম নাই।
উটের জন্যে কাঁদিসনে যদিও তা হারিয়েছে, বদরের কথা ভেবে কাঁদ, ওরে কপাল পুড়েছে।
হাসীস, মাখযুম আর আবু ওলিদ ছিলো গোত্রের প্রাণ, আকীলের জন্যে হারেসের জন্যে ফেলো চোখের নীর
ওরা ছিলো ব্যাঘ্রের ব্যাঘ্র ওরা ছিলো বীর।
সবার নাম নিওয়া তবু কাঁদো ওদের তরে, কেউ হাকিমা হায় আমি বোঝাই কেমন করে
আবু হাকিমার শোক কোনভাবেই সমকক্ষ তার, অজ্ঞাত লোক বদরের কারলে আজ হলো সর্দার।
মদীনায় বিজয়ের সুসংবাদ
মুসলমানদের বিজয় পরিপূর্ণ হওয়ার পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনাবাসীদের তাড়াতাড়ি সুসংবাদ দেয়ার জন্যে দূত পাঠালেন। মদীনা দু’টি এলাকায় খবর দেয়ার জন্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এবং হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)-কে প্রেরণ করা হলো।
এর আগে ইহুদী এবং মোনাফেকরা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মদীনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে রেখেছিলো। এমনকি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহত হওয়ার খবর পর্যন্ত প্রচার করা হয়েছিলো। হযরত যায়েদ ইবনে হারেসাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাসাওয়া নামক উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে আসতে দেখে একজন মোনাফেক বলেই ফেললো যে, সত্যি সত্যি মোহাম্মদ নিহত হয়েছে। ওই দেখো তার উটনী। আমরা এ উটনী চিনি। ওই দেখো যায়েদ ইবনে হারেস। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে। এমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে যে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। উভয় দূত পৌছার পর মুসলমানরা তাদের ঘিরে ধরে এবং বিস্তারিত বিবরণ শুননে লাগলেন। সব শোনার পর বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মুসলমানরা আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। ‘নারায়ে তাকরীর, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে মদীনার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। যে সকল মুসলমান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বদর প্রান্তরে যাননি তারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে বদরের পথে বেরিয়ে পড়লেন।
হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, হযরত ওসমান (রা.)-এর সহধর্মিনী নবী নন্দিনী হযরত রোকাইয়া(রা.)-কে দাফন করে যখন আমরা কবরের উপরের মাটি সমান করে দিচ্ছিলাম, সেই সময় আমাদের কাছে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের খবর এসে পৌছুলো। হযরত রোকাইয়া(রা.) অসুস্থ ছিলেন। তাঁর দেখাশোনার জন্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে আমাকেও মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন।
গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) প্রসঙ্গ
যুদ্ধ শেষ হওয়ার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন দিন বদর প্রান্তরে অবস্থান করলেন। মদীনার পথে রওয়ানা হওয়ার আগেই গনীমতের মাল প্রসঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলো। এ বিষয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেন যে, যার কাছে যা কিছু আছে, সবই যেন তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়। সাহাবারা তাই করলেন। এরপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহীর মাধ্যমে এই সমস্যার মীমাংসা করে দিলেন।
হযরত ওবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মদীনা থেকে বেরিয়ে বদরে পৌছুলাম। লোকদের সাথে যুদ্ধ হলো এবং আল্লাহ তায়ালা শত্রুদের পরাজিত করলেন। এরপর একদল লোক কাফেরদের ধাওয়া করতে লাগলেন, কাউকে গ্রেফতার এবং কাউকে হত্যা করছিলেন। একদল লোক গনীমতের মাল জমা করতে শুরু করলেন, আর একদল লোক সর্বক্ষণ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ঘেরাও দিয়ে রাখছিলেন। তাঁরা ভাবছিলেন, শত্রুরা ধোকা দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন প্রকার কষ্ট দিতে পারে। রাত্রিকালে গনীমতের মাল সংগ্রাহকরা বলাবলি করতে লাগলেন যে, আমি এই পরিমাণ সংগ্রহ করেছি, এগুলো সব আমার, আমি এর ভাগ অন্য কাউকে দেবো না। শত্রুদের ধাওয়াকারীরা বললেন, আমরা এই সব মালামাল থেকে শত্রুদের তাড়িয়ে দিয়েছি; কাজেই এসব আমাদের। যে সকল সাহাবী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা বললেন, আমরা আশঙ্কা করছিলাম যে, শত্রুরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অমনোযোগী মনে করে কষ্ট না দেয়। এ কারণে আমরা তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। এ ধরনের মতবিরোধ দেখা দেয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, ‘লোকে আপনাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, ‘যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ তায়ালা এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মোমেন হও।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ১)
আল্লাহর রসূল এরপর সেই যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেন [মোসনাদে আহমদ,৫ম খন্ড, পৃ. ৩২৩, হাকেম ২য় খন্ড, পৃ. ৩২৬]।
মদীনার পথে মুসলিম বাহিনী
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনদিন বদর প্রান্তরে কাটানোর পর চতুর্থ দিন মদীনার পথে যাত্রা করেন। তাদেঁর সঙ্গে মক্কার কোরায়শ বন্দীরাও ছিলো গনীমতের মালও ছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কা’বকে এসবের তত্ত্ববধানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ছাফরা প্রান্তর অতিক্রমের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দারবে এবং নাজিয়ার মাঝামাঝি জায়গায় একটি টিলায় অবস্থান করেন। সেখানেই যুদ্ধলব্ধ সামগ্রীর এক পঞ্চমাংশ পৃথক করে রেখে বাকি সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করে দেয়া হয়। ছাফরা প্রান্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নযর ইবনে হারেসকে হত্যার নির্দেশ দেন। বদরের যুদ্ধে এই লোকটি কোরায়শদের পতাকা বহন করছিলো এবং সে অপরাধীদের অন্যত্তম। ইসলামের শত্রুতায় অগ্রণী ভুমিকা পালনকারীদের অন্যত্তম ছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে হযরত আলী (রা.) নযর ইবনে হারেসকে হত্যা করেন।
এরপর তাঁরা উবকুজ জাবিয়া পৌছেন। রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে ওকবা ইবনে আবু মুঈতের হত্যার নির্দেশ দেন। সে ইসলামের শত্রুতায় অগ্রনী ছিলো, এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতো। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। এই লোকটিই আল্লাহর রসূলের নামায আদায়রত অবস্থায় তাঁর কাঁধে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিলো এবং গলায় চাদর জড়িয়ে আল্লাহর রসূলকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হঠাৎ উপস্থিত হয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই দুর্বৃত্তের হাত থেকে উদ্ধার করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দুর্বৃত্তকে হত্তার নির্দেশ দিয়ে বললো, ওহে মোহাম্মদ, সন্তানদের জন্যে কে আছে? তিনি বললেন, আগুন।[সুনানে আবু দাউদ, সরহে আওনুল মাবুদ, ৩য় খন্ড পৃ. ১২]।
পরে হযরত আসেম ইবনে ছাবেত আনসারী (রা.) অথবা হযরত আলী (রা.) ওকবার শিরচ্ছেদ করেন।
যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুই দুর্বৃত্তকে হত্যা করা ছিলো জরুরী। কেননা এরা ছিলো যুদ্ধাপরাধী।
অভ্যর্থনাকারী প্রতিনিধিদল
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওয়াহা নামক জায়গায় পৌছুলে অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে আসা মুসলমানদের সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। এরা দূতদের মুখে মুসলমানদের বিজয় সংবাদ শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভিনন্দন এবং অভ্যর্থনা জানাতে মদীনা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা মোবারকবাদ জানালে হযরত সালমা ইবনে সালমা (রা.) বলেন, আপনারা আমাদের কিসের মোবারকবাদ জানাতে এসেছেন আমাদের তো মোকাবেলা হয়েছে মাথা নুয়ে পড়া বৃদ্ধদের সাথে যারা ছিলো উটের মত। একথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে বললেন, ভাতিজা, এসব লোকইতো ছিলো কওমের নেতা।
এরপর উসায়েদ ইবনে খোযায়ের (রা.) আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহরর, যিনি আপনাকে কামিয়াবী দান করেছেন এবং আপনার চক্ষু শীতল করেছেন। আল্লাহর শপথ, আমি জানতাম না যে, শত্রুদের সাথে আপনার মোকাবেলা হবে, আমি তো মনে করেছিলাম, আপনি একটি কাফেলার সন্ধানে বেরিয়েছেন। যদি জানতাম যে, শত্রুদের সাথে মোকাবেলা হবে, তবে কিছুতেই পেছনে থাকতাম না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সত্য বলেছো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আসার একদিন পর যুদ্ধবন্দীরা এসে পৌছুলে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে সাহাবাদেরকে ভালো ব্যবহার করার উপদেশ দিলেন। এই উপদেশের ফলে সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা খেজুর খেয়ে থাকতেন, কিন্তু কয়েদীদের রুটি খেতে দিতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মদীনায় খেজুরের চেয়ে রুটির মূল্য ও গুরুত্ব ছিলো অধিক।
যুদ্ধবন্দী প্রসঙ্গ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে অবশিষ্ট যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসূল, ওরাতো চাচাতো ভাই এবং আমাদের আত্বীয়স্বজন। আমার মতে আপনি ওদের কাছ থেকে ফিদিয়া অর্থাৎ মুক্তিপণ নিয়ে ওদের ছেড়ে দিন। এত করে যা কিছু নেয়া হবে, সেসব কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি হিসাবে কাজে আসবে। এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের হেদায়াত দেবেন এবং আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবের মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমি আবু বকরের মতের ভিন্ন মত পোষণ করি। আমি মনে করি যে, আপনি আমার আত্ত্বীয় অমুককে আমার হাতে তুলে দিন, আমি তার শিরচ্ছেদ করবো। একইভাবে আকীল ইবনে আবু তালেবকে হযরত আলীর হাতে তুলে দিন, আলী তার শিরচ্ছেদ করবেন। একই ভাবে হামযার ভাই অমুককে হামযার হাতে তুলে দিন, হামযা তার শিরচ্ছেদ করবেন। এতে আল্লাহ তায়ালা বুঝতে পারবেন যে, কাফেরদের জন্যে আমাদের মনে কোন সমবেদনা নেই। এ সকল যুদ্ধবন্দী হচ্ছে কাফেরদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।
হযরত ওমর (রা.) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ের কথা শোনার পর হযরত আবু বকরের পরামর্শ গ্রহন করেন, আমার পরামর্শ গ্রহন করেননি। ফলে কয়েদীদের কাছ থেকে ফিদিয়া গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। পরদিন খুব সকালে আমি আল্লাহর রসূলের বাছে গিয়ে দেখি, তিনি এবং আবু বকর উভয়ে কাঁদছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল, আপনারা কেন কাঁদছেন, আমাকে বলুন। যদি কান্নার কারণ ঘটে থাকে, তবে আমিও কাঁদবো। যদি কারণ না ঘটে, তবে আপনাদের কান্নার কারণে আমিও কাঁদবো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ফিদিয়া দেয়ার শর্ত গ্রহন করার কারণে তোমার সঙ্গীদের ওপর যে জিনিস পেশ করা হয়েছে, সেই কারণে কাঁদছি। একথা বলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আযাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে পেশ করা হয়েছে। [তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ৩৬]। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেন, দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুতে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্যে সঙ্গত নয়। ‘তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ তায়ালা চান পরকালের কল্যাণ। আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহন করছো, সে জন্যে তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হতো।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ৭৬-৬৮)
আল্লাহ তায়ালা উপরোক্ত আয়াতে পূর্ব বিধানের যে উল্লখ করেছেন, সেটা হচ্ছে সূরা মোহাম্মদের চতুর্থ আয়াতের একটি নির্দেশ। তাতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতপর হয় অনুকম্পা না হয় মুক্তিপণ।’
এই আয়াতে যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে ফিদিয়া নেয়ার অনুমতি থাকায় বন্দীদের ব্যাপারে ফিদিয়ার সিদ্ধান্ত দেয়ায় সাহাবায়ে কেরামকে আযাব দেয়া হয়নি, বরং ধমক দেয়া হয়েছে। ধমকও আবার এ কারণে দেয়া হয়েছে যে তারা এমন সব কাফের থেকে ফিদিয়া বা মুক্তিপণ নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন, যারা শুধু যুদ্ধবন্দীই ছিলো না বরং গুরুতর অপরাধীও ছিলো। আধুনিক আইনও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করে ছাড়ে না। এ ধরনের অপরাধীদের ব্যাপারে দায়েরকৃত মামলার শাস্তি হয়তো মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
হযরত আবু বকর (রা.)-এর মতামত অনুযায়ী যেহেতু সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে, এ কারণে মোশরেকদের কাছ থেকে ফিদিয়া নেয়া হয়েছে। ফিদিয়ার পরিমাণ ছিলো এক হাজার দিরহাম তিন হাজার দিরহাম এবং চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। মক্কাবাসীরা লেখাপড়া জানতো। পক্ষান্তরে মদীনাবাসীরা লেখাপড়ার সাথে তেমন পরিচিত ছিলো না। এ কারণে এরূপ সিদ্ধান্তও রাখা হয়েছিলো যে, যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ নেই, তারা মদীনায় দশটি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শিক্ষা করলে শিক্ষক কয়েদীদের জন্যে সেটা হবে মুক্তিপণ।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকজন বন্দীকে বিশেষ দয়া কারায় তাদের কাছ থেকে ফিদিয়া গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেয়া হয়। এরা ছিলো মোত্তালেব ইবনে হানতাব, সাঈফি ইবনে আবু রেফায়া এবং আবু আযযা জুমাহী। শেষোক্ত ব্যক্তিকে ওহুদের যুদ্ধে পূনরায় কয়েদ এবং পরে হত্যা করা হয়। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে আছে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জামাতা আবুল আসকে এই শর্তের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি নবী নন্দিনী হযরত যয়নব (রা.)-এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।
এর কারণ ছিলো যে, হযরত যয়নব আবুল ইবনে আস এর ফিদিয়া হিসাবে কিছু সম্পদ পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হারও ছিলো। হারটির মালিকানা ছিলো হযরত খাদিজা (রা.)-এর। হযরত যয়নব (রা.)-কে আবুল আস-এর ঘরে পাঠানোর বিদায়কালীন সময়ে তিনি আপন কন্যাকে উপহার স্বরূপ সেটি দিয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখামাত্র তাঁর দুইচোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, আবেগে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আবুল আসকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের মতামত চান। সাহাবারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই প্রস্তাব সশ্রদ্ধভাবে অনুমোদন করেন। অতপর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জামাতা আবুল আসকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে, আস হযরত যয়নব (রা.)-কে মুক্তি দেবেন। মুক্তি পেয়ে যয়নব (রা.) হিজরত করে মদীনায় চলে আসেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা এবং অন্য একজন আনসারী সাহাবীকে মক্কায় প্রেরণ করেন। তাদের বলা হয় যে, তোমরা মক্কার উপকণ্ঠ অথবা জায নামক জায়গায় থাকবে। হযরত যয়নব (রা.) তোমাদের কাছে গিয়ে যখন যেতে থাকবেন, তখন কাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এই দুইজন সাহাবী মক্কায় গিয়ে হযরত যয়নব (রা.)-কে মদীনায় নিয়ে আসেন। হযরত যয়নব (রা.)-এর হিজরতের ঘটনা অনেক দীর্ঘ এবং মর্মস্পর্শী।
যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সোহায়েল ইবনে আমরও ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান বক্তা। হযরত ওমর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসূল, সোহায়েল ইবনে আমরের সামনের দু’টি দাঁত ভেঙ্গে ফেলার ব্যবস্থা করুন, এতে তার কথা মুখে জড়িয়ে যাবে। এত সুবক্তা হিসাবে আপনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে সুবিধা করতে পারবে না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রস্তাব প্রথ্যাখান করলেন। কেননা মানুষের অঙ্গহানি করা ইসলামের পরিভাষায় ‘মোছলা’ করার শামিল। কেয়ামতের কঠিন দিনে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।
হযরত সা’দ ইবনে নোমা’ন (রা.) ওমরাহ পালনের জন্যে বের হয়েছিলেন। এ সময় আবু সুফিয়ান তাকে গ্রেফতার করে। আবু সুফিয়ানের পুত্র আমর যুদ্ধবন্দী ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমরকে আবু সুফিয়ানের হাতে ন্যস্ত করায় বিনিময়ে তিনি হযরত সা’দকে মুক্তি দিলেন।
পবিত্র কোরআনের পর্যালোচনা
আল্লাহ তায়ালা বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আনফাল নাযিল করেন। প্রকৃতপক্ষে, এটি হচ্ছে বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহর পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন। দুনিয়ার অন্যান্য বাদশাহ, সেনানায়ক বা অন্য যে কারো মূল্যায়নের চাইতে সম্পূর্ন আলাদা। আল্লাহর পর্যালোচনা ও মুল্যায়ন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যাচ্ছে। [সাইয়েদ কুতুব শহীদ রচিত তাফসীর ফী যিলালিল কোরআনে [সূরা আনফাল খন্ডে] এ ব্যাপারে কিছু মূল্যবান আলোচনা করা হয়েছে ]।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন সর্বপ্রথম মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতার প্রতি আলোকপাত করেন। এই সংর্কীণতা ও দুর্বলতা তাদের মধ্যে ছিলো, যা যুদ্ধশেষে অনেকটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে আলোকপাত করেন এজন্যে যে, মুসলমানদের তা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এত করে তারা ঈমানের পূর্ণতা লাভে সক্ষম হবে।
অতপর এই যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য এবং গায়েবী সাহায্য সম্পর্কে তিনি উল্লখ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, মুসলমানরা যেন নিজেদের বীরত্ব ও বাহাদুরির ধোকায় না পড়ে। কেননা এর ফলে তাদের মনে অহংকার দেখা দেবে কিন্তু আল্লাহ তায়ালা চান যে, মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরতা এবং রসূলের প্রতি আনগত্যের গুনই যেন দেখা দেয়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে নিয়ে এ ভয়াবহ ও রক্তাক্ত অভিযানের পথে পা রেখেছিলেন, এরপর যে বিষয়ে অপরিহার্য চারিত্রিক গুণাবলী ও বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অতপর মোশরেক, মোনাফেক, ইহুদি ও যুদ্ধবন্দীদের উদ্দেশ্য এমন উচ্চাঙ্গের উপদেশ দেয়া হয়েছে যাতে করে, তারা সত্যের সামনে মাথা নত করে সত্যের অনুসারীতেই পরিণত হয়।
এরপর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে মৌলিক নীতিমালা ব্যাখ্যা করা হয়।
যুদ্ধ ও সন্ধির বিধানও এখানে ব্যাখ্যা করা হয়। ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে এর অপরিহার্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই ব্যাখ্যা ও নীতিমালা এ কারণেই দেয়া হয়েছে যাতে, মুসলমানরা ইসলাম পূর্ব যুদ্ধ এবং ইসলাম পরবর্তীকালের যুদ্ধের পার্থক্য করতে পারে। এছাড়া নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যেন তারা উচ্চতর মর্যাদা লাভেও সক্ষম হয়। বিশ্ববাসী যেন এর মাধ্যমে জানতে পারে যে, ইসলাম শুধু একটি আদর্শ মাত্র নয়, বরং ইসলাম যে নীতিমালা ও বিধি বিধানের দাওয়াত দেয়, সেই অনুযায়ী অনুসারীদের বাস্তব প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে।
এরপর ইসলামী রাষ্ট্রের নীতিমালা সম্পর্কে কয়েকটি ধারার উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সুষ্পষ্টভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মুসলমান এবং এবং এর বাইরের সীমারেখার মুসলমানদের মধ্যকার পার্থক্য বোঝা যায়।
আরো ঘটনা
দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসে রোযা এবং সদকাতুল ফেতের ফরয করা হয়। যাকাতের পরিমাণ অর্থাৎ নেছাবও এই সময়ে নির্ধারণ করা হয়। মোহাজেরদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছিলেন খুবই গরীব। তাদের রুটি রুজির সমস্যা ছিলো প্রকট। পেটের ক্ষুদা নিবারণের জন্যে বিভিন্ন স্থানে ছুটোছুটি করা তাদের জন্যে ছিলো কষ্টকর। সদকায়ে ফেতের এবং যাকাত সম্পর্কিত বিধান তাদেরক অন্ন-বস্ত্রের কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়।
মুসলমানরা প্রথমবারের মতো ঈদ উদযাপন করেছিলো দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে। বদরের যুদ্ধের সুস্পষ্ট বিজয়ের পর এই ঈদ উদযাপিত হয়েছিলো। মুসলমানদের মাথায় বিজয় ও সম্মানের মুকুট রাখার পর আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে এই ঈদ উদযাপনের সুযোগ দেন। ঈদ মুসলমানদের জন্যে অসামান্য সম্মান ও সৌভাগ্য বয়ে এনেছিলো। সেই ঈদের নামায আদায়ের দৃশ্য ছিলো খুবই মনোমুগ্ধকর। আল্লাহর হামদ, তকবীর, তাসবীহ ও তাওহীদের ঘোষণা উচ্চস্বরে করতে মোসলমানরা ময়দানে বেরিয়ে আসেন। সেই সময় মুসলমানদের মন আল্লাহর দেয়া নেয়ামত এবং সাহায্যের কারণে পরিপূর্ণ ছিলো।
তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি আরো বেশী পরিমাণে লাভ করা জন্যে আগ্রহী ছিলেন। তাদের মাথা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে ছিলো অবনত। আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে সেই নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্বরণ করো, যখন তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক। পৃথিবীতে তোমরা দুর্বলরূপে পরিগণিত হতে, তোমরা আশঙ্কা করতে যে, লোকেরা তোমাদের আকস্মিকভাবে ধরে নিয়ে যাবে। অতপর তিনি তোমাদের আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্যে দ্বারা তোমাদের শক্তিশালী করেন এবং তোমাদের উত্তম বস্তুসমূহ জীবিকারূপে দান করেন যতে, তোমরা কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ২৬)
সূত্রঃ- আর- রাহিকুল মাখতুম
১৭ তম খন্ড

No comments

Powered by Blogger.